ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কাব্যভাবনা
তিনি
বলেছেন—আমরা কেউই জানিনা কেমন করে একটা কবিতা জন্ম নেয়....
আন্দালুসিয়ার
নদী,
জল, ঘোড়া, জিপসি, বলদ,
ষাঁড়, ফ্লামেঙ্কো গান লোরকার কবিতার দেহে শিরায় শিরায়
লীন হয়ে থাকে। রূঢ় বাস্তবকে সরাসরি না দেখে কবি দেখেন
তার প্রতিবিম্ব।
অসীমের
প্রতি যে অকৃত্রিম আকর্ষণ তাঁর কবিতায় প্রত্যক্ষ করি তাতে কোনও চোখ-ধাঁধানো আড়ম্বর
নেই,
আছে এক স্নিগ্ধ সারল্য। লোরকা-বিশেষজ্ঞ গিয়ের্মো দিয়াস প্লাহার মতে
লোরকার সৃষ্টি আন্তর্জাতিক নয়, কিন্তু সর্বজনীন। আপাতবিরোধী
মন্তব্য সম্ভবত এইজন্যে তিনি অতিমাত্রায়
আন্দালুসিও হয়েও এমন কাব্য সৃষ্টি করেছেন যা পৃথিবীর সর্বত্র পাঠকের মনোগ্রাহী হয়ে
ওঠে। স্পেনের নোবেলজয়ী কবি হুয়ান রামোন হিমেনেস-এর
মতে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ‘খাঁটি আন্দালুসিও’।
লোরকা কবিতায় চিত্রকল্প নির্মাণ করেন, রঙের জাদু ছাড়া তাঁর কবিতা উপভোগ করা যায় না। মনে রাখা ভালো যে, লোরকা ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতরচয়িতা এবং পিয়ানো-শিল্পী। ফলে কাব্যে এবং নাটকে এইসব গুণের সমাহার দেখা যায়।
১৯৩৩ সালে আর্জেন্টিনার বোয়েনোস আইরেস শহরে এক
উল্লেখযোগ্য ভাষণ প্রদান করেন লোরকা যার
শিরোনাম ‘দোয়েন্দের খেলা এবং তত্ব’, অত্যন্ত পরিশীলিত ভাষায় কবি নান্দনিকতা এবং
কাব্যের সম্পর্ক নিয়ে মনোগ্রাহী আলোচনা করেন। এই বক্তব্যে কবি
তিনটি মৌলিক ভাবনার প্রতীকের উল্লেখ করেন, সেগুলো হল— মিউজ, দেবদূত
এবং দোয়েন্দে। এই তিন প্রতীক তিনটি শক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত যা
হল—“কল্পনা, উদ্দীপনা, বিযুক্তি”। এই শক্তিগুলো গভীর
কবিতা সৃষ্টির অনুপ্রেরণা, এরাই জীবনের মৌল ভাবের সঙ্গে আমাদের সংযোগ ঘটায় এবং প্রসঙ্গত কবি
‘দোয়েন্দের’ প্রসংগ নিয়ে আসেন। DUENDE (দোয়েন্দে)
শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘প্রেতাত্মা’ কিন্তু আন্দালুসিয়ার মানুষের বিশ্বাস যে,
‘দোয়েন্দে’ এক
অতিপ্রাকৃত শক্তি এবং এর প্রভাব না থাকলে শিল্পী শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না,
আবার এ এক দাহিকা শক্তি,
শিল্পীকে মৃত্যুচেতনায়
আচ্ছন্ন করে। ‘দোয়েন্দে’
সৃষ্টি ও ধ্বংসের শক্তি, দৈব নয়, মাটিতেই তার অস্তিত্ব। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা কাব্যসৃষ্টিতে
এই শক্তির প্রভাব স্বীকার করেছেন। মৃত্যুচেতনা
আর ‘দোয়েন্দে’ কবির কাছে অভিন্ন। জীবন, মৃত্যু, আবেগ আর রক্তপাত—এই বিষয়গুলো গার্সিয়া লোরকার রচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাঁর মতে শিল্প এবং কাব্য গভীর
বাস্তবতা উদ্ঘাটন করে, উন্মোচন করে তার নির্যাস। সেইজন্যে লোরকা খুব অল্প বয়সেই বাস্তবতার
নিজস্ব ব্যাখ্যা নির্মাণ করেন। বিবরণধর্মী কোনও বিশ্লেষণ তাঁর মনঃপুত নয়। ‘পুরাতনী গানের কবিতা’ (Poema del cante jondo) কাব্যগ্রন্থে
লোরকা যে অতলস্পর্শী জগৎ উদ্ঘাটন করেন তার সঙ্গে মেলে না মানুয়েল মাচাদোর একই
বিষয়ের রচনা। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে লোরকার ‘নিউ ইয়র্ক’ অন্য
লেখকদের দেখা ‘নিউ ইয়র্ক’ থেকে আলাদ। মনে রাখা ভালো যে, লোরকার কাব্যভাবনার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে থাকে
