হিমেল হাওয়ায় শিরীষ গাছের পাতাগুলো কাঁপছিল। চারপাশ
নরম আদুরে রোদে আচ্ছন্ন। পাতলা সরের মত কুয়াশায় দূরের দিগন্ত আবছা। বাগানের গোলাপ
গাঁদা চন্দ্রমল্লিকা টগর রোদ্দুরে মেলে দিয়েছে শরীর। পাতার উপর মুক্তোদানা শিশির
এখনো বিদ্যমান। ছোট্ট হলুদ বাড়িটা বহুদিন পর প্রজাপতির পাখনা মেলে এই সবুজের মাঝে
হাসছে। নিচে একটা বড় একটা ছোট ঘর, রান্নাঘর
আর কলঘর। উপরে একটামাত্র ঘর আর ছাদ মিলে বেশ খোলামেলা বাড়ি।
ছাদের রেলিঙে ঝুঁকে প্রমিত দুচোখ ভরে শুষে নিচ্ছিল
যাবতীয় সুষমা। সিগারেট ধরিয়ে পরিবেশটাকে নষ্ট করতে ইচ্ছে করল না। সকালে কলঘর থেকে
একেবারে স্নান সেরে বেরিয়েছে। মা গ্যাসে জল গরম করে দিয়েছে। এতক্ষণে মনে পড়ল মাকে
একটা গিজার কিনে দিতে হবে। মাকে বলবে না। বললেই না -না করবে। ঠিক করল একেবারে কিনে
এনে হাজির হবে। এতদিন টিউশনের ওই কটা টাকায় কোনমতে চলেছে। একমাস হল এখানকার স্কুলে
চাকরি পেয়েছে। দ্বিতীয়বার এস এস সি দেওয়ার পরই মনে হচ্ছিল হয়ে যাবে। এতদিনে
নিশ্চিন্ত হয়েছে। কাল মাইনে পেয়েছে। টাকাগুলো হাতে পেয়ে ও বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে দিতেই
দেখেছিল টলটলে জল। বাবার ছবির সামনে নামিয়ে অস্ফুটে বলেছিল “ওকে
আশীর্বাদ কর। “তারপর জোর করে ওর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল,
“অনেক কষ্ট করেছিস। এবার একটু নিজের দিকে তাকা। “ অনেক রাতে মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি মায়ের পার্সে কিছু টাকা রেখে এসেছে।
সারাজীবন কত লড়াই করে মা ওকে আর দিদিকে মানুষ করেছে। বাবার সম্পত্তি বলতে ছিল এই
বাড়ি আর কিছু টাকা। প্রাইভেট কোম্পানি আর কিছুই করেনি। মা প্রথম টিউশন শুরু করল।
প্রমিত তখন ইলেভেন। মা কিছুতেই ওকে টিউশন নিতে দেয়নি। বলেছিল, “আগে হায়ার সেকেন্ডারি শেষ হোক।“
কিন্তু দিদির অত্যাচারে টিউশন করতে বাধ্য হল। দিদি
ছিল অবাধ্য ও স্বার্থপর। নিজেরটা খুব ভাল করে আদায় করতে পারত। মাকে কত যে কাঁদিয়েছে!
হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর একদিন পালিয়ে বিয়ে করে নিল শৈবালদাকে। মা বলত ,”দেখ! কবে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায়!”
কিন্তু মায়ের কথা ভ্রান্ত করে শৈবালদার ব্যক্তিত্ব আর শাশুড়ির চাপে দিদি অবশেষে বি এ পাশ করে
এক কন্যার জননী। মাঝে মাঝে বাড়ি এসে দিদি রেগে বলত, “কী
দজ্জাল শাশুড়ির পাল্লায় যে পড়েছি!”
মাও মুখের উপর জবাব দিত, “নইলে তোমার মত দজ্জাল বউকে কে সামলাবে!”
দিদি রাগ করত। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ফোন করত না। প্রমিত
উদ্বিগ্ন হলে মা বলত, “আরে দেখ না!
ওকে আমি জানি, কদিন তুইও চুপচাপ থাক, দেখবি
ঠিক এসে হাজির হবে!”
সেই দিদি এখন অনেক শান্ত। মা যেটা পারেনি মাসিমা সেটা
করে দেখিয়েছেন। মানুষ যে কখন কিসে বশ হয় কে জানে! ও ঠিক করল দিদিকে একটা ভাল শাড়ি
কিনে দেবে। পুচকুটাকেও।
(২)
শনিবার। চার পিরিয়ড হয়ে স্কুল ছুটি। সাইকেল নিয়ে
আয়েসি পায়ে হাঁটছিল প্রতিম। শনিবার এলেই ওর মন ফুরফুরে হয়ে যায়। খুব হাল্কা লাগে।
জীবন পাখির পালকের মত ভেসে যেতে চায়। স্কুল যাওয়ার রাস্তাটা খুব সুন্দর। দুদিকে বড়
বড় গাছ আর ঝিরঝিরে হাওয়ায় মনটা আজ উদাস। কুব কুব পাখির ডাকে হঠাৎ চমকে উঠল। ইলেভেন
টুয়েলভে এই ছায়াময় শ্যামলিমা মেখে ও আর খেয়া কতদিন একসঙ্গে বাড়ি ফিরত। দুজনে
দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে কত না বলা কথা যে এক নিমেষে বুঝে যেত! সবাই ঘুমিয়ে পড়লে
রাত জেগে চিঠি লেখার কী ধুম তখন!
