১
বউকে বিয়ে দিয়ে পল্টনের নির্ভার লাগছে কিনা জানে না , তবে বেশ নিঃস্ব , রিক্ত লাগছিল ।
বউকে বিয়ে দিয়ে পল্টনের নির্ভার লাগছে কিনা জানে না , তবে বেশ নিঃস্ব , রিক্ত লাগছিল ।
বউয়ের প্রেমিক আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালো।
সে বললো – ভাই , ইচ্ছে হলেই এসো কিন্তু ।
বউ বললো ~ এবার থেকে আপনি আমার দাদা
হলেন । বোনটিকে ভুলবেন না কিন্তু ।
শুধু পল্টনের মন ভিতরে ভিতরে কেঁদে
উঠলো । নিজের বউয়ের বিয়ে দিয়ে মনে হলো সে যেন প্রিয়জনকে দাহ করে শ্মশান যাত্রা থেকে
ফিরলো ।
স্থানীয় কাগজগুলিতে আগামীকাল পল্টনের
ছবি ছাপা হবে । সাক্ষাৎকারও নিয়েছে কেউ কেউ ।
শুধু পল্টনের বৃদ্ধা , অন্ধ মা এসব
কিছু জানেন না ।
ভোরবেলা উঠেই হয়তো ডাকবেন – বউমা ,
বউমা ।
পল্টন ভজনদার ডেকরেটার্সের দোকানে
কাজ করে । খাতা পত্তর লেখে । আবার কখনও কখনও গায়ে গতরেও খেটে দেয় ।
ভজন-দা তেমন খুশী হননি । অবাকও
হয়েছেন । তিনিই পাত্রী দেখে দিয়েছিলেন । সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভজনদাকে বলেছিল
পল্টন ।
শুনে ভজন-দা বলেছিলেন –
পুরুষের মতোন ব্যবহার কর পল্টন ।
দু-ঘা লাগা ~ সব বেচাল ঠিক হয়ে যাবে ।
পল্টন বাংলা ভাষায় এম. এ. । চাকরি না
পেয়ে শেষমেশ ভজনদাকে ধরেছিল । রবীন্দ্রনাথের গীতবিতানের অনেক গানই তার মুখস্থ ।
সদ্য প্রাক্তন হয়ে যাওয়া বউয়ের রবীন্দ্র সংগীত একেবারেই ভালো লাগত না । বরং বলা
যায় অসহ্য লাগতো । তবে সে কর্মঠ ছিল । রান্না-বান্না , ঘরের কাজ মুখ বুজে যন্ত্রের
মতোন করে যেত ।
রাতেও মিলন হয়েছে কয়েকবার । তবে
ও-পক্ষের কোন মানসিক সাড়া ছিল না ।
যাই হোক , ওসব ভেবে কাজ নেই ।
অনেকদিন পর ছিলিমে টান দিলো পল্টন আর সোজা চলে গেলো শ্মশানে । চোখ দুটো রক্তাভ তখন
তার , নাসারন্ধ ফুলে উঠেছে ।
শ্মশানটা হাসপাতালের কাছে-ই । একটা
অস্বাভাবিক দেহ সুরত হাল আর পোস্ট-মর্টেমের পরে দাহকার্যে এসেছে । লোকজন তেমন নেই
। রঘু ডোমও তার কাছে থেকে চেয়ে নিয়ে টান দিয়েছে ।
এইসময় পল্টনের নজর পড়ল এক ভৈরবীর
দিকে । মাথায় জটা , লাল কাপড় পরিহিত । ভৈরবী পল্টনকে ডাকছিল ।
পল্টন কাছে গেলো ।
ভৈরবী আদেশের কণ্ঠে বললে – কেন এসেছিস শ্মশানে !