‘দোয়েন্দে’-তত্ব। তাই তথাকথিত যুক্তির বদলে তাঁর কবিতায় অনায়াসে চলে আসে
যুক্তিহীনতা এবং জাদু। ফেদেরিকো
গার্সিয়া লোরকার প্রায় সমগ্র কাব্যসাহিত্যে, বিশেষত শ্রেষ্ঠতর সৃষ্টিতে, দেখা যায় এক স্বপ্ন-মদিরতা, অবাস্তবের খেলার সঙ্গে রহস্যময় মুগ্ধতা। শিশুর কাছে কবি যে চাঁদের রূপকথা
নিয়ে আসেন তার মধ্যে থাকে অযৌক্তিক কিছু শক্তি, অন্ধকারাবৃত, কল্পনার
দূরতিক্রম্য জগৎ, যা সমকালীন কোনও কবির রচনায় দেখা যায় না। এইরকম কল্পনার সৃষ্টি দেখা যায় পিকাসোর অমর সৃষ্টি ‘গের্নিকা’তে, মার্ক চাগাল-এর ইহুদি জীবনের কল্পনায় আর মিরোর
ছবিতে অবশ্যই। সেই সময় কিংবা
তার আগে যে কালজয়ী সাহিত্য কিংবা শিল্পসৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে ‘দোয়েন্দে’র
অপ্রাকৃত শক্তি কাজ করেছে বলে মনে করা হয়। তার প্রভাবেই
লোরকার চোখে ধরা দেয় ‘নিউ ইয়র্কের’ নারকীয় চিত্র আর তিনি রচনা করেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ
কাব্যগ্রন্থ ‘নিউ ইওর্কে কবি’
এমন চূড়ান্ত উদ্দীপনায় ভেঙ্গে যায় নিয়মকানুন, কবিতা নিজের পথ নিজেই খুঁজে নেয়। ১৯২৬ সালে কবি-বন্ধু হোর্হে গিইয়েন-কে লোরকা যে চিঠি লেখেন তাতে কবিতার
বিষয় এবং আঙ্গিক নিয়ে বিহ্বলতা উপলব্ধি করা যায়:
“এখনও এমন
কবিতা লেখা হয়নি যা তরবারির মতো হৃদয় বিদ্ধ করে দেবে। সংগীতশিল্পী (বাখ) যেমন আবেগ সৃষ্টি করেন তা
ভেবে আমি অবাক হয়ে যাই কারণ তার মধ্যে থাকে জটিল কিন্তু সম্পূর্ণ এক অঙ্ক”।
‘তরবারি যেমন হৃদয় বিদ্ধ করে দেয়’ : এই ছিল লোরকার
কাব্যভাবনার মূল সুত্র। এই ভাবনার উৎস ছিল ‘দোয়েন্দের খেলা এবং তত্ব’।
আরেক কবি-বন্ধু হেরার্দো দিয়েগোর ‘কাব্যসংকলনের’
অন্তর্ভুক্ত ‘কাব্যিক’ শীর্ষক রচনায় তিনি লেখেন :
‘...ঈশ্বরের দয়ায় আমি কবি হতে পেরেছি— কিংবা শয়তানের
কৃপায়-, তার সঙ্গে আছে আঙ্গিক নিয়ে অধ্যাবসায় এবং কবিতা কী তা
বোঝার অবিরাম চেষ্টা’।
ঈশ্বরের বিকল্প হিসেবে যে শয়তানের উল্লেখ করা
হয়েছে তার মধ্যেই প্রচ্ছন্ন আছে ‘দোয়েন্দে’। গার্সিয়া লোরকার
বিশিষ্টতা এইভাবে অনুধাবন করা যায়; তাঁর আয়ত্বে ছিল নিখুঁত পরিশীলিত আঙ্গিক; তথাপি তিনি ডুব দিয়েছিলেন
বাস্তব এবং বাস্তবোত্তর সাগরের গভীরে, হোক না সে
ইতিহাসের নির্মমতা কিংবা মৃত্যুর বীভৎস আতঙ্ক, হোক সে ইচ্ছের অবাধ উড়ে চলা বা সীমার শেষ দেখার
আনন্দ এবং তার সঙ্গে মিলেছিল ‘অন্য জগতের ধারণা’। আঙ্গিক কেবল
কাঠামোর ভিত, তাতেই শেষ হয় না সবকিছু; এটা
মাধ্যম, তা কখনও লক্ষ্য হতে পারে না। সারল্যে পূর্ণ লোরকার কবিতা, আতিশয্যহীন, কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হতে পারে ঠিক তার বিপরীত। “বাস্তব বেঁধে রাখে কল্পনাকে; যা
নেই তা নিয়ে কল্পনা করা যায় না”; কল্পনা সম্বন্ধে এই কথা বলেছিলেন লোরকা। তাঁর কবিতায় রূপকালঙ্কার স্পষ্ট, পরিচ্ছন্ন, কিন্তু এ কথাও ঠিক যে কবি তার মধ্যেই আবদ্ধ
থাকেন না। “স্পেনের
পুলিশের লোকগাথা” (Romance de la Guardia
Civil Espanola) কবিতাটিতে জিপসিদের শহরের
আকাশে যে চাঁদের কথা বলা হয় সে উদ্বিগ্ন, অস্থির, অশুভ শক্তি সে নয় কিন্তু জীবন ও মৃত্যুর সংকেত
তার মধ্যে দেখা যায়, ধ্বংসের ইঙ্গিতবাহী। এখানে বলা যেতেই পারে যে, লোরকা ছিলেন
