গণনাট্য আন্দোলনের পঁচাত্তর বছর
পূর্তির প্রেক্ষাপটে
আজকের নাট্যচর্চা
নির্দিষ্ট
একটি সমাজের যাপনপ্রণালীর মধ্যেই নিহিত থাকে তাদের সাংস্কৃতিক আচার-আচরণ। ফলে
সংস্কৃতি শুধু বিনোদন নয়, একটি জাতির আইডেনটিফিকেশনও বটে। সংস্কৃতির উৎস যেমন সমাজ, তেমন প্রায়শই সময়ের দাবিতে সমাজ থেকে উৎসারিত সংস্কৃতিকেই
বিলকুল বদলিয়ে দেয় তারই বীজতলাপুরানো সমাজকে। এটা সমাজবিজ্ঞানের একটা সাধারণ
সূত্র। আর এই নেতিসূত্রের প্রথা মেনেই ব্রিটিশ-ভারতবর্ষের শেষ লগ্নে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে, দাঙ্গা-দুর্ভিক্ষ জর্জরিত বিপন্ন সময় সমাজ আর মানুষের
অনিবার্য রসায়নে নির্মিত হয় একটি ভিন্ন সমাজ-সাংস্কৃতিক জাতীয় চেতনা, যার অভিমুখ নির্দিষ্ট হয়, শুধু ব্রিটিশ বিরোধিতায় নয়, তৎকালীন যাবতীয়
সামাজিক বঞ্চনা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধেও। শুধু ভারতে নয়, অত্যাচারের বুলডোজার সেই সময়ে চলছিল সারা পৃথিবী জুড়ে। অত্যাচারী
নাজিবাহিনীর দাপটে কম্পিত গোটা দুনিয়ার শুভ বোধযুক্ত কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানীরা
নানা প্রতিবাদী সংগঠনের পতাকার তলে নিজেদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন। যাদের মধ্যে ভারতীয়
প্রগতি লেখক সংঘ (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ), ফ্যাসীবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। সংগঠিত হয়েছিলেন ছাত্র এবং যুবরাও ছাত্র
ফেডারেশন এবং ইউথ কালচারাল ইনস্টিটিউটের পতাকার নিচে যথাক্রমে ১৯৩৬ ও ১৯৪০
খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ সর্বঅর্থেই পটভূমি প্রস্তুত ছিল। অতঃপর ১৯৪৩ সালের মে মাসে
সারা ভারতবর্ষ যে সমাজ-সাংস্কৃতিক সংগঠনের জোয়ারে প্লাবিত হয়ে গেল, তার নাম হল-‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’।
অনেকে বলেন
ব্রিটিশ নাকি বীরের জাত। ইতিহাস কিন্তু সে কথা বলে না। তারা আদতে হল বানিয়ার জাত।
আর এই বানিয়াবৃত্তির সঙ্গে নিপুণভাবে মেশানো স্থানীয় রাজনীতির ফয়দা ওঠানো
বিভাজন ও শাসনের কূটনীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষলগ্নে অহিংস স্বদেশি আন্দোলন, সুভাষপন্থী আজাদ হিন্দ ফৌজের বিক্রম আর বামপন্থীদের
সংঘবদ্ধতায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ স্বাধীনতার মোড়কে আসলে ভারতবাসীকে উপহার
দিয়েছিল চিরস্থায়ী একটি আত্মহননের বীজ। স্বাধীনতার ছলে তারা গভীর চক্রান্তে আসলে
ক্ষমতার হস্তান্তর করে ভারতবর্ষকে তিন টুকরো করেছে। প্রত্যক্ষ বিদেশি পুঁজি শোষণের
পরিবর্তে প্রবর্তন করেছে নিয়ন্ত্রিত মুৎসুদ্দি পুঁজি শোষণের। ঘটনাটা যাই হোক, ব্রিটিশ সিংহের এই পশ্চাদ অপসরণের নেপথ্যে যেমন ছিল ঢেউয়ের
মতো গণআন্দোলনগুলির চাপ, তেমনি সেই
গণআন্দোলনগুলির সমর্থনে সমান্তরাল ও পরিপূরক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকাও কম ছিল
না। এক কথায় বলা যেতেই পারে দেশে-বিদেশে সর্বত্র ব্রিটিশ সিংহের মুখ না পোড়া
অবধি তারা তাদের সাধের কলোনি ছেড়ে পালায়নি। আর সেই পশ্চাদপসরণে একটি ঐতিহাসিক
ভূমিকা পালন করেছিল তৎকালীন বামপন্থী কর্মীদের সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা Indian People's
Theatre Association (IPTA)-এর প্রথম ইউনিটটি
তৈরি হয় বাঙ্গালোরে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। সম্পাদক ছিলেন অনিল ডিসিলভা। পরের বছর
১৯৪২ সালে মুম্বাইতে তৈরি হয় সংগঠনের দ্বিতীয় শাখাটি। আর সর্বভারতীয় সংগঠন
হিসাবে এটা কাজ শুরু করে ১৯৪৩ সালের ২৫ মে থেকে। নথি থেকে জানা যায় ১৯৪৩ সালে
বোম্বাই-এ অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসের অন্তর্গত ‘প্রগতি লেখক সংঘ’-র অধিবেশনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অনুগামী সংগঠনটি ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ শিরোনামে আত্মপ্রকাশ করে। বিনয় রায়ের একটি গানের দল ছিল, যারা শ্রমিক কৃষক আন্দোলনের পক্ষে কাজ করত। গণনাট্য সংঘ
তৈরি হলে,
তারাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে একযোগে কাজ শুরু করে। একইভাবে তৎকালীন
নাট্যকর্মী-সাহিত্যিক-চিত্রশিল্পী-সাংবাদিকদের ঠিকানা হয়ে গেল ৪৬ নং ধর্মতলা
স্ট্রিট,
যা কিনা আদতেভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা দপ্তর ছিল।
গণনাট্যের প্রেরণা ও উদ্দেশ্য :
এটা ঠিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের
আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রটি এমন একটি বিস্ফোরণ-উন্মুখ অবস্থানে থিতু ছিল, যার ফলে অনিবার্য ছিল এমন একটি সংগঠনের, যার মধ্যে প্রতিফলিত হয় গণতান্ত্রিক মানুষজনের পুঞ্জীভূত
আবেগের। তথ্য বলছে যে, ভারতীয় গণনাট্য
সংঘের জন্মের আগেই ছাত্র, যুব এবং লেখক
শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা আলাদা আলাদা সংগঠনের মধ্যেসাধ্যমতো কাজ শুরু করেছিল। পরে ‘গণনাট্য’কে মূল সংগঠন করেসেগুলিমিলিত
হয়ে যায়। গাছের বীজের মধ্যেই যেমন নিহিত থাকে তার বনস্পতিতেপরিণত হওয়া বা না হওয়ার ঠিকানা, তেমনি গণনাট্য সংঘ বা সমচিন্তার ভাতৃসংগঠনগুলির নিষিক্তকরণে
দেশি অপেক্ষা বিদেশি বীজের ভারসাম্যের আধিক্যে
সমাজের জনমানসে তাদের স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ ছিল। না হলে
স্থাপনার পরে মাত্র দশ বছরের মধ্যেই সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় মহাসংঘটি
কোন প্রতিকুলতায় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল? তথ্য বলছে যে গোটা ভারতে সংঘের অসংখ্য