পল্টন বললো ~ ভূত-পেন্তী ,
ডাকিনী-যোগিনীদের দেখা পেতে ।
ভৈরবী আগুন জ্বালিয়েছে , হোম করছে ।
সেই হোমের আগুনে পল্টনের মনে হলো ভৈরবী বেশ সুন্দরী । অবশ্য গাঁজার নেশায়ও হতে
পারে ।
ভৈরবী বললো – তুই নাকি বউয়ের বিয়ে
দিয়েছিস পল্টন !
এরা সর্বজ্ঞা হল । পল্টন ‘পায়ে’ হাত
দিয়ে প্রণাম করতে গেলে ভৈরবী চমকে উঠলো ।
বললো – পায়ে হাত দিতে নেই পল্টন ।
পল্টন জড়ানো গলায় বললো ।
সত্যি , আপনি ডাকিনী – যোগিনী দেখাতে
পারবেন !
ভৈরবী বললো – আমার হাত দুটো স্পর্শ
কর – পল্টন ।
পল্টন ভৈরবীর হাত দুটো স্পর্শ করল ।
খুব নরম ও সুন্দর ।
পল্টন ভৈরবীর আদেশ মতোন চোখ বুজে রইল
। ভৈরবী বোধহয় আগুনে কি-সব আহুতি দিতে থাকলো আর বলতে লাগলো ~ ওং হ্রীং ফট ডাকিনী ,
যোগিনী স্বা-হা ।
পল্টনের মনে হলো , অগুনতি ডাকিনী –
যোগিনী তার চারপাশে নৃত্য করছে ।
একটা সময় ভৈরবী বললো – চোখ খোলো
পল্টন । ভয় নেই , আমি আছি ।
আস্তে আস্তে চোখ খুললো পল্টন । সদ্য
সুরত হাল করে আসা লাশটা উঠে বসেছে যদিও তার চোখ দুটো বোজা ।
কোনক্রমে বাড়ি ফিরে এলো পল্টন ।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতেই পাশের বাড়ির ঝন্টু বললো – থানার বড়বাবু তোকে ডেকেছে ,
পল্টন ।
২
তখন স্যার গাঁজা খেতাম ।
অনুজ চমকে উঠলেন । পুলিশ আধিকারিকের
কাছে বয়ান দিচ্ছে ছেলেটা ~ তখন গাঁজা খেতাম ।
এরপর অনুজ বললেন ,
এখনও তোর মাথাটা ঠিক আছে তো !
এবার সে হেসে বললো –
হ্যাঁ , স্যার – একদম ।
নিজের বউয়ের বিয়ে দিলি – কষ্ট হলো না
তোর !
চোখ দুটো ছলছল করে উঠল ছেলেটার ।
আমার তো বয়স হয়ে গেছে স্যার , তার
উপর বেশ মোটা হয়ে গেছি ।
মধ্যপ্রদেশও তো যাচ্ছেতাই ।
স্মার্ট কণ্ঠস্বর কিন্তু বেদনা যে
রয়েছে টের পেলেন অনুজ ।
বিয়েটা তবে করতে গেলি কেন !
ছেলেটি তখন বললো –
যদি বলি মায়ের জন্য , অর্ধসত্য বলা
হবে ।
অনুজ হেসে বললেন ,
পুরো সত্যিটা তবে কি !
থানার চাকরিতে অনুজের মতন
আধিকারিকদের দেখা যায় না । পদার্থ-বিদ্যায় স্নাতক অনুজের কলেজের নাম ছিল বেলুড়
বিদ্যা-মন্দির । তারপর যাদবপুর বিশ্ব-বিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করার সময়েই পুলিশের
চাকরিতে ঢোকা , সাব ইন্সপেক্টর । এই সবে কোস্টাল থানার বড়বাবু হয়েছেন তিনি । বউকে
সন্দেহ করে স্বামী খুন করেছে বা পরকীয়া দেখতে পেয়ে খুন ~ এরকম অনেক দেখা যায় এবং
‘হিংসা’ এখন সমাজের স্বাভাবিক ঘটনা ।
রিপুর তাড়না স্যার ।
বললো ছেলেটি । চমকে উঠলেন তিনি ।
কি করিস তুই !
