ঈর্ষা। খুব একটি সামান্য বিষয় নয়। দ্বেষ জনিত যাবতীয় বিদ্বেষের জন্মদাতা এই ঈর্ষা। ঈর্ষা একটি
সংক্রমক রোগ। এবং ভয়াবহ ভাবেই সংক্রমক। এই
রোগের প্রতিষেধক একটিই। সেটি ভালোবাসা। সেটি প্রেম। মায়া মমতা স্নেহ। যাকে আমরা ভালোবাসি। যাঁর প্রেমে পড়ি। তাঁকে আমরা ঈর্ষা করতে
পারি না। যাঁর প্রতি আমাদের মায়া মমতা
স্নেহ যত বেশি। তাঁর সম্বন্ধে ঈর্ষান্বিত হওয়ার সম্ভাবনা তত কম। এই বিষয়ে সাধারণ ভাবে আমাদের ভিতরে খুব একটা মতভেদ থাকার কথা নয়।
কারণ একটিই। আমরা প্রায় প্রত্যেকেই কম বেশি
ঈর্ষার মতোন একটি ভয়াবহ এবং সংক্রমক রোগের শিকার। এবং তার ঠিক বিপ্রতীপে। আমাদের ভিতরে প্রত্যেকের জীবনে ভালোবাসা প্রেম এবং মায়া মমতা
স্নেহের মতো প্রতিষেধক আবেগগুলি সক্রিয়।
সমস্যা এক জায়গায়। আমরা যাঁকে ঈর্ষা করি। তাঁকে ভালোবাসি না। আবার আমরা যাঁর প্রেমে পড়ে যাই। তাঁকে ঈর্ষা করতে পারি না। হ্যাঁ, বহু সময় বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ভালোবাসা কিংবা প্রেমের মোহ বা আবেগ কেটে গেলে সেই জায়গাটি
ঈর্ষার মতোন ভয়াবহ মনোবৃত্তিও দখল করে
নিতে পারে। যে ঈর্ষার পরিণতি কালকের ভালোবাসার মানুষের উপরে বিক্ষুব্ধ আক্রোশে গিয়েও পৌঁছাতে পারে। সংক্রমক রোগের প্রতিষেধকের ভ্যালিডিটি
এক্সপায়ার করে গেলে। রোগের কবলে পড়ার
মতোন।
একটা বিষয় বেশ স্পষ্ট। ঈর্ষা যে একটি ভয়াবহ সংক্রমক রোগ। আমরা সকলেই কম বেশি সেটি জানি। এবং গোটা
বিষয়টি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। এবং ভালোবাসা
প্রেম মায়া মমতা স্নেহের মতো প্রতিষেধকের খোঁজও আমরা রাখি। অথচ তারপরেও এই রোগের কবল থেকে আমরা প্রায় কেউই মুক্ত নই। ঠিক তখনই প্রশ্ন
যাগে মনে। তবে কি প্রেম ভালোবাসা মায়া মমতা
স্নেহের মতোন ঈর্ষাও একটি সহজাত মানবিক প্রবৃত্তি। মানবিক শব্দটুকুর ব্যবহার এই কারণেই যে, মানুষের প্রবৃত্তি তাঁর প্রকৃতিগত একটি বিষয়। আর মানুষের
প্রকৃতিগত প্রতিটি বিষয়ই আসলে
মানবিক। এবং এইখানে আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে। পশুজগতের ভিতরে ঈর্ষার বিশেষ কোন স্থান থাকে না। ফলে ঈর্ষাকে পাশবিক কোন
প্রবৃত্তি বলার সুযোগ আমাদের নেই বলেই
মনে হয়। জানি না, সকলেই এই বিষয়ে
সহমত হবেন কিনা। কিন্তু মানুষের জগতে ঈর্ষার দৌরাত্ম্যের তুলনায়। পশুজগতে এই প্রবৃত্তি সাদা চোখে ধরা
পড়ে না অন্তত। রাজপথের ধারে আস্তাকুঁড়ে
পড়ে থাকা খাবার নিয়ে পথের কুকুরদের ভিতরে যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। সেটিকে ঈর্ষাজনিত বিকার বা প্রবৃত্তি বললে খুব বড়ো ধরণের ভুল করবো আমরা। সেটি
শুধুমাত্র ডারুইন কথিত স্ট্রাগল ফর
এক্সিসটেন্স। সার্ভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট -এর মহাসত্য। তার বেশি বা কম কিছু নয়।
পশু জগতের সাথে মানুষের জগতের তুলনা থাক। ঈর্ষা যে মানুষের প্রকৃতিগত সহজাত একটি প্রবৃত্তি। আশা করি
এই বিষয়ে দ্বিমত হওয়ার কোন অবকাশ নেই।
