হে মৃত্যুহীন,নিয়ো শ্রদ্ধা,নিয়ো প্রেম
“ আমাকে তোমার প্রয়োজন?
লিখে রাখো স্মৃতির খাতায়………”
কবিতাটি সুবলদা হোয়াটস এ্যাপে পাঠায় আমাকে। তার শেষ যাত্রার দিন
পনেরো আগে। ভেলোর থেকে,যেখান থেকে আমি ফিরে এসেছিলাম তারও কয়দিন আগে। প্রথম লাইনটা পড়ে চমকে উঠেছিলাম।
সুবলদাকে আমার প্রয়োজন চিরকাল। এই যে তাকে নিয়ে
স্মৃতিচারণ, কোনো শব্দে আটকে গেলে তার ফোন নাম্বারেই চলে যায় অভ্যস্ত আঙ্গুল। তারপর দীর্ঘ্শ্বাস –
হায়রে,এ ডাক তো সুবল দত্তের কাছে পৌঁছবে না, কেননা সে সাড়া দিয়েছে ঈশ্বরের ডাকে।
ঈশ্বরের ডাক সে শুনতে পাচ্ছিল ক বছর ধরেই। ২০১৮য় ধরা পড়ে প্রস্টেটে ক্যানসার। তার কিছুদিন পর চিকিৎসা শুরু হয় সি এম সি,ভেলোরে। ২০২০তে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার বই ‘এক এক মুগ্ধতার ছটা’ । এ বইয়ে প্রথম কবিতাগুচ্ছের নাম – কষ্ট সাইট থেকে বেড়িয়ে এলাম। এই কষ্ট সাইট আসলে ভেলোরের সিএমসি হাসপাতাল,যেখানে কবি দেখতে পায় ‘আকাশে অগুনতি বিষন্ন ক্যথিটার থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঝরছে জীবন’। ওপারের ডাক তখনই সে শুনেছিল কিন্তু সাড়া দেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলনা। তাই লিখেছিল,
‘সেই যে ঘড়িটা আমার অসময়ের ঘন্টা বাজিয়ে মৃত্যু ঘোষণা করেছে ‘ কিংবা
‘এখন মারক তুই মাথার উপর চেপে বসে…….. কুট কুট আয়ু কেন খাস?
হ্যাঁ,ডাক শুনেও সে ডাককে উপেক্ষা করছিল সুবলদা। তার লেখা,তার রেখা,তার গান, তার স্মিত হাসি দিয়ে বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই চালাচ্ছিল। আমি যখন ভেলোর থেকে ফিরে আসছি, তখনও তার ঠোঁটে হাসি,’আমিও বাড়ি ফিরছি খুব শিগগিরই’। এই আত্ম বিশ্বাস কদিন বাদেই চিড় খায়। তখন ফোনের ওপারে তার কন্ঠস্বরে ক্লান্তি,বিষন্নতা, এমনকি করুণ
আর্তি – ‘ আমার জন্য প্রার্থনা কোরো’
প্রার্থনা তো করেছিল তার আপামর গুণগ্রাহী। কিন্তু ভগবান শুনলেন কই? তাঁর নিজেরই যে বড় প্রয়োজন এই সৃজনশীল,বিনয়ী,আদ্যন্ত ভালো মানুষটিকে। সুবলদার সব প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে তিনি তাকে টেনে নিলেন ৩০ জুলাই,২০২৩।
সুবলদাকে আমার প্রয়োজন সেই ১৯৮৮ সাল থেকে। তখন প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় তার বাড়িতে আড্ডা।সঙ্গে দেবাশীষ চক্রবর্তী।এক সন্ধ্যায় একা তার বাড়িতে গিয়ে তাকে না পেয়ে বৌদির কাছে রেখে আসি একটা কবিতা,তার কয়েকটি লাইন –
বর্ষায় আমার ঘরে থৈ থৈ করে জল/আর গরমের দুপুরে জল জল করে/আমার সামনেই মারা পড়ল সেই
বুড়ো ভিখিরি/কাউকেই কিছু দেওয়া হলনা আর/জীবনের অর্দ্ধেকটাই চলে গেল প্রায়………
তখন আমি এক প্রাইভেট স্কুলে। পরের সকালে ক্লাসে এক খন্ড কাগজ দিয়ে গেল স্কুলের দারোয়ান।সুবলদা লিখেছে –
জল চাইলেই করুণাময় হতে হবে/
কোনো মানে নেই/সে কি সফল কাতর, নাকি চিমটিয়ে বড় করে সুখী লোমকূপ?
এভাবেই সৃষ্টি হল সুবল দত্ত ও চন্দন সরকারের যুগ্ম কবিতা ‘জীবন’ যা প্রকাশ পেল অশ্বমেধ এর দ্বিতীয় সংখ্যায়। এ সংখ্যার প্রচ্ছদে ছিল সুবলদার কাটুম-কুটুম। ছিল তার প্রবন্ধ নি:সঙ্গতা তার। এ নামে তার প্রবন্ধ সংকলন বেরোল এইতো ২০১৭য়। অশ্বমেধ ৩ – বিশেষ অস্থিরতা সংখ্যাতেও সুবলদার প্রচ্ছদ। এবং এ সংখ্যাতেই তার অসামান্য গল্প ‘শাম্বর বংশবীজ,অর্জুনের দ্বন্দ্ব’।
অশ্বমেধ পর্বে সুবলদার বাড়িতে গিয়ে দেখতাম কখনো মাটির তাল, কখনো গাছের শুকনো
ডালকে প্রাণবন্ত করে তুলছে সুবলদা,কখনো বাচ্চাদের নাটকের জন্য মুখোশ তৈরি করছে, আবার কখনো ধানবাদ কয়্যারের গানের অভ্যেস। আর ছড়ানো ছিটানো তার ডায়েরীময় অজস্র কবিতা,স্কেচ,নাট্য সংলাপ, ছোট গল্প।এই ডায়েরি কবির কিছু পঙ্ক্তি আমার স্মৃতিতে অক্ষয় থাকবে চিরকাল :-
প্রকৃতি প্রেমিক সুবল: ফুলেদের জন্য কিছুই কি করবেনা সরকার?