ঠিকাদারের কাছে । ভজন ডেকরাটর্সে খাতা
লেখা ও অন্য কাজ ।
পড়াশুনা করিসনি !
বাংলায় এম. এ. করেছিলাম ।
মুখ ফসকে বলে ফেললেন অনুজ ,
স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা দাওনি ! ভিতর
থেকেই সম্বোধনে সম্ভ্রম আনলেন অনুজ ।
সব জায়গায় প্রচুর ঘুষ চাই স্যার । ৯ –
১০ লাখের নীচের চাকরি নেই ।
অনুজ বললেন – এই ভাবনাটা ঠিক হলো না
। এর বাইরেও কিছু ছেলে- মেয়ে চাকরি পাচ্ছে নিজের যোগ্যাতার জোরে ।
ছেলেটি স্নাতকোত্তর করেছে জেনে একটা সম্ভ্রম-বোধ তৈরি
হয়েছে অনুজের । সম্বোধন ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’ হয়েছে ।
তবে এই চেয়ারের সঙ্গে অনুজের
স্বাভাবিক সৌজন্য বোধও এক রকমের অন্তরায় । এটা সতীর্থেরা অনেকেই বলেন ।
পার্থ-দা সেদিন ঠাট্টা করে বললেন –
পুলিশের গণ-সংযোগ বাড়াতে হবে কিন্তু তাই বলে দাগী ডাকাতকে তুই যদি ‘আপনি’ বলে
সম্বোধন করিস ~ তবে কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ।
তমাল বললো – বারাকপুর ট্রেনিং-এ ১২
কি. মি. কমপ্লিট করতিস প্রতিদিন !
অনুজ হেসে বললেন – করতাম ।
তারপর খিস্তি দিতিস না ।
অনুজ বললেন – হ্যাঁ ।
তবে ! সেসব দিন হারিয়ে ফেলিস না !
‘খিস্তি’ পুলিশের ভূষণ ~ না , হলে চেনা যায় না । আর তো কিছু নেই ।
তবে এই ছেলেটি আসামী নয় , নিজস্ব কৌতূহলে অনুজ ওকে
ডেকেছেন । আবার অনুজের পুলিশ সত্তা জেগে উঠলো ।
‘তুই’ সম্বোধনে নেমে এলেন ।
গাঁজা কেন টানিস ।
মোক্ষম একটা খিস্তি দেওয়ার জন্য
নিজেকে তৈরি করছিলেন অনুজ ।
স্যার, ওসব আগে করতাম । শুকনো নেশার
ধারে কাছে এখন যাই না ।
তবে কি মাল খাস এখন !
বউয়ের বিয়ে দেওয়ার পর বিয়ার পান
করেছিলাম । ঘুম ভালো হয়েছিল আর পেটও বেশ সাফ হয়ে গেছিল ।
কি করে বুঝলি বউয়ের প্রেমিক রয়েছে ।
বোঝা খুব কঠিন ছিল । অভিনয় ছিল
নিখুঁত । কাজে কোন ক্রটি রাখতো না ।
হাওয়া খানিকটা ভারী হয়ে উঠল ।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অনুজ অজান্তেই ।
তাঁর বউ যদি এরকম পরকিয়া করেন , তিনি কি পারবেন এতোটা নিস্পৃহ থাকতে । সবে বিয়ে
করেছেন অনুজ । তাঁর চেহেরা সুভদ্র । কখনও কখনও মনে হয় বিশাখা সত্যিই তাঁকে নিয়ে
সুখী তো !