আমরা স্বভাবজাত ভাবেই ঈর্ষার দাস। আমাদের শিক্ষা দীক্ষা এবং হৃদয়ের প্রেম ভালোবাসাই একমাত্র পারে, ঈর্ষার দাসত্ব থেকে আমাদেরকে মুক্তি দিতে। সমস্যা মুক্তির উপায় বা পথ নিয়ে নয়। সমস্যা, মুক্তির ইচ্ছা বা মুক্তির প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে সচেতনতার অভাবটুকুই। আমাদের ভিতরে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন। যাঁরা
অত্যন্ত দৃঢ় ভাবে মনে করেন। ঈর্ষা না
থাকলে জীবনে উন্নতি করা অসম্ভব। যাঁরা সুতীব্র ভাবে বিশ্বাস করেন। প্রতিযোগিতার প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্য লাভের পিছনে ঈর্ষাই অন্যতম প্রধান
অনুঘটক। বা প্রধান চালিকা শক্তি। আবার
এটাও ঠিক। আমরা অধিকাংশ মানুষই অতসব তত্ত্ব কথায় আগ্রহী নই। আমাদের সে সময়ও নেই। কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের ভালোর জন্য কম বেশি
ঈর্ষার দাসত্ব করে থাকি। এবং অধিকাংশ সময়েই
সচেতন ভাবে। এইখানে এসে নতুন একটি বিষয় সামনে এসে দাঁড়ালো তবে। আমাদের ভালো থাকা। অর্থাৎ, সেই ভালো থাকার সাথে ঈর্ষার একটা সংযোগ বা সমন্বয় সুত্র রয়ে
গিয়েছে বলেই। মনে করি আমরা। এই যে আমাদের
প্রতিদিনের জীবন। এই জীবনের প্রধানতম যে শর্ত। সেটি হলো প্রতিযোগিতা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদেরকে এই
বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে
হয়। প্রতিযোগিতার একটিই মাত্র লক্ষ্য থাকে। বাকি সকলকে পিছনে ফেলে রেখে এগিয়ে যেতে হবে। না হলে প্রতিযোগিতার পিছনের সারিতে পড়ে
থেকে কেবলই কপাল চাপড়াতে হবে আজীবন। এই
যে বাকি সকলকে পিছনে ফেলে নিজেকে সকলের আগে আগে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অদম্য এক তাগিদ। সেই তাগিদের বাস্তবায়নের পিছনে ঈর্ষার একটা বড়ো
ভুমিকা রয়েছে। সেই ভুমিকাটি আমরা টের
পেতে শুরু করি প্রায় ছেলেবেলা থেকেই। বিশেষ করে লেখাপড়া শেখার হাত ধরেই। আর এই বিষয়টা গড়ে ওঠে মূলত বাবা মা, অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানেই।
এই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই শৈশব থেকে কৈশোর পার হয়ে যৌবনে প্রবেশ করি আমরা। পারিবারিক সংস্কৃতি এবং
ঐতিহ্যের ভিতর দিয়েই ছেলেমেয়েরা ঈর্ষার সাথে
পরিচিত হয়ে ওঠে। এবং পরবর্তীতে কর্মজীবনে প্রবেশ করে প্রায় আজীবন দাসত্ব করে যেতে হয়, এই প্রবৃত্তির। সবচেয়ে বড়ো যে বিষয়টি। সেটি হলো। ঈর্ষার দাসত্ব করতে করতে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলির ভিত ক্রমেই আলগা হতে থাকে।
পারস্পরিক সম্পর্কগুলির ভিতরে ফাটল দেখা
দিতে শুরু করে। ন্যূনতম স্নেহ মায়া মমতা ভালোবাসার মতো সহজাত প্রবৃত্তিগুলি দিয়েই যে ফাটলগুলির অধিকাংশকেই মেরামত করে দেওয়া যায়। কিন্তু
দুঃখের বিষয়, সেই খেয়ালটুকুই আমরা হারিয়ে ফেলি। কিংবা খেয়াল রাখতে চাই না। সচেতন ভাবে।
রাখতে না চাওয়ার একট অর্থই হয়। ঈর্ষা
যে দ্বেষের জন্ম দেয়। এবং আমাদের সমস্ত চেতনা যখন দ্বেষে সমাচ্ছন্ন হয়ে উঠে আমাদের ভিতরে এক বিদ্বেষের জন্ম দেয়। সেই বিদ্বেষ আমাদেরকে সম্পূর্ণ