প্রতীকবাদী, কিন্তু সম্পুর্ণভাবে তা নন, তাঁকে কোনও ‘ইজম’ দিয়ে বেঁধে ফেলা যায় না। সমস্যাটি সহজ নয়। আকাশের সঙ্গে মাটির সম্পর্ক, উচ্চতম শিখর আর সর্বনিম্ন স্তর, বিশাল বাস্তব
জগতের প্রশ্ন, সহজাত এক ধারণা থাকতে পারে, কিন্তু কাব্যভাষা আমাদের চমকিত করে, কবির বাঁধনছেঁড়া প্রকাশ, কিন্তু তা অপ্রয়োজনীয় নয়, সবকিছুর মধ্যে প্রসারিত জগতের কথা কবি বলেন। প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্যে কবি বারবার পান্ডুলিপি সংশোধন করেন।
উদ্দীপনা-সঞ্জাত গার্সিয়া লোরকার কবিতার পেছনে আছে
ঐতিহ্যের টান এবং সমকালীন সাহিত্যের প্রভাব। ১৯১৭ সালে
প্রকাশিত হয় হুয়ান রামোন হিমেনেস-এর “সদ্য বিবাহিত এক কবির দিনলিপি” এবং ততদিনে
প্রাগ্রসর সাহিত্যিক মহলে ‘মোদের্নিস্মো’ (আধুনিকতা) আন্দোলন প্রায় অবক্ষয়ের মুখে
যদিও তার প্রভাব যে ছিল না তা নয় এবং সেই কারণে লোরকার যৌবনকালে রচিত কবিতাকে বলা
হয় সেই আন্দোলনের ফসল। নিকারাগুয়ার ‘মোদের্নিস্তা’ বিশ্বখ্যাত কবি রুবেন
দারিও’র প্রভাবে লালিত তিনি কিন্তু পুরোপুরি তা নয়; গ্রানাদার যুবক গভীর মনোযোগ
দিয়ে পাঠ করেছিলেন রোয়েদা (Rueda) , হুয়ান রামোন হিমেনেস এবং মাচাদো ভাইদের কবিতা। লোরকার প্রথম
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতার বই’ যেখানে উপরোক্ত কবিদের, বিশেষভাবে রুবেন দারিওর প্রভাব ছিল যথেষ্ট।
‘মোদের্নিস্মো’ আন্দোলনের জনক রুবেন দারিওর শৈলী শুধু নয়
লোরকা গ্রহণ করেছিলেন তাঁর কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গিও। এই জগতের
প্রাণস্বরূপ চালিকা শক্তি শরীরী আবেদন, কামনা-বাসনার
উচ্চকিত প্রকাশ এবং সর্বোপরি সর্বেশ্বরবাদ এসেছিল রুবেন দারিওর কাব্য থেকে। ১৯৩৪ সালে পাবলো নেরুদার সঙ্গে বিখ্যাত সংলাপে গার্সিয়া লোরকা অকপটে
স্বীকার করেন যে, রুবেন দারিওর কাছেই তিনি পেয়েছিলেন
কবিতা রচনার প্রেরণা। তবে কবি-জীবনের শুরুতে তাঁকে বিহবল এবং বিদ্রোহী করেছিল
জীবনের রহস্যময়তা, রূপকথার জ্ঞান এবং সুতীব্র দুঃখবোধ
যার পরিচয় পাওয়া যায় কবিতায়। প্রথম দিকের গদ্যে এবং কবিতায়
রুবেন দারিও-সুলভ ইউরোপীয় পরাকাষ্ঠার প্রকাশ স্পষ্ট। রুবেন দারিওর
কবিতা পাঠে এবং তাঁর মাধ্যমে লোরকা
জেনেছিলেন বিখ্যাত প্রতীকবাদী কবিদের, , যেমন, Baudelaire, Rimbaud, Verlaine, Lautreamont যাঁদের ছাপ বেশ ধরা পড়ে তাঁর রচনায়। তার আগে লোরকা পাঠ
করেছেন স্পেনে জনপ্রিয় Victor Hugo। (যে নামগুলো স্পেনীয় নয় সেগুলো লেখা হয়েছে রোমান হরফে—অনুবাদক)।
ফেদেরিকো
গার্সিয়া লোরকার মতো এক রচয়িতার বিকাশপর্বে সমস্ত প্রভাবের কথা বলা খুব সহজ কাজ নয়। তবে ‘কবিতার বই’ গ্রন্থের শেষের কবিতাগুলো স্বকীয়তায় উজ্জ্বল, কবিতার মধ্যে পরিণত বোধ দেখা যাবে আরও পরে। দার্শনিক
সেনেকার (SENECA) মতো ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা মৃত্যুর গীত রচনা করেন যেন এ এক অতি
স্বভাবিক পরিণতি। কবিতা ও নাটকে
মৃত্যূর আসা যাওয়া, কখনও প্রচ্ছন্ন, কখনওবা একেবারেই বে-আব্রু। মহাজাগতিক রহস্য মৃত্যু ও জীবন— এই দুই
মেরুতে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কাছে জীবন বড়ো প্রাণবন্ত, বেহিসেবি আগুনের মতো গণগণে তার
স্বভাব আর মৃত্যু বড়ো যান্ত্রিক, শীতল অথচ যুক্তিসমত তার