একদিন গান গাইছিল বিশাখা ~ আমি যে
গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতার ঝরার বেলায় ~ মনে রেখো ।
হঠাৎ-ই ঢুকেছিলেন অনুজ । বিয়ের এক
বছরের মধ্যেও তিনি জানতেন না বিশাখা গান গাইতে পারে । এছাড়াও ৬ মাস তাঁরা প্রেম
করেছেন ।
তিনি ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলেন
রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান দেখে ।
তিনি বললেন , তুমি এতো ভালো গান গাও
জানতাম না তো !
বিশাখা অবাক হয়ে গেলো অনুজের এতো
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসা দেখে ।
বিশাখা যেন চমকে উঠল , বললো – তুমি
এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলে !
একটা সেমিনার ছিল , তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে
গেলো ।
বিশাখা বললো – ‘ও’ ।
খুবই ঠাণ্ডা প্রতিক্রিয়া ।
অনুজ বললেন , বেড়াতে যাবে !
বিশাখা হাই তুলে বললো – ঘুম পাচ্ছে
খুব । কোথায় যাবে ! তখন তাঁরা জলপাইগুড়িতে
থাকেন । জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানায় পোস্টিং ।
অনুজ বলেছিলেন ~ তিস্তার ধারে ।
বিশাখা বললো – ‘পুলিশ’ লেখা গাড়িতে
আমি উঠবো না ।
অনুজ জানতেন , এর আগেও বিশাখা বলেছে
~ তবে সেদিন বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন ।
ছেলেটি এবার বললো , স্যার , আমি যাই
তাহলে ।
কি চা খাবি ~ লিকার না দুধ !
ছেলেটি বুঝতে পারলো , পুলিশ একবার
ডাকলে নিস্তার নেই । সে যতো ভালোই কাজই করুক ।
সে বললো – স্যার , দুধ ‘চা’ খাবো ।
দুধতো জোটে না , চায়ের সঙ্গে খানিকটা যাবে ।
হাসলেন অনুজ । সন্ধে হয়ে আসছে ।
রজনীগন্ধায় ছেয়ে আছে থানার বাইরেটা । খুব সুন্দর করে বাগান করিয়েছেন অনুজ ।
বিশাখার পছন্দের ফুলগুলিই তিনি মালী দিয়ে লাগিয়েছেন । জুঁই , কাঁঠালি চাঁপাও রয়েছে
।
দিনের বেলা অনুজ একরকম , রাত হলেই
তিনি বদলাতে থাকেন । প্রায় রাত কাটে থানায় । অবসর বলতে দুপুর ২ টে থেকে ৪ টে । এই
সময় বিশাখার সঙ্গে যান্ত্রিক সঙ্গম । মুখ দেখে বোঝা যায় সে উপভোগ করছে না ।
বাবাও কখনও ভাবেননি অনুজ পুলিশের
চাকরি নেবে । নিজে কলকাতার নামী কলেজে অধ্যাপনা করতেন ।
বিশাখার সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে যাদবপুরে
পড়ার সময় । রির্সাচ করার কথা ছিল অনুজের । হঠাৎ কি যে হলো পুলিশের সাব-
ইনসপেক্টরের চাকরি তাঁকে চুম্বকের মতন টানলো ।
পুলিশের ড্রেস পরিহিত অবস্থায় বাবাকে
প্রণাম করতে গেছিলেন অনুজ । তিনি প্রণাম গ্রহণ করেননি ।
বলেছিলেন , আজ থেকে তুমি নীচের ঘরে
শোবে । বউমাকে ছোঁবে না ।
মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনুজ ।
কোন প্রতিবাদ করতে পারেননি । আসলে পড়াশুনা করতে তাঁর আর ভালো লাগছিল না ।
পুলিশের উর্দি , ক্ষমতা , সমাজের
বাঘা বাঘা মানুষদেরও খিস্তি দেওয়ার গোপন অভিলাষ অনুজকে দিশেহারা করে তুলেছিল ।
বিশাখা একদিন অনুজের প্রেমিকা ছিল
বলেই গভীর রাতে অনুজের ঘরে এসেছিল । অনুজ নিজের বউ এবং প্রেমিকার উপর ঝাঁপিয়ে
পড়েছিলেন । তাকে সঙ্গম না বলে ধর্ষণ বলাই ভালো ।
অনেক মাস পর তিনি এও জানলেন বিশাখা
গান গাইতেও ভালোবাসে ।
অনুজ হঠাৎ বললেন – তোর বউ গান করতো !
