সুন্দরের
বিশেষণ
বরুণার মনে হল, নাকছাবিটি নড়ে উঠল যেন! লাল ভেলভেটে মোড়া ছোট্ট বাক্সটি
বাঁ হাতের তালুর ওপর রেখে ডান হাতে বাক্সের ঢাকনাটা যখন খুলল তখন নাকছাবিটা তাকে দেখে
হেসে উঠল। আবারও তার মনে হল। কেন মনে হল? সে জানে না। নাকছাবিটি নড়ছে। খুশি খুশি মুখে
হাসছে যেন...!
বিভূতি তার স্বামী। আজ বরুণার জন্মদিন। স্বামীর উপহার। গতকাল এনেছিল।
জানায়নি তাকে। আজ সকাল হতে স্ত্রীর হাতে বাক্সটা তুলে দিয়েছিল। তারপর বলেছিল-তোমার
জন্মদিনের উপহার।
বরুণাও খুশি হয়েছিল খুব। ভীষণ খুশি। ওই নাকছাবিটির মতো।
এমনিতে বরুণাকে দেখতে তেমন নয়। মোটামুটি। চলনসই। গায়ের রং ভীষণ কালো। তবে স্বাস্থ্য
ভাল। মুখমণ্ডলটি তেমন সুখকর নয়। নাকটির উচ্চতা তেমন নেই। খ্যাদাই বলা চলে। শুধু দুই
ফুটো সমেত নাকের ডগাটা আকাশ পানে উঁচিয়ে আছে। নাকের গোড়া বলতে যা বোঝায়, তা একদম নেই।
সে নিজেও জানে।
তবুও আয়নায় বার বার নিজের মুখ ঘুরিয়ে ঘারিয়ে দেখে। কীভাবে নিজেকে সুন্দর
রাখা যায় আপ্রাণ চেষ্টা করে। আসলে তার সব প্রচেষ্টা বিভূতির জন্য। বিভূতি তাকে ভালোবাসে।
ভালোবাসে বলেই বোধহয়, এমন মেয়েকে সে বিয়ে করেছে। এইরকম তার ধারণা। এখনও পর্যন্ত তার
প্রতি খারাপ ব্যবহার করেনি।
২
তো মায়ের দেখে দেওয়া মেয়েকেই বিভূতি বিয়ে করেছে। বেশি বয়সের বিয়ে। অনেক
কষ্টেসৃষ্টে ছেলেকে রাজি করিয়েছেন সুরঞ্জনা। এবার বিয়ে কর বাপ আমার। আমারও তো বয়স
হচ্ছে নাকি! কোন দিন দেখবি, টুপ করে মরে যাব। তখন তোকে কে রেঁধেবেড়ে খাওয়াবে...!
ঠিক কথা। একদম ঠিক কথা বলেছে মা। এতটা তলিয়ে সে ভাবেনি।
মায়েপোয়ে ছোট্ট সংসার। মায়ের একটু কিছু হলেই সে বিচলিত বোধ করে। অমনি
ডাক্তারের দোরে হাজির হয়। সময়ে সময়ে ওষুধ। অফিস যাওয়া বন্ধ। হাত পুড়িয়ে রান্না
ভাতে সেদ্ধ সবজি। মানে যতটা মাকে রিলিফ দেওয়া যায়...।
মায়ের মুখে ‘মারা’ যাওয়ার কথা শুনে বিভূতি ভীষণ ঘাবড়ে যায়। এরপর সে কোনও
নাকুড়ঝাকুড় করেনি। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেছিল।
মায়ের অনেক দিনের পরিচিত বান্ধবী কংকনার মেয়ে এই বরুণা। পাত্রের বয়স পাত্রীর
চেয়ে বেশি হলেও তাতে আপত্তি করেনি কংকনার পরিজনরা।
ওই তো রূপের ছিরিছাদ। একবারের বেশি দুবার তাকানো যায় না। এমন রূপ বেচারির।
চোদ্দগুষ্টির ভাগ্য ভালো। ‘বিয়ে হচ্ছে না, হচ্ছে না’, করে করে এমন পাত্র পাওয়া মানে
হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। বেশি বয়স তো হয়েছেটা কী। তার ওপর ছেলে সরকারি চাকরি করে। মেয়ে
বরং সুখে থাকবে। এই যুক্তি পরিজনদের।
তবে এ কথাও ঠিক, সুখেই আছে বরুণা। বিয়ের বয়স দু’বছর হতে চলল।
