সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

অরুণাংশু ভট্টাচার্য/জুন'২০২২

 


নির্মাণ বিনির্মাণের বৈদেশিক তত্ত্বটাই  ভুল

 

                             

বাংলা কবিতায় পুরাণের নির্মাণ ও বিনির্মাণের বিষয়টি একটু অস্পষ্টই মনে  হল। পুরান বা পুরাণের অনুষঙ্গ যদি বাংলা কবিতার থাকে, তাহলে সেটা নতুন করে কিছু নির্মাণ, এমনটাই বোধ হয় ঠিক। যেমন এখন কোনও কবিতার কোথাও যদি পুরাণের কোন কাহিনি, চরিত্র বা বিষয়ের ব্যবহার বা উল্লেখ থাকে,  তবে তা পুরাণের ফটোকপি হওয়ার কথা নয় । সেই অর্থে পুরাণকে বলা যায় সৃষ্টি । সৃষ্টির নানা ব্যাখ্যা পরবর্তী কালে হতেই পারে বা হয়েছেও। এই প্রেক্ষিতে আমাদের ধারণায় এমন মনে হয় যে, বিষয়টির শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল —পুরাণ সৃষ্টি ও নির্মাণ। অর্থাৎ ক্রিয়েশন এবং কনস্ট্রাকশন। তারপর তা বাংলা কবিতায় কেমন ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এবং স্বাভাবিকভাবে সেই অনুষঙ্গের নতুন কিছু ব্যঞ্জনা বর্তমান লেখার মধ্যে দাবি করে বলেই তো তার অন্যরূপ দেওয়ার চেষ্টা । তা এক ধরণের নির্মাণ হতেই পারে। পুননির্মাণও বলা  যেতে পারে, পুননির্মাণ অর্থে একই রকম আর একটা গড়া হল। –এটাও ভাবা ভুল নয় । কিন্তু  বিনির্মাণ শব্দের অর্থ  কী ?এখানে একটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন এই যে, বিনির্মাণ শব্দটি কোনও বাংলা  শব্দ নয়। বি- উপসর্গের যে ব্যাখ্যা তাত্ত্বিকরা আমাদের দিয়েছেন, তা সর্বাংশে ভুল। আর একটি ভুল হচ্ছে  টাইম এবং স্পেসের পরিপ্রেক্ষিতে জীবন ও সাহিত্যকে তত্ত্ব নাকি এগিয়ে নিয়ে যায়। এমন চূড়ান্ত ভ্রান্ত  ধারণাকে ভিত্তি করে কী করে যে তাঁরা জীবন ও সাহিত্যকে ব্যাখ্যা করেন বোঝা ভার