অস্তিত্ব। এই দুইয়ের
প্রতীক মাটি আর চাঁদ।
‘কবিতার
বই’ গ্রন্থে যে বৈশিষ্ট্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল— ঐতিহ্যবাহী পটভূমি আর গভীর
মমত্ববোধের প্রকাশ। চিত্রকল্প, ছন্দ, উপমা আর বিষয়বস্তু নতুন কিন্তু শিকড়বিহীন নয়। সহজতম ভাষায় প্রকাশিত হয় শিশুর নিষ্পাপ
হাসি আর বয়ঃসন্ধিকালের অনুচ্চারিত যন্ত্রণা কাব্যিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সদ্যযৌবনের উদ্দামতা, বেদনা আর হতাশা প্রকৃতির নানা
সৃষ্টির মধ্যে প্রকাশিত হয়— জলের বহুমুখী লীলায়, মাটির সহনশীলতায়, গাছের স্নিগ্ধতায়, আকাশের তারার নীরব অস্তিত্বে। ভাবাবেগের আতিশয্য থাকলেও কবিতায় নেই
পুরনো অলঙ্কারের ভার, অবাঞ্ছিত শব্দের অসংযত প্রয়োগ নেই, নেই জ্ঞানগর্ভ বাণী প্রচারের
চেষ্টা।
জল
হয়ে ওঠে এক ভাবনা। সুখ, দুঃখ, মৃত্যু কিংবা অবিনশ্বরতার প্রতীক জল। ‘La luz me troncha las alas y el dolor de mi tristeza va
mojando los recuerdos en la fuente de la idea/’আলো কেটে নেয়
আমার ডানা আর বিষন্নতার ব্যথা সিক্ত করে যত স্মৃতি, ভাবনার ঝরনাধারায়’। ‘স্বচ্ছ ছোটো নদী’ (Arroyo claro) এবং স্থির শান্ত ঝরনা’(Fuente serena) শিশুসংগীত হয়ে
অবিনশ্বর আত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়। কবি বলেন—“ ‘কবিতার বই’ গ্রন্থে
যৌবনের যন্ত্রণা, সংশয়, উদ্দাম উচ্চাশার সঙ্গে জীবনের এক উচ্ছল সংগীত
প্রাণে এক দীপ জ্বালিয়ে যায়; গ্রামের সরল প্রতিচ্ছবির মধ্যে শৈশবের আবেগ আর স্বপ্ন
ধেয়ে চলে প্রকৃতির নানা বর্নময় সৃষ্টির তরঙ্গে”। অধ্যাপক
সুদেষ্ণা চক্রবর্তী সম্ভবত সেই কারণে লিখেছিলেন-“স্প্যানিস কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া
লোরকা যে কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করেছেন সেখানে মানুষ ও প্রকৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, কোথাও বন্ধু, কোথাও বা
শত্রুরূপে”। সমুদ্রের দ্বিমুখী আচরণ, মানুষের মতো, সৃজনশীল এবং ধ্বংসাত্মক।
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কাব্যসৃষ্টির জগতে ‘কবিতার
বই’কে শুধু সম্ভাবনাময় বললে উপেক্ষা করা হয়, কিন্তু মনে রাখা জরুরি যে, এটি তাঁর
গীতিধর্মিতার এক পরিণত রূপ।
গার্সিয়া লোরকার কাব্যভাবনার মূলে থাকে এক হতাশা। অশ্বারোহী ছুটে যাচ্ছে কিন্তু
গন্তব্যস্থানে পৌছবে কি না ঠিক নেই; সবই যেন শৈশবের স্বপ্নের মতো, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ হয়ে যায়; তেমন
হতাশা বন্ধ্যা পুরুষ কিংবা সন্তানহীনা নারীর। নাটকে এবং
কবিতায় বারবার উঠে আসে এই যন্ত্রণা। এই বিফলতা, ট্র্যাজিক ভবিতব্য দেখা যায় দুটো
স্তরে—অতীন্দ্রিয় এবং ঐতিহাসিক, সত্তাতাত্বিক
এবং সামাজিক। এরা কখনও পরস্পরে সম্পৃক্ত থাকতে পারে কিন্তু তাদের
সম্যক উপলব্ধি করার জন্যে বিচ্ছিন্নভাবে
দেখাই সঙ্গত। ‘নিউ ইয়র্কে কবি’ পুঁজিবাদী সভ্যতার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর
চিৎকার কিন্তু তাছাড়াও আছে সময়ের প্রেতাত্মা, অপ্রতাশিত মৃত্যু।
দুই ভিন্ন মেরুতে বিভক্ত কবির ভাবনা। বিপলবী আশাবাদ থেকে অনেক দূরে গিয়ে লোরকা সমস্ত নিপীড়িত মানুষের মুখে কথা
দিয়ে সময়ের অসহায়ত্ব ব্যক্ত করেন যেন এর পরিত্রাণের পথ তাঁর জানা নেই। মানুষের কষ্টভোগই যেন ভবিতব্য।
