ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে
বিমলা। সব সময় মনে হয় এ সংসার আর তার জন্য নয়। নিখলিশ চলে যাবার পর এই সংসারে সে
একেবারেই বেমানান। শুধু ভৎসনা নিয়ে কেমন করে কাটাবে সারাটা জীবন।অথচ মরে যাবে সে
সাহসও হয় না।কয়েকবার
যে ভাবেনি তাও নয়।
বড় জা কথা বলা বন্ধ
করেছে। বাড়ির কাজের লোকগুলো পর্যন্ত কেমন বাঁকা চোখে তাকায়।
ধীরে ধীরে বাগানের দিকের
জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। চারিদিক সবুজে সবুজ। বড় বড় গাছগুলো কেমন মাথা তুলে
দাঁড়িয়ে আছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ্দুর ঝিলিক দিচ্ছে। মনটা ভরে গেলো।কষ্টগুলো যেন
একটু একটু করে সরে যেতে লাগল।
একজন কাজের মেয়ে এসে খবর দিলো "বৌদিমনি একটি
ছেলে এসেছে। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।"
অবাক লাগে
বিমলার।জিজ্ঞাসা করে , ' কি নাম
ছেলেটির?'
-"নাম বলছে
অমূল্য চরণ"।
নামটা শোনার সাথে সাথে এক
অপার্থিব স্নেহ বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে।অস্ফুটে বলে ওঠে,
- "অমূল্য
এসেছে? ওকে বাইরের ঘরে বসাও । আমি আসছি।"
বিমলা ছুটে চলল অন্দর মহল
থেকে বার মহলে।
অমূল্য মুখখানা শুকনো। যেন আষাঢ়ের কালোমেঘ জমে আছে।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে।
বিমলাকে দেখেই অমূল্যর
সেই মেঘে যেন বর্ষা নেমে এলো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,"দল আমি ছেড়ে দিয়েছি দিদি। যে আদর্শে মেতে ছিলাম,সে মোহ ভেঙে গেছে তাই জানাতে এলাম।"
- "আপোষ
করোনি ঠিকই করেছো ।কিন্ত তোমাকে যে আমার বড় দরকার অমূল্য। শোনো, আমি একটা অনাথ আশ্রম করবো ঠিক করেছি। তুমি জমি দেখো। একটা সুন্দর পরিবেশে
গড়ে তুলবো এক আনন্দ আশ্রম। তুমি থাকবে তো আমার সাথে।"
-"হ্যা ,দিদি আমিও তো চাই দেশের সেবা ,দশের সেবা করতে।
দেখতে দেখতে কখন দিন ,মাস পেরিয়ে বছর ঘুরে
গেল। মনের মতো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে বিমলা অস্থির হয়ে ওঠে।
অনেক খুঁজে
শান্ত নির্জন পরিবেশে মনের মতো জায়গা পাওয়া গেল। সেখানেই গড়ে উঠলো বিমলার আনন্দ
আশ্রম। কচিকাঁচাও জুটে গেল তাঁরই দয়ায়।
ছোট্ট আশ্রমে সব কচি কাঁচাদের নিয়ে বেশ দিন কেটে যায়
বিমলার। তার সমস্ত গয়নাগাটি দিয়ে সে গড়ে তুলেছে এই আনন্দ আশ্রম।
অমূল্যই সব ব্যাবস্থা
করেছে। বড় ভালো ছেলে!
চারদিকের
গাছপালার মাঝে এই ছোট্ট আশ্রম। আবার একটি রাধা গোবিন্দের মন্দিরও আছে।বিমলা রোজ ফুল
তুলে মালা গেঁথে তাঁর পায়ে অর্পণ করে।এভাবে দিন কেটে যায় । আসে রাত। চারদিকে আলো
জ্বালিয়ে দেয় পাহারাদার।
সেদিন দোল
পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় থৈ থৈ চারিধার।বিমলা ঘর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ায়। বুকের ভিতরটা
হু হু করে ওঠে। এক মুহূর্তে জীবনের খাতাটা তার চোখের সামনেখুলে গেল। কেমন করে হারিয়ে গেল জীবনের সব ভালো ভালো
বছর। কেমন এক ঘোর। সব কিছু বুঝে ওঠার আগেই যেন সব শেষ হয়ে গেল।
না !না ! সব ভুলে
যেতে চায় সে। তাই তো সে গেরুয়া বসনে ঢেকেছে নিজেকে।
কেন তবু এত কষ্ট
হচ্ছে ! মনকে বোঝাতে ভাবে, এ সন্ন্যাস তো তার প্রাপ্যই ছিল।
বুদ্ধ,শ্রীচৈতন্য তো স্বেচ্ছায় সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। তাই বলে কি প্রচ্ছন্ন সন্ন্যাস ছিল না–
যশোদা ,বিষ্ণুপ্রিয়ারও।
ঠিক তারই মতো।
0 মন্তব্যসমূহ