কব্জা করে নেয়। আর তখনই আমাদের
নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আর আমাদের হাতে থাকে না। সেই নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিদ্বেষের মতোন ভয়াবহ এক অপশক্তির হাতে। সে বড়ো সুখের সময় নয়। একজন
সাধারণ মানুষও তখন অসাধারণ ভাবে খারাপ
মানুষে পরিণত হয়ে যেতে পারে। এমন কোন দুষ্কর্মই নেই। যা, তখন বিদ্বেষের কবলে পড়া
কোন মানুষের অসাধ্য হতে পারে।
এমন নয়। এই সমস্ত কিছুই আমাদের অজানা। আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিতরেই এই বিষয়গুলি আমাদের কাছে সত্য এবং বাস্তব।
আমরা শুধু সামান্য সচেতনতার অভাবে টের পাই
না। জীবনের মূল বাস্তবতাকে আমরা যদি প্রতিযোগিতার ইদুঁর দৌড়ে সত্য করে তুলতে না ছুটি। জীবন বাস্তবতাকে যদি
পারস্পরিক সহযোগিতার মানবিক ভিতের উপরেই
দাঁড় করাতে পারি। একমাত্র তাহলেই। হয়তো কেন, নিশ্চিত ভাবেই আমরা তখন নিজেদেরকে ঈর্ষা জনিত দ্বেষ ও বিদ্বেষের ভয়াবহ পরিণতির কবল থেকে রক্ষা
করতে সক্ষম হব। আমাদের চারপাশের যে জীবন
বাস্তবতা। তার মূল ভিতটুকু দাঁড়িয়ে রয়েছে একমাত্র প্রতিযোগিতার উপরে। দেশ কাল জাতি ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে। আর আধুনিক বিশ্বের সমস্ত
ণত্ব এবং ষত্ব তো এই প্রতিযোগিতার নিরিখেই ঠিক
হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিষয়টি আদৌ ব্যক্তিগত ভাবে কারুর একার হাতেও নেই। মানুষের যে সভ্যতাকে আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তিলে তিলে গড়ে
তুলেছি। সেই সভ্যতারও ভিত সেই
প্রতিযোগিতা। সহযোগিতা নয়। যদি হতো। আর সব কিছু বাদ দিলেও। দেশে দেশে জাতিতে
জাতিতে মানুষে মানুষের এত হানাহানি
যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকতো না। প্রতিযোগিতার এই সভ্যতাকে সহযোগিতার সভ্যতায় সত্য করে তুলতে গেলে। শুরু করতে হবে একেবারে নিজের
মনের ভিতর থেকে। না, ব্যক্তিগত ভাবে বিচ্ছিন্ন থেকে নয়। ব্যক্তিগত ভাবেই বাকি সকলের সাথে
সংযুক্ত হয়ে, তবেই। ব্যক্তির সীমা ছাড়িয়ে একমাত্র তবেই সমষ্টিগত প্রত্যয়ে একদিন হয়তো
মানুষের সভ্যতা প্রতিযোগিতার অন্ধকার
থেকে মুক্ত হয়ে সহযোগিতার আলোকিত রাজপথে গিয়ে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। আর সেই পথে নিজেদেরকে সার্থক করে তুলতে গেলে। শুনতে ক্লিশে শোনালেও।
আমাদেরকে মনের ভিতরের সেই সহজাত
প্রবৃত্তিটুকু। যাকে আমরা প্রথমেই ঈর্ষা বলে চিহ্নিত করেছি। সেই সহজাত প্রবৃত্তির কবল থেকে উদ্ধার করতে হবে নিজেকে। নিজেদরকে। যেটি সম্ভব
একমাত্র ভালোবাসা প্রেম মায়া মমতা স্নেহ
ইত্যাদির মতো অন্যান্য সহজাত প্রবৃত্তিগুলির নিরন্তর চর্চা করতে করতেই। আর তখনই আমরা অনুভব করতে সমর্থ্য হব। প্রতিযোগিতা নয়।
আমাদের উন্নতি আমাদের সমৃদ্ধির আসল সোপান
একমাত্র সহযোগিতা। অন্য কিছু নয়। অন্য কিছু নয়।
২৯শে জুন’ ২০২২
কপিরাইট
শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত
0 মন্তব্যসমূহ