কিন্তু লোরকার কাব্যে প্রেম দুর্বার, যৌনতা ছাড়িয়ে প্রেম হয় শাশ্বত। কামনারহিত হয় না প্রেম, কিন্তু একথা বলা
যাবে না যে, লোরকা প্রেমের আধ্যাত্মিক উত্তরণের
কথা জানতেন না। ‘ওয়াল্ট
হুইটম্যানের উদ্দেশ্যে ওড’ কবিতাটিতে তা স্পষ্ট হয়। এও সত্যি যে, কবি
প্রেমের আদিরসাত্মক প্রকাশে অকপট, শরীরী মিলনের
উচ্ছলতার সংগীত রচনা করেন সুন্দর শব্দে। বিশেষ কোনও
যৌনতাকে কবি অগ্রাধিকার না দিয়ে সর্বপ্রকার
যৌনতার বন্দনা করেছেন। ‘অন্ধকার প্রেমের সনেট’ কবিতায় সমকামের কথা
থাকলেও কবি বলেন, ‘কবির বুকে ঘুমায় প্রেম’, ‘কবি প্রেমকে বলেন, চিঠি লিখো আমাকে’। কবির প্রেম দ্ব্যর্থবোধক। সামাজিক রক্তচক্ষুর ভয়ে নয়, কবি প্রেমের কবিতাকে সর্বজনীন করতে চেয়েছেন।
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতায় থাকে এক অন্ধকার গোপন ব্যথা, এক গুপ্ত ক্ষতের মতো, অধিকাংশ প্রেমের কবিতায় এই যন্ত্রণার আভাস পাওয়া
যায়, কখনও
স্পষ্ট, কখনও প্রচ্ছন্ন। এই যন্ত্রণা একেক সময় মরিয়া হয়ে বিদ্রোহ করে। ‘জিপসি লোকগাথা’
শীর্ষক মহাকাব্যিক রচনায় প্রেমের বিলাপ, অধিকাংশই নারীর
কন্ঠে শোনা যায়। পুরুষেরও বিলাপ আছে, পরিত্যক্ত বঞ্চিত প্রেমিক ‘প্রেমের বিফলতায় মৃত’। কিন্তু পরে কখনও কখনও যৌনাবেগের তাড়নার উপশম হলে আনন্দের প্রকাশ দেখা যায়, যেমন Divan de
Tamarit শীর্ষক সঙ্গীত-সঙ্কলনে। (শিরোনামের বাংলা প্রতিশব্দ ঠিক হচ্ছে না। আন্দালুসিয়ার ‘গাসেলা’ অর্থাৎ
‘গজল’ গানের গ্রন্থ)। সঙ্গীতে প্রকাশ পায় প্রেমের সুখ, প্রেমের পূর্ণতা।
লোরকার কবিতার আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ‘বন্ধ্যাত্ম’। সমকামী ভালোবাসায় যেমন তেমনই ‘ইয়ের্মা’ নাটকে প্রেমের নিষ্ফলতাজনিত
বিয়োগান্ত পরিণতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ‘নিউ ইয়র্কে কবি’ গ্রন্থের একটি
কবিতার শিরোনাম ‘আদাম’ যেখানে উর্বর আর বন্ধ্যা পুরুষের সম্পর্ক হয়ে ওঠে করুণ এবং
‘আলোর শিশু’কে পুড়ে যেতে হয়। এই কবিতায় অজস্র মৃত শিশুর
মৃত্যুর সঙ্গে বন্ধ্যাত্বের বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
হতাশা আর বেদনার সঙ্গে কবিতায় থাকে মৃত্যু। সেইজন্যেই কবি পেদ্রো সালিনাস সঙ্গতভাবেই বলেছিলেন যে, মৃত্যুর পথেই লোরকা জীবনকে দেখেছিলেন। লোরকার মধ্যে ছিল জীবন ও মৃত্যু নিয়ে দোলাচল। আমৃত্যু রোমান্টিক ভাবধারার উত্তরাধিকার বহন করে
চলেছিলেন তিনি। কবি সব সৃষ্টির মধ্যে ‘দোয়েন্দে’র ছায়া দেখতেন বলে
লোরকার সাহিত্যে সর্বত্র থাকে অশুভ এক সংকেত, শুভ-অশুভের চিরায়ত দ্বন্দ্ব তাঁর সৃষ্টির এক
বিশেষত্ব। প্রেম এবং মৃত্যু, প্রেমের বিপ্রতীপে মৃত্যু। এই বিশ্বাসের সংগে সম্পৃক্ত লোরকার
অস্তিত্ববাদের সংকট। এই ধারায় কবির চোখে ধরা দেয় প্রান্তিক মানুষের টিকে
থাকার প্রশ্ন। তাঁর কবিতায় অনায়াসে স্থান পায় ডাকাত, জিপসি আর
পরিত্যক্ত প্রেমিক।
মানুষের এক বিশাল হতাশার নাম মৃত্যু। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার ভাই ফ্রান্সিস্কো গার্সিয়া লোরকা তাই লিখেছিলেন-
“ফেদেরিকোর মনে হয় যে, মৃত্যুর জন্যে
অপেক্ষা করতে হয় না, কারণ দিনের কোনও এক সময় সে এসে আমাদের চমকে দেয় এবং সব মৃত্যুই একরকমের হত্যা”। তাই বোধহয় লোরকার সাহিত্যে হিংসার ছড়াছড়ি, হিংসা যে মৃত্যুর খাঁটি মুখ। মৃত্যু আবার একরকমের শাস্তি। কবির একটি বিখ্যাত কবিতার শিরোনাম