ইউনিটের মধ্যে বাংলাই ছিল অগ্রণী। এপস্টাইনের ‘পিপিলস
ওয়ার’ এবং রমা রলাঁর ‘পিপলস থিয়েটার’ বইদুটি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রেরণার মূলে কাজ করেছিল। এপস্টাইনের মতে
সাংস্কৃতিক কাজকর্ম রাজনীতির বাইরে হতে পারে না। অন্যদিকে নাট্যসম্পর্কিত মূল তিনটি
সূত্রে রমা রলা বললেন:(১) থিয়েটার আর বিশুদ্ধ শিল্পচর্চা নয়। এ হল জনগণের শিল্প।
মূল লক্ষ্য হবে জনগণের মনোরঞ্জন। তাতে বৈদগ্ধ্যগুণ ক্ষুন্ন হলেও ক্ষতি নেই।(২)
থিয়েটার সতই জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবে। উন্নত শিল্পচর্চার ছলে কদাপি এর থেকে সরে
যাওয়া চলবে না।(৩) আমাদের থিয়েটার অবশ্যই উদ্দেশ্যমূলক। যারা বলেন, থিয়েটার উদ্দেশ্যহীন বা নিরপেক্ষ, তারা ভুল। প্রসঙ্গত, এখানে বলা ভালো যে ভারতীয় লোকনাট্যের সহজাত প্রতিবাদ-ঋজুতা বা আমাদের প্রাচীন
নাট্যশাস্ত্রগুলির ভিত্তি, উদ্দেশ্য-বিধেয় বা
তার কার্যকারণগুলির কোনোটাকেই গণনাট্য নির্মাণকালে স্মরণ করা হয়নি।
সংস্কৃতিকর্মীদের এই বিস্মরণের ট্রাডিশন অবশ্য প্রথম নয়। কারণ আমাদের
থিয়েটারচর্চার শুরুই হয়েছিল মাত্র দুশো/আড়াইশো বছর আগে বাবু-কালচারের হাত ধরে, ইংরেজি থিয়েটারের নকলনবিশি করে, আমাদের হাজার হাজার বছরের নাট্যচর্চার ঐতিহ্যময় অভিজ্ঞতাকে
অস্বীকার করে। তার ফলে আমাদের মঞ্চচৰ্চা যতটা থিয়েটার-অনুগামী, তার দশ শতাংশও নাট্যানুসারী। নয়। সব কর্মের একটা উদ্দেশ্য
বা লক্ষ্য থাকে। গণনাট্যেরও অবশ্যই ছিল। গণনাট্যের খসড়া সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘Our
Production should be simple and direct.’গণনাট্য
প্রযোজিত নাটক ‘নবান্ন’র এর স্মারকপত্রে মুদ্রিত আছে, বাংলার নাট্যশালাগুলি দর্শকদের সত্যিকারের চাহিদা মেটাতে
ব্যর্থ। এই সংঘের কাজ হলো যেমনি একদিকে
স্তিমিতপ্রায় সংস্কৃতিকে জাগিয়ে তোলা, তেমনি অন্যদিকে তাকে জনগণের ব্যাপ্তির মধ্যে টেনে এনে প্রাণবন্ত করে তোলা।
মানুষকে বৈপ্লবিক প্রাণশক্তিতে বলীয়ান করে তুলতে সংস্কৃতির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তাই এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোভাগে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ অবিচলিত দেশপ্রেম নিয়ে
কাজ করে যাবে। এর থেকে পরিষ্কার বিদেশি বা ইউরোপের ধনতান্ত্রিক দেশগুলির
সাংস্কৃতিক চেতনার বীক্ষাতে এদেশের শিক্ষিত সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব যতটা দীক্ষিত ছিলেন, স্বদেশের শ্রমজীবী মানুষদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী
সংস্কৃতি নিয়ে ততটা অবহিত ছিলেন না। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক নেতৃত্বটি বরাবরের মতোই
ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের হাতেই। অতঃপর গণনাট্য সংঘ পথচলা শুরু করে ১৯৪৩ সালের মে
মাসে। তৎকালীন ‘নাট্যভারতী’ (বর্তমানে কলেজ স্ট্রিটের ‘গ্রেস সিনেমা’) তে বিজন
ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ ও বিনয় ঘোষের ‘ল্যাবরেটরী’ নাটক মঞ্চস্থ করে।
গণনাট্যের পথচলা ও সামাজিক
প্রতিক্রিয়া :
প্রথম দিকে
গণনাট্য সংঘের উল্লেখযোগ্য পরিবেশনাগুলি হল মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের ‘হোমিওপ্যাথি’; বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবানবন্দী’; জ্যোতিরিন্দ্র নাথ মৈত্রের ‘মধুবংশীর গলি’, যা আবৃত্তি করতেন
শম্ভু মিত্র। এছাড়া ছিল উষা দত্ত, পানু পাল, শম্ভু ভট্টাচার্যের নাচ, ছায়া নৃত্য ইত্যাদি। দলে ছিলেন হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, রবিশংকরের মতো সব যুগান্তকারী প্রতিভা। শান্তি বর্ধন, অবনী দাশগুপ্তের মতো বিস্ময়কর তরুণরা। একথা অনস্বীকার্য যে
‘নবান্ন'ই হল সর্ববিচারে গণনাট্যের শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা । এই নাটকটির প্রথম শো হয়েছিল
সেকালের ‘শ্রীরঙ্গম’ মঞ্চে ১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবর। তথ্যানুসারে জানা যায়
যে এই নবান্ন মঞ্চায়নের আগেই গণনাট্য সংঘ নানা অনুষ্ঠানে কলকাতা, মেদিনীপুর, জামশেদপুর, দিনাজপুর, বিজয়ওয়াড়া, যশাহোর, পাঞ্জাব, পাটনা, এলাহাবাদ, লাহোর, দিল্লি, লক্ষ্মৌ, মুম্বাই ইত্যাদি
শহরে লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে তাদের অনুষ্ঠান পরিবেশন করে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ
করে।
গণনাট্যকর্মীদের
যাবতীয় খরচখরচার দায় বহন করত People's Relief Committee। শর্ত ছিল তারা গোটা দেশে ঘুরে ঘুরে নতুন
প্রগতিবাদী শিল্পকলা পরিবেশনের মাধ্যমে দেশের সমাজ-পরিস্থিতি বুঝে সচেতন করবে আর
সেই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষের জন্য ত্রাণ তহবিলের টাকা তুলবে। অর্থাৎ জনগণকে
বিনোদিত করে, জনগণের জন্য, জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। এটাপরিষ্কার যে দেশের
জন্য,
দশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এবং সাংস্কৃতিক পটুত্বে পেশাদারি না
হলে এই গণকর্মে সামিল হওয়া সম্ভব নয়। একথা অস্বীকার করার কোনোউপায়নেইযেপ্রথম
দিকের গণনাট্যকর্মীরা, আক্ষরিক অর্থেই এমন
ছিলেন। এই সময়ের শিল্পী ও নায়কদের মধ্যে অগ্রণী অংশকে নির্বাচন করে গণনাট্যের
মধ্যেই ‘Voice
of Bengal” নামে একটি বিশেষ ইউনিট গঠন করা হয়।এই
ইউনিট প্রায় এক লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে PRC-কে দেয়। সরোজিনী নাইডু , বিজয় পণ্ডিত, ভি.শান্তারাম, মতিলাল, পৃথ্বীরাজ কাপুর, খাজা আহম্মদ আব্বাস, মজরুহ সুলতানপুরী প্রমুখ সাগ্রহে এগিয়ে আসেন
