কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম
ইংরেজি ১৮৯৯ সালে। এই বছরেই বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জন্ম ও রবীন্দ্র প্রতিভার
সুস্পষ্ট বিকাশলাভ। কবি জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্য "ঝরাপালক"-এর
কবিতাগুলি " বঙ্গবাণী ", " কল্লোল", "কালি-কলম", " বিজলী ", " প্রগতি " প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে তখন
রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সের প্রজ্ঞা, মননশীল জীবনবীক্ষণ ও পূর্বস্মৃতি রোমন্থনের গভীরতায়
আত্মপ্রকাশ করছেন আর নজরুল তখন অসামান্য জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তিনি এঁদের পাশাপাশি
থেকে কবিতার মৃত্তিকা কে কর্ষণোপযোগী করে তাতে বীজবপনে যে অপরিসীম ফসল ফলিয়েছেন, তাতেই
তাঁর প্রতিভার সূর্য জাজ্জ্বল্যমান হয়েছে।
কবি জীবনানন্দের প্রথম
কাব্য "ঝরাপালক" (প্রকাশকাল ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাস) এবং শেষ কাব্য
"বেলা অবেলা কালবেলা "। এই দুই কাব্যের মধ্য বর্তী কাব্যগ্ৰন্থগুলি
যথাক্রমে "বনলতা সেন"," ধূসর পাণ্ডুলিপি "," রূপসী বাংলা","মহাপৃথিবী"," সাতটি তারার তিমির "। তাঁর সাতটি কাব্যগ্রন্থ রচনাকালের মধ্যে রাষ্ট্র ও
সাহিত্যের ক্ষেত্রে নববের আন্দোলন বেল তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। " ঝরাপালক
"-এর কবিতাগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রচিত হয়েছিল। এদেশে গান্ধীবাদী ও
সন্ত্রাসবাদী এই দুই ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন তখন তুঙ্গে। " সাতটি তারার তিমির
"প্রকাশকালে ভারতবর্ষ ইংরেজ শাসনমুক্ত হয়েছে আর ভারতবর্ষীয় এক আততায়ীর
গুলিতে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু হয়েছে। তখন দেশে নবভাবের আন্দোলন জেগেছে। অন্যদিকে
সাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্র প্রভাব অতিক্রম করার যে
সাধনা শুরু হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর (১৯৪১) পরও সে সাধনা অব্যাহত রইল। আর পৃথিবীর অপরদিকে
(১৯২৫) তখন সুরারিয়ালিস্টদের প্রভাব। তাঁরা ছবিতে নাটকে ভেঙে দিচ্ছিলেন নতুন অর্থ, তাৎপর্য।
সুতরাং অধিবাস্তববাদ (সোর -রিয়ালিজম), অস্তিবাদ (এক্সিসটেনশিয়ালিজম), অ্যাবসার্ডবাদ
প্রভৃতি শিল্পজগতের নিত্যনতুন আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিতি ঘটেছে নবীন বাঙালি কবিদের ।
সব মিলে রাষ্ট্রচিন্তা ও শিল্পসাহিত্য চিন্তায় বাঙালি প্রবেশ করেছে নতুন দিগন্তে।
মনে হয় তৎকালীন কবিদের মধ্যে জীবনানন্দকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল
অধিবাস্তববাদীরা বা অস্তিবাদীরা।
কবির "বনলতা
সেন" কাব্যগ্ৰন্থে মৃত্যুচিন্তা এবং মানব অস্তিত্বের সার্থকতা সম্পর্কে বিবিধ
প্রশ্ন উচ্চারিত। ধীরে ধীরে "ধূসর পাণ্ডুলিপি", " মহাপৃথিবী", "সাতটি তারার তিমির" এবং "বেলা অবেলা কালবেলা"
কাব্যগ্ৰন্থগুলিতে সেই সমস্ত প্রশ্ন গভীরতর হয়ে উঠতে লাগল। "বনলতা সেন"
কাব্যগ্ৰন্থে বনলতা সেন নায়িকা নারী। এই কাব্যে বনলতা সেন ছাড়াও আরও নায়িকা