‘ইগ্নাসিও সাঞ্চেস মেহিয়াস-এর জন্য বিলাপ’ (Llanto
por Ignacio Sanchez Mejias)। এই স্মরণীয় ‘এলিজি’ লেখার সময় কবি
যেন এক বিশেষ বোধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন, একটানা লিখে শেষ
করলেন চার অংশের বিশাল কবিতা। বন্ধুরা বলেছিলেন- অনবদ্য! স্পেনীয়
সাহিত্যে এই কবিতা এক বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত আছে আজও।
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার বিশ্বাস ছিল ক্যাথলিক ধর্মে
কিন্তু চার্চের ভূমিকায় ছিলেন বিরক্ত। একটি কবিতার নাম ‘পূজাবেদির মহামহিম পবিত্রতম স্তোত্রের প্রতি
ওড’(Oda al Santisimo Sacramento del
Altar)। এই কবিতায় কবি চার্চের ভূমিকার নিন্দা করেছেন। কবি এখানে সমাধিস্থ মানুষের
সর্বাঙ্গীন মৃত্যুর ধারণা নস্যাৎ করে বলেন যে, মৃত্যুর পরেও চেতনা জাগ্রত থাকে। এই মত একান্তই কবির নিজস্ব, এর মধ্যে
সর্বজনীন সত্য আছে কি না তা বিতর্কমূলক। প্যাগানযুগে মৃত
ব্যক্তির জাগ্রত হওয়ার কথা কবির জানা ছিল এবং পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি যে, মেক্সিকোর বিখ্যাত লেখক হুয়ান রুলফোর ‘পেদ্রো
পারামো’ এবং কলম্বিয়ার নোবেলজয়ী লেখক গার্সিয়া মার্কেস-এর ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’
উপন্যাসে মৃত ব্যক্তির স্বাভাবিক আচরণ, জীবিত মানুষের মধ্যে বিচরণ। সুতরাং লোরকারও
এমন বিশ্বাস থাকতেই পারে।
প্রসঙ্গত আসে ‘সময়’ সম্পর্কে কবির অভিমতের প্রশ্ন। অপ্রকাশিত SUITES কাব্যগ্রন্থের কবিতায় দেখা যায় কবি বলছেন যে, একটি বস্তু বা ঘটনা অন্য সময় অন্যরকম হতে পারত। মানুষের আত্মপরিচয়, আমি (YO) বদলে যায়, সময় যায়, সময় আসে, ঘড়ির কাঁটায় কবির সময়ের হিসেব চলেনা। কবি মানতেন যে, এক জীবনে এই জগতের সবকিছু জানা সম্ভব নয়, তাই একটি কবিতায় তিনি লেখেন “La respuesta es la misma/pregunta disfrazada” অর্থাৎ ‘উত্তর একই/প্রশ্নের ছদ্মবেশ’। তাই কবি জীবনের বাঁধা সময় নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।
তদানীন্তন সময়ের
প্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, লোরকার কবিতায় বিপ্লবী আদর্শের উচ্চকিত ঘোষণা নেই যা সেই
সময়ের অন্য কবিদের রচনায় ছিল। কিন্তু ‘স্পেনীয় পুলিশের লোকগাথা’(Romance de la Guardia Civil espanola)কবিতাটি যেন পিকাসোর ‘গের্নিকা’ ছবির এক নাট্যরূপ, অনেক আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ের শাসনব্যবস্থা এবং
রাজনীতি হত্যা করেছে ‘উৎসবের শহরকে’(la
ciudad de fiesta) কিছুদিন পরেই লোরকা লিখবেন
নিউ ইয়র্কের কবিতা যেখানে আর্থিক মন্দাঘটিত হাহাকার শোনা যাবে অসামান্য কাব্যিক
পরিবেশনে। কবির চোখে ধরা পড়েছিল যে, ক্যাথলিক চার্চ ফ্যাসিবাদ এবং তাদের সেনাবাহিনীর
সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। কবিতার শিরোনাম ‘রোমের প্রতি চিৎকার’ (Grito a Roma)।
কবি আন্তোনিও মাচাদো বলেছিলেন- তোমার কবি তোমার কথা ভাবে
(tu poeta piensa en ti)। লোরকার ধারণা একরকম হলেও প্রকাশের
ভঙ্গি ভিন্ন। তিনি
লিখলেন—‘বালিকাটি আমার সামনে হেঁটে যায়’। এই অসহায়