গণনাট্যের সমাজকল্যাণী কর্মকান্ডের মধ্যে। ১৯৪৪-এর জুন মাসে ২৪ পরগনার কিষাণ সভায়
বিশাল সমাবেশে উপস্থিত ছিল মোট ৫০ হাজার মানুষ। ১৯৪৪-এর অক্টোবরে যখন নবান্ন
প্রযোজিত হয়, ততদিনে গণনাট্যের পালে লেগেছে আরও নতুন নতুন শিল্পী, কর্মী আর দরদিদের ব্যাপক উদ্যোগের ফাল্গুনীহাওয়া। কলকাতাতেই নবান্নের চল্লিশটি অভিনয় হয়। বর্ধমানের
হাটগোবিন্দপুরে প্রাদেশিক কিষাণ সম্মেলনে উপস্থিত ছিল প্রায় পনেরো হাজার মানুষ।
গণনাট্য সংঘের বিবরণী থেকে জানা যাচ্ছে যে কমবেশি মোটে চল্লিশ হাজার শ্রমিক
কৃষক-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ ‘নবান্ন’
প্রযোজনার সাক্ষী থেকেছে। সমাজ-আন্দোলনের বাই প্রোডাক্ট যেমন সাংস্কৃতিক আন্দোলন, তেমনি সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন আবার প্রত্যক্ষ এবং
পরোক্ষভাবে তার উৎসভূমি মানুষকে শুদ্ধ বা ঋব্ধ করে। গণনাট্য সংঘের প্রেক্ষাপটে এটা
একশো শতাংশ সত্য। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের আর্বিভাবে শুধু ভারতীয় জনগণ বা আমাদের
সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি নয়, এই আন্দোলন সরাসরি
প্রভাব ফেলেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর প্রশাসনিক কাজকর্মেও সিদ্ধান্তে।
পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক এবং সমাজ-গবেষকরা গণনাট্য সংঘের ভূমিকা নিয়ে নানা ইতি-নেতি
মন্তব্য করলেও, সংঘের এই ভূমিকা নিয়ে কিন্তু নীরব
থেকেছেন। গণনাট্যের আবির্ভাবে শাসক ইংরেজ ও তার পদলেহী তৎকালীন পেশাদারি থিয়েটার
কোম্পানিগুলি কম্পিত হয়েছিল। বাম-আন্দোলন নিয়ে বরাবরই আতঙ্কিত ছিল ব্রিটিশ
প্রশাসন। শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষের মধ্যে বামপন্থীদের গ্রহণযোগ্যতার জন্য তো বটেই সঙ্গে সহিংসবাদী এক অংশের কংগ্রেসিদের
ও বামপন্থীদের মাখামাখি ব্রিটিশ সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
পেশাদারি থিয়েটারের ‘থোড় বড়ি-খাড়া’ নাট্যচর্চায় ধুঁকতে থাকা থিয়েটার-মালিকরাও গণজোয়ারের
প্রাবল্যে ভীত হয়ে ভারতীয় গণনাট্য সংঘকেমভাড়া দিতে অস্বীকার করেছিল। বকলমে পক্ষ
নিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকের। এদের মধ্যে তৎকালীন নাট্যব্যক্তিত্ব ‘শ্রীরঙ্গম’ মঞ্চের শিশির ভাদুড়ী এবং ‘রঙমহল’ মঞ্চের অহীন্দ্র চৌধুরীও ছিলেন। ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ক্ষেত্রে
যেভাবে ব্রিটিশ প্রশাসন কেঁপে উঠেছিল, গণনাট্য সংঘের নবান্নর ফলেও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। অনেকের স্মরণে থাকতে
পারে গণনাট্যের আবির্ভাবকাল অর্থাৎ ১৯৪৩-৪৪ সালে পূর্বভারতের আকাশের দখল নিয়েছিল
হাজার হাজার চিল আর শকুন। কারণ প্রশাসন, মালিক-মজুতদারদের অপদার্থতা, বন্টনব্যবস্থার
দুর্নীতিতে দেশে নেমে এসেছিল দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া আর তাতে মারা গিয়েছিলেন কম
করে পঞ্চাশ লক্ষ সাধারণ মানুষ। নবান্নর অভিনয় দেখেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
জন্য ভারতে আগত কিছু ইংরেজ। এঁদের মধ্যে কেউকেউ ইংলন্ডে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে
যুক্ত ছিলেন। তারা বিভিন্ন লেখালিখির মাধ্যমে ইংলন্ডের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে
সাড়া ফেলেছিলেন। ফলে তৎকালীন চার্চিল সরকার কিছুটা নরম মনোভাব নিয়ে দুর্ভিক্ষের
প্রতিকারে এগিয়ে আসে ও ‘দুর্ভিক্ষ তদন্ত
কমিশন’-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ প্রশাসনকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করে।
একটি তথ্য থেকে জানা যায়, সে বছর চাহিদার
অনুপাতে ভারতে চল্লিশ লক্ষ টন খাদ্যশস্য ঘাটতি থাকলেও যুদ্ধের অজুহাতে দশ লক্ষ টন
শস্য রপ্তানি করে সরকার। অর্থাৎ কোনও মন্ত্রী আমলা বা মিডিয়া নয়, প্রশাসনের এতাদৃশ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর বর্বরতা চোখে আঙুল
দিয়ে তুলে ধরেছিলেন গণনাট্যকর্মীরাই। প্রকৃত গণসংস্কৃতি একযোগে দুটি কাজ করে।
প্রথমটি হল, অত্যাচারী শাসকের স্বরূপ উন্মোচন আর
অন্যটি প্রচার-আন্দোলন। এটা স্পষ্ট যে দুটি দায়িত্বেই একশোভাগ সফল ভারতীয়
গণনাট্য সংঘ। শুধুমাত্র রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিকই নয়, সংঘ পালন করেছিল মহান এক ঐতিহাসিক দায়ও। এই মন্তব্যেরই প্রতিফলন
ঘটেছে সেই সময়ের প্রথমশ্রেণির দৈনিক সংবাদপত্র ‘যুগান্তর’-এর পাতায়‘এই ধরনের নাটক কেবল নতুনতর আর্ট হিসাবেই নয়, দুঃস্থ ও নিপীড়িত মনুষ্যত্বের প্রতি ইহা যে বেদনা জাগ্রত
করে,
তাহার মূল্য অপরিসীম।‘
অর্থাৎ অন্যান্য আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া ছাড়াও
নবান্নর ভূমিকা ছিল যুগান্তকারী। যার ফলে এর প্রতিক্রিয়া গিয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষ
নামক উপনিবেশকে নিয়ন্ত্রণকারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সদর দপ্তর সুদূর ইংলন্ডে।
স্বভাবতই এই ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক আর একই সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং
বামপন্থী আন্দোলনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নিবন্ধ গণনাট্যের দিনলিপি বা ইতিহাস নয়, বরং সমকালের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের
মাইলস্টোন গণনাট্যকে একটু পক্ষপাতহীনভঙ্গিতে বুঝে নেওয়ার প্রয়াস মাত্র।
মধ্যবিত্ত-কেতনে শুধু আপোষের সুর :
নবান্ন প্রযোজনার পূর্ণ সাফল্যের পরে ১৯৪৬ সাল
থেকেই গণনাট্য সংঘের কর্মকাণ্ডে শৈথিল্য নজরে আসে।কার্যকারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এর নেপথ্যে
