গ্রন্থের নাম-মেয়েদের কথা/প্রতিভা সরকার
গ্রন্থের নাম- ঊর্ণনাভ/ যশোধরা রায়চৌধুরী
আলোচক পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়
গ্রন্থের
নাম-মেয়েদের কথা
লেখিকা-প্রতিভা সরকার
প্রকাশক- নবজাতক প্রকাশন
তরবারির চেয়ে শক্তিশালী হল
কলম। সেই কলমের চালিকা শক্তি হল চিন্তাশক্তি - যার আধার হল মন। কালি কলম মন লেখে
তিনজন। যে কোনো অন্যায় ব্যবস্থাকে অন্যায় বলে চিহ্নিত করানোর জন্য প্রয়োজন সমাজের
মনটাকে প্রস্তুত করানো। সমাজের মনকে তৈরি করার জন্য দরকার কিছু সচেতন মন, যা ধরবে কলম। এমনই এক সচেতন মনের মানবী হলেন এই গ্রন্থের
লেখিকা, যিনি ভূমিকাতে স্পষ্ট বলে দেন " শুধু
বিপ্লবের সেবাদাসী নন এমন সাহসিনী মেয়ের পাশাপাশি রয়েছেন পরম্পরার কারণে মার খেয়ে আসা
মেয়েরাও। দু'কথা রয়েছে সংসারসীমান্তে থাকা সোনাগাছির
মেয়েদেরকে নিয়েও। লোক আদালতে, মহিলা কমিশনে...বিচার চেয়ে
আসেন যাঁরা, সেই মেয়েরাও উপস্থিত এখানে। তবে সবচেয়ে
বেশি জোর দেওয়া হয়েছে... নানা আন্দোলনে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপর।"
প্রায়শই একটু এগিয়ে থাকা
মেয়েরা যখন অত্যাচারিত মেয়েদের হয়ে কথা বলতে যায় বা লেখে, তখন একটা অংশ তীব্র ভর্ত্সনা ভাসিয়ে দেয়- আপনি কি শ্রমজীবী? আপনি কি অত্যাচারিত? আপনি এসি ঘরে বসে মেয়েদের নিয়ে বলছেন বা লিখছেন। তাতে তাদের কী উপকার হচ্ছে?
প্রথম কথা হল, পুকুরে ঢিল ফেললে তার তরঙ্গ অনেক দূর অবধি পৌঁছে যায়। তাই, যতক্ষণ সমাজে একটিও মেয়ে অত্যাচারিত হবে ততক্ষণ পর্যন্ত
অন্য কোনো মেয়েই তার আঁচ থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, লেখাটা একটা বিরাট কাজ। এক কথা বারবার লিখে লিখে সমাজের মাথায় পেরেক ঠোকার মত হাতুড়ি মেরে মেরে ঢুকিয়ে দেবার
চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া জরুরী।
এই কাজ অনেকেই করছেন।
তাঁদের মধ্যেই এক উজ্জ্বল নাম প্রতিভা সরকার।
তাঁর লেখার বিষয়ে বৈচিত্র্য
রয়েছে।
তাঁর লেখার বিষয় হিসেবে
যেমন এসেছে লৌন্ডা, নাচনী, যৌন কর্মীর অন্তরের ব্যথা তেমনই উঠে এসেছে বিধ্বংসী ঝড়ের
নাম স্ত্রী লিঙ্গ চিহ্নিত নামে নামকরণ করার প্রবণতার কথা।
তিনি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন
কীভাবে এনআরসি ব্যবস্থায় মেয়েরা সবচেয়ে বেশি বিপন্ন। লিখেছেন কাশ্মীরের মেয়েদের
বিপন্নতার কথা। "শরিয়ত সম্মত নারী স্বাধীনতা" নামক সোনার পাথরবাটির কথা
আলোচনা করেছেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনে নারীর ভূমিকা খুব জরুরী তথ্য ভিত্তিক আলোচনা।
চালের দাম কমানো এবং রেশন দোকান খোলার দাবি নিয়ে বাঙালী মহিলাদের আন্দোলন ও বঙ্গীয়
প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি (1943) গঠনের কথা খুব
গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলনের পরেই কলকাতায় ষোলোটি ন্যায্য দড়ের দোকান খোলা ও সরকারি
ক্যান্টিনের পত্তন হয়। এসব তথ্য এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা।
এমন অনেক বিষয়কে তিনি তুলে
এনেছেন যা দৈনন্দিন জীবনে এমন ভাবে জড়িয়ে রয়েছে যাকে আমরা সহজে অত্যাচার অবিচার