বালিকার কথা তিনি কতবার বলেন ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে।
লোরকা বিশ্বাস করতেন কাব্যের ভাষায় থাকবে রূপকালঙ্কার। বাস্তবতার বিভিন্ন স্তরের জন্যে তিনি রূপকের আশ্রয় নিতেন। মাটি আর আকাশ, উচ্চ এবং নিম্নস্থান, নিকট এবং দূর, পার্থিব এবং অপার্থিব সবকিছুর মধ্যে মিলনের সেতু নির্মাণ
করে রূপক এবং অলঙ্কার। ‘চাঁদের বাহু নড়ে’ – এই বাক্যে কবি তার আলোর কথাই বলতে চান। এমন অজস্র প্রকাশ আছে লোরকার কবিতায়। ‘চোখের ভেতর
দেখি পাখিদের অবিরাম মিছিল্, ‘চোখে জ্বলে ওঠে অশ্বারোহীদের ল্যান্ডস্কেপ’, ‘তোমার চোখে
দেখেছি দু দুটো পাগল গাছ’। অন্যত্র বলেছেন জিপসি মেয়ের ঢোলক
‘পার্চমেন্টে লেখা চাঁদ’; বাতাসের ইচ্ছেয় বাচ্চা মেয়েটার পেট হয়েছে ‘একটি নীল গোলাপ’;
হাওয়ায় হাওয়ায় আখের খেত হয়েছে ‘ছায়াবীথির বাঁশি’; একটি লড়াইকে বলা হয়েছে এক ‘ষাঁড়’
যে ‘দেওয়াল বেয়ে ওপরে ওঠে’; মাটিতে রক্তের ধারার মধ্যে প্রবেশ করেছে ‘সাপের বোবা
সংগীত’; ভোর হওয়ার আগে পলাতক অন্ধকার যেন ‘ছায়ার মাছ’। এমন অনেক রূপকের
দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় লোরকার কবিতায়। আসলে কবি এমন এক জগৎ নির্মাণ করতে
চান যেখানে এইসব রূপকের অন্তরালে থাকে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের আত্মপরিচয়। তত্বকথায় না গিয়ে বলা যায় যে, এই দৃশ্যমান
পৃথিবী এত প্রাণের স্পর্শে উচ্ছল, এত অনুভূতি-সম্পন্ন বলেই তার মধ্যে সবকিছুর স্থান হয়ে
যায়। আন্দালুসিয়ার জিপসিদের
ছোট্ট জগতের মধ্যেই যেন নিউ ইয়র্কের বিশাল ব্যাপ্তি উপলব্ধি করা যায়। চাঁদ নেমে আসে গুহায়, নিয়ে যাবে জিপসি বালককে যেমন রক্তের ফোঁটা খুঁজে চলে কী
কেউ জানে না। নিউ ইয়র্কের
‘মৃত্যুর নাচ, মিশে যায় হলুদ চাঁদের গায়ে’; ‘নক্ষত্রের আঙ্গুলে রক্তের ফোঁটা খোঁজে আলো’। সমস্ত বোধের মিলন এখানে। অশ্বারোহীর গানে এক আশ্চর্য আলঙ্কারিক ‘ফুল’
ফুটলে চোখের দেখার সঙ্গে মিশে যায় সুগন্ধ, ‘চাকুর ফুলের গন্ধ’থেকে রক্ত গড়ায়...। দর্শন, স্পর্শ এবং ঘ্রাণ একসঙ্গে খেলা করে যে কবিতায়
তার শিরোনাম ‘অবিশ্বাসী বিবাহিতা’ :
তার ঘুমন্ত
স্তন স্পর্শ করলাম,
আর সঙ্গে
সঙ্গে খুলে গেল আমার জন্যে
জলজ
সুগন্ধি ফুলের তোড়া।
লোরকার প্রিয়
প্রতীক চাঁদ, জল, রক্ত, অশ্ব, ঘাস, ধাতব বস্তু ইত্যাদি। এইসব প্রতীক যৌনতা, প্রেম, জীবন, মৃত্যু, শক্তি এবং অস্ত্র ইত্যাদির সূচক। প্রাচীন সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক ছিলেন কবি। তাঁর রূপকে থাকে ‘মিথ’-কেন্দ্রিক শব্দ কিন্তু
তিনি বলেছিলেন যে, অনেক সময় ‘মিথ’ তিনিই উদ্ভাবন
করেছেন। আন্দালুসিয়ার পুরাতনী গানের সূত্রে লোরকার জিপসিরা আসে
আন্দালুসিয়ায়; তাদের জীবনে যে ‘মিথ’ আছে তা বেদনার, , প্রেমের, ওরা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম: সেইজন্যে চাঁদ
এসে নিয়ে যায় বালকটিকে, জিপসি মেয়েকে তাড়া করে হাওয়া আর কাম্বোরিও(কবিতার
চরিত্র) জলে ছুঁড়ে দেয় লেবু আর জল হয়ে যায় সোনা। এইসব ‘মিথ’ আসে
বিভিন্ন সূত্রে। মূল সুত্র বাইবেল, যিশু আসেন আত্মত্যাগের আদি
প্রতিমা হয়ে। ধ্রুপদী সাহিত্য আর পূরাণ থেকে পার্কাস, ভেনাস এবং
অন্যান্য বড়ো দেবদেবী কাব্যের জগতে চলে আসেন কবির ইচ্ছেতে।
প্রতীকের