    যাই হোক, বাংলা অভিধানকে যদি বিন্দু মাত্র মান্যতা দিই, তাহলে দেখা যায় এই শব্দটি কোনও অভিধানে এখন পর্যন্ত নেই। নির্মাণ শব্দটি আছে, পুননির্মাণও আছে। বিদেশি তাত্ত্বিকরা ডিকনস্ট্রাকশন নামে একটি শব্দ কিছুকাল ধরে ব্যবহার করছেন, বিনির্মাণ তারই বাংলা বলে অনুমিত হয়। এখানে কেউ কেউ এমন কথা বলতেই পারেন যে, বাংলা ভাষায় এমন বহু শব্দ আছে, যে সমস্ত অভিধানে খুঁজলে মিলবে না।  অবশ্যই কথাটি ঠিক। অন্য ভাষা থেকে শব্দ চলে আসা বা নতুন শব্দ তৈরি হওয়া – এগুলি সব ভাষারই বৈশিষ্ট সবকালেই। কিন্তু কোনও তত্ত্ব যা  দিয়ে শুধু সাহিত্য নয়, অনেক কিছুর ব্যাখ্যা করার প্রবণতা আমাদের মধ্যে আছে, সেই শব্দটি অভিধান গ্রহণ করবে না, এটা এখন পর্যন্ত খুব যুক্তি পূর্ণ মনে হয় না। যাই হোক, যাকে বিনির্মাণ বলা হচ্ছে, বিশেষত বাংলা কবিতার এই আলোচনায়, ধরে নিলাম বিষয়টি পুরাণের কোনও বিশেষ প্রেক্ষাপটে নতুন করে নির্মাণ। তো তা বাংলা সাহিত্যে, কবিতায় তো বটেই নতুন  কোনও বিষয় নয়; বরং বহু প্রাচীন । বিদেশি তাত্ত্বিকেরা ডিকনস্ট্রাকশন বলতে যা বোঝাতে চান, তাকে  বাংলা ভাষার কোনও কোনও অতিতাত্ত্বিক বিনির্মাণ নাম দিয়ে ব্যাপারটিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছেন ছাড়া কিছুই নয়। এখানে বেশি বলার বা বেশি উদাহরণ দেওয়ার কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু একটি কন্টেন্টকে বুঝতে বা ব্যাখ্যা করার রলাঁ বার্ত যেমন বলতে চান, কন্টেন্টটির স্বাভাবিক অর্থের বাইরেও তা অন্যভাবে দেখার অভ্যাস বা তজ্জনিত প্রক্রিয়া মানুষের মধ্যে থাকে। সেটা ঠিক সোজাসুজি কোনও ডিসকোর্সের টেরিটোরিতে পড়ে না। আগে যে নির্মাণ তাকে ভেঙে ফেলে নতুন নির্মাণের যে গল্প অর্থাৎ কাঠামোটাকে ভেঙে দেওয়া – এটাই বিনির্মাণ আর একটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে আগের নির্মাণ নতুন কাঠামোয় নতুন ভাবে নির্মিত হওয়া বিদেশি তাত্ত্বিকদের যাবতীয় ব্যাখ্যা এর উপর ভিত্তি করেই । যা প্রথমে বলতে চেয়েছিলেন ফার্দিনান্দ দ্য সোস্যুর। ১৯১৬ সালে তাঁর ক্লাস নোট গুলিকে একত্রিত করে 'কোটস ইন জেনারেল লিঙ্গুইস্টিকস'  – নাম দিয়ে তাঁর ছাত্ররা তা প্রকাশ করে। তাতেই ভাষার পেছনের এই কাঠামো বা স্ট্রাকচারের কথা বলা হয়। রলাঁ বার্ত এই নতুন কাঠামোরই নাম দিয়েছিলেন উত্তর  কাঠামোবাদ বা পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম। জাঁক দেরিদা এই তত্ত্বকে ছাড়িয়ে ডিকনস্ট্রাকশনের কথা বললেও আসল বস্তু কিন্তু তাই থেকে গেল। ফলে বিষয়টিকে জটিল থেকে জটিলতর করা ছাড়া আর কিছুই করতে  পারলেন না, পারেনওনি। বরং কনটেন্টের প্রতিটি পাঠই নতুন – এরকম ভ্রান্ত ধারনার জন্ম দিয়েছেন। যেসব নিজেরাও বিশ্বাস করতেন না। ব্যাপারটা গিয়ে এমন  এক পর্যায়ে দাঁড়ায় যে, লুই আলথুসার একসময় নিজের অস্তিত্বেও সন্দেহপ্রকাশ করেছিলেন।    

 

