সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

অরূপরতন হালদার : অনুবাদ:W.B Yeats এর কবিতা

 


W.B Yeats এর পাঁচটি কবিতা 

 অনুবাদ : অরূপরতন হালদার 

 

 অ্যডামের অভিশাপ



এক গ্রীষ্মের শেষাশেষি আমরা একসঙ্গে বসেছিলাম
সেই মেদুর, চারুকেশী নারী, তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তিনি,
এবং তুমি আর আমি, আমরা কবিতা নিয়ে কথা বলছিলাম।
আমি বললাম, 'একটা পংক্তি নিয়ে হয়তো আমাদের
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতে পারে, তবুও যদি তা 

কোনো এক মুহূর্তের চিন্তা বলে মনে না হয়, তবে আমাদের এই বুনে তোলা

অথবা আবার সুতো খুলে ফেলা শেষাবধি অর্থহীন।

তার চেয়ে ভালো তোমার অস্থিমজ্জার ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া
এবং কোনো রান্নাঘরের মেঝে ঘষে মেজে তোলা, অথবা কোনো
বৃদ্ধ কপর্দকহীনের মতো যে কোনো আবহাওয়ায় পাথর ভেঙে চলা;
কারণ মধুর শব্দদের একসঙ্গে উচ্চারণ করা
এসবের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন, আর এতদসত্ত্বেও
কোলাহলময় ব্যাঙ্কার, স্কুলশিক্ষক আর যাজকের দল
আমাকে নিষ্কর্মা ভেবে নেয়
যেমন শহীদ যাঁরা তাঁরা ভেবে নেন বাকি পৃথিবীকে'

                                                 আর তার ওপর
সেই সুন্দরী মেদুর নারী যার জন্য অনেকেই
বুকের মাঝখানে জেগে থাকা সমস্ত ব্যথাকে খুঁজে পাবে
তারা খুঁজে পাবে তার মধুর, নীচু গলার কণ্ঠস্বর, আর
বলবে, 'একজন নারী হয়ে জন্মানো মানে সেই জ্ঞান অর্জন করা
যদিও তারা ইস্কুলে এ সম্বন্ধে কোনো কিছু উচ্চারণ করে না
আর আমাদের সুন্দর হয়ে ওঠার জন্য পরিশ্রম করতে হয়।'

আমি বললাম, 'এটা নিশ্চিত যে অ্যাডামের পতনের পর থেকে
সূক্ষ্ম জিনিস বলে কিছু নেই, আর তা অনেক শ্রম দাবি করে।
তেমন প্রেমিকেরা আছে যারা মনে করে
প্রেম হওয়া উচিত উঁচু পর্দার সৌজন্যে মোড়া
যাতে পাণ্ডিত্যে ভরপুর বইপত্র থেকে
তাদের উদ্ধৃতি এবং দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে পারে
প্রাচীন চমৎকার সব বই থেকে তারা উদাহরণ টেনে আনতে পারে ;
যদিও এখন এসব আলসেমিতে ভরা ব্যাপার স্যাপার বলে মনে হয়।'

আমরা ক্রমে শান্ত হয়ে বসে রইলাম ভালোবাসার নামে;
আমরা দেখলাম দিনের আলো শেষবারের মতো জ্বলে উঠে নিভে গেল,
আর কেঁপে ওঠা আকাশের সবুজাভ নীলের ভেতর
একটা চাঁদ, ক্ষয়ে আসা যেন সে কোনো শামুকের খোল
ধুয়ে যায় সময়ের সেইসব স্রোতে যারা তারাদের চারপাশে জেগে ওঠে 

এবং বিরত হয়, ভেঙে পড়ে দিন আর বছরদের ভেতর।

অন্য কোনো কিছু নয়, শুধু তোমার শ্রবণ জেগে ছিল আমার ভেতর :
এ তো সত্যি যে তুমি বড়ো সুন্দর, আর আমার সমস্ত যুদ্ধ ছিল
ভালোবাসার প্রাচীন রাজপথের মধ্যে দিয়ে তোমাকে ভালোবেসে যাওয়া;
যেন সবকিছুই তখন আরও সুখের, এবং তার মধ্যেও আমরা
ওই অগভীর চাঁদের মতো শ্রান্ত হৃদয়ের মানুষ হয়ে বেড়ে উঠব।