৩
নাকছাবিটি হাতে নিয়ে বরুণা ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘুরেফিরে
আবার নিজেকে নতুন করে দেখে। কাপড়ের আঁচলটা ঘরের মেঝেতে লুটায়। নিজের বুকের দিকে তাকায়।
কালো পাথরের জামবাটির মতো ভরাট বুক। অমনি চোখ বন্ধ হয়ে আসে। স্বামীর শরীরের স্পর্শ
পায় যেন! কানের কাছে গরম শ্বাসের উত্তাপে তার কানের লতি একটু একটু করে পুড়ছে। আহা কী
সুখ! কী আনন্দ! বিভূতি আদর করছে। ভালোবাসছে। কিছুতেই চোখ খুলতে ইচ্ছে করে না।
বড় অবাক লাগে। কেন এমন হয়, জানে না সে। ভালোই লাগে।
দু’আঙুলের চুটকিতে ধরা নাকছাবিটিও সেদিকে তাকিয়ে আবারও নড়েচড়ে ওঠে। ঝকমক
করে ওঠে চারপাশ। খিলখিল করে হেসে ওঠে। বরুণা বুঝতে পারে না, কে হাসছে? এদিক সেদিক তাকায়।
সেই হাসির চিকন সুর কানে আসতেই বরুণা চোখ খোলে। কে হাসছে? নিজেকেই প্রশ্ন করে। বার
বার। এই ঘরে, সে ছাড়া কেউ নেই!
আবারও হাসির শব্দ। কে? হাসছে কে? নিজের মনেই বার বার প্রশ্ন করে।
-আমি গো আমি।
-ঘরে তো কেউ নেই!
-আমি তো আছি।
-আমি কে?
-আমি তোমার সৌন্দর্য।
নাকছাবিটি চোখের সামনে মেলে ধরে বরুণা। সত্যিই সুন্দর। অদ্ভুত সুন্দর।
পাকা ভুট্টার দানার মতো রং। সাধারণ নাকছাবির থেকে অনেকটা আলাদা। বড় ধরনের। একটি
ছোট্ট তারার মতো। মিটিমিটি জ্বলছে। জ্বলজ্বল করছে সর্বক্ষণ।
সরষে দানার মতো পুরনো নাকছাবিটি টপ করে খুলে ফেলে বরুণা। এটা তার বহু
বছরের পুরনো। যখন তার পাঁচ বছর বয়স ছিল তখন ছোট কাকি বিঁধিয়ে দিয়েছিল নাক। একটুও
ব্যথা লাগেনি। চোখের জলও পড়েনি। অথচ ইঞ্জেকশনে কী ভীষণ ভয় পেত। খুব কাঁদত। আর ‘এখন
দেখ, একটুও চোখে জল নেই’। এই নিয়ে কত হাসাহাসি, আলোচনা করেছিল পরিজনেরা।
এখনও মনে পড়লে হাসি পায়। নিজের মনেই হো হো করে হেসে ওঠে বরুণা।
সেই হাসির রেশ নিয়ে নতুন নাকছাবিটি পরে নেয় বরুণা। তারপর আয়নায় দেখতে
থাকে বড় বড় চোখ করে। মুহুর্তে নাকের ভূগোলটা যেন অদ্ভুত ভাবে পালটে যায়। নাকটাকে
অনেকটা পুরুষ্টু মনে হয় তার। নাকের গোড়াটা আর আগের মতো নেই। ‘রেলগাড়ি’ চলার মতো রাস্তা
নেই। কেউ আর বলতে পারবে না এই কথা। ডগাটা যেন আরও ধারালো হয়েছে। চকচক করছে। নাকের ডান
পাটায় নাকছাবিটি বার বার ঝলমল করে উঠছে। ক্ষণে ক্ষণে টুকরো টুকরো আলোর বিচ্ছুরণ ঠিকড়ে
বেরিয়ে বাতাসের সঙ্গে উধাও হয়ে যাচ্ছে। নিভে যাচ্ছে। আবারও মিটিমিটি জ্বলছে।
সেই বায়বীয় ছবি দেখতে দেখতে বরুণা নিজের দু’গাল, দু’হাতের তালুতে চেপে
ধরে। আর তখনই কে যেন আবার বলে উঠল-এবার বিশ্বাস হচ্ছে তো আমি তোমার সৌন্দর্য।
-তা ঠিক। বরুণা মিহি হেসে বলল।
-আমার সৌন্দর্য তোমাকে রক্ষা করেছে তা কি জানো?
