'রতনলাল ও চার পরী' নিয়ে দু'চার কথা'
মানুষের জীবন যত জটিল হয়েছে, জটিল হয়েছে তার সৃষ্টিও। কবিতা তো বটেই, সাহিত্যর নবীনতম শাখা, ছোট গল্পও দিন দিন হয়ে উঠছে
নির্মাণে অভিনব এবং জটিল। শুধু আজই নয়, শুনেছি গ্যেটেও
নাকি সেই যুগেই বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ছোটগল্পের নাম করে যা
চলছে, তা নেহাতই গল্প। অর্থাৎ ছোট গল্পের একটি পৃথক চরিত্র
আছে, যা নিয়ে মতবিরোধ তখনও ছিল এবং এখনও আছে।
এত কথা বললাম কারণ পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়ের 'রতনলাল ও চার পরী', ভেতরের পাতায়
টাইটেলের নিচে লেখা আছে 'এ
কালেকশন অফ শর্ট স্টোরিজ', অর্থাৎ, ছোটগল্পের
একটি সংকলন। এবং বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছে যথার্থই এটি একটি ছোট গল্পেরই সংকলন।
ছোট গল্পের যা কিছু প্রচলিত সংজ্ঞা এবং বৈশিষ্ট্য
পাপড়ির গল্পগুলির ক্ষেত্রে সেগুলো সবই প্রায় সুপ্রযোজ্য। সংকলনের আটাশটি গল্পের
অধিকাংশেরই মূল সুরটি কিন্তু, কবির
ভাষা ধার করে বলতে গেলে, "ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা, নিতান্তই সহজ সরল...।"
প্রত্যেকটি গল্প আয়তনে ছোট, কোনো কোনোটি তো, যেমন, 'এক চিলতে সময়', 'বিভাজন
রেখা', 'জীবন মরণের সীমানা' মাত্র
দেড়-দু পাতার। কোনো গল্পেই কোনো উপকাহিনি নেই, চরিত্রর
সংখ্যাও নিতান্তই প্রয়োজনীয় দু-চারটি। অথচ সেই স্বল্প পরিসরেই পরিস্ফূট হয়ে
উঠেছে আখ্যানের কেন্দ্রীয় ভাবটি।
তবে কোনো কোনো গল্পে "...নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ, অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হইয়াও না হইল শেষ"- রবীন্দ্রনাথের এই আপ্তবাক্যর ব্যত্যয় ঘটিয়ে
পাপড়ি ন্যারেটিভে গুঁজে দিয়েছেন তত্ত্ব ও উপদেশ। 'লৌহ কপাট'
তেমন একটি গল্প। কিন্তু আটাশটি গল্পের মধ্যে এক আধটি বাদ দিলে বেশির
ভাগ গল্পেই অনুসরণ করেছেন
গল্পবলার কথকতার আঙ্গিকটি। প্রায় পুরো আখ্যানটিই যেন বিবৃত হচ্ছে কোনো মরমী কথকের
দ্বারা। এবং সেই সব আপাত একরৈখিক, সহজ সরল গল্পের মধ্যেই ধরা
পড়েছে নাগরিক জীবনের জটিল মনস্তত্ত্বের বিচিত্র স্তর, বিভিন্ন
রঙ।
একদম আজকের সময়ের তরুণদের মানসিকতা, তাদের জীবন, অভ্যাস, সংস্কৃতি, তাদের প্রেম অপ্রেম আবেগ ভারি সুন্দর
ফুটিয়ে তুলেছেন 'জীবন মরণের সীমানা', 'হিল্লে' বা 'নানা রঙের দিন'-এর মতো গল্পে। আসলে গল্পগুলো পড়তে পড়তে টের পাচ্ছিলাম পাপড়ি কতটা
মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করেন তার চারপাশের মানুষদের। এই প্রজন্মের মানুষদের। এবং
বুঝতে পারছিলাম শুধু বহিরাঙ্গেই নয় ওর দৃষ্টি চারিয়ে যায় আশেপাশের মানুষদের
অন্তরমহলেও। 'ভূত ভবনের রহস্য', 'বাতাসে
স্বপ্ন ভাসে', 'শুধু ছবি'-র মতো গল্পে
বাস্তব জগত ছেড়ে পাপড়ি মুন্সিয়ানার সঙ্গে উড়াল দিয়েছেন কল্পলোকেও। লেখায়
পরিপার্শ্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার অভাব, সংলাপের অভাব
সত্ত্বেও টানটান সরল গদ্য
পাঠকদের মূল প্লটের প্রতি আকর্ষণকে ব্যাহত হতে দেয় না।
তবে এই সংকলনের সেরা গল্পগুলো হলো 'কার্গিল কার্গিল', 'লিলিথ অথবা পাপিয়া
মিত্রের গল্প', 'কোনো ধর্ম নেই', 'কাচের
ব্যবধান', 'সেরা দম্পতি প্রতিযোগিতা' ইত্যাদি। 'কার্গিল কার্গিল'-এ ছোট্ট ছেলে প্লুটোর
চোখ দিয়ে দেখা বিজন ও কথাকলি-র সম্পর্ক আমাদের ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
এমন আপাত সুখের পরিবার তো আমরা কতই চিনি আজকের আত্মকেন্দ্রিক দুনিয়ায়। 'কাচের ব্যবধান' গল্পে জলি ও তার মায়ের মধ্যে দিয়ে
আধুনিক ভোগবাদী জীবনের অবক্ষয় ও সর্বগ্রাসী লালসা ফুটে ওঠে অব্যর্থ ভাবে। 'লিলিথ এবং পাপিয়া মিত্রের গল্প'-তে লিঙ্গ-বৈষম্যের
ছবি এঁকেছেন অফিস রাজনীতির চালচিত্রে। সংকলেনর প্রথম গল্প 'সেরা দম্পতি
প্রতিযোগিতা' দাম্পত্যের মান-অভিমান, ভুল
বোঝাবুঝি নিয়ে এক অত্যন্ত নির্মল আনন্দের গল্প। আর যে গল্পটির কথা আলাদা করে
উল্লেখ না করলেই নয় তা হল, সংকলনের শেষ গল্প, 'রতনলাল ও চার পরী'। অপ্রাপ্তির অপার রহস্য পুরুষের মনের মধ্যে জাগিয়ে
রাখে যে গোপন কামনা, ভারি সুন্দর করে তার কথা বলেছেন রতনলালের জীবন কাহিনির আধারে।
আঠাশটি গল্পের প্রতিটির সম্বন্ধে আলাদা করে কিছু লিখছি না, বরং
পাঠকদের অনুরোধ করব সংগ্রহ করে পড়তে। সহজ ভাষায় সরল অথচ গতিমান চলনে বলা
গল্পগুলো পাঠকের হৃদয় স্পর্শ
করতে পারে সহজেই কারণ পাপড়ি আমাদের অতিপরিচিত আটপৌরে জীবনের চেনা পরিসর থেকেই খুঁটে নিয়েছেন অধিকাংশ
গল্পের বিষয়। এখনও যে সব পাঠকেরা ছোটোগল্পে কৃৎকৌশলের চেয়ে আখ্যানের বিষয়কেই
প্রাধান্য দেন, তাদের এ'বই ভালো লাগবে
বলেই আমার বিশ্বাস।
রতনলাল ও চার পরী
পরিবেশক- সাহিত্যজগৎ
মূল্য- ২০০/-
0 মন্তব্যসমূহ