আত্মকেন্দ্রিক সুবল: রক্তে চরে বিষ,বিষের শরীর ভাসে প্রেমে/প্রেম নয়তো সমর্পিত,আত্মা কাঁদে ঘুমে
অবসাদ গ্রস্ত সুবল:কবি নেই, কোনো কবি পৃথিবীতে নেই
রাগী সুবল:সবাই বাঞ্চোত পাপী,অক্ষম,অবলা, নিরূপায়
আদিম ছন্দময় সুবল: আমার তসর গুটি,রাগে কুটি দুসরা শুয়াঁ পোকা/ আমার ইমলী বনে বিষ বিহনে নি:শাস আঁকাবাঁকা/আমার পাহাড়ফাঁক,গতর খাক,জেসাস পাতে জাং/হে হে ডিংডুপুল,ধাতিন জিবাং তাং তাং তাং! :
অহংকারী সুবল আমি যখন বলব আমি,তখন আমিইইই………
ভাস্কর,চিত্রকর,কবি,ঔপন্যাসিক,প্রবন্ধকার, গল্পকার – সব পরিচয় ছাপিয়ে সুবলদা ক্রমশঃ হয়ে উঠেছিল আমার বড়ভাই। বিশেষত শেষ ছয় মাসে চিকিৎসা সূত্রে দু দফায় দু পক্ষকাল তাদের সঙ্গে ভেলোরে নিবাস কালে।
সৃজনশীল মানুষ নাকি তেমন সংসারী হয়না – এ ধারণার সম্পূর্ণ উল্টো পথে ছিল সুবলদার যাপন। ভেলোরে তাদের লজে গিয়ে দেখেছি -কখনো দাদা-বৌদি একসাথে কবিতা পাঠ করছে,কখনো সুবলদার নতুন লেখা মন দিয়ে শুনছে বৌদি, কখনো বৌদিকে কবিতা লেখার তালিম দিচ্ছে দাদা, কখনো বৌদি
গ্যাস স্টোভের সামনে আর সুবলদা বিছানায় বাবু হয়ে বসে হাস্যমুখে সবজি কাটছে।সেখানেও ক্রিয়াশীল তার শৈল্পিক আঙ্গুল। আমাদের দারুন সুস্বাদু মোচা রেঁধে খাইয়েছিল বৌদি। আমার স্ত্রীর
অভিমত – সে স্বাদে বৌদির হাতের গুণের মতোই দারুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সুবলদার নিখুঁত মোচা কর্তনের। আমরা যখন হাসপাতালে ব্যস্ত সে সময়ে আমাদের কন্যাকে সপ্রেমে,সস্নেহে,সযত্নে রেখেছিল এ দম্পতি। সুবলদার সৃজন কখনো বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। তার ট্রান্সফর্মেশন উপন্যাসটি আমার পড়া ছিল খানিক। তবুও সে যখন উপন্যাসটির কিছু অংশ পড়ে শোনাচ্ছিল,আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম – কী ভাবে ভাবো এসব? ঘোরের মধ্যে থাকো? উত্তরে মহা বিনয়ী সুবল দত্তর শুধুই হা হা হা ! এই একই প্রশ্ন যখন তাকে তার সহধর্মিণী করে, সুবলদার জবাব,’মগজে গিজগিজ করে’। তার দীর্ঘ অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার নেবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু কানে সার্জারির পর আমি যে তখন কিছুই শুনতে পাই না।
বহুমুখী প্রতিভাবান এই সাহিত্যিকের সেরা সৃষ্টি তার ছোট গল্প গুলো। এ স্বাদ যাঁরা এখনো পাননি,সংগ্রহে রাখুন সুবল দত্তর ‘প্লেগিয়ারিস্ট’,’প্রদাহ বোধ ১১’ ও ‘দাহ-প্রদাহ’। যাঁরা তাঁকে স্বীকৃতি দিচ্ছেননা,হে প্রভূ, তুমি তাঁদের ক্ষমা ক’রো।
‘শৈলী’সম্পাদক অমলেন্দু চক্রবর্তী ও ‘শিল্পে অনন্যা’ সম্পাদক ড:দীপক কুমার সেনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যথাক্রমে ‘শৈলী ৪৮’(সাহিত্যিক সুবল দত্তের ক্রোড়পত্র) ‘সুবল দত্ত,:দীপ্ত বলয়ের বিভা’ গ্রন্থটির জন্য।
হে মহান শিল্পী,যেখানেই থাকো, ভালো থেকো আর স্বপ্নে এসে আমার সঙ্গে আড্ডা মেরে যেও। তোমাকে আমার প্রয়োজন চিরকাল।
1 মন্তব্যসমূহ
খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে বলেছিস চন্দন ।প্রিয় মানুষ টার অনুপস্থিত বড় কষ্ট দেয় প্রতি মুহূর্তে।
উত্তরমুছুন