ছিল পার্টি এবং গণনাট্যের নেতৃত্ব উভয়ের মধ্যেই এক ধরনের মধ্যবিত্ত বা
পাতিবুর্জোয়া মানসিকতার কৃষিকরণ। পার্টির প্রসঙ্গ থাক। আমরা গণনাট্য প্রসঙ্গে
আলোচনায় থাকি। আমাদের ধর্মগ্রন্থ ‘গীতা’, ‘নাট্যশাস্ত্র’, রমা রলার ‘People's Theatre’বা মাও সে তুং-এর ‘ইয়েনান ফোরাম’ সর্বত্রই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটি কথাই উচ্চারিত হয়েছে। সেটা হল :যখনি সমাজে
অন্যায়,
অত্যাচার আর বৈষম্য মাথাচাড়া দেবে, ঠিক তখনি তার প্রতিবাদে জনসমাজে সংগঠিত হবে স্বতঃস্ফূর্ত
সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এটা একটা স্বাভাবিক সমাজ-সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। এই কারণে
চল্লিশের দশকে বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, স্বাধীনতা
আন্দোলনের অস্থিরতা আর বিপন্ন প্রেক্ষাপটে মূলত সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততায়
দানা বেঁধেছিল গণনাট্য আন্দোলন। তবে এটাও সার কথা, এই আন্দোলন প্রসবের নেপথ্যে আবেগ যতটা সক্রিয় ছিল, যুক্তি বা শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি ততটা নয়। অভিনেতারা প্রায়
সবাই ছিলেন আনকোরা। কেবলমাত্র শম্ভু মিত্রের ছিল কিছুটা পূর্ব পেশাদারি অভিজ্ঞতা।
বিজন ভট্টাচার্য পেশাদারি সাংবাদিকতা ছেড়ে হোলটাইমার হন। একটি নথি থেকে জানা যায়
অনেক শিল্পী-সদস্য মাসোহারা পেতেন। বিজন ভট্টাচার্য একশত পঞ্চাশ, শম্ভু মিত্র চল্লিশ, তৃপ্তি ভাদুড়ী সত্তর এবং বাদবাকিরা সবাই ত্রিশ টাকা করে পেতেন। গণনাট্য সংঘ
থেকেই প্রথম বাংলা নাটকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মহিলাদের অভিনয়ের জন্য নিয়ে আসা হয়।
তাছাড়া ছোটো বড় সব চরিত্রে সমগুরুত্বআরোপ করা বা মাসসিন বা গ্রুপঅ্যাক্টিংয়ের
খুঁটিনাটি বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দেওয়ার অনিবার্য ব্যাপারগুলির সূচনা হয়েছিল
গণনাট্যেই। মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘এমন রূপতপস্বী সমবেত অভিনয় কোনো ব্যবসায়ী থিয়েটারের
পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ছোটো বড়ো বহু ভূমিকা সযত্নে সমান যত্নে প্রাণ দিয়ে
অভিনয় করতে পারেন তারাই, যারা জানেন জনসেবাই
এর লক্ষ্য—নিজেদের প্রতিষ্ঠা নয়।‘(জনযুদ্ধ, নভেম্বর দিবস, বিশেষ সংখ্যা, ৮.১১.১৯৪৪)। মহর্ষি যেটা বলেছেন সেটা শিল্পীকর্মীদের
আন্তরিকতাগিদ বা আবেগের কথা। উহ্য রয়ে গেছে নিত্যদিনের চর্চায় তাকে উন্নীতকরণের
কথা।সবার কাছেই শুরুটা অন্তরের আবেগ থেকে হলেও, তাকে স্থায়ীরূপ দিতে যে বিষয়গত শিক্ষায় তা ক্ষুরধার করতে হয়, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে উঠে আসা গণনাট্যকর্মীদের কখনোই
ছিল না। ছিল না সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের তদানুসারী নির্দেশ। আর আবেগ
যেহেতুক্ষণস্থায়ী তাই ‘নবান্ন’ প্রযোজনার মতো একটি চুড়ান্ত উত্তেজনাময় কর্মকাণ্ডের পরে তা থিতিয়ে
গিয়েছে। অহংকার, আত্মপ্রসাদে
অধিকাংশ শিল্পী বুর্জোয়া শিল্পবানিয়া শিবিরের উপঢৌকনে তৃপ্ত হতে শুরু করেছিলেন।
প্রতিবেদক ব্যক্তিগত ভাবে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, তাপস সেন, সলিল চৌধুরী, শম্ভু ভট্টাচার্য প্রমুখের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে যা জেনেছে, সেটা মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদের বিম্বন ব্যতীত অন্য কিছু নয়।
সামান্য গুটিকয় সদস্য ছাড়া তা প্রায় সবার মধ্যেই প্রকট হয়েছিল। নবান্নের
সাফল্যে শম্ভু মিত্র প্রায় একক কৃতিত্ব হিসাবে দাবি করেছিলেন। সুদুর গ্রামাঞ্চলে
দিনযাপনের অসুবিধাজনিত কারণে এবং রিভলভিং স্টেজ ইত্যাদির পরিকাঠামো না থাকার কারণে
প্রায় কেউই কলকাতার বাইরে শো করতে রাজি হচ্ছিলেন না। বেশ বোঝা গেল অনেকেই
শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার জন্যই গণনাট্য শিবিরে আশ্রয়ের খোঁজে সমবেত
হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অর্থনৈতিক সংকটে তখন সর্বস্তরের রাজনৈতিক
মঞ্চগুলি দেউলিয়া। তারই প্রভাবে শুধু বাম নয়, অভিজাত তথা ধ্রুপদী সংস্কৃতিতেও সংকট ঘনীভূত হয়েছিল। সমাজের সর্বত্র বিস্তৃত
নিরাপত্তাহীনতা। আন্তর্জাতিক মানের নৃত্যাচার্যউদয়শংকর বাধ্য হয়েছিলেন তার
আলমোড়ার শিক্ষণকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে। কলকাতারবেশকিছুপ্রাচীনসওদাগরী
ও সরকারীঅফিসেরবার্ষিক বিবরণী থেকে জানা যায় যে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৩ সাল
অবধি দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, বোমাতংক আর অস্বাভাবিক যাপন পরিস্থিতির জন্য যাবতীয় কার্যপ্রণালী স্থগিত করে দিতে হয়েছিল।
এককথায় সর্বগ্রাসী এক বিপন্নতায় কলকাতা প্রায় শ্মশান হয়ে গিয়েছিল। নথি থেকে
জানা যায় যে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফের নতুন করে চালু হয়েছিলতৎকালীন দপ্তরগুলি।বোম্বাইয়ের সিনেমাজগৎ আর কলকাতার
পেশাদারি মঞ্চগুলিতেও ঝোলাতে হয়েছিল বড় বড় তালা। শিল্পীরাও তো মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত মানুষ, ফলে গণনাট্য সহ তামাম সংস্কৃতিজগৎ তখন নাচগান থিয়েটার নয়, চাল ডাল আর প্রাণ নিয়ে ছুটে মরছিল।
ভিত যখন
নড়বড়ে,
তখন উপরিকাঠামোর সংস্কৃতি তো দুলবেই। দ্রুত ঘটমান তৎকালীন
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিগুলির সঙ্গে মোকাবিলাকরা তো দূরের কথা, আমাদের পার্টি ও তার
