শমীবৃক্ষের নিচে
ভাষার অরণ্যে প্রতিদিন ছদ্মবেশে যাই। সেখানে একা একটি শমীবৃক্ষ। এর ছায়ায় গিয়ে চুপচাপ বসি। একে ঘিরে জমেছে নানা পুরাণকাহিনি; যে কাহিনির আমিই শ্রোতা আর আমিই কথক। নিজের এই দ্বৈত পরিচয়ে শব্দ করে হেসে উঠি। দু-টি লেজঝোলা পাখি প্রবল বিরক্তিসহ মায়াসরোবরের দিকে উড়ে যায়। পায়ের কাছে চুপসে-যাওয়া একটা ফানুস এসে পড়ে।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ভাবি, এইবার হাসি আর কথার সংযম। এইবার গূঢ় ছদ্মবেশ। অজ্ঞাতবাসের কালে পাণ্ডবেরাও এ-রকম ছদ্মবেশে ছিল। শমীবৃক্ষের খোড়লে তারা লুকিয়ে রেখেছিল অস্ত্রপাতি, ভুষা ও আভরণ।
লোভাতুর আমি ভাষার অরণ্যে নিতান্ত শখের বশে প্রবেশ করেছি। বিপদ আর সম্ভাবনা দুটোই এখন আমার সঙ্গী। আমি এখানে প্রতিটি ঝোপের ভেতর আর গুহার ভেতর ঢুকে পড়ছি আর কুড়িয়ে চলেছি আদি বীরদের পরিত্যক্ত অস্ত্র ও বর্ম। যেন আমিই তাঁদের একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকার। যেনবা পরম্পরাবাহিত এক অঘোষিত মহাযুদ্ধের ঢাকের কাঠি বয়ে চলবার কর্তব্য বর্তেছে আমার ওপর।
মনে হলো, বেশ । ক্ষত্রিয়ের মতন ক্ষার ও তেজই তবে আমার সম্বল। যেন এক লোন ওয়ারিয়ার। যেন এক একাকী পাণ্ডব আমি । আমি চাই, আমার মৃগয়াপথ আপাতত গোপন থাকুক ; আমার প্রয়োজন এমন ছদ্মবেশ যা ধারণ করলে নিজের চেহারাকেও মনে হবে অন্যের চেহারা ।
বলো খুল্লতাত, বলো, আমি কি পাণ্ডব?
কোন দ্রাঘিমার
নিচে, কত চেনা ও অচেনা নদীতীরে,
কত লক্ষ
চাঁদের উদয়-অস্ত ঘটে গেছে------আর,
ইত্যবসরে কত লক্ষ মহাবলী হয়েছে নিথর!
যাবতীয় শব্দ-বাক্য, উপমা-প্রতীক আমি আমার ঝোলার ভেতর যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছি। সৌরমনীষার আঁচে একদিন স্থির হবে এদের প্রত্যয়; রণধর্মে এরা বহু চক্রব্যূহ দেবে।জানি আমি বিফল হবো না।
আপাতত ভাষাপাহাড়ের অদৃশ্য ফাটলে--- ত্রস্তে--- এদের আড়াল করি। অগুনতি খোড়লের ভেতর চাপা দিয়ে রাখি আমার অস্থিরতা। অতি উল্লাসের কম্পন যেন অসময়ে না দোলায় আমাকে। এ নিয়ে কিছু আর না বলাই শ্রেয়। আপাতত শমীবৃক্ষটিই ভরসা। কেননা স্ত্রীলোকের মতো এটি প্রগলভ নয়।
এরই খোড়লে আমি অক্ষরের পেয়েছি সিন্দুক;
সেখানে
প্রত্যহ জমা করে রাখছি ভবিষ্য যুদ্ধের সব সম্ভাব্য আয়ুধ। আর,
চতুর্দিকে জেগে উঠতে দেখছি এক অনন্ত-কুরুর মাঠ; পাশের সরোবরটি যেন এক অস্থির আয়না। এতে অনেক দূরের দৃশ্য চকিতে ভেসে উঠে মিলিয়ে যেতে দেখি। সেখানে সংখ্যাহীন সীমাহীন মহাবলিদানের ইশারা;
আমি বুঝে গেছি, এক রণরক্তভরা পৃথিবীর দিকে আমাকে ছোটাতে হবে রথ। অরি ও স্বজন সকলেই বধ্য যেখানে। এমনকি, সেখানে আত্মবধও অনিবার্য শ্রেয়;
অক্ষরের স্বরচিত সুরম্য মিনারটিও একঘেঁয়ে হয়ে ওঠে যদি, তবে নিজ হাতে ধ্বংস কাম্য এরও। এ-ও কাম্য, একদিন আত্মবধের খর্পর ঝলসে উঠবে গূঢ় অশ্লেষায়।
ভাবছি, আমি কি অর্জুন? শমীবৃক্ষটির নিচে আমরা দু-জন এসে দাঁড়িয়েছি আলাদা সময়ে। আমি এবং সে। ভাবছি, কী কারণে আমরা আলাদা!
একটি নীলচে অজগর ঘুমের ভেতর তার খোলস ছাড়ল; সে এখন ভাবছে, পরিত্যক্ত খোলসটি অন্য কারোর। অর্জুনও কি ভাবছে, আমি আর সে আদতে আলাদা কেউ?
ইত্যবসরে একটি হলদে পাতা অকস্মাৎ নিজেকে ঝরাল। ঘুরে-ঘুরে নিচে নামতে-নামতে সে আমাকে বললো, আদি বা অন্ত বলে কিছু নেই। মহাকালের ভেতর তুমি আর অর্জুন একই লোক। তখন আর এখন---- দুটোই আদতে এক। তীব্র উন্মোচনের আগে আপাতত লুকাও নিজেকে।
শ্বাপদে ঠাসা,
কণ্টকিত ভাষার অরণ্যে মাথা নিচু করে, মুখ ঢেকে আর বেড়ালের মতন নি:শব্দে চলাই
শ্রেয়। কেননা ওঁত পেতে রয়েছে বহু অচেনা বিপদ। গুহাগুলি মাকড়জালে ঢাকা। ভেতরে
জুলজুল করছে প্রতিহিংসু জন্তুদের শ্যেন চোখ । শুকনো পাতায় পা পড়ামাত্র মচমচ আওয়াজ
; তাতে ঘুমের ভেতরে নড়ে উঠছে মাংসাশীরা।
নি:শব্দ চরণে চলাই এখন বিধেয়। আপাতত ধরো ছদ্মবেশ। আপাতত বাকহীন, মূক-বধির হয়ে থাকো। আপাতত প্রতীকে মুড়িয়ে শমীবৃক্ষটির কোটরে লুকিয়ে রাখো নিজের ক্ষাত্রতেজ।
জেনো,
অচিরেই ঝলকাবে
তোমার
কালো অক্ষরের
তরবারি;
অচিরেই তোমার পতাকা পতপত
অচিরেই বহু
পরিমাণ বসন্ত ও কুহু
অচিরেই জয়!
----------
0 মন্তব্যসমূহ