পত্রিকা --
যদিও উত্তরমেঘ
সম্পাদক ঃ জিল্লুর রহমান (চট্টগ্রাম)
সম্পাদক ঃ জিল্লুর রহমান (চট্টগ্রাম)
আলোচনায় দেবযানী বসু
আমরা কবিতা কানে গুঁজে কবিতা খুঁজতে বেরিয়েছি। যা পাচ্ছি যা পড়ছি তাতে সন্তুষ্ট হতে পারছি না। একে অপরের কবিতার প্রতি সন্দেহ পোষণ করছি। আবার প্রবীণ ও নবীন কবির কবিতাবোধে বিপুল তরঙ্গময় দূরত্ব আর সংঘাত।
একটা সমাধানে এসে সবাই পৌঁছেছেন যে যুগ যুগ ধরে কবিতার ভাষা ও রীতির পরিবর্তন অবশ্যই ঘটবে। এখন যারা লেখালেখি করছি তখন আর তারা থাকব না। আর ভবিষ্যতের কবিতা এখন যদি লিখে ফেলি সেটিও তো এখনকার কবিতাই হবে, কালানুযায়ী ভবিষ্যতের হবে কি করে। সব কবি ভবিষ্যতের কবিতার পথ বাৎলে দিতে পারেন না। কোনো কোনো কবি এমন কিছু সংকেত রেখে যান লেখায় যা পরবর্তী কবিদের কেউ কেউ তার অনুসরণ করে নতুন কবিতারীতির প্রচলন করতে পারেন। কারণ কবিতা বিভিন্ন ঘরানার পরম্পরা। একজন বারীন ঘোষাল একজন মলয় রায়চৌধুরী একজন শম্ভু রক্ষিত একজন অমিতাভ মৈত্র ছিলেন/আছেন বলেই আজ শূন্য দশকের কবিরা নিজের নিজের স্বাতন্ত্র বজায় রাখছেন।
শূন্য দশকের কবিরা পূর্ববর্তী কবিদের রচনারীতি আত্মস্থ করে নিজেদের সমুচ্চ সাধনা তুলে ধরেছেন। তারা শব্দের কম্বিনেশন ও পারমুটেশনের সঙ্গে আত্মার মীমাংসা অমীমাংসা মিশিয়ে নিয়েছেন। অভিজিৎ পাল, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, সৌম্যজিৎ আচার্য , সব্যসাচী হাজরা ও স্বয়ং এই প্রবন্ধকার, কবি বিশ্বজিৎ এদের কয়েক জনের কবিতা অধিগত করলে বক্তব্য পরিষ্কার হবে যে এই সময়ের কবিরা উপযুক্ত ভবিষ্যতের কবি তৈরি করে যাবেন। কবি অনুপম মুখোপাধ্যায় এর পুনরাধুনিক ও প্রকল্পের কথা আমরা জানি। শূন্য দশকের আমরা ইতিমধ্যেই নতুন প্রজন্মের কবিদের মুগ্ধতা অর্জন করেছি। কে বহুদিন একনায়ক তন্ত্র করবেন সেটাও ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। সঞ্জয় ঋষি কবিতায় বলছেন ' জল সেলাই করে যেভাবে মাছ; সেইভাবে প্রেম হোক। হোক নাকে নাক ঘষাঘষি। চোখে চোখ ঘষাঘষি।' সব্যসাচী হাজরা লিখেছেন 'ফ র র ফরর পিক পিক পিক চিকম চিকমম/ ফটফটির উল্লাস ঙ-য় হৌম আবেগে/ হাঙরের মতো বহুতল/ নানাময়ী বিড়াল/ ধর্মে হ, বর্ণে হ...' ইত্যাদি। কবির চোখে লেগে থাকা ডিসপোজিশন । সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রাত্যহিক জীবনের অনুষঙ্গ কবিতায় প্রকাশ করে চলেছেন নতুন নির্মাণ শৈলীর মাধ্যমে পাঠকের জন্য রসবিনিময় ও মতবিনিময় সহজ ও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে না সবসময়। নাস্তিক্যবাদী মণীষাকে সমাজের এক বৃহত্তর অংশ স্বীকার করে না। পরিবর্তনের ফলে কবিতা হারায় না।