সাংস্কৃতিক সংগঠন তার সঙ্গে তালরাখতেই পারেনি। পি সি জোশী, তৎকালীন পার্টি সেক্রেটারি তার রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে
সংস্কৃতিজগৎ বিশেষ করে গণনাট্যকর্মীদের নীতিগতভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।ফলে আপসের পাপোষে
মুখঘষা এক পার্টির সাংস্কৃতিক সংগঠনটিও সংস্কারের পাঁকে গা ডুবিয়ে দিল। সংস্কৃতির
পশরা দিয়ে প্রান্তিক মানুষজনের কাছে ছুটে যাওয়া সংস্কৃতিকর্মীরা তার নির্দেশে
শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতি পরিবেশনের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। ফলে অনিবার্যভাবেই
গণনাট্যের কেতনে লাগল আপসের সুর আর ভুলুষ্ঠিত হল গণনাট্যের মৌল আদর্শটি। যার ফলে
প্রায় তামাম গণনাট্যকর্মীরা রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের আঙিনা ছেড়ে পা রাখলেন
বোম্বাইমুখী হাওয়াই জাহাজের সিঁড়িতে। চারুপ্রকাশ ঘোষের সেল রিপোর্ট থেকে জানা
যায়,
নবান্নের পরে সংগঠনের দুটি পরিষ্কার বিভাজন দেখা যায়। এক
দলের নেতা ছিলেন শম্ভু মিত্র আর অন্যটির প্রধান সুধী প্রধান। তৎকালীন সম্পাদকের
লিখিত মন্তব্যে পাওয়া গেছে এক অবিশ্বাস্য তথ্য। তিনি বলেন, ‘নেতৃস্থানীয় গণনাট্য কর্মী শ্রীশম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র
মৈত্র পুরোপুরি অসহযোগিতা শুরু করে দিয়েছেন। পরবর্তীকালে শুধু ব্যক্তিগত উচ্চাশা
বা রাজনৈতিক কারণ নয়, প্রতিক্রিয়াশীলদের
লাগাতার আক্রমণের ভয়েও অনেকে দ্রুত দলত্যাগ করলেন। কারণ ইতিমধ্যেই ডিকশন লেনে
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়িতে গণনাট্য সংঘের এক সভায় আগত দুই কর্মীকে ভাড়াটে
গুন্ডারা গুলি করে হত্যা করে। হামলা হয় পার্টি অফিসে আর গণনাট্য সংঘের কেন্দ্রীয়
দপ্তরে। শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য তো
আগেই গিয়েছিলেন, একে একে দেউটি
নিভিয়ে চলে গেলেন শান্তি বর্ধন, অবনী দাশগুপ্ত, রবিশংকর, তৃপ্তি ভাদুড়ী
(মিত্র),
গঙ্গাপদ বসু, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, মহম্মদ ইসমাইল
প্রমুখ। দুর্ভিক্ষ আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘাড়ে-ঘাড়েই এল কপর্দকহীন ছিন্নমূলের
স্রোতে দেশভাগ, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, নিজভূমে পরবাসী থাকার সুখে কংগ্রেসি শাসনের বিপন্ন সময়।
কংগ্রেসি অপশাসনে আরও কঠোরভাবে নাট্যসংস্কৃতির গলদেশে চেপে বসল ব্রিটিশের লাগু করা
‘নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন’। এতদিন যারা
ব্রিটিশের তাবেদারি করেছে, যুদ্ধের বাজারে
ঘোলা জলে মাছ ধরে, কালোবাজারি মুনাফা
করে টু-পাইস কামিয়েছে, সেই ধনী, জমিদার আর মজুতদারের প্রতিনিধিরা যেমন কমিউনিস্ট পার্টিকে
বেআইনি ঘোষণা করে ১৯৪৮ সালের ২৬ মার্চ-এ, তেমনই সেই সময়ে গণনাট্য প্রযোজিত মোট ৫৯টি নাটকের পাণ্ডুলিপি নিষিদ্ধ করেছিল
তারা।
নিষিদ্ধ
পার্টির চরমপন্থীরা ক্ষীণভাবে আওয়াজ তুললেন, ‘দেশকা জনতাভূখাহ্যায়, ইয়ে আজাদী ঝুটা
হ্যায়।‘।অন্যদিকে গণনাট্যকর্মীদের ওপর আক্রমণ, ভয় দেখানো, প্রলোভন দেখিয়ে অনুগত সংস্কৃতিতে
আনার চেষ্টা চালিয়ে শেষ অবধি সরকারি অর্থানুকূল্যে (১৯৬৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি)
লোকরঞ্জন শাখাপ্রতিষ্ঠাকরে, গণনাট্যকর্মীদের
অনেককে স্পষ্টত কিনে নেওয়া হল। যারা বাইরে রইলেন, তাদের
জন্য ছিল পেটের খিদে সহ গ্লানিময় জীবনযাপন আর পুলিশের তাড়া। ফলে মধ্যবিত্তসুলভ
নানা হাতছানি, অসূয়া আর মূল সংগঠনের নিয়ন্ত্রনহীনতার
দরুন এই মহীরুহ যেন ডালপালাহীন হয়ে বিসদৃশ এক কংকালময় বৃক্ষকাণ্ডে পরিণত হল।
এক-একজন শিল্পী বা ব্যক্তিত্বকে ঘিরে এক-একটি স্বতন্ত্র থিয়েটারের দল।১৯৫১ সালের
গোড়াতে কংগ্রেসি সরকার পার্টির ওপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তার আগেই
অবশ্য গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় নেতত্ব গণনাট্য সংঘের দলিলে ভাবাদর্শ পরিবর্তন
করে আপসকামী ভঙ্গিতে দক্ষিণপন্থীদের আনুগত্য স্বীকার করেছিল। কারণ ১৯৫২ সালের
পার্টি প্রোগ্রামেও আপসপন্থাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তেলেঙ্গানার সশস্ত্র সংগ্রামের
বি্রোধিতা করে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে পথই শোষণমুক্তির পথ হিসাবে ঘোষণা করা
হয়। গণনাট্য সংঘের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত অষ্টম সম্মেলনে তো প্রকাশ্যেই ঘোষিত হয় যে, ‘অতঃপর ‘গণনাট্য সংঘ’ আর কোনো রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে থাকবেনা। স্পষ্টত, এই প্রস্তাবে কোনো শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি, শ্রেণিশত্রুচিহ্ণিতকরণ বা বিপ্লবের নামগন্ধ নেই। এর পরে
দৃশ্যত কংগ্রেসি সরকার পরিচালিত সংগীতনাটক আকাদেমির আমলাদের সঙ্গে ডিনার পার্টিতে
দেখা গেল নেতৃস্থানীয় গণনাট্যশিল্পী এবং স্বয়ং পার্টি সম্পাদক পি সি জোশীকে।
যিনি পার্টির মুখপত্র ‘New Age' পত্রিকায় খোলাখুলি
লিখলেন যে, ‘অবশেষে গণনাট্য সংঘ কেন্দ্রিয়
সরকারের সঙ্গীত নাটক আকাডেমির স্বীকৃতি ও সহযোগিতা পেয়েছে এবং ধনাঢ্য ব্যবসায়ী
শীলাভরত রাম গণনাট্য সংঘের পৃষ্ঠপোষণায় সম্মত
হয়েছেন।‘ এটা ছিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত অষ্টম সম্মেলনের নৈতিক
সিদ্ধান্তের বাস্তবিক দৃশ্যায়ন। এর পর সারা দেশের নানা রাজ্যে নিশ্চয় নানা
প্রগতিবাদী নাট্যচর্চা হয়েছে, গণনাট্য প্রযোজিত নাটকও হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় সম্মেলন বলতে যা বোঝায়, তা আর একটি বারের জন্যও অনুষ্ঠিত হয়নি।
পিপলস থিয়েটার’ কেন শিকড়মুখী নয়?
