সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

নীলম সামন্ত:গ্রন্থ পরিচয়:আপনি কিছুই জানেন না মঁসিয়ে:শীলা বিশ্বাস

 



 'আপনি কিছুই জানেন না মঁসিয়ে' সম্পর্কে

 

ভালোবাসার অনেক কোল, প্রেম, বন্ধু, মা, জানালা, আকাশ, দরজা, ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড৷ একটা সম্পর্ক আপনাকে ঠিক কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে আর তার বাঁক কোথায় কতটা সূক্ষ্ম কিংবা স্থূল তা নির্ভর করে রাসায়নিক প্রক্রিয়া চলে দুই ব্যক্তির মধ্যে৷ এক এক বাঁকে এক এক নাম নেয়। যাকে আমরা অধ্যায় বলতে পারি, আবার অংশও বলতে পারি। এতো কিছু বললে এটা পরিষ্কার হয় ভালোবাসা একটা পথ। ভালোবাসা একটা যাপন। ভালোবাসা জার্নি, যার পৌঁছোনোর জায়গা কোথায় সম্পর্কে আবদ্ধ মানুষগুলো জানে না৷ কবি শীলা বিশ্বাসের কাব্যগ্রন্থ 'আপনি কিছুই জানেন না মঁসিয়ে' খানিকটা এমন কথাই বলে। 

 মঁসিয়ে - ফরাসী শব্দটির মানে হল মশাই৷ মশাইয়ের উদ্দেশ্যে বলা ছত্রিশটি গদ্য কবিতা নিয়ে এই গ্রন্থটি আসলে রিপুর সাথে খেলতে থাকা যাপন উল্লাস। উল্লাস কেন বললাম? আসলে উল্লাস আমার বড় প্রিয় শব্দ। কারণ জীবন মানেই তো উল্লাস৷ গ্রন্থে বর্ণিত এই উল্লাস এক ডার্ক চকলেট প্রিয় প্রেমিকানারীর সলিলকি। তাঁর একাকিত্বের ভেতর সিঁড়ি উঠে গেছে। প্রতিটা ধাপে প্রণয়পুরুষের এক একটা প্রতিচ্ছবি।  

 সিরিজের প্রথম কবিতাতেই দেখছি প্রেমিকা তাঁর পুরুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন কথা না রাখতে পারার মুহুর্ত। বলছেন, পুরুষ এসেছিল ভালোবাসতে। যেমনটা রবিঠাকুরের ছত্রছায়ায় হয় বলে দাবী করেন অনেকেই৷ সেখানে শরীর কাম এসব সরিয়ে কেমন মন নিয়ে দাপাদাপি করে প্রেমের যাপন সাথে৷ মঁসিয়ে এমনই একজন পুরুষ। কিন্তু তাঁর কথা রাখতে পারেননি৷ 'কিছুদিন পরেই তাকে বিছানায় চাইলেন'  প্রেম হয়তো এমনই। কবিতায়, কথায়, চোখে ছুঁতে ছুঁতে কখন যে নাভি স্পর্শ করে স্তনের ওপর দাঁতের দাগ বসায় তা দুজনেরই বুঝে ওঠার আগে ট্রেন স্টেশন ছেড়ে দেয়৷ 

 "পালক পিতার কাছ থেকে মায়ের পরিচয় পেয়েছিলেন তবু মায়ের কাছে যাননি মঁসিয়ে।" মঁসিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর কন্যাসম প্রেমিকার পিতা হয়ে কোন এক সমুদ্রের ধারে৷ একটা সময় বোধহয় মায়ের থেকেও বেশি প্রেমিকার আঁচলে আশ্রয় দরকার হয়ে পড়ে। মাকে অবহেলা করতে পারলে বয়সে অনেক ছোট প্রেমিকাকে পারে না৷ কমবয়সীর আবদার আহ্লাদের ওপর কথা না চড়িয়ে শিশুসুলভ হয়ে যাওয়াও আরেক ধরনের প্রেম। সেখানে মা যে কখন কোন বেশে সম্পর্কে ঢুকে পড়েন আর আসল মা ভেসে যায় স্রোতে তা বোঝার জায়গা দেয় না মোহময়ী আবেগ নামক স্পর্ধা। মা ক্ষমা চাইলেও তাকাতে ভুলে যেতে হয়। এ যেন অটুট বাস্তব। কারুর গায়ে লাগতেই পারে কিন্তু এখানে সত্য ফুটে উঠেছে সূর্যফুলের মতো৷ 