জীর্ণ বাস পরিত্যাগ করে আত্মা যেমন নব কলেবর ধারণ করতে চায় তেমনি কবিতাও খোলনলচে বদলে ফেলবে। এখনকার সরকারি যে সব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে আমাদের ভাগ্যে ভবিষ্যতের কবিদের কপালে যা নাও থাকতে পারে।
প্রাবন্ধিক শাহিদ হাসান বলেছেন : কবিতা অনিবার্যভাবে
পাল্টে যাবে এবং প্রযুক্তিনির্ভর হবার সম্ভাবনা বেশি।খুব ভালো লাগলো এই ভবিষ্যদ্বাণী।
আমি বলছি ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে, এমন সফ্টওয়্যার তৈরি হবে যে কবিতার ভাষা ও নমুনা
যন্ত্রে ইনপুট করা মাত্র কম্পিউটার বা রোবট কবিতা লিখে দেখাবে। হয়তো শখানেক জীবনানন্দধর্মী,
মলয় রায়চৌধুরীধর্মী, অলোক বিশ্বাসধর্মী কবিতা লিখে দেবে কম্যান্ড ও ডিম্যান্ড অনুযায়ী।
এর জন্য কাউকে আর ভানুসিংহ ছদ্মবেশ নিতে হবে না। অথবা কোনো নতুনতম কবিতা লিখে দেখাবে।
আশ্চর্যান্বিত হয়ে লাভ নেই।
আমাদের বঙ্গীয় সাহিত্য সবটুকুই তো বৈদেশিক সাহিত্য থেকে ধার করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওয়ার্ডসওয়ার্থ কীটস প্রমুখ রোমান্টিক কবিদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। পোস্ট মডার্ন , পাওয়ার পোয়েট্রি, ম্যাজিক রিয়ালিজম, অ্যান্টি পোয়েট্রি ইত্যাদিও বৈদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সাহিত্যতে অ্যাংরি ইয়ং মেনদের কবিতা নতুন যুগের সৃষ্টি করল। জন অ্যাসবেরি , মার্গারেট অ্যাটউড, সল বেলো, রিচার্ড ব্রটিগান প্রমুখ হাজার কবি কবিতা লিখেছেন। এই ঢেউ বাংলা সাহিত্যে এসে পৌঁছেছে স্বাভাবিকভাবেই। আশির দশকে বাংলা কবিতায় ব্যাপক ভাষাবদলের প্রভাব দেখা যায়।
এখন শূন্য দশক পেরিয়ে প্রথম দশকের কবিতায় আবেগের ভাটা পড়েছে সামান্য। আবেগ নামক সোনায় খাদ মিশিয়ে বেশ শক্তপোক্ত কবিতা গড়ে তোলা হচ্ছে যাকে বিনির্মাণবাদী কবিতা শৈলী বলা যায়। বয়স্ক
প্রাচীনপন্থী এবং নব্য প্রাচীনপন্থী উভয়েই গেল গেল রব তুলছেন। তবে খুব ছোট্ট একটা পয়েন্ট তৈরি হয়ে গেছে।ঐ বিন্দুতে কিছু কবি কাজ করে চলেছেন। একঘরে হবার ভয়ে বেশির ভাগ কবি এ পথ মাড়ায় না। তারা জনগণপ্রিয় কবি নন। তারা সরকারের দ্বারা আদৃত কবি নন। এদের কবিতার মধ্যে আয়রনি, প্লেফুলনেস, ব্ল্যাক হিউমর, হাইপাররিয়েলিটি, প্যারানোইয়া , ফ্র্যাগমেন্টেশন ইত্যাদি কতোরকম বৈশিষ্ট্য আছে।