এই নিবন্ধের
উদ্দেশ্য ভারতীয় গণনাট্য সংঘের স্থাপনা বা তার ইতিহাসক্রম নিয়ে আলোচনা করা নয়, বরং এখানে সালতামামি আর নথিতথ্য, ঘেঁটে একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, আমাদের অতীত এবং বর্তমানের নাট্যকর্মীদের নেওয়া
সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে ঐতিহাসিক স্ববিরোধিতাগুলি এবং আগামীর নাট্যচর্চার কিছু
বিজ্ঞানসম্মত সংকেতকে। প্রথমে আসি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রাসঙ্গিকতায়। হ্যা, এটা ঠিক যে আজ থেকে ঠিক পঁচাত্তর বছর আগে তৎকালীন সামাজিক
আন্দোলন যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন একদল শিক্ষিত
মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তাঁরা শ্রেণিসংগ্রামের দৃষ্টিকোণে থিয়েটারকে গণসংগ্রামের
হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার কথা বললেও, সেই সর্বভারতীয় মহাসংঘটি স্থাপিত করে আপামর জনমানসকে তাঁদের আশা আকাঙ্খায়
প্রবলভাবে উদ্দীপিত করলেও মাত্র চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই নানা কারণে অনৈক্যের
শলাকায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এই তথ্য আজ আর অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এটা যদি
সত্য হয়,
তার থেকে আরও বেশি সত্য যে আজ আমরা যারা যেখানে যেভাবে
থিয়েটারচর্চা করি, তারা প্রত্যেকেই
সেই গণনাট্যচর্চার উত্তরসূরী। আরো পরিষ্কার করে বলা যায়, আমাদের বর্তমান থিয়েটারের ধারাতে না আছে বাবু কালচারের হাত
থেকে পাওয়া ইংরেজি থিয়েটারের নকলনবিশিকৃত গিরিশ-শিশিরের পেশাদারি থিয়েটার, নাআছে আমাদের প্রান্তিক জনযাপনের প্রতিনিধিত্বমূলক বা আদি
ভারতীয় শিকড়ের লোকজসংস্কৃতি। তাহলে আমাদের বর্তমান থিয়েটারচর্চার বিকাশ বা
উৎসটি ঠিক কোথায়? মালিকানাভিত্তিক
পেশাদারি থিয়েটারের যাবতীয় ধ্যানধারণাকে চুরমার করে আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ যে জনমুখীন বা গণমুক্তির থিয়েটারচর্চার সূত্রপাত করেছিল, আমরা আসলে সেই ভাবাদর্শ অথবা স্কুলিং-এর ধারাবাহিকতার ফসল।
ফলত,
‘গণনাট্যচর্চা’র
ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় বীজগুলিকেই আমরা, এই সময়ের থিয়েটারকর্মীরা আমাদের শোণিতে বহন করে চলেছি। আজকের
গ্রুপ-থিয়েটারচর্চার উৎসটি নিহিত অতীতের গণনাট্য ধারাতেই। যে চর্চাধারাটি একই
সঙ্গে ভারতের মধ্যে সর্বপ্রথম গণসংস্কৃতির বোধকে আমাদের মধ্যে নিষিক্ত করেছে আবার
অন্য দিকে মধ্যবিত্ত মানসিকতায় আপসপন্থায় শিকার হয়ে জনগণের আশাআকাঙ্ক্ষা পূরণের
বিপরীত শিবিরে আত্মসমর্পণ করেছে। আমাদের গণনাট্যচর্চা আমাদের বর্তমান
থিয়েটারচর্চার পূর্বসূরী হলেও, আমরা। সমকালীন
থিয়েটারকর্মীরা সেটা তেমনভাবে স্বীকার করছি না। এটা অনেকটা কিছু দোষত্রুটিযুক্ত
আপন পিতাকে অস্বীকার করার মতোই। আমার জনক যদি কোনোভাবে রোগজীবাণুর সংক্রমণগ্রস্ত
হন,
তাহলে তার প্লাতিনাম জুবিলিতেও আমি এতাদৃশ নিস্পৃহ, নিরাসক্ত আর নীরব থাকব কেন? আমাদের থিয়েটার কর্মীদের সেই গৌরবময় ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা এভাবে বিস্মৃতিতে
ডোবাতে পারি আমরা? আমরা কোন সংস্কৃতির
কাছে,
কীভাবে দায়বদ্ধ? নাকি কালের সংস্কৃতিকর্মীদের কারও কাছে কোনো দায়বদ্ধতাই নেই? আমরা যদি মনে করে থাকি যে, গণনাট্য সংঘ মধ্যবিত্ত স্ববিরোধিতায় পূর্ণ একটি বিস্মৃত ইতিহাস তাহলে
তাহলে অনিবার্যভাবে প্রশ্ন আসে, আমাদের সমকালে থিয়েটার কি
স্ববিরোধিতাপরিপূর্ণ নয়? সত্যি কথা বলতে কি
আজকের থিয়েটার কর্মীরা নির্দিষ্ট কোনো আদর্শবোধকে মাথায় রেখে মোটেই একত্রিত নন।
কেউ পুজিবাদী মুনাফাভিত্তিক বাণিজ্যগন্ধী নাট্যচর্চার নামে ‘কোম্পানি থিয়েটার’ কনসেপ্টে বিশ্বাস
করেন। কেউবা সরকারি অনুদান-মাসোহারা আর গণনাট্যবোধের থিয়েটার চর্চার মধ্যে
ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন। কেউ কেউ আবার নন-প্রসেনিয়াম থিয়েটার আর গ্রামীণ
নাট্যচর্চার মেলবন্ধনে নতুন কোনও অন্বেষণে আছেন। সব মিলিয়ে আজকের থিয়েটার শুধু
দিশাহীনই নয়, করপোরেটবিলাসী হয়ে
দু-পায়ে ঘুঙুর বেঁধে বাইজি সেজেছে। আমাদের সংবিধানে শ্লোগানে By the people,
for the people, of the people'-এর কথা সাড়ম্বরে
মুদ্রিত থাকলেও যেমন কার্যত গণতন্ত্রটি বিমূর্ত, ঠিক তেমনি আমাদের তত্ত্বে বা মুখে বারংবার জনগণেশের কথা উচ্চারিত হলেও বস্তুত
তার প্রতিফলন অদ্যাপি অধরা। সংস্কৃতি-গবেষকদের মতে আমাদের থিয়েটারচর্চার
উৎস-ইতিহাসটি শুরু থেকেই শিকড়হীন। ভারতীয় থিয়েটারের উষাকাল ইংরেজি থিয়েটারের
নকলনবিশি করে। সত্যি কথাটি হল, পাঁচ হাজার বছরের
সমৃদ্ধ একটি নাট্য-অভিজ্ঞতা, সাড়ে তিন হাজার
বছরের একটি প্রামাণ্য এবং অদ্যাবধি আধুনিক আর স্বয়ংসম্পূর্ণ নাট্যপ্রকরণ ‘ভরতের নাট্যশাস্ত্র’ আমাদের ঘরে মজুত থাকা সত্ত্বেও আমরা তাকে মর্যাদা দেওয়া তো দূরের কথা, খুলেও দেখিনি কোনোদিন। সত্যি কথা বলতে কি, ভারতীয় নাট্যচর্চার ঐতিহ্য, পূর্বভারতের গঙ্গারিডি অঞ্চলের প্রাক-আর্য লোকনাট্যধারাই যে গোটা পৃথিবীর
থিয়েটারচর্চার উৎস এই ঐতিহাসিক তথ্যটি আমরা কতজন জানি?