“প্রমিত!”
চমকে পিছন ফিরে তাকাল। ওহ! হেনাদি। কতদিন পর দেখল!
প্রমিত যখন কোলকাতায় এম এ পড়ছে তখনই শুনেছিল হেনাদির বিয়ে হয়ে গেছে। হেনাদির
খুড়তুতো বোন খেয়া। আজ হেনাদিকে দেখে বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল প্রমিতের। কোনরকমে
নিজেকে সামলে বলল, “কেমন আছ?”
হেনাদি ওর সামনে এসে দাঁড়াল । খুঁটিয়ে মুখটা দেখে বলল,“একইরকম আছিস।“
প্রমিত আশ্চর্য হয়ে বলল, “মানে!”
“সেই নিষ্পাপ মুখ! সেই চোখ! তোকে দেখলে আমার খুব আফসোস হয়
জানিস!”
“কেন গো!”
“খেয়াটাকে কেমন জবরদস্তি বিয়ে দিয়ে দিল বল!”
এবার রাগ হচ্ছে প্রমিতের, “করল কেন! একবার আমাকে বলতে পারল না! চাকরি না করলে কী হয়েছে!
দুজনে টিউশন করে তো সংসার চালাতে পারতাম!”
“একদম ঠিক বলেছিস। সুযোগ ছিল না তা নয়। আমি কতবার বলেছিলাম,
প্রমিতকে বল।“
“জোর করে এখনকার দিনে একজন অ্যাডাল্ট মেয়েকে কখনও বিয়ে দেওয়া
যায়!”
“একদমই । কী যে হল ওর! বুঝতে পারি না।“
“ও নিজেই অনিশ্চয়তায় ভুগছিল! আমার উপর ভরসা করতে পারেনি।“
দুজনে হাঁটতে শুরু করল এবার। স্টুডেন্ট কলিগ সবাই
এগিয়ে গেছে। রাস্তাটা বড় নির্জন। এখন বোধহয় কথাটা জিজ্ঞেস করা যায়। খুব আস্তে
নিজেকে শোনানোর মত বলল, “কেমন আছে ও?”
হেনাদি ওর দিকে তাকাল, “তুই কিছু জানিস না। তোকে বলব বলেই আজ এই সময়ে এসেছি।”
প্রতিম আরও অবাক, “কী জানব!”
“খেয়া ফিরে আসছে বাবা মার কাছে।“
প্রতিম থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, “কিন্তু ওর তো ছোট বাচ্চা আছে!”
“অ্যাডপটেড”
“ কী!”
(৩)
নিজের ঘরে চুপচাপ বসেছিল প্রতিম। কী থেকে কী হয়ে যায়
কেউ বলতে পারে! যে খেয়ার উপর দুর্জয় রাগ ও অভিমানের পাহাড় জমেছিল তা কেমন যেন গলে গলে নেমে যাচ্ছে। ওর বরের নাকি পৌরুষত্ব নেই!
ও নাকি আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়! প্রমিতের সাহায্য চায়। ও কী করবে!
এসব কথা কার কাছে বলে হালকা হবে! মাকে বলে এই বয়সে আর
বিব্রত করতে চায় না। বহুদিন পর
মা বেশ হাত পা ছড়িয়ে জীবন কাটাচ্ছে।
ও আস্তে আস্তে ছাদে এসে দাঁড়াল। জ্যোৎস্নায় চারপাশ
ধুয়ে যাচ্ছে। চাদরটা গায়ে মাথায় জড়িয়ে নিল ভাল করে। এই স্তব্ধ রাত, চারপাশের নিঝুম পরিবেশ মনকে উদার হতে শেখাচ্ছে। খুব গভীরে,
মনের একেবারে অতলতলে, কাদাজলে জমে থাকা
ভালবাসাকে ভাসিয়ে আনল প্রমিত। ঠিক। যা ভয় করেছিল! যার জন্য ও প্রাণপণে ভুলে থাকতে
চাইত অতীতকে, সেই খেয়াকে ও আজও ভালবাসে। খেয়ার হারিয়ে যাওয়া
মুখখানা চোখের সামনে এনে অঙ্গীকার করল, হ্যাঁ, ও সাহায্য করবে খেয়াকে জীবনে ফেরার পথে।
0 মন্তব্যসমূহ