না স্যার ।
হয়তো করতো , তুই জানতে পারিস নি ।
আমার অন্ধ মা-কে স্নান করিয়ে দিতো ,
ভাতও খাইয়ে দিতো কিন্তু গান করতে শুনিনি ।
তোর বউটা তবে ভালো মেয়ে ছিল শুধু
পরকিয়া করতো এই যা ।
ছেলেটি বললো –
শুধুমাত্র ফোনে ।
ওরাতো গোপনে শুতেও পারে ~ তুই কি করে
জানবি !
সে কখনও বাড়ির বাইরে যাইনি । আমার
মায়ের প্রতি যাবতীয় কর্তব্য পালন করেছে ।
তোর মা তো অন্ধ , চোখে দেখতে পায় না
। কিছুই বুঝতে পারেনি হয়তো ।
ছেলেটি বুকভরে রজনীগন্ধার সুবাস নিলো
। গুমোট কেটে গিয়ে এখন হাওয়া দিচ্ছে ।
এবার সে বললো – আমি যখন তার শরীর
চাইতাম , সে দিতো । না করতো না ।
তবে শুধু টেলিফোনে আড়ি পেতেই শিউর
হলি ।
অনেকটাই স্যার । আর যদি কেউ ভালো না
বাসে তার শরীরের ঘ্রাণে বোঝা যায় ।
অনুজ যেন নিজের মধ্যেই হারিয়ে
যাচ্ছেন ।
বললেন , কি-ভাবে বোঝা যায় !
আমার শরীরের গন্ধে তার বমি পেতো আর
আমারও যেন মনে হতো এই গন্ধে গর্হিত কিছু রয়েছে । আমি বুঝি পরকিয়া করছি ।
অনুজ এবার মুখ খারাপ করলেন ।
শালা , গান্ডু ।
আরো একটা চার অক্ষর বের করতে গিয়ে
সংযত হলেন ।
বাবা একদিন মেনে নিলেন চাকরিটা ।
ঘটনাটা রেপের । একটি মুসলিম মেয়ে ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে ধর্ষিতা হয়েছিল । অনুজ
ছেলেটিকে শুধু ধরে তা নয় শাস্তি দিতেও সক্ষম হয়েছিলেন । অফিসের অর্থাৎ থানার কোন
কিছু অনুজ আলোচনা করতেন না । মা বেঁচে নেই অনুজের , থাকলে তিনি হয়তো শুনতেন ।
ঘরে ফিরে নীচের ঘরে আলো নিবিয়ে
শুয়েছিলেন ধ্বস্ত অনুজ ।
বাবা এসে লাইট জ্বাললেন । সঙ্গে
বিশাখাও । আরো দুজন ছিলেন ~ সেই ধর্ষিতা মেয়েটি ও তার বাবা । ইফতারের খাবার এনেছেন
মেয়েটির বাবা অনুজকে দেবেন বলে ।
ইতস্তত করছিলেন অনুজ । বাবার সামনে
তিনি ঘুষ নেবেন ।
বাবা-ই বললেন – নাও । এটা তোমার
পুরস্কার । প্রাপ্য ।
অনুজ নিলেন , মেয়েটি তাঁকে প্রণাম
করলে অনুজ গ্রহণও করলেন ।
ওঁরা চলে গেলে বাবা বললেন – তুমি
এবার থেকে উপরেই শোবে । আমার গর্ব হচ্ছে আজ । তোমার জন্য ।
বিশাখাও সেদিন হৃদয় থেকে ভালোবেসেছিল
, অন্তত সেই রাতে ।
অনুজ বললো – তোর জীবনটা যে নষ্ট করে
দিলো ~ প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে হয়নি !