কবি আহমেদ মওদুদ কবিতার পন্য হয়ে যাবার দিকটি দেখিয়েছেন। এই সমস্যাও চিরকালের। জুয়া খেলার মেশিনে ঢুকে পড়ে কে কিভাবে দু পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে আর নুন আনতে পান্তা ফুরানোর কবিরা বই বিলিয়ে দেবার আনন্দে মেতে ওঠে। বেঁচে থাকার অহংকার আর কি।
আবার আজিজ কাজল বললেন : কারণ ভার্চুয়াল বিশ্বের রেডিও অ্যাক্টিভ তেজষ্ক্রিয়তায় বহুবিধ অনুষঙ্গ ভবিষ্যতের কবিতানির্মাণ শিল্পকে নষ্ট করে দেবে।
কি এক আশংকা তাকে অধিকার করেছে যেন। এ প্রসঙ্গে বলা বাহুল্য হবে না যে রেডিও অ্যাক্টিভ মিনারেল বৃষ্টি নামের একটি কবিতার বই রয়েছে আমার। রয়েছেন অংকের সঙ্গে কবিতাকে মিলাতে ব্যস্ত এক কবি তিনি নব্বই দশকের অনিন্দ্য রায়। পুনরাধুনিক প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত অনুপম মুখোপাধ্যায়। অসংখ্য আংকিক চিহ্ন ব্যবহার করে কবিতা লিখছেন প্রথম দশকের কবি রাহুল গঙ্গোপাধ্যায়। ফারজানা মনির কবিতায় আছে ছুরির ধার।
বাস্তবধর্মী কবিতা লেখা উদ্দেশ্য হলেও কবিতার নিজস্ব গুণে বাদলা ও পাগলা হাওয়া এসে তাকে উল্টে দেয়। ব্যঞ্জনাময় না হলে তো আধুনিকোত্তর কবিতা জলসা হয়ে যাবে , মামুলি হয়ে যাবে, মননশীলতা হারাবে। এমন কি রবীন্দ্রানুসারী কবিতাও লিখতে পারি না এই সময়ের দাবি মেনে। কবিকে সবসময় নতুনত্বের সন্ধানে থাকতে হবে। আমাদের বাস্তব জীবনের নাইটক্লাব, ফাটকাবাজি, টাকা নয়ছয় করা, হত্যা, ঘুষ ইত্যাদি ইত্যাদি যুগযুগ ধরে প্রতিটি সমাজেই বিরাজমান। ইদানিং বাংলা গানের লিরিক্সও পাল্টে গেছে। একটা বিষয় অবশ্য বলা যায় অপরিচিত নতুন কবিরা আগেও যেমন প্রকাশকের ভরসাস্থল ছিলেন না এখনো তেমন নন। আগে জনপ্রিয়তা অর্জন করে এসো তারপর সরকার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে।
তাহলে ভবিষ্যতের কবিতা কি জিনিস বলতে গিয়ে কবি অনিন্দ্য রায় যা বলেন তাই গ্ৰহণযোগ্য হোক : কবির বাস্তবতা যেমন সাধারণের বাস্তবতার সাথে মেলে না , পারপেন্ডিকুলার, সময়ও কবির কাছে রিয়েল টাইমের সাথে পারপেন্ডিকুলার ও ইমাজিনারি।
এমন একজন মানুষ , যিনি সময়ের উল্লম্বে চলাচল করছেন, লিখছেন কবিতা।
এমন একজন মানুষ, যিনি সময়ের উল্লম্বে যাতায়াত করছেন, পড়ছেন কবিতা।
তাঁরা কেউই , সময়ের সোজা পথ ধরে হাঁটবেন না, হাঁটতে পারবেন না। কোনোদিনই ভবিষ্যতে পৌঁছবেন না কবি ও পাঠক।'