সমাজ যদি
মাটি বা ভূমি হয়, তাহলে সংস্কৃতি হল
তার শিকড়। শিকড়রূপ সংস্কৃতি দিয়েই সমাজকে ধরে রাখা হয়। অন্যদিকে সংস্কৃতি রস
বা রসদ সংগ্রহ করে সমাজ থেকেই। সমাজ আর সংস্কৃতি যেহেতু পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক, তাই এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশের মাটিতে ফলদায়ক হয় না, হলেও তা হয় বিস্বাদ কিংবা কাঁটাময়। ভারতীয়দের
থিয়েটারচর্চার চিত্রটি অনেকটাই অনুরূপ। পলাশীর আমবাগানে ইউনিয়ন জ্যাকউন্নীত
হওয়ার পরে কামিনীকারণাসক্ত বাবুরা নিছক আমোদ-প্রমোদের জন্য যে থিয়েটার শুরু
করেছিল,
তাতে দেশি শিকড়-অনুগামী হওয়ার কোনো দায় তাদের ছিল না। পরবর্তীকালে
থিয়েটারটা যখন পাকাপাকিভাবে প্রচলিত হল, তখন তৎকালীন সিরিয়াস নাট্যব্যক্তিত্ব | গিরিশ-অমৃতলাল-দীনবন্ধু-মধুসূদন-শিশিরবাবুরাও থিয়েটারকে নাট্যমুখী করেননি। এর
পরবর্তীকালে আসে গণনাটোর জোয়ার। সেই ভিন্নধারার থিয়েটারচর্চার শুরুতে অন্তত মুখে
লোকসংস্কৃতির কথা উল্লেখ করা হলেও চর্চা বা প্রয়োগে ছিল না কোনো ভারতীয়
নাট্য-ঐতিহ্যের শিকড়গন্ধী প্রভাব। যদিও বিগত থিয়েটারধারার শিকড় কেটে, মুনাফা থিয়েটারের তত্ত্ব বাতিল করা, ‘জনগণের জন্য জনগণের থিয়েটার’ এই তত্ত্ব প্রয়োগের কালে এটা বড়ই জরুরি ছিল। তবে বাস্তবে তা হয়নি। গণনাট্যও
হেঁটেছে পুঁজিবাদী ও মালিকানাভিত্তিক থিয়েটারের পথ অনুসরণ করেই। ভারতীয় জনতার
দীর্ঘদিনের বোধ-বিশ্বাস আর আচরণে মিশে আছে লোকনাটক। তারা থিয়েটারকে ভাবে ভদ্র
বাবুদের আমোদ। তাদের হাসিকান্নার আবেগগুলি আন্দোলিত হয় পালাগানে, লোকনাটকে। আমরা যতটা থিয়েটারমনস্ক, ততটা নাট্যমনস্ক নই। যার ফলে আমাদের আমজনতার কাছে, আমাদের থিয়েটারের গ্রহণযোগ্যতা, লোকনাটকের তুল্যমূল্য বিচারে একেবারেই নেই। থিয়েটার তাদের
কাছে ‘ফরেন’, অন্যদিকে লোকনাটকে পায় তারা বিশ্বস্ত নকশিকাঁথার আদর।
আমাদের থিয়েটারে লোকহীনতার এটাই অন্যতম কারণ। থিয়েটারে আর নাটকে আদতে কোনো বিরোধ
বা পার্থক্য নেই। যেটা আছে সেটা হল, আপন সংস্কৃতিতে বিচরণের তৃপ্তির আশ্বাস। এই অপশন প্রতিটি মানুষের নিশ্চয় থাকা
উচিত। থিয়েটারকর্মীরা সাগ্রহে স্তানিশ্লাভস্কি পড়েন, ব্রেক্ষট পড়েন, কেউ পড়েন ‘ইয়েনান ফোরাম’ কেউ বা পীপলস্ থিয়েটার। পড়ুন ক্ষতি নেই, কিন্তু এদের প্রত্যেকের থেকে কয়েক। হাজার বছরের প্রাচীন আর
অদ্যাবধি সারা পৃথিবীর মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নাট্যব্যাকরণ গ্রন্থটি নয় কেন? সেটি কি নিষিদ্ধ না অপ্রাসঙ্গিক? যদিও নাট্যশাস্ত্রে বারবার ‘লোকানুমনোরঞ্জন’ আর ‘লোকাবৃত্ত অনুসরণের’ কথা উচ্চারিত হয়েছে। ভারতীয় থিয়েটার ‘নাটক’না হয়ে ওঠা অবধি তার পালে লাগবে না গতিময় বাতাস। আর ঠিক
এই পথে হেঁটেই বিশ্বখ্যাত ব্রের্টোল্ডব্রেক্ষট থিয়েটারের মধ্যে গণমুক্তির দিশা
দেখিয়েছেন। আধুনিক থিয়েটারচর্চার স্থপতি হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত ব্রেক্ষটের নাম।
তিনি বিখ্যাত তার ‘এলিনিয়েশন’তত্ত্বের জন্য, যা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, পেয়েছিলেন ভারতীয় লোকনাটক দেখে। থিয়েটারের সঙ্গে একাত্ম হয়েও কীভাবে আর
কেন বিচ্ছিন্ন হওয়া প্রয়োজন, প্রতিবাদী বা
অত্যাচারী চরিত্র কীভাবে মঞ্চে বিম্বিত হবে বা আদর্শ একটি গণ-থিয়েটার কনটেন্ট এবং
ফর্মে কেমন হওয়া দরকার—এইসব অতিপ্রয়োজনীয়
অনুজ্ঞাগুলির ভুরিভুরি নমুনা মেলে আমাদের লোকনাটকে। আমাদেরই লোকনাটক থেকে আহরিত
বীজগুলি যখন বিদেশি থিয়েটারে প্রতিষ্ঠিত হয়, আমরা তাতে বিস্মিত হই, কিন্তু তার ভাঁড়ারঘরটি
যে আমাদের উঠোনেই নিত্য স্থাপিত, সে খবর আমরা রাখি
না। লোকনাটকের কাছে না গেলে, নাটক বা থিয়েটার
যাই বলুন না কেন, তা জনগণের কাছে
গ্রহণযোগ্য হবে না— এটা আগে অনেকে
বললেও,
সম্প্রতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন ব্রেক্ষট সাহেব তার ‘এলিনিয়েশন’ তত্ত্বের মাধ্যমে।
ভারতীয়
গণনাট্যচর্চার প্রেক্ষাপটে আমাদের সমকালীন থিয়েটারচর্চা যে বিপথগামী তাতে কোনো
সন্দেহ নেই। থিয়েটারের মধ্যে বহু প্রাচীন কাল থেকেই মিলেমিশে আছে সমাজবোধ আর
নান্দনিকতা। এর যে কোনও একটি অদৃশ্য বা কমবেশি হলেই থিয়েটার মুখ থুবড়ে পড়বে। আর
এই থিয়েটারচর্চার আঙ্গিকটি যে দেশের থিয়েটার, সেই দেশের আঞ্চলিক সংস্কৃতিস্নিগ্ধ না হলে, আমজনতার কাছে গ্রহণযাগ্যোতার কোনো গ্যারান্টি নেই।
ভারতীয়