 মঁসিয়ের উদ্দেশ্যে তার প্রেমিকার অনেক প্রশ্ন। যা পাঠককেও ভাবয়ে তোলে। কেন মঁসিয়ে খড়ের কাঠামোকে পূজো করেন? মনে পড়ছে শূন্য এ বুকে সিনেমাটির কথা। শিল্পী একটি নারী মুর্তির স্তন সুডৌল করতে করতে মিটিয়ে নিচ্ছেন রমনসুখ। তবে কি খড়ের কাঠামোতে মাটির প্রলেপ পড়লে দেবী নারী হয়ে ওঠে? যাকে দেখে তীব্র প্রেমের পুরুষরা পূজোর ঊর্ধ্বে গিয়ে অভ্যন্তরীণ খিদে মেটাতে নিজেকে আড়াল করে। 

 সিরিজের বারো নম্বর কবিতায় প্রেমিকার দৃঢ়তা দেখতে পাই। তিনি আশ্রয়দাতা। তিনি গঠনমূলক শক্তি।  অথচ তিনি মা হয়ে উঠেছেন। প্রতিটি নারীর মধ্যের মা আছে। তা অস্বীকার করা যায় না। পুরুষকে তারা ছেলের মতো শাসনের পাশাপাশি প্রেমিকার গন্ধ দিলেও প্রতিটি ভাঙনের মুখে মা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। 

 "আপনাকে উত্তেজিত করতে চেয়ে, মিথ্যে প্রমাণ করতে চেয়ে যতবার আঘাত দিতে চেয়েছি সেসব আঘাত আমার পিঠে কুঁজ হয়ে ফিরে এসেছে।" 

 পারস্পরিক লেনদেন সমস্ত সম্পর্কেই থাকে৷ যেভাবে থাকে আঘাতের প্রত্যাঘাত। কে যে কখন কাকে আঘাত করে আর তারই প্রত্যাঘাত কড়ায় গণ্ডায় ফিরে আসে তা জল ও রক্তের মধ্যে তফাৎ না করেই বিস্ময় প্রকাশ করে। তবে এসবের মাঝে যে সৌন্দর্য আছে তা কবির কথায় বোঝা যায়৷ তবে কি বলতে পারি ক্ষতস্থানের সৌন্দর্য নিয়েই প্রেমের সমর্পণ?  হয়তো তাই। আঘাত ছাড়া মজবুত হতে চাওয়া সম্পর্কগুলো কেমন যেন নৌকাহীন ভাসমান নক্ষত্রপুঞ্জ।  কেউ কাউকে দেখে না, নিজের মতো আলো দেয়। আলো ফুরোলে যে যার নিভে যাবে কালের স্রোতে। তাদের কিছুতেই কিছু আসে যায় না। কিন্তু যারা প্রতিটি আসাযাওয়া পরখ করে তাদের মধ্যে আঘাত-প্রত্যাঘাতের মালা চিরকারই অটুট। 

 সব শেষে কবি দেখিয়েছে মহাপ্রস্থানের পথ৷ সেখানে প্রেমিকা দুঃখিত। কিন্তু আঁকাবাঁকা আলোপথ মিশে গেছে আনন্দধ্বনি ধারায়৷ সমস্ত পোড়া দাগ তখন সরল। স্বভাবতই ভেতরের সাধুসঙ্গ বেরিয়ে এসে শুভকামনা জানায়৷ কারণ বিবাদের জায়গাগুলো নির্লিপ্ত।  অধিকারের জায়গায় তখন ঘাস ফোটার জন্য আলো পড়েছে৷ একসময় সমস্ত আগুন নিভে আসে। 

 বড্ড চার্মিং বললে কম বলা হয় শীলাদির এই গ্রন্থখানি৷ কবিতার গঠনে অনেক ভাঙাগড়া রয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট গদ্য কবিতার তরল অথচ তরল নয় লেখাগুলি কবিতার আকারে মনের নানান স্তরের চিত্রকল্প৷ এতো সহজ ভাসায় সমস্তটাই গোছানো ব্র‍্যান্ডেড ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং-এর মতো নিট অ্যান্ড ক্লিন। কিংবা বলা যায় সাধের বাগান। যেখানে রঙ আছে। আকাশ আছে। আছে জীবনের নানান ঋতু। 

 এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করে আবার শুরু করার মতো এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছে আলোপৃথিবী প্রকাশনা৷ আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই৷ বইটির জন্য রইল এক আকাশ শুভকামনা। ও হ্যাঁ, অসাধারণ প্রচ্ছদটি করেছেন সমীরণ ঘোষ। তাঁকেও জানাই অভিনন্দন৷ শীলাদিকে আমার ভালোবাসা এমন সুন্দর সিরিজ উপহার দেবার জন্য। 


আপনি কিছুই জানেন না মঁসিয়ে:

শীলা বিশ্বাস

প্রকাশক : আলোপৃথিবী

মুদ্রিত মূল্য -১৬৫/-

 


নীলম সামন্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