-জানি।
-এবার তোমার মুখের দিকে অনেকেই তাকাবে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আশ্চর্য হবে!
নাকছাবি খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল-অনেকেরই নজর কাড়বে তুমি...।
বরুণা এবার হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। তারপর উঠে বসল।
আবার ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নাকছাবিটি খুলে ড্রেসিংটেবিলের ওপর রাখল।
আর তখনই নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেল। নাকটি তার আগের মতো হয়ে গেছে!
চোখের এক তারা থেকে এক তারায় তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে বিস্ময়ের বুদবুদে ভরা এক
রেলগাড়ি।
-এবার বুঝতে পারছো তো আমার কথাটা কতটা সত্যি।
-হ্যাঁ। তুমি ঠিক বলেছ।
-তাহলে খুললে কেন?
বরুণা এই প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে পারল না। ফ্যাল ফ্যাল করে আয়নার দিকে
তাকিয়ে থাকল।
৪
বিয়ে হচ্ছিল না। বয়সও বেড়ে যাচ্ছিল হু হু করে। সে তিন বোনেদের মধ্যে সবার
বড়। তাদের বিয়ে হয়ে গিয়ে একটা দুটো করে বাচ্চার মা হয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে অ্যাত
দিন নিজের বিয়ের কথা, সংসারের কথা ভাবত। তারপর ভগবান অ্যাত দিন পর মুখ তুলে তাকালেন।
তার অদ্ভুত নাকের আর গায়ের রঙের জন্য একের পর এক বিয়ে ভেস্তে যাচ্ছিল। তারপর কোথা
থেকে কী যে ঘটে গেল! বিভূতি যেন যুবরাজের মতো হাজির হল তার চোখের সামনে...।
এই মুহুর্তে মনে পড়ে গেল আবার। মনে পড়তেই শরীরটা ভিতর থেকে রিনরিন করে
কাঁপতে লাগল। আর মনে প্রশ্ন জাগল, বিভূতি কী সত্যি সত্যি তাকে ভালবাসে? নাকি নিজের
নিরাপত্তার জন্য সে বিয়ে করেছে?
শাশুড়ি মা গত হয়েছেন আজ এক বছর হতে চলল। বিভূতি অফিসে চলে যাওয়ার পর এই
চারটে ঘরঅলা বাড়িতে বরুণা একাই থাকে। অনেকটা ভয়ে ভয়ে। এরপর কী হবে, কী হতে পারে! কত
কী যে হচ্ছে চারপাশে তার কোনও হিসাব নেই।
বছর দুয়েকের মধ্যে সে বুঝেছে তার স্বামী কম কথার মানুষ। সময় মেনে চলে।
কোনও বাজে কথা বলে না। চুপচাপ থাকতেই ভালবাসে। কোনও নেশাভান নেই। বিয়ের পর এই প্রথম
হাতে করে একটি গয়না আনল। তাও আবার নাকছাবি। মেয়েদের প্রথম গয়না।
হয়তো তার পুরনো নাকছাবিটি পছন্দ নয়। সেই জন্য কী।
কাঁপা হাতে আবার নতুন নাকছাবিটি নাকে গুঁজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে
নতুন করে দেখতে থাকল বরুণা।
৫
ঘর অন্ধকার। পাশে শুয়ে আছে বিভূতি। এখনও নাক ডাকা শুরু হয়নি। অন্য সময়
হলে বিছনায় শুয়ে অমনি নাক ডাকত। এখনও ডাকছে না। মানে জেগে আছে। বরুণা পাশ ফেরে। আলতো
করে স্বামীর কাঁধের ওপর ডান হাত রাখে। অমনি বিভূতি তার দিকে ঘুরে যায়। স্ত্রীর নাকের
ওপর চোখ যায়। স্ত্রীর নাকটা আলোয় ঝলমল করছে। একটা তীব্র আলোর ছটা সারা ঘরময় লেজার শোয়ের
মতো ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিভূতি অবাক হয়ে যায়। তার চোখের সামনে নাকছাবিটা বড় হতে হতে বরুণার মুখটা
ঢেকে ফেলছে। বিভূতি ব্যাকুল ভাবে স্ত্রীর মুখটা দু’হাতে চেপে ধরে।
গৌতম দে