অনার্য লোকনাটকের সূত্রেই সারা পৃথিবীর থিয়েটারচর্চার নিষিক্তকরণ। সেই ভারতেই, তার বর্ণময় নাট্যচর্চার ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও, নাট্যচর্চা শতধাবিভক্ত, পুঁজিবাদের কোলে আশ্রিত। আমাদের ঐতিহাসিক ত্রুটিগুলি, মধ্যবিত্তসুলভ বিচ্যুতিগুলি চিহ্নিত করে, আমাদের থিয়েটারকে নাট্যমুখী করে, নাট্যনদীটিকেসংস্কার না করলে, আগামী প্রজন্মের সংস্কৃতিকর্মীদের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে ।
তথ্য সূত্র : গণনাট্য আন্দোলন, দর্শন চৌধুরী, অনুষ্টুপ প্রকাশনী। ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের
ইতিহাস-সুপ্রকাশ রায়, ভারতবর্ষের আধুনিক
ইতিহাস--প্রগতি প্রকাশন , ১৯৮২ Marxist Cultural Movement in India, Sudhi Pradhan,নবান্নের প্রথম স্মরণিকা, বহুরূপী ৩৩তম সংখ্যা, গণনাট্য সম্পর্কিত
কিছু প্রামাণ্য নথিপত্র ।১। গণনাট্য সংঘের প্রথম বুলেটিন
'People's Thatre Stars the People'
INDIAN PEOPLES THEATRE ASSOCIATION
Annex -8 Bulletin No. 1 July 1943
The Indian People's Theatre Association
has been formed to coordinate and strengthen all the progressive tendencies
that have so far manifested themselves all the nature of drama, songs and
dances.
It stands for the defence of culture
against Imsperialism and Fasism and for the englightining the masses about the
causes and solution of the problems facing them.
Our producing should be simple and
direct so that the masses can easily appreciate and understand and also participate
in the creation and production of those. A revival of the folk arts, mass
singing and open air stage are specially desirable for this purpose. (51091010)
ALL INDIA COMMITTEE President: N. M.
Joshi (Genl. Secy. All India Trade Union
Congress Genl. Secy : Anil de Silva Jt.
Secys : Benoy Roy (Bengal), K. T. Chandy (Bombay) Treasurer: K. Ahmed Abbas
Members : Mama Varekar (Bombay),
Snehashu Acharya, Monoranjan Bhattacharyya (Bengal), Eric Cyprian (Punjab),
Sarala Gupta (Delhi), Dr. Rashid Jehan (U.P.) KPS Namboodri (Malabar),
KeshariKeshavan (Mysore), Kulkund Shiva Rao (Mangalore), MakhdoonMahindin
(Hyderabad), Dr. Raja Rao, (Andhra), S. C. Jog (C.P. & Bihar), K. Ramanthan
(Tamilnadu), Bankim Mukherjee (All India Kisan Sava), S. A. Dange (President,
All India Trade Union Congress), SajidZaheer (Genl. Secy, All India Progrssive
Writers Association), Arun Bose (All India Student Federation)
Organising Provincial Committee of
Bengal
Sunil Chatterjee, Dilip Roy,
ShambhooMitra, Bejan Bhattacharyya, Sujata Mukherjee, Monoranjan Bhattacharyya,
Snehanshu Acharya, Bishnu De, Binoy Roy.
২। স্বাধীন
দেশের গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত কিছু গণনাট্য প্রযোজনার তালিকা :
Proceedings of the Legislative
Assembly, West Bengal, 10 Nov. 1953 নথি মােতাবেক জানা
যায় যে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বিধান সভায় গণনাট্য সংঘ প্রযোজিত
উনষাটটি নাটকের তালিকা পেশ করেন, যেগুলি তৎকালীন
কংগ্রেসি সরকারের আদেশে ও পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে নিষিদ্ধ করা হয়।
প্রযোজনার পাণ্ডুলিপিগুলি হল :
১।অহল্যা ২।
অহল্যা উদ্ধার ৩।আবাদ ৪। উদয়াস্ত ৫। কণ্টক ৬। ভূয়া স্বাধীনতা ৭। ধরতী কি কাল ৮
চাষার বারোমাসী ১। দলিল ১০| পথ ১১। ভাঙা বন্দর
১২। পথিক ১৩। জবানবন্দী ১৪। নবান্ন১৫। সংঘবদ্ধতা ১৬। গোরা ১৭। মাউন্টব্যাটেন কাব্য
১৮। নিচের তলার মানুষ ১৯। চার্জশীট ১০। নাগপাশ ২১। দুর্ভিক্ষের পাঁচালি ২২। নাটক
নয় ২৩। জনক ২৪। মালয়ের 'য়ের মুক্তিযুদ্ধ
২৫। কাচড়াপাড়া ২৬। India Immortal ২৭ শহীদের
ডাক ২৮। দিশাহারা ২. বসর্জন ৩০। বিচার ৩১। BailaPahos৩২। চার অধ্যায় ৩৩। সব পেয়েছির দেশ ৩৪। নয়নপুর ৩৫। যাদু কি কুরসি ৩৬ রেল কা
কণ্ঠস্বর ৩৭।কাটোওয়ালা ৩৮। We want light ৩৯। শুকসারী ৪০। মৃত্যু নাই ৪১। অতলান্তিক চুক্তি ৪২। হাসপাতাল ৪৩ | অরুণোদয়ের পথে ৪৪। Hang over ৪৫। ঢেউ ৪৬। কে ৪৭। মহেশ ৪৮। মঞ্জিল ৪৯। যুদ্ধ চাই না ৫০। ইতিবৃত্ত ৫১। Till the day I
die ৫২। নীলদর্পণ ৫৩। পদধ্বনি ৫৪। ছেড়াতার
৫৫।উলুখাগড়া ৫৬। আবর্ত ৫৭। Lest you forget ৫৮। মহুয়া ৫৯। অফিসার।
লক্ষণীয় যে
গণনাট্য সংঘের আবির্ভাবের মাত্র দশ বছরের মধ্যেই তৎকালীন নাট্যকারগণ সহ নিষিদ্ধ
করা হয়েছিল এমনকি সমরেশ বসু, ঋত্বিক ঘটক, তুলসীদাস লাহিড়ী, বিজন ভট্টাচার্য, হেমাঙ্গ বিশ্বাস
এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
নথিসুত্র : দর্শন চোধুরী – গণনাট্য আন্দোলন।