হয়নি বললে ভুল বলা হবে । আকাশ ভেঙে
পড়েছিল মাথায় । গুম হয়ে বসেছিলাম কয়েকদিন । কাজেও যেতে পারিনি ।
অনুজ বললেন – তারপর ।
এইসময় একজন মহিলা কনস্টেবল এসে দুটো
ডিম-ভাজা দিয়ে গেলো । একটা অনুজ আরেকটা এই ছেলেটির জন্য । রাত্রি নেমেছে , আকাশ আজ
তারাভরা । মা বেঁচে থাকতে ছাদে গিয়ে আকাশের সঙ্গে পরিচয় করাতো ‘মা’ । লুব্ধক ,
অরুন্ধতি , সপ্তর্ষি –মন্ডল , কালপুরুষ ~ এই সমস্ত কিছু মায়ের মৃত্যুর পর কতো রাত
একা একা ছাদে কাটিয়েছেন অনুজ । আর তিনি আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রকে খোঁজেননি , খুঁজেছেন
চিরকালের মতোন হারিয়ে যাওয়া মা-কে ।
এইসময় সাব-ইনসপেক্টর কৃষ্ণেন্দু এলো
। চোখ দুটো আরক্ত , পুলিশের উর্দিতে জমাট ঘামের স্পষ্ট প্রকাশ । একটা সিগারেট
চাইলো অনুজের কাছে । অনুজ দিলেন । সিগারেটে আগুন ধরিয়ে কৃষ্ণেন্দু বললো –
কিছুতেই স্বীকার করছে না । কাল
কোর্টে তুলতে হবে এর চেয়ে বেশী মারা যাবে না । স্যার , আপনি কি চেষ্টা করবেন !
হার্ড কোর ক্রিমিনাল । এর আগে দুটো
বউকে খুন করেছে । এটা থার্ড । সায়নির চেষ্টায় ধরতে পারলাম ।
বেঁচে থাকলে তো আরো খুন করবে ।
কৃষ্ণেন্দু বললো ।
তবে কাল ভোরে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময়
বুড়িগঙ্গার কাছে নিয়ে যাবি ।
কৃষ্ণেন্দু বললো – স্যার । একদম ।
এতে কোন পাপ হবে না ।
হো হো করে হেসে উঠলেন অনুজ ।
তুই কি এখনও পাপের ভয় করিস !
কৃষ্ণেন্দু বললো – একেবারে মুছে
যাই-নি স্যার । পাপবোধ এখনও আছে ।
এইবার কৃষ্ণেন্দুর পল্টনের দিকে চোখ
গেলো । আরে বউয়ের বিয়ে দিয়ে তুই তো এখন হিরো ।
পল্টন অর্থাৎ ছেলেটি ম্লান হাসলো ।
এইসময় আবার সেই মহিলা কনস্টেবল এলো ।
পল্টনকে বললো ~ আমায় চিনতে পারছ !
পল্টন বললো ~ না ।
এবার সেই মহিলা পুলিশ বললো ~ আমি
শ্মশানের ভৈরবী । তান্ত্রিক । চমকে উঠলো পল্টন ।
এবার অনুজ বললেন – কালও তুই গজ্ঞিকা
সেবন করেছিলি । কিন্তু শ্মশানে কেন গেছিলি !
ভূত বা পেত্নি দেখতে । পল্টন উত্তর
দিলো ।
পেলি সেই পেত্নীকে !