নারী আছে যেমন, শঙ্খমালা, সুদর্শনা, শ্যামলী, সুরঞ্জনা, সবিতা, সুচেতনা ইত্যাদি। জীবনানন্দের নায়িকারা এখানে জীবনরূপিনী নয়, মৃত্যুর
সঙ্গে তাদের সহমর্মিতা, অর্থাৎ তাঁর কাছে নারী, প্রেম ও মৃত্যু একাকার। প্রেম ও
মৃত্যুর মধ্যে কার প্রতি কবির শ্রদ্ধা বা আগ্ৰহ বেশি তা বলা কঠিন, তার
কারণ যদি মৃত্যুর প্রতি শ্রদ্ধা বা আগ্ৰহ থাকত তাহলে কবি বলতেন না --
"পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন ;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই
কাছে "। (সুচেতনা)।
এই প্রসঙ্গে রিলকের কথা
মনে পড়ে--" Can it even be cancelled
"--একথা রিলকে জীবনের
ক্ষণস্থায়িত্ব আছে জেনেই প্রশ্নচ্ছলে উত্তর দিয়েছেন। জীবনানন্দ বলেছেন ---"
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে "। অর্থাৎ অপূর্ণতা সত্ত্বেও এই জগৎ বর্জনীয়
নয়। মুহূর্তেই কবির নিজেকে মনে হয় করুক্ষেত্র যুদ্ধের অর্জুন সদৃশ। তাইতো এই
পৃথিবীতে জীবনানন্দের নায়ক রণক্লান্ত সব্যসাচীর মতো সখেদে উচ্চারণ করেছেন :
" আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্র ঘুরে প্রাণ
পৃথিবীর মানুষকে মানুষের
মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু
দেখেছি আমার হাতে হয়ত
নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে
আছে "।
(সুচেতনা)
জীবনানন্দের নায়ক যদি
নিজেকে নিমিত্ত মাত্র ভাবতে পারতেন তবে হয়ত সান্ত্বনা থাকত। কিন্তু এখানে নায়ক
কর্তা, নিমিত্ত নয়। তাইতো সে ভালোবাসতে গিয়ে ভালোবাসাকে হত্যা করেছে। ইচ্ছার
স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। কিন্তু আজকের মানুষের সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা
স্বাধীনতা বিলোপ। তাইতো তিনি স্পষ্ট হয়ে উঠেছেন :
" আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না।
থাকত না আজকের জীবনের
টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা
ও অন্ধকার
আমি যদি বনহংস হতাম
বনহংসী হতে যদি তুমি
"।
(আমি যদি হতাম/বনলতা সেন)
ইংরেজিতে যাকে বলা হয়
" Anxiety", কিয়েডগার্ড যাকে বলেছেন "Angst", তাকেই জীবনানন্দ বলেছেন " বিপন্ন বিস্ময়"। "আট বছর আগের এক
দিন" কবিতায় অনামী নায়ক আত্মহত্যা করে বসলো ফাল্গুনের এক পঞ্চমী
রাতের আঁধারে। কিন্তু কেন? তার কারণ ওই বিপন্ন বিস্ময় অর্থাৎ Angst, তাই
জীবনানন্দ লিখেছেন :
"অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা
নয়----
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের
ভিতরে
খেলা করে,
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত ক্লান্ত করে
"।
তথাকথিত প্রেম ভালোবাসা
সত্ত্বেও যে যন্ত্রণার জন্য মানুষটি রাতের আঁধারে লাশকাটা টেবিলে শেষ শয্যা
নিয়েছিল, তা হচ্ছে ওই বিপন্ন বিস্ময়। সেই আত্মগত বেদনার বোধ থেকেই জীবনানন্দ লিখেছেন
--
" কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ
বহুদিন থেকে শান্তি নেই
"
(জনান্তিকে।
সাতটি তারার তিমির)
অথবা,
"সে আমার হাতে রাখে হাত
সব কাজ তুচ্ছ হয়---পন্ড
মনে হয়