    এবার আমাদের দিকে লক্ষ  করি । প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে (যাকে পুরাণ বলে অনেকেই ভুল করেন)  নির্মাণই বলুন আর বিনির্মাণই বলুন, এসবের হাজারো উদাহরণ রয়েছে। দু-একটির উল্লেখ করে এই আলোচনা শেষ করব । মনে করুন, অসুরবিনাশিনী দুর্গার রূপ। পুরাণের কথাই বলি, পুরাণই বলছে, ওই সময়  দুর্গা একাধিক রূপ ধারণ করেছিলেন। পুরাণ অবশ্য কারও কারও সৃষ্টি। কবি ছিলেন কিনা আমাদের জানার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যে চিত্র তিনি বা তাঁরা এঁকেছিলেন , সেসব যে কোন ক্রিয়েশন ও কন্সট্রাকশান, যেমন রক্তবীজ নামের অসুরকে যখন মেরেও শেষ করা যাচ্ছে না কেন না , তাঁর রক্ত একফোঁটা মাটিতে পড়লে  হাজার রক্তবীজের জন্ম হচ্ছে—এরকম একটা সময়ে দেবী এমন এক রূপ ধারণ করলেন, যাতে রক্ত বীজের রক্ত মাটিতে পড়বে না, দেবীর মুখেই পড়বে। এই রকম একটা চিত্র কল্পনা কি খুব স্বাভাবিক মনে হয় ? বাস্তবে থাকে নাকি এমন ? দেবীর রূপ যেভাবেই হোক, একটা ধারণা নিয়ে আমাদের কল্পনায় আছে। কিন্তু  তাঁর দশ মহাবিদ্যার চিত্র তো স্রষ্টারই কল্পনা। তত্ত্ব দিয়ে বিচার করলে সেও তো সেই পুরনো কাঠামোকে ভেঙে ফেলে নতুন কাঠামো নির্মাণ। আবার রামায়ণে যখন রাবণের দশ মুণ্ড কল্পিত হয়, তখন ভারতীয় প্রেক্ষিতে তার যে দার্শনিক ব্যাখ্যাই থাক না কেন; সেখানে তো নির্মাণ বিনির্মাণ একসঙ্গে । কী করে একটি রাক্ষস নামধারী জীব সোনার হরিণে পরিণত হয় ? কল্পনাই তো । ডিকনস্ট্রাকশন বলুন পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম বলুন, সেও তো সেই নতুন কাঠামোই। রাক্ষস থেকে সোনার হরিণ, - আগের নির্মাণ কে ভেঙে ফেলে নতুন নির্মাণ – উদাহরণটি ঠিক কি না । তারপর যদি মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধে আসি  সেখানে সমস্ত তত্ত্বের চূড়ান্ততম পর্যায় লক্ষ করি না কি আমরা ? কোথায় তখন এই সমস্ত তত্ত্বের কথা ! এবং এখানে একটা বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে প্রাচীন কাহিনি বা কাঠামোকে ভেঙে তাকে নতুন  করে গড়ার মধ্যে আমাদের লেখকদের কোনও অনিশ্চয়তার প্রশ্ন কখনই ছিল না। বিভ্রান্ত করার মত এই সমস্ত ভিত্তিহীন তত্ত্বের কচকচিও ছিল না ।নিজেদের দৃঢ় ও প্রবল বিশ্বাস থেকেই তাঁরা ওই সব বিনির্মাণ করেছেন। যা অনেক সময় নিজেকে ভেঙে ফেলার প্রক্রিয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষের দিকে ছবিকেই তাঁর অন্যতম সঙ্গী করে নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষ এক জায়গায় লিখেছেন, --“ সমসাময়িক এই পরিবেশের মধ্যে আমরা দেখতে পাই আলোড়িত আন্দোলিত দ্বিধা বিচ্ছিন্ন এক সজীব মানুষ হিসাবে। নিজের বিরুদ্ধে নিজেকে যিনি উশকে দিচ্ছেন বারে বারে, আন্দোলন চলছে নির্মাণ আর সৃষ্টির মধ্যে, মুখোশ আর মুখশ্রীর বিরোধে যিনি ছিঁড়ে যাচ্ছেন কেবলই, আর তাঁর থেকেই তিনি ক্ষণে ক্ষণে তুলে আনছেন রবীন্দ্রনাথেরই এক নবীন মূর্তি। ইয়েটস-এর কবিতায় বড়ো রকমের এক বদল হয়েছিল তাঁর জীবনের শেষার্ধে , সে কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই নিজেক ভেঙে ফেলা আর নতুন করে নিজেকে গড়ে  তোলার তেজে রবীন্দ্রনাথের আর কোনও দোসর আছে বলে মনে হয় না

     শেষে শুধু একটাই কথা । যে সমস্ত তত্ত্বের ভিত্তিটাই অবিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে , ষে সব তত্ত্ব সমূহকে অভ্রান্ত ভেবে শিল্পসাহিত্যের প্রাণ ও লাবণ্য কখনও অধিবাসিত হয় না । আর তত্ত্বকে ভিত্তি করে তারপর সাহিত্য রচিত হবে, এ ধারণা আরও ভুল এবং মারাত্মক।      

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে জারিত এই প্রবন্ধ সবার অবশ্যপাঠ্য l

    উত্তরমুছুন
  2. অরুণাংশু আপনার নাতিদীর্ঘ এই রচনাটি একটি ভিন্নধর্মী চিন্তার দরজা খুলে দিলো। বিস্তারিত সাক্ষাতে।অপরূপ

    উত্তরমুছুন
  3. তোমার এই ভাবনা আমায় সমৃদ্ধ করেছে এ কথা অকপটে বলতে পারি ভাই...

    উত্তরমুছুন