মূল কবিতা : "Adam's Curse"
কাব্যগ্রন্থ :
  In The Seven Woods



তার প্রশস্তি


যাদের প্রশংসা শুনতে পেতাম সে ছিল তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
আমি সেই বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়িয়েছি, ওপর-নীচ করেছি
যেমন নতুন কোনো বই প্রকাশ পেলে একজন করে থাকে,
অথবা সেই উদ্ভিন্নযৌবনা মেয়েটি যে তার নতুন গাউনে সাজগোজ করে,
আর যদিও আমি কোনও না কোনও ভাবে কথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম
যতক্ষণ না পর্যন্ত তার স্তুতি একটা সর্বোচ্চ বিষয় হয়ে ওঠে,
একজন নারী তার পড়া নতুন একটা কাহিনির কথা শুনিয়েছিল,
একজন পুরুষ তার আধখানা স্বপ্নের মধ্যে তখনও বিভ্রান্ত
যেন অন্য কোনো নাম তার মাথার ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
সেই নারী ছিল তাদের মধ্যে ছিল অগ্রবর্তিনী
যাদের স্তুতি আমি শুনতে চেয়েছিলাম।
লম্বা একটা যুদ্ধ অথবা বইপত্র কোনো কিছুর কথাই আমি আর বলব না
কিন্তু শুকনো কাঁটাঝোপের পাশ দিয়ে হেঁটে যাব যতক্ষণ না পর্যন্ত
আমি খুঁজে পাব এক ভিখারি ঝোড়ো হাওয়া থেকে আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে

আর কথাবার্তা চালিয়ে যাব যতক্ষণ না পর্যন্ত তার নাম ফিরে আসে।
তার কাপড়চোপড় যথেষ্ট ছেঁড়াখোঁড়া হলেও সে তার নাম জানবে
এবং তা স্মরণে রেখে সে খুশি হয়ে উঠবে যেমন পুরোনো দিনে ঘটত,
যদিও সেই নারী যুবকদের স্তুতি এবং বয়স্কদের দোষারোপ বয়ে চলেছে,
গরীবদের মধ্যে বয়স্ক এবং কমবয়সী সবাই তার প্রশংসা করেছিল।


মূল কবিতা :
 "Her Praise"
কাব্যগ্রন্থ : Wild Swans at Coole

 

 

দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তন


আরও বড়ো, প্রকাণ্ড হয়ে ওঠা সেই ঘূর্ণির দিকে ঘুরে যাই
বাজপাখি তার পালকের কথা শুনতে পায় না;
চারপাশ ভেঙে পড়ে, কেন্দ্র থেকে ঝরে যায় সব,
অবিমিশ্র এক নৈরাজ্য তার বিস্তার খুলে দেয় পৃথিবীর ভেতর,
রক্তকে নিভিয়ে দেওয়া স্রোত তার শরীর আলগা করে দেয়,
প্রত্যেক জায়গায় সারল্যের উদযাপন ডুবে যাচ্ছে;
যা সর্বোত্তম তার মধ্যেও বিশ্বাস শূন্য হয়ে এল,
আর সবচেয়ে খারাপ ভরে উঠছে তীব্রতায়।

অবশ্যই কিছু উন্মোচন জেগে থাকে;
এ এক দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তন যা আমার জন্য রয়ে যায়।
দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তন! এই শব্দদের উচ্চারণ করা বড়ো কঠিন
যখন সময়কে সূচিত করে দেওয়া এক বিরাট দৃষ্টিকোণ
মরুভূমির বালির ভেতর কোথাও আমার দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দেয়
সিংহের দেহ আর মানুষের মাথাওয়ালা এক অবয়ব,
সূর্যের মতো নির্দয় আর শূন্য একটা দৃষ্টি,
তার জঙ্ঘা দোলায়, যখন তার সম্পর্কিত যাবতীয় সবকিছু
ঘৃণায় ভরে ওঠা মরুভূমির পাখিদের ছায়াকে কাঁপায়
আরও একবার অন্ধকার নেমে আসে; কিন্তু এখন আমি জানি
কুড়িটি শতাব্দীর প্রস্তরীভূত ঘুম
একটা আন্দোলিত দোলনায় দুঃস্বপ্নের মধ্যে পীড়িত হতে থাকে,
আর সেই কর্কশ পশুরা, তাদের সময় শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসে,
জুবুথুবু গতিতে বেথলেহেমের দিকে চলে যায়
তারা কি জন্ম নেবে আরও একবার?


মূল কবিতা :
 "The Second Coming"
কাব্যগ্রন্থ :
 Michael Robartes and the Dancer




মৃত্যু


ভয় অথবা আশা কেউই
মৃতপ্রায় পশুর দিকে ফিরে তাকায় না;
ভয় আর আশার মধ্যে দিয়ে এতদূর হেঁটে এসে
একজন মানুষ তার অন্তিম সময়ের জন্য অপেক্ষা করে ;
অসংখ্যবার সে মৃত্যু স্পর্শ করেছে,
অসংখ্যবার সে উঠে দাঁড়িয়েছে।
কেউ একজন মহৎ তার অহংকারের ভেতর
হত্যাকারীদের মুখোমুখি হয়
শ্বাসরোধী সবকিছুর দিকে
তার উপহাস ছুঁড়ে দেয়;
সে মৃত্যুকে তার অতল পর্যন্ত জানে
মানুষই সৃষ্টি করে চলে মৃত্যুকে।

মূল কবিতা : "Death"
কাব্যগ্রন্থ : The Winding Stair and Other Poems




বাইজান্টিয়াম


দিনের অবরুদ্ধ ছায়ারা সরে যায়;
সম্রাটের মত্ত সৈনিকরা সব শয্যাগত;
ক্যাথিড্রালের প্রকাণ্ড ঘণ্টার শব্দ শেষ হয়ে গেলে
অপসৃয়মান রাত্রির অনুরণন, মিলিয়ে যায় নৈশ ভ্রামণিকদের গান,
এক নক্ষত্রখচিত অথবা জ্যোৎস্নায় ধোয়া গম্বুজ
ঘৃণা করে যা কিছু মানবিক,
নিছকই সব জটিলতা,
মানুষের শিরার মধ্যে থেকে যাওয়া সব ক্রোধ আর পঙ্কিলতা।

আমার সামনে জেগে ওঠে একটা ছবি, মানুষ কিংবা ছায়া
মানুষের অধিক কোনো ছায়া, ছায়ার অধিক কোনো ছবি;
হাদিজের সুতো কোনো মমির কাপড়ের সঙ্গে জড়িয়ে যায়
যেন জড়িয়ে যাওয়া একটা রাস্তাকে খুলে দেয়;
একটা মুখ যার অভ্যন্তর ভিজে নয়, যার ভেতর শ্বাস অস্তিত্বহীন
শ্বাসহীন মুখেরা আমাকে ডেকে নেয়;
আমি চিৎকার করে সেই অলৌকিক মানুষকে ডেকে উঠি;
তার নাম দিই জীবনের মধ্যে মৃত্যু অথবা মৃত্যুর মধ্যে জীবন।

অতিলৌকিক কিছু, পাখি অথবা সোনালি কারুকাজ,
পাখি অথবা কারুকাজের চেয়ে অতিলৌকিক কিছু,
নক্ষত্রখচিত সোনালি শাখার ওপর কুঁদে তোলা
তার ভাল লেগে যেতে পারে হাদিজের কাকের উদ্ধত ঘাড় বাঁকানো,
অথবা তেতো চাঁদের পাশে
অপরিবর্তনীয় কোনো ধাতু, চেনা পাখি বা ফুলের পাপড়ি
কিংবা রক্ত বা কাদার জটিলতার সমস্ত মহিমার দিকে
চিৎকার করে অবজ্ঞা ছুঁড়ে দেওয়া।

মাঝরাতে সম্রাটের শান-বাঁধানো রাস্তার নড়ে-ওঠা ডানার ওপর
সেই শিখা যার স্বাদ প্রত্যাখ্যান করে জ্বালানি কাঠেরা
না কোনো ইস্পাত জ্বলে ওঠে সে আগুনে,
না কোনো ঝড় তাকে এলোমেলো করে, শিখা থেকে জেগে ওঠে শিখা,
যেখানে রক্ত থেকে জেগে ওঠে আত্মারা
এবং ছেড়ে চলে যায় ক্রোধের জটিলতা,
তারা মরে যায় কোনো নাচের ভেতর,
সমাধির যন্ত্রণা,
সেই শিখার মর্মবেদনা যা একটা আস্তিনকে পোড়াতে অক্ষম।

শুশুকের কাদা ও রক্তের ওপর দু পা ফাঁক করে চেপে বসে
একের পর এক আত্মা! কামারশালারা বন্যার আগল খুলে দেয়।
সম্রাটের সোনালি কামারশালা!
নেচে ওঠা মেঝের শ্বেতপাথরেরা
জটিলতার তেতো ক্রোধ ভেঙে ফেলে,
সেইসব ছবি যারা এখনো জন্মায় নি
এবং নতুন ছবি থেকে জেগে ওঠে
সেই শুশুকের ছিঁড়ে-ফেলা, ঘণ্টার শব্দের মধ্যে যন্ত্রণায় দীর্ণ এক সমুদ্র।



মূল কবিতা :
 "Byzantium"
কাব্যগ্রন্থ : The Winding Stair and Other Poems


উইলিয়াম  বাটলার ইয়েটস :

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ডব্লু বি ইয়েটস। আইরিশ সাহিত্যের অন্যতম স্তম্ভ এই কবি ১৮৬৫ সালে এক প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন আইনজীবী ও চিত্রকর। ছোটোবেলায় চোদ্দো বছর লণ্ডনে কাটালেও তাঁর আইরিশ শেকড় ছিল অত্যন্ত গভীর।
১৮৮৫ সালে তাঁর কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় Dublin University Review পত্রিকায়। এইসময় জন ও লিয়ারি তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। ১৯০৮ সালে তাঁর Collected Works of Verse and Prose of William Butler Yeats প্রকাশিত হয়।
ইয়েটসের কবিতা সাধারণ দৈনন্দিন জীবন ও ঐতিহ্য থেকে তার প্রতীক খুঁজে নিয়েছিল।
ইয়েটস আইরিশ ঐতিহ্য ও তার জাতীয় জীবনের উপর ভিত্তি করে একাধিক নাটক রচনা করেছিলেন। Abbey Theatre এর সঙ্গে তাঁর গভীর যোগাযোগ ছিল।
আইরিশ গৃহযুদ্ধের সময় তিনি নতুন আইরিশ সরকারের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং আয়ার্ল্যান্ডের জাতীয় জীবনে নতুন শক্তির পক্ষে দাঁড়ান। ১৯২৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। অডেন তাঁকে ইংরেজি গীতিকবিতার অন্যতম পুরোধা বলে বর্ণনা করেন। তিনি কবিতায় জীবনের স্থানিক বিষয়গুলিকে বহির্জগতের ও প্রকৃতির সঙ্গে একীভূত করে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন।
১৯৩৯ সালে ৭৩ বছর বয়সে ফ্রান্সে তাঁর জীবনাবসান হয়। 

 

 



অরূপরতন হালদার

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. W.B Yeats এর কবিতাগুলির অনুবাদ পড়তে পড়তে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম।
    কবি অরূপ রতন হালদার যেভাবে অনুবাদের কাজটি করেছেন, বাংলা ভাষায়,
    মূল কবিতাগুলির শব্দবিন্যাসের যে আবহ, এখানে আশ্চর্য ভাবে একই সুরে বেজে চলেছে। কতটা আত্মগত হলে এমন কাজ সম্ভব ভাবছি। পাঠকের মনোনিবেশ এখানে চুম্বকের মত।

    উত্তরমুছুন