প্রসঙ্গে আসে প্রতীকী অঞ্চল। আন্দালুসিয়া লোরকার সেই স্থান, রোমান ও মুসলমান প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত আন্দালুসিয়া, উজ্জ্বলতার পাশে
বেদনার অন্ধকার, অব্যক্ত
যন্ত্রণা আর প্রেমের ভবিতব্য মৃত্যু। আন্দালুসিয়া কখনও দৃশ্যমান, কখনও অদৃশ্য। তার স্থান সেক্সপিয়ারের
ইংল্যান্ডের মতো অথবা মহান ট্র্যাজেডির জন্মদাতা গ্রিসের মতো। নির্যাতন এবং
প্রেমের আন্দালুসিয়া থেকে আসে লোরকার প্রিয় ফ্লামেঙ্কো গান, জিপসিদের কন্ঠে গান
হয়ে ওঠে আপন জীবনের স্বর, যদিও তার জন্ম
হয়েছে খ্রিস্টান, মুসলমান এবং ইহুদি সংস্কৃতির মধ্যে। আন্দালুসিয়ার
জিপসিরা নিজেদের মতো করে নিয়েছে ফ্লামেঙ্কো গান।
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কাব্যভাবনায় তিনটি পর্ব আছে। ‘কবিতার বই’ মুখবন্ধ হলেও শৈল্পিক বোধে উত্তীর্ণ, ১৯২১ থেকে ১৯২৭ সালের মধ্যে প্রথম
পর্ব, লেখা হয় SUITES(শব্দটি ফরাসি সংগীতের, তাই রোমান হরফ) ‘পুরাতনী গানের কবিতা’ এবং ‘জিপসি
লোকগাথা’। এই সময় ‘বিশুদ্ধ কবিতা’ রচনা ছিল লোরকার লক্ষ্য।
১৯২৭ সালের মধ্যভাগ থেকে পরাবাস্তবতা(Surrealism)
প্রভাবিত করে লোরকাকে। তখন থেকে শুরু হল গদ্য কবিতা রচনা। তার চূড়ান্ত রূপ
‘নিউ ইয়র্কে কবি’(Poeta en Nueva York) যার সম্বন্ধে কবি স্বয়ং বলেন ‘ শিরা খোলার কবিতা’। লোরকার স্বকীয় ভাষার কবিতা যেখানে একেবারেই ভিন্ন ধরণের রূপক এবং প্রতীক
দেখা যায়।
Divan de Tamarit এবং সনেট লেখেন লোরকা যেখানে কবিতায় প্রকাশিত হয় অন্তরঙ্গতা এবং প্রেম। এই দুটি সংকলনের মধ্যবর্তী সময়ে বুল-ফাইটার বন্ধু ইগ্নাসিও সাঞ্চেস
মেহিয়াস-এর মৃত্যু কবিকে শোক- বিহবল করে দেয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই লেখেন ‘বিলাপ’। ‘ইগ্নাসিও সাঞ্চেস মেহিয়াসের জন্যে বিলাপ’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতাটিতে ‘জিপসি লোকগাথা’
এবং ‘নিউ ইয়র্কের কবি’র শৈলী এবং আবেগ জাদুমন্ত্রের কাজ করেছে। এর মধ্যেই কবি রচনা করেন ‘গালিসিয়ার ছটি কবিতা’।
এই তিন পর্বের মধ্যে যেমন এক ঐক্যবোধ আছে তেমনই আছে
বৈচিত্র। নিজের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন কবি, সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য কবিতা যা স্পেনের আধুনিক
কাব্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে গণ্য হবার মতো। ‘পুরাতনী গানের
কবিতা’ থেকে ‘গান আর গান’, ‘জিপসি লোকগাথা’
থেকে ‘নিউ ইয়র্কে কবি’, ‘বিলাপ’ আর সনেট’, ‘ওড’ থেকে ‘গদ্যকবিতা’—প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের ভাবনা আলাদা, অভিজ্ঞতা ভিন্ন, যেন এইসব কবিতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘খেলা আর তত্ব’:
‘কিন্তু পুনরাবৃত্তি করা কিছুতেই সম্ভব নয়। এই ব্যাপারটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ‘দোয়েন্দে’
কখনও পুনরাবৃত্তি করে না, যেমন ঝড়ের মধ্যে
সমুদ্রের রূপ বদলায় না’।
রচনা— তরুণ কুমার ঘটক।
মো— ৮৯৬১০ ১২২১০
সূত্রঃ
১। OBRAS COMPLETAS-1(POESIA)/রচনাসমগ্র-১(কাব্য)।
২। পশ্চিমবংগ পত্রিকা, আগস্ট, ২০০০(লোরকা
সংখ্যা)
৩। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা—তরুণ ঘটক।
৪। Federico Garcia
Lorca---Guillermo Diaz Plaja.
0 মন্তব্যসমূহ