আমাদের দেশে কবিদের সবচাইতে বড় আশা ও ভরসাস্থল লিটিল ম্যাগাজিন। অনেকটা বাংলা সিরিয়ালের ছোটপর্দার মতো। নিজেদেরকে বিগ হাউসের চোখে পড়ানোর চেষ্টা সবসময়ই বর্তমান বড়ো দাদাদের যথেষ্ট উন্নাসিকতা ও উদাসীনতা থাকা সত্ত্বেও। ধর্মীয় নেতাদের মতো বিগ হাউসের ভাবাবেগে আঘাত পাবার ব্যাপারে সচেতন সচকিত থাকেন।এখন ফেসবুক ও ব্লগ বড়ো ভরসাস্থল। বিদেশে একাডেমী অব আমেরিকান পোয়েটস আর বহুবিধ ওয়ার্কশপ ফেলোশিপ লেকচারস ইত্যাদি আছে কবিতাকে গুরুত্বপূর্ণ বাতাবরণ দেবার জন্য। এখানে অনেকটা লাইফ টাইম এচিভমেন্টের মতো পুরষ্কার দেয়া হয়। লক্ষনীয় এই যে একাদেমী পুরষ্কারপ্রাপ্ত কবিরাও অনেকে নতুন প্রজন্মের কাছে অনুসরণযোগ্য বিবেচিত হচ্ছেন না।
রাহুল গঙ্গোপাধ্যায়ের ইঙ্গিতময় একটি কবিতা পড়ে নেওয়া যাক।
মিথোজীবি কবিতা মাত্রা
ক্রমশঃ বিক্রিয়ায় গাছ খনিজ মাটির প্রতিস্থাপন
মাটি ~ প্রতিস্থাপক : আকরিক মাটি
ভিজে জল ~ শরীর ভেজায়। শরীর জুড়ে শেকড়
কতোপথ ভিজে গেলো ~ ভারীমেঘ জলে
বরফিলা আয়নাছবি।
একটু দীক্ষিত ও শিক্ষিত পাঠকের কাছে এদের আবেদন। কে পড়বে আপনার কবিতা, কোন ধরনের আলোয় এনলাইটেন্ড তিনি এসব দিক লক্ষ্য করে কি কবিতা সবসময় লেখা যায়? যায় হয়তো। জীবনপ্রনালীর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাই কবিতার ভাষা ও রীতি পাল্টে যায়। আমরাও বলতে পারি আমার সন্তান যেন থাকে কবিতাতে। আমাদের কবিতার সংকেত ধরে আসবে ভবিষ্যতের কবি।
কবি তানসিম রিফাত বললেন : কবিতা কেবল ভাষা নয়, এর
দার্শনিক স্তরটার দিকেও মন দেওয়া জরুরি। নিজ কালের চিন্তার সঙ্গে এর মতো দূরত্ব থাকবে
, ততো নিজ মানুষের সত্যভাষন থেকে দূরে চলে যাবে কবিতা। ' এই ধারণাটা কবিতা সম্পর্কে
একটা প্রচলিত হোয়াক্স বলা যেতে পারে। মিথ্যে ব্যাপারটাও জীবনের একটা সত্যি। সত্যিকারের
সত্যি তো খুব কর্কশ আর কঠিন। তাকে যেমন আছে তেমনি দেখানোয় কবিতার মায়াজাল ছিন্ন হবে।
কবিতার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে না এইভাবে। নতুন কবিতা দু তিন বার পাঠ করলে আস্তে আস্তে
অর্থময়তা আসে। কবি স্বদেশ সেন নতুন কবিতা লেখার সূচনা করেন। আজ যারা একটু অন্যরকম
কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন সেটা এইসব বরেণ্য কবিদের সাধনার আলোয় পরিমার্জিত।
আমার কবিতার নমুনা রাখলাম।
চৌরেখা - ১৫
ফুটকি প্রেমী চিতার একশো মিটার দৌড়ে জয় আমার। হাল্কা দর্শনকে জলে পয়সা ছুঁড়ে গম্ভীর করে তুলি। যতো সম্বন্ধপদের চিহ্ন নিয়ে রূপো রঙ ধুলো ওড়ে। দোলের রঙিন জল পেট্রোলের পিছন ছুটছে আর ময়নাতদন্ত বলে ঘোড়ার মালাইচাকিটি আমার।'
কুহক বিদ্যার অন্যতম এই কবিতা ভাষিক
যোগাযোগ গড়ে তুলবে মানুষে মানুষে সমাজে সমাজে এ আশা করা অমূলক নয়।
দেবযানী বসু