অসাম্য বলে চিহ্নিত করতে পারি না। অনিবার্য বলে মেনে নিই। সেগুলি আলোচনার আলোয়
তুলে আনা জরুরী ছিল। সেরকম একটি লেখা হল- লোক আদালত ও মেয়েরা। একটু উদ্ধৃতি রইল, " মহিলা কমিশন পারে অনেক কিছু। যা পারে না তা হল ক্ষমতার
সমীকরণ পাল্টাতে আর হৃদয় পরিবর্তন করতে। তিনটি কেসে
দেখা গেল মায়ের বিরুদ্ধতা করল মেয়েরা...মায়েরাও একই কথা আউড়ালেন, টাকা ছড়িয়ে বাবা আনুগত্য কিনেছে। কথাটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
ছোটরা ভালোমন্দের বিভিন্ন স্তরগুলো বুঝে ফেলবার পরিপক্কতা নিয়ে জন্মায় না।... শুধু
একটা দামী মোবাইলের লোভে বড়দেরও সাময়িক আনুগত্য কেনা যায়।"( পৃ ১৩)
এই ধরনের লেখার জন্য যে
সহজবোধ্য অথচ বলিষ্ঠ ভাষার প্রয়োজন
সেটাই ব্যবহার করেছেন লেখিকা।
তবে কিছু কিছু লেখা যেন
হঠাত শেষ হয়ে গেল। যেন আরো কিছু বলার ছিল। হয়ত শব্দ সংখ্যার সীমা মেনে সেসব লেখা
নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে।
পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়
গ্রন্থের নাম- ঊর্ণনাভ
লেখিকা - যশোধরা রায়চৌধুরী
প্রকাশক-বার্ণিক
যশোধরা রায়চৌধুরী বর্তমান বাঙলা সাহিত্য জগতে অতি পরিচিত ও প্রিয়
নাম। কবিতা দিয়ে সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর পদার্পণ ঘটলেও গল্প, উপন্যাস,
স্মৃতিকথা,মুক্ত গদ্য - সাহিত্যের প্রতিটি
ক্ষেত্রেই তাঁর মেধাবী বিচরণ।
উল্লিখিত গ্রন্থটি একটি গল্প সংকলন। নানা ধরণের গল্প এতে সংকলিত
হয়েছে। অলৌকিক থেকে কঠোর বাস্তব, নির্ভেজাল সরস গল্প - সবই
জায়গা পেয়েছে। এর ফলে পাঠক এই লেখকের সব ধরণের লেখা দুই মলাটের মধ্যে পেয়ে যাবেন।
তবে অলৌকিক বলতে রক্ত মাখা করোটি জাতীয় গল্প এই লেখিকা লেখেন না। আমরা সাধারণ
মানুষেরা নিজেদের নিত্য যাপনে নানা রকম অলৌকিকত্বের আভাস পাই। সেগুলিই উঠে এসেছে,
যেগুলি কিছুটা মানসিক অবসেশন কিছুটা স্মৃতি কাতরতা থেকে উঠে আসা।
"মোহিনী" আর "এটিকের ঊর্ণনাভ" এরকমই দুটি গল্প। পরাবাস্তবতা
আর মানসিক জটিলতার মিশেল।
লেখিকা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তুলে আনেন গল্পের পটভূমি। তাই সত্তর
আশি দশকের কড়া বাংলা মিডিয়াম বালিকা বিদ্যালয়ের পরিবেশের নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যায়
"ফুল ফুটুক না ফুটুক" গল্পটিতে। যারাই এই ধরণের স্কুলে পড়েছে তারাই এই
গল্পের চরিত্রগুলির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে পারবে।
"ঝাঁঝ" আর " পুরুষমানুষ তৈরি হবার গপ্পো" তে
মধ্যবিত্ত বড় পরিবারগুলিতে পুরুষ প্রাধান্যের কথা যেমন এসেছে তেমনই এসেছে এই
প্রাধান্য প্রথা তৈরি হবার পেছনের ইতিহাস।
কিছু গল্পে উঠে এসেছে অফিসের পরিমণ্ডল।
"মুহূর্ত" গল্পটিতে সরকারি উচ্চ পদে যোগদানের পূর্বের
ট্রেনিং পিরিয়ডের বর্ণময় কাহিনী।
"অমসৃন" গল্পটিতে সরকারি কাজে বিদেশ যাওয়া টিমের বিচিত্র
অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসেছে ভারতবাসীর মনের এক অন্ধকার দিক।ধর্মীয় পরিচয়ের
কারণে অবিশ্বাস ঘাপটি মেরে থাকে সহকর্মীদের সহযাত্রার মধ্যেও।
" নাজিরবাবু" খুব উপভোগ্য গল্প। সরকারি আপিসের অভিজ্ঞতা
যাদের আছে তাদের চেনা চরিত্র চেনা গল্প। কিন্তু লিখতে পারে কয়জনা?
