করুনাধারা
লোকটাকে খুব চুমু খেতে ইচ্ছা হল হিদার। বহুদিন পরে এতো সুন্দর পুরুষ দেখলো সে। কাঁধ, বাহু, বেশ সুগঠিত। ঠোঁট টা অন্যরকম সুন্দর। পায়ের বুটটা বেশ দামী।জল খাওয়া খুব দরকার। শরীরের ভেতর অবধি জ্বালা করছে।সানগ্লাস টা খুলে রাখলো হিদা। গলার স্কার্ফ খুলে শুকনো মুখ টা মুছলো। সমস্ত এলাকা তে কার্পেট বোম্বিং হয়েছে। লম্বা লম্বা বাড়ি গুলো কেবল মাত্র কংক্রিটের কংকাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হওয়াতে এই লম্বা বাড়ি গুলো এক একটা দুর্গ হয়ে উঠেছে। হিদা যে দলে সেখানে মোট সাত জন মেয়ে।হিদার পার্টনার রুহা। ওরা দুজন একসঙ্গে কাজ করে। এই কুড়িতলা বাড়িটাকে শত্রুপক্ষের কব্জা থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করা যায় সকলকেই খতম করা গেছে।সাততলার একটা ফ্ল্যাটে হিদা দাঁড়িয়ে আছে। ঘরগুলোতে প্রায় সব কিছু ভেঙে গেছে। রুহা ওপরের তলায় উঠে গেছে। আর কেউ লুকিয়ে আছে কিনা জানার জন্যে।
ফ্ল্যাটে একটা বাথরুম অদ্ভুত ভাবে অক্ষত। । ইস যদি এক বালতি জল থাকতো।সাতদিন স্নান হয়নি। শরীরে অসম্ভব আনচান। সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামবার আওয়াজ পেল। হিদা সতর্ক হল। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নিল।রুহা নেমে এসেছে। “নাহ্ উপরে কেউ নেই” ছাদ অবধি ঘুরে এসেছে সে। হিদা ওকে বাথরুম দেখালো। বাথটাব, বেসিন, এমনকি আয়না অবধি অক্ষত। আয়নায় নিজেদের পুড়ে যাওয়া চেহারা দেখলো তারা। নিজেদের চেহারা অনেক টানাপড়েন সহ্য করে রোগা হয়েছে,শ্রীহীন হয়েছে। হেসে ফেলল একে অপরের দিকে তাকিয়ে। “একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে” হিদা বলে।“ তুই সিগারেট খাস?” “ না কোন দিন খাইনি, তবে ছেলেরা খায় তো। খুব কষ্টকর কাজের পর সিগারেট ধরায়। পেলে খেতাম”। রুহা সব শুনে ফিক ফিক করে হাসে। আয়নায় দুজনেই আবার চেহারা দেখে চুল ঠিক করে।
হিদা আর রুহার দুজনের পরিবারের আর কেউ বেঁচে আছে বলে তারা জানে না। দুজনের কথা বলার ভাষা আর কথনশৈলী এক রকম সম্ভবত সেই কারণেই বন্ধুত্বটা এতো গাঢ়। ওদের সহযোদ্ধাদের সাথে ভাষা গত ঐ তফাৎ টা রয়ে গেছে।আজ বিকেল অবধি এই বাড়িতেই আস্তানা। টীম লিডার নির্দেশ দিয়েছে। রুহা আর হিদা কাল পুরো রাত ঘুমিয়েছে তাই আজ তারা ওপর থেকে নজর রাখবে। জানালার ধারে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র কে ভালোভাবে বসাল হিদা। এখান থেকে চৌরাস্তা অবধি দেখা যাচ্ছে। ট্রাক বা ট্যাঙ্ক ঢুকলে আঘাত করা যাবে।
রুহা লোকটার দিকে তাকাল। উপুর হয়ে পড়ে আছে হলঘরের মাঝখানে। পায়ে দামী ফৌজি বুট। রোজ খেতে পাওয়া চেহারা।
রুহা তার ফুটো বুট ওয়ালা বাম পা, লোকটার পিঠের ওপর তুলে দিল।
“ অ্যায় পা নামা”
“কেন?”