সব চিন্তা প্রার্থনার সকল
সময়
শূন্য মনে হয়
শূন্য মনে হয়"।
(বোধ। ধূসর পাণ্ডুলিপি)
একাকিত্বের বোধ হচ্ছে
অস্তিত্বের সংকট। এই সংকটস্বরূপ উপলব্ধি থেকে বেদনার কবি বলেছেন --
" শরীর রয়েছে তবু মরে গেছে আমাদের মন"
(জীবন। ধূসর পাণ্ডুলিপি)
তখন মনে হয় দেহের আগে
মনের এই মৃত্যুর চেয়ে দেহের ধ্বংস অনেক বেশি কাম্য --
"যক্ষ্মার রোগীর মত ধুঁকে মরে মানুষের মন।
জীবনের চেয়ে সুস্থ
মানুষের নিভৃত মরণ।
মরণ --সে ভালো এই অন্ধকার
সমুদ্রের পাশে। "
(জীবন।
ধূসর পাণ্ডুলিপি)
জীবনানন্দ মৃত্যু বা
নৈরাশ্যে তাঁর বক্তব্য শেষ করেননি। অপূর্ণতা এবং খন্ডতা সত্ত্বেও এই জীবনে তার
কাছে মৃত্যুহীন সত্য হচ্ছে প্রেম এবং মানব অস্তিত্বের সার্থকতা ধরা পড়ে এই
প্রেমের। তাইতো কবিকন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে --
"ফলন্ত মাঠের পরে আমরা খুঁজি না আর মরণের স্থান,
প্রেম আর পিপাসার গান
আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর
ভাঁড়ের মতন"।
(অবসরের গান। ধূসর পাণ্ডুলিপি)
হৃদয়ে প্রেম আছে বলেই
জীবনের বিহ্বলতা হয়ে আমাদের দিন চলে এবং জীবনানন্দ বলেন " পৃথিবীর
গভীরতম অসুখ এখন " তথাপি তাঁর বিশ্বাস ---
"প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি, তাই রাখিয়াছি ঢেকে
পাখির মায়ের মত প্রেম
এসে আমাদের বুক।
সুস্থ করে দিয়ে গেছে
আমাদের বুকের অসুখ।
(প্রেম। ধূসর পাণ্ডুলিপি)
স্বপ্নের জগতে কিছুকালের
জন্য আশ্রয় কামনা করলেও জীবনানন্দ স্বপ্নবিলাসী ছিলেন না। ছিলেন না তিমির
বিলাসীও। 'তিমির বিলাসী' হতে চেয়ে তাঁর এই প্রার্থনায় মিথ্যাচারিতা ছিল না ----
" আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ
মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর
বিছানার কিনারে। "
(কমলালেবু।
বনলতা সেন)
দুঃখ আছে বলে জীবনকে
অস্বীকার করতে হবে, সত্য ও সুন্দরকে পরিত্যাগ করতে হবে, এ ধারণা জীবনানন্দের ছিল না।
একালের মানবজীবনের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা, স্ববিরোধিতার ব্যথা ও ক্ষণস্থায়িত্বের
হাহাকার আছে, সেসব কিছু মেনেও জীবনানন্দ মানব জীবনের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতে বিশ্বাসী
অস্তিবাদীদের মতোই বলেছেন,
"যদিও মৃত্যুই অনন্ত শান্তি হয়ে
সর্বত্র বিরাজিত, তথাপি ---
" এখন যে-কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি,
দেখা যাক পৃথিবীর ঘাস
সৃষ্টির বিষের বিন্দু আর
নিষ্পেষিত মনুষ্যতার
আঁধারের থেকে আনে কী করে
যে মহা নীলাকাশ,
ভাবা যাক--ভাবা যাক --
ইতিহাস খুঁড়তে রাশি রাশি
দুঃখের গান
ভেদ করে শোনা যায়
শুশ্রূষা মতো শত শত
শত জল ঝর্নার ধ্বনি।
( হে
হৃদয়। বেলা অবেলা কালবেলা)
কবিতার জগৎ বিশেষ থেকে
নির্বিশেষে উত্তীর্ণ রম্যলোক। সুতরাং এই রম্যলোক সৃজনে সফলকাম কৃতি পুরুষ যিনি, সেই
কবির সঙ্গে দার্শনিকের কোনও শত্রুতা নেই। তাহলে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ দীক্ষিত কবি
জীবনানন্দের কাব্য থেকে আধুনিক দর্শনের একটা বিশেষ তত্ত্বে কিছু বৈশিষ্ট্য সন্ধান
বৃথান্বেষণ হবে না।
0 মন্তব্যসমূহ