" মানচিত্র" গল্পটি কর্মসূত্রে বিশাল এক কোয়ার্টারে একলা
থাকা এক পদস্থ মহিলার অভিজ্ঞতা। আউটহাউসে কিছু আউটসোর্সড পুরুষ স্টাফ থাকে। মহিলা অফিসার নিজেকে
পদমর্যাদার সঙ্গে এক করেই চিরকাল ভেবে এসেছেন।আলাদা করে নিজেকে নারী বলে কখনও
চিহ্নিত করেননি। কিন্তু হঠাত এক ঘটনায় তিনি আবিষ্কার করেন যে অফিসার হলেও তিনি
লিঙ্গ চিহ্নে নারী। অনিরাপত্তা বোধ তাঁকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দেয়।কিন্তু পরে তিনি
নিজ ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা সুন্দর ভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে
সক্ষম হন।
করোনা কাল নিয়ে দুটি গল্প আছে বইটিতে।" চলো মন গঙ্গা
যমুনাতীরে" গল্পটি পিঁপড়ে তুল্য মনুষ্যজীবনের কাহিনী। কিন্তু করোনা কাল নিয়ে
"তুমুলের কপাল" গল্পটির মত গল্প আর পাইনি। এই গল্প হল দু:খ শোকের সমুদ্র
ছেঁচে একটু মজা খানিক হাস্যরসের মুক্তো তুলে আনা অভিজ্ঞতা। খুব উপভোগ্য।
" গোপন" হল মা-মেয়ের গল্প। মেয়েদের হঠাত একদিন বালিকা
থেকে নারী হয়ে ওঠার গল্প। মায়েদের তরুণী বেলার গল্প। মোটকথা এই গল্প চিরন্তন
নারীদের গল্প। নারী শরীর,নারী মন।
চাকরি সূত্রে মেসে থাকতে আসা এক গুচ্ছ মেয়ের বন্ধুত্ব ও নানা
জটিলতার চিত্র হল "নবনীতার রুমমেট"
অসম আর্থিক অবস্থার শহুরে নারী আর গ্রাম্য পুরুষের প্রেম আর প্রেম
পরবর্তী তিক্ত বিবাহ অভিজ্ঞতার গল্প " ঘর ও ছাতের গল্প "
" সেইসব বাড়িয়ে বলা গল্পগুলো" হল সাধারণ মেয়ের অসাধারণ
পরিবারে বিয়ে হয়ে নিজেকে সংসারের সকলের সুখ সুবিধায় বিলিয়ে দিতে দিতে শেষ হয়ে
যাবার কাহিনী।
এই গল্প গ্রন্থের কোনো চরিত্রই কাল্পনিক নয়।চোখ মেলে দেখলে সকলেই
আমাদের আশেপাশে ঘুরছে ফিরছে। লেখিকা তাঁর দেখা প্রত্যেক ঘটনা প্রত্যেক চরিত্রকে
গল্পে পরিণত করে ফেলতে পারেন অসাধারণ দক্ষতায়। জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা- এই
আপ্তবাক্য তিনি বর্ণে বর্ণে পালন করেন। তাঁর মস্তিষ্কের এন্টেনা আর চোখের দূরগামী অথচ সূক্ষ্ম দৃষ্টি থেকে কিছুই
বাদ পড়ে না।
ভবিষ্যতে পাঠক এই লেখিকার কাছ থেকে এরকম আরও গল্প সংগ্রহ পাবে এই আশা
করাই যায়।
পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়।
|
|
0 মন্তব্যসমূহ