“দ্যাখ লোকটা কি সুন্দর”
“ধ্যুত, মরে গেছে তো”
“ তো কি হয়েছে”
রুহা পা নামিয়ে নেয়। লোক টাকে তেমন কিছু আকর্ষক মনে হল না তার। বড্ড বড় পা। নইলে বুট জোড়া নিয়ে নেওয়া যেত। অস্ত্র টা হাতে তুলে নেয় রুহা। নীচে টীম লিডার কে জমা দিতে হবে।
দুপুরে খাওয়ার জন্যে দু প্যাকেট বিস্কুট পাওয়া গেছে। এতেই পেট ঠাণ্ডা রাখতে হবে। হিদা চোখ দিয়ে বসে আছে চৌরাস্তার দিকে।সানগ্লাস ছাড়া তাকিয়ে থাকা যায় না।জল খাওয়া খুব দরকার।রুহা বাথটবে গিয়ে হাত বোলায়। “আমার বাপের বাড়ির একটা বাথটাব ছিল। কিন্তু বাপের দ্বিতীয় পক্ষের বৌ কিছুতেই স্নান করতে দিত না।বলত জল নষ্ট হবে। আর রোজ রাতে সুগন্ধ ঢেলে নিজে স্নান করত। হারামজাদি একটা...”। হিদা ধীর স্বরে বলে,“আখান আমাদের দোতালার জন্যে এমনি একটি বাথরুমের ডিজাইন করে ছিল। একবার একটা হোটেলে দুজন মিলে বাথটাবে …”চুপ করে গেল হিদা।তখন হিদার সদ্য সতের বছর। নিজের চওড়া হাতের পাঞ্জায় হিদার হাত ধরে আখান বলেছিল , “হাত না মাখন”। স্মৃতির ছায়ায় আখানের সেই হাতের স্পর্শ টা খুঁজতে নিজের হাতটা ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দেখল হিদা।রুহা জল খুঁজতে গেল। যদি এক লিটার জল ও পাওয়া যায়।
যুদ্ধ শেষ হওয়া টা খুব দরকার। যুদ্ধ শেষ হলে পুরনো শহরে ফিরবে হিদা। ওদের পাড়ায় কে কে বেঁচে আছে? যে রাতে তারা ঘোর থেকে উৎখাত হল, সে দিন টা ভুলতে চেষ্টা করে সে। সব ভুলে আবার নতুন জীবন তৈরি করতে হবে। আখানের মতো আরও কাউকে খুঁজে পেতে হবে।আবার সব আগের মতো হবে? রোজ খেতে পাবে, স্নান করবে,ঋতুর সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন, সারা রাত ঘুমোবে একটুও চমকাবে না, ............এমন হবে?জ্বর হলে কেউ কপালে হাত রাখবে, মন কেমন হলে কাউকে জড়িয়ে ধরা যাবে? যুদ্ধ বন্ধ হলে সেগুলো হবে? আর হবে না।
লোকটার কাছে ফিরে এলো হিদা। গালে হাত দিল, যুদ্ধে আসার আগে দাড়ি কেটে এসেছিল। মরে গেলে মানুষ কি ভীষণ ঠাণ্ডা হয়। ঠোঁটটা বড্ড সুন্দর। তিন ঘণ্টা হল মারা গেছে। এবার গন্ধ বার হবে। মাথার চুলে হাত দিল। ছোট্ট ছোট্ট চুল। গলায় সৈনিকের পরিচয় দেওয়া স্টিলের চেন। বড়লোক এরা রোজ খেতে পায়। ঠোঁটটাতে আঙুল দিল হিদা। আখান আর হিদা বিদেশী সিনেমা দেখে চুমু খাওয়া শিখতো।নানান দেশের নানান চুমু। লোকটার ঠাণ্ডা আঙুলে আঙুল রাখলও হিদা। সত্যি খুব চুমু খেতে ইচ্ছা করছে। মৃতদেহ কে চুমু খাওয়া অন্যায় না পাপ? দেহ টাকে সোজা করে দিল সে। উপুর করতেই হাত ভিজে গেল তার । বাম পাঁজর থেকে রক্ত বার হচ্ছে। অত্যাধুনিক যুদ্ধ পোশাক ভেদ করেছে বুলেট। যন্ত্রণা পায়নি খুব একটা।তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত হয়ে কেউ ঘুমচ্ছে। পকেট গুলোতে হাত ঢোকাল হিদা। কিছু টাকা, খাবার যদি পাওয়া যায়। বেশ কিছু স্ক্রু ড্রাইভার, স্প্যাচুলা, ছোট ছুড়ি আর একটা প্ল্যাস্টিকের ছোট প্যাকেট। প্যাকেট টা খুলল হিদা। বেশ কিছু ফটোগ্রাফ।একটি শিশুর হাসি মুখের ছবি, মায়ের সাথে আলহাদের ছবি, সাইকেল চড়ার ছবি, কেক কাটার ছবি।হিদা চোখে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সব ঝাপসা। তার চার মাসের শিশুকন্যার কোন ছবি তো তার কাছে নেই। সে যখন মরবে তখন তো সে টুকু আশ্রয় ও তার কাছে নেই। সে কি বুকে করে মরবে? হিদার সারা শরীর শুষ্ক। কিন্তু তার স্তনবৃন্ত দুটি ঠোঁটের স্পর্শ চাইছে। তার খুকী কে সে কত দিন স্তন খাওয়াইনি। স্নানহীন, তরলহীন শরীরে তার স্তন দুটি অমৃত নিয়ে তীব্র ভাবে জেগে উঠছে।
রুহা তিন বোতল জল খুঁজে পেয়েছে। পরম উল্লাসে হিদার কাছে ফিরে আসে। সে দেখল , যে বিদেশী সৈনিক কে সে এক গুলিতে কাবু করেছে তাকে জড়িয়ে ধরে হিদা অঝোরে কেঁদে চলেছে।
নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত