বাজেকবিতা
– একটি রম্যনিবন্ধ
সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর “প্রথম আলো” বইতে রবি ঠাকুরের “দাঁড়াও আমার আঁখির আগে” গানটির
লিরিক প্রসঙ্গে বলেছেন, “প্রথম পঙক্তিটি আসে আকাশ থেকে সহসা অশনিপাতের মতন। কোনও
পূর্বপ্রস্তুতি থাকে না, মনের গহন কোণেও যেন এই চিন্তার অস্তিত্ব ছিল না। পর পর
ঠিক এই চারটি শব্দ আগে কেউ সাজায়নি, যদিও কোনও শব্দই নতুন নয়। “
যেহেতু আমার
আকাশে সুগম অংশটির পরিমাণ ক্ষুদ্র ও সংকুচিত, আমার কপালে “আঁখির আগে”র মহিমা নেই,
বরং তার বদলে আমি আজ সকালে পেয়ে গেলাম এই লাইনটা
“মাঝে খুব বাজেকবিতার প্রাদুর্ভাব হয়েছিল
মাঙ্কি পক্সের মতন …”
বসে ভাবছি এর
পরের লাইনটা ঠিক কি হতে পারে যাতে কিনা আমি আমার কবিত্বের নৈপুণ্য দেখাতে পারি,
মেসেজ আসে শীলা বিশ্বাসের কাছ থেকে – “এবং সইকথা”র জন্য প্রবন্ধ চাই যতশীঘ্র
সম্ভব। খানিকটা কাকতালীয় নিশ্চয়, কিন্তু তাও লেখাটার নাম ঠিক হয়ে গেল ওই আকাশ
থেকেই – “বাজেকবিতা – একটি
রম্যনিবন্ধ”।
বাজেকবিতা কি?
দান্তের ইনফার্নোর ইংরেজি অনুবাদের মুখবন্ধে Robert and Jean Hollander লিখছেন –
What is a
“great book”? It is probably impossible to define the concept analytically to
anyone’s satisfaction, but it may be described pragmatically: a work that is
loved, over time, by millions of more-or-less ordinary readers and by thousands
of scholars.
ভালো বইয়ের এই
সংজ্ঞা যদি আমরা ব্যবহার করি ভালো কবিতার ক্ষেত্রেও, তাহলে ভালো কবিতা হচ্ছে সেই
কবিতা যা বহু সাধারণ পাঠককে ছুঁয়ে যাবে কালের সীমা পেরিয়ে, আর একই সঙ্গে কবিতা
বিশ্লেষকদের কাছেও সমাদৃত হবে।
পাঠককে একটি
ভালো কবিতা ছুঁয়ে যেতে পারে নানান ভাবে – তার সূক্ষ্ম দ্যোতনায়, তার সংক্ষিপ্ত
উপস্থাপনায়, তার শব্দচয়ন ও চলনের গভীরতায়। ভালো কবিতার সবচেয়ে বড় পরিচয় বোধহয় এই
যে, ‘দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে’; এ কবিতা একবার পড়ে মন ভরে না, বারবার পড়তে হয়।
বারবার ফিরে আসে তার ‘সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান’।
কিন্তু সোশ্যল
মিডিয়ার যুগে সব ভাষার কবিতাতেই একটা বিশাল পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ফেসবুক,
ইনস্টাগ্রামে হাজির অনেক কবিতাকেই আমাদের মনে হয় জোলোসহজ, একবার পড়লেই এ লেখা খতম,
মনে হয় এ কবিতা না লিখলেও চলত। এ লেখা যেন মনোযোগের অভাবদুষ্ট জনতার জন্যে লেখা।
লেখক, সম্পাদক, এবং বিশ্লেষক Yasmin Belkhyr এই ধরনের কবিতা প্রসঙ্গে বলেছেন these
poems aren't emotionally vulnerable at all, অর্থাৎ এই ধরণের কবিতায় অনুভবের কোনো
কাব্যিক প্রকাশ নেই। (উল্লেখসূত্র – “Bad Poetry Is Everywhere. Unfortunately,
People Love It”, Shivani Dubey https://www.vice.com/en/article/z3mnn8/why-is-bad-poetry-everywhere)
সোশ্যল মিডিয়ার
কবিতার সমালোচনা আমরা করতে পারি কিন্তু তার পাশাপাশি কবিতা-সংক্রান্ত
পরিসংখ্যানগুলো কিন্তু আমাদের উপেক্ষা করা চলবে না। আমেরিকার National Endowment
for the Arts জানাচ্ছে আমেরিকাতে কবিতা পাঠকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে গত পাঁচ বছরে।
আর কবিতা পাঠকের সংখ্যা সবচেয়ে বেড়েছে ১৮-২৪ বয়স গ্রুপে। এটা শুধু অভাবনীয়ই নয়,
অত্যন্ত আশা আর উদ্দীপনার খবর। কি কি কারণে কবিতা পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে এত বেশি?
The Academy of American Poets জানাচ্ছে তাদের অভিমত – প্রধানত পাঁচটি কারণে এই
পাঠকবৃদ্ধি –
১) সময় যখন
কঠিন হয়, কবিতা তখন অন্তর্দৃষ্টি আর প্রেরণা যোগায়;
২) সোশ্যল
মিডিয়া কবিতার পক্ষে আদর্শ;
৩) কবিরা
নিজেরাই সোশ্যল মিডিয়া ব্যবহার করে কবিতাকে জনপ্রিয় করে তুলছেন;
৪) আমেরিকান
সংস্কৃতির মূলধারায় কবিদের উপস্থিতি বেড়েছে অনেক বেশি;
৫) আমেরিকার
বিভিন্ন কবিতা সংগঠনের অগ্রনেতারা এই প্রথম একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করেছেন ভাল
কবিতাকে তুলের ধরার জন্যে।
কবিতাকে
জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে সোশ্যল মিডিয়ার কবিদের অবদান কত? আর একটি পরিসংখ্যান দেখি
আমরা। এটি ২০১৫ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবর। অনলাইন কবি Tyler Knott Gregson-এর
প্রথম কবিতার বই “Chasers of the Light,” সারাদেশে জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়ায় এবং এই
বইটির বিক্রী হয় ১২০ হাজার কপি। পাশাপাশি Louise Glück-এর কবিতার বই “Faithful and Virtuous Night,” যা কিনা সে বছর
জাতীয় পুরস্কার পায় (পরে উনি ২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন), বিক্রী হয়
মোট ২০ হাজার কপির মত। আর একজন অনলাইন কবি ক্যানাডিয়ান-ভারতীয় Rupi Kaur এর প্রথম
বই “milk and honey” নিউইয়র্ক টাইমসের সবচেয়ে জনপ্রিয় লিস্টে আসে ২০১৭ সালে। এ
বইটির সব কবিতাই প্রায় তিন থেকে পাঁচ লাইনের – ইনস্টাগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাটের
জন্যে আদর্শ ফরম্যাট।
শুধু
স্বল্পদৈর্ঘ্যের বলে এই ধরণের কবিতাকে সমালোচনা করা অনুচিত হবে। কবিতা কত ছোট হতে
পারে তার কবিতা-ভাব বজায় রেখেও? বিধিবদ্ধ ভাবে লেখা জাপানি ছোট কবিতা (যার
মোটামুটি ভাবে দশটি প্রচলিত প্রকার - হাইকু সেই দশটি প্রকারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত) সারা
পৃথিবীতেই জনপ্রিয়। অনেক বিশ্লেষকের মতে কবিতার modernism যুগের (অর্থাৎ মোটামুটি
ভাবে ১৮৯০ – ১৯৫০) কর্ণধার কবি এজরা পাউন্ডের ২ লাইনের কবিতা In A Station Of The Metro, ইংরেজি ভাষায় লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা।
কবিতাটা দিচ্ছি এখানে
In A Station
Of The Metro / Ezra Pound (1926)
The apparition
of these faces in the crowd;
Petals on a
wet, black bough.
বিশ্লেষকরা তাই
সোশ্যল মিডিয়ার কবিতাকে শুধু ছোট বলে বাজেকবিতা বলছেন না, তাঁদের মূল বক্তব্য হলো
এই যে এই ধরণের অনেক কবিতাই emotionally lazy and vacant – তাড়াহুড়ো করে দু’ চারটে
সপি লাইন লিখে ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া।
সোশ্যল মিডিয়ার
এই “বিপ্লবে”র আগে কবিতার ল্যান্ডস্কেপটা কেমন ছিল? কবিতার মেধাসম্পদের পুরো
বাজারটাই নিয়ন্ত্রণ করত বড় পাবলিশাররা । কবিতার বই প্রকাশ করা পাবলিশারদের কাছে
একটা বড় আর্থিক ঝুঁকি নেওয়া। তাই নতুন চিন্তার, নতুন ভাষায় নিপুণ কবিদের পক্ষেও
কবিতা প্রকাশ করা দুরূহ ব্যাপার ছিল। অন্যদিকে আমেরিকার গত ৩০ বছরের বিশিষ্ট কবিরা
সকলেই প্রায় ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আর তাতে কবিতার একটা বিশেষ ধারাই শক্তিশালী হয়ে
উঠছিল – প্রোমোশন এবং টেনিওর পাওয়া যে নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত কবিদের স্বীকৃতির
ওপর! এই “group think” এর জন্যে জীবনের অন্য পরিধি থেকে আসা লেখক এবং কবিরা
দাঁড়াতে পারছিলেন না। গত দশ বছরে সেই ব্যাপারটা অনেকটা পাল্টেছে। ক্যালিফোর্নিয়া
প্রদেশের “রাজকবি” (poet laureate) Dana Gioia বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন এই বিষয়টি
নিয়ে। তাঁর হিসেব মত আজকের নতুন কবিরা অনেকেই কাজ করেন স্কুল-কলেজের বাইরের জীবনে
– তাঁরা কেউ কফিশপের বারিস্তা, কেউ পানীয়বার বা রেস্তোরাঁতে পরিবেশক , কেউ বা আবার
ডাক্তার, নার্স, বা উকিল। এতে জীবনের অভিজ্ঞতার অনেক নতুন দিক কবিতায় উদ্ভাসিত
হচ্ছে, কবিতার মেধাসম্পদের একটা গণতন্ত্রীকরণ ঘটছে। উদাহরণ হিসেবে বলি, ২০২২ সালে
কবিতায় পুলিতজার পেয়েছেন Diane Seuss – যিনি পেশাতে একজন Social Worker । এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত স্প্যানিশ-আমেরিকান লেখক ও দার্শনিক George
Santayanaর কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাঁর “Interpretations of Politics and
Religion” বইতে Santayana লিখছেন –
“All observation is observation of brute fact, all discipline is mere
repression, until these facts digested and this discipline embodied in humane
impulses become the starting-point for a creative movement of the imagination,
the first basis for ideal constructions in society, religion, and art.” তাই
আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা যদি সীমিত হয়ে থাকে সায়ন্তন ঠাকুর যাকে বলেন “খিড়কি থেকে
সিংহদুয়ারে”, আপনার কবিতাও হবে সীমিত মাপের, একঘেয়ে।
তাহলে শেষটা কি
দাঁড়াল? বাজেকবিতার প্রাদুর্ভাব সবমিলিয়ে ভালো না মন্দ সমাজের পক্ষে? আমার নিজস্ব
মতামত এ ব্যাপারে একেবারে খোলাখুলি স্পষ্ট। ফেসবুকে এবং কূপমন্ডুক কিছু দীর্ঘশ্বাসে মাঝে মাঝেই দেখি, এত কবি
কেন, আমি অবাক হই তাতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস নীরেন চক্রবর্তী বেঁচে থাকলে উনিও অবাক
হতেন, কারণ উনি বলেছিলেন ১৯৭৮ এর কলকাতা ইউনিভার্সিটির একটি টকে (আমার সৌভাগ্য আমি
উপস্থিত ছিলাম সেখানে) – “আমার প্রতিজ্ঞাটা অন্য রকমের । আমি ঠিক করেছি বাংলাদেশে
সব্বাইকে আমি কবি বানাব। দেখি পারি কি না”। তাই আসল প্রশ্নটা হচ্ছে এই –
এত কম কবি কেন?
এত কম কবি কেন?
প্রত্যেকে ভালো
কবিতা লিখতে শিখতে পারেন, কবিতা লেখা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার একটা অপরিহার্য
পরিচয়। অনেকটা নাচের মত। যে কেউই নাচ থেকে আনন্দ পেতে পারেন, তারা নাচকে পেশা
হিসেবে না নিলেও। একই কথা বলে গেছেন পরাবাস্তববাদী (surrealist) আন্দোলনের
প্রতিষ্ঠাতা ফরাসী কবি আঁন্দ্রে ব্রেতন (Andre Breton)। তিনি স্বপ্ন দেখতেন যে
একটা সময় আসবে যখন দলে দলে কবিরা ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাষার
প্রকাশে দক্ষ হতে শিখবে। আজকাল আমরা একেই সৃজনী লেখার ক্লাস বলি।
তাই সবাই
লিখুন। আরো লিখুন। প্রাদুর্ভাব থেকে মহামারীর মতন ছড়িয়ে পড়ুক কবিতা লেখা। পাঠক
হিসেবে আপনি খুঁজে পড়ে নিন যে ধরণের কবিতা আপনাকে মাতায়। কিন্তু কবিতা পড়ার পর
প্রশ্ন করুন নিজেকে – ১) এ কবিতা আমার ভালো লাগলো কেন? আর ২) আমি কি এ কবিতা আবার
পড়ব না একবার পড়েই সব মানে বোঝা হয়ে গেল? এই শৃঙ্খলাবোধ যদি আপনার থাকে তাহলে দেখবেন
যেখানেই শুরু করুন না কেন, আপনি একটু একটু করে আপনার কবিতা পড়ার পরিধি বাড়িয়ে
ফেলেছেন, আর শেষে ক্ষ্যাপার মতন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই কবিতা যাকে ছুঁতে গেলে আপনাকে
“স্তর ভেদে পৌঁছতে হবে মূলে। পাহাড়ি বাঁকের মতো। সবটা কখনোই একটি বাঁক থেকে দেখা
যাবে না”। (সমর্পিতা ঘটক)।
আর যদি আপনি
চান সেই কবিতা লিখতে যা কিনা বহু সাধারণ পাঠককে ছুঁয়ে যাবে কালের সীমা পেরিয়ে, আর
একই সঙ্গে অনেক কবিতা বিশ্লেষকের কাছেও সমাদৃত হবে, তাহলে শেষ করি Wallace Stevens
এর কবিতা “The Planet on the Table” কবিতার কয়েকটা লাইন দিয়ে –
And his poems, although makings of his self,
Were no less makings of the sun.
It was not important that they survive.
What mattered was that they should bear
Some lineament or character,
Some affluence, if only half-perceived,
In the poverty of their words,
Of the planet of which they were part.
3 মন্তব্যসমূহ
পড়লাম। আবারও পড়ার প্রয়োজন আছে। এটাই অমিত চক্রবর্তীর লেখার রাজু। আমার কাছে।
উত্তরমুছুনএত কবি কেন?
উত্তরমুছুনপাল্টা প্রশ্ন এত কবি কেন নয়?
কবিতা লিখুক কড়া পড়া হাতে কাদা মাখা মাঠের কৃষক, সারা গায়ে কালি মাখা মোটর মিস্ত্রি। খুব সঙ্গত বিষয় উঠে এসেছে লেখায়। বাজে কবিতাও কবিতা। লেখা হোক বাজে কবিতাও।
এত কবি কেন?
উত্তরমুছুনপাল্টা প্রশ্ন এত কবি কেন নয়?
কবিতা লিখুক কড়া পড়া হাতে কাদা মাখা মাঠের কৃষক, সারা গায়ে কালি মাখা মোটর মিস্ত্রি। খুব সঙ্গত বিষয় উঠে এসেছে লেখায়। বাজে কবিতাও কবিতা। লেখা হোক বাজে কবিতাও। দেবাশিস ঘোষ