কৃষ্ণেন্দু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে
।
মহিলা কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে পল্টন
বললো – শ্মশান ভৈরবী একটা সদ্য লাশের দেহে প্রাণ এনেছিল কিছুক্ষণের জন্য ।
সবটাই আমাদের প্ল্যান । অনুজ বললেন ।
পল্টনের কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে । সে গতরাতে শ্মশানে গেছিল । শুকনো নেশা করেছিল ।
কোন কিছুই ভালো লাগছে না তার । কয়েকদিন হলো সর্বাণীর বিয়ে দিয়েছে । তার কেন জানি
মনে হয়েছিল সর্বাণী সুখে নেই । শ্মশানে সে খুঁজতে গেছিল কেন জানি সর্বাণীকেই ।
অনুজ বললেন – সে তো তোকে কখনও
ভালোবাসেনি । এখন তো সে সুখী । মরবে কেন !
ডুকরে কেঁদে উঠল পল্টন ।
আমি একজন সাধারণ ছেলে স্যার । বিয়েতে
অনেকগুলি টাকা খর্চা হয়েছিল ।
চুপ করে রইলেন অনুজ কিছুক্ষণ । তারপর
বললেন – ভুলে যা । নতুন করে বাঁচতে হবে তোকে । আজ যেটাকে অ্যারেস্ট করেছি ~ তার
জন্যই শ্মশানে ফাঁদ পেতেছিলাম । তোর জন্য আসামী হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল ।
পল্টন মুখ নীচু করে বসেছিল ।
অনুজ বললেন – তোর কি এখন প্রতিশোধ
নিতে ইচ্ছে করছে !
উত্তর দিলো না পল্টন । চুপ করে রইল ।
অনুজ বললেন – ঝোঁকের মাথায় যেটা
করেছিস সেটাই ঠিক । বউকে খুন করলে তুই ‘মানুষ’ থাকতিস না । কতোজন তোকে ভালো বলছে ।
মিডিয়া তোর ইন্টারভিউ নিয়েছে ।
কৃষ্ণেন্দু বললো – তুই তো এখন স্টার
।
পল্টন বললো – স্যার , আমার মতোন
ছেলেরা কি আর ভালোবাসা প্রত্যাশা করতে পারে !
মহিলা কনস্টেবলটি এবার এগিয়ে এসে
বললো – আমি ভৈরবী নই , তান্ত্রিকও নই , পুলিশও নই ~ এক নারী । তুমি আমায় বিয়ে করবে
!
পল্টন বললো – আমার তো কিছু নেই ।
ভালোবাসতে পারবে না আমায় ! পুরোনো সব
কিছু ভুলে গিয়ে ।
শ্মশান ভৈরবীর মতোন অবিকল দেখতে এই
মহিলা পুলিশ । তার হাতের স্পর্শ এখন আবার মনে পড়ছে ।
বলেছিল ~ চোখ বোজো পল্টন । আত্মা আসছে , তোমার সঙ্গে কথা
বলবে । নেশার ঘোরে ডাকিনী- যোগিনীদেরও দেখেছিল পল্টন ।
পল্টন থানা , বড়বাবু সব ভুলে গিয়ে
বললো ~ তোমায় স্পর্শ করবো ।
সে বললো ~ হ্যাঁ ।
নতুন ভালোবাসার অমৃত স্পর্শে জেগে
উঠছে পল্টন । নিজের বউকে প্রত্যার্পণের এমন পুরস্কার সে কল্পনাও করতে পারেনি ।
অনুজ কৃষ্ণেন্দুকে বললেন – সায়নি
আমাকে বলে সে পল্টনের মতোন ছেলেকে বিয়ে করতে চায় । তাই ওকে ডেকেছিলাম ।
অনুজ বললেন – গজ্ঞিকা সেবন ছাড়তে হবে
। পল্টন বললো ~ স্যার ।
সায়নি জানে , পল্টন পারবে । মনের জোর
পল্টনের রয়েছে আর ভালোবাসা তো রইল-ই ।
অভিজিৎ চৌধুরী