অলেখা অধ্যায় – ২
পর্ব-৪
অষ্টাদশ অধ্যায়
ইন্দ্রপ্রস্থ রাজপুরীর অন্দরমহলের দ্বিতলে, একটি শ্বেত পাথরে ঢাকা অলিন্দে
আজ ভারী হৈ চৈ। পান্ডবপুত্রেরা একত্রিত হয়েছে। প্রতিবিন্ধ্য, শতানীক, শ্রুতকীর্তি, শ্রুতসেন ,সুতসোম, যৌধেয়,
সর্ব্বোগ, অভিমন্যু। বর্ষা
ঋতু এখন। বেলা দ্বিপ্রহর। সারাদিন আকাশে আজ সূর্যের দেখা মেলেনি। অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে। বালকদের
অস্ত্রশিক্ষা, খেলা, সব বন্ধ এই অবিরাম বারিপাতে। বিদ্যাভ্যাসও
বন্ধ। শাস্ত্রগুরু এই প্রবল বৃষ্টিতে পথে বের হতে পারেননি। সময় আর কাটছে না তাদের। তাই করেণু মায়ের কাছে আজ পুত্ররা
উপাখ্যান শুনতে চায়। করেণু ক্ষুদ্রকায়া ত্বন্বী, তার মুখে এখনও বালিকার ভাব। তাকে প্রকৃত বয়সের চাইতে কম দেখায়। এই বালকেরা হয়তো সেই জন্য তাকে কিছুটা নিজেদের সমপর্যায়ের মনে করে। করেণুমা তাদের বড় প্রিয়। করেণুমতীও এই অমল মুখের বালকদের
সাহচর্যে খুব আনন্দ পায়। রাজপ্রাসাদের পরিবেশ ঐশ্বর্যপূর্ণ। পুরজনেদের
ব্যবহার পরিশীলিত। কিন্তু সে আবাল্য অনুভব করেছে, এই উজ্জ্বলতার মধ্যে দিয়ে
চোরাস্রোতের মতো নিয়ত বয়ে চলে অসূয়া, বিদ্বেষ। সংসারের
দৈনন্দিন গ্লানি, এখনও এই বালকদের স্পর্শ করেনি। তাই সে তাদের
সঙ্গে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ বোধ করে। আরো কিছুকাল পরে, যখন স্বার্থবোধ,
অধিকারচেতনা জেগে উঠবে তাদের মধ্যে, হয়তো তারা বদলে যাবে।
কিন্তু কি সুন্দর এখনকার এই মুহূর্তগুলি। এই বাল্যকাল। সময় চলে যাবে আপন নিয়মে। তবু এদের মধ্যেকার শিশুগুলি যেন
বেঁচে থাকে আজীবন! করেণুমতী হৃদয় ভরে এই প্রার্থনা করে। আহা শৈশবের
অনাবিল সারল্যের সঙ্গে যদি মিলিত হোত
পরিণত বয়সের প্রজ্ঞা, সে ভাবে।
ছেলের দল ঘিরে ধরে তাকে। করেণু আজ আকাশের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে একটি নীল বসন পরেছে। আর পরেছে যূথীর ফুলের গহনা। বালকগুলিকেও সে একের পর এক সাজিয়ে
তোলে ফুলের মালায়। ললাটে এঁকে দেয় তিলক। শিশুদের দেহের
কি সুঘ্রাণ। ফুলের গন্ধ মিশে যায় তার সঙ্গে।
“এবার তবে কাহিনী বল! অসুর হত্যার গল্প। সেই সব কালো
চেহারা আর নাক নেই যাদের। ইন্দ্র যাদের জয় করেছিলেন, যাদের পুরী ভেঙে দিয়েছিলেন
সেই সব অসুর।” – অভিমন্যু বড় বড় চোখে তাকায়। সাজসজ্জার ধৈর্য
নাই তার। অভিমন্যুর খুব
পছন্দের একটি তির ধনুক আছে, রুপা দিয়ে তৈরি। সে কখনও কাছ
ছাড়া করে না সেগুলি। এখনও হাতে ধরা
রয়েছে। তার প্রিয় খেলা হোল সেই তির ছুঁড়ে কাল্পনিক অসুর বধ। দুষ্ট অসুরকে কখনও সে দেখে, প্রকান্ড গুঁড়ি সমেত বট বৃক্ষের কান্ডে, কখনও
বা অলিন্দের স্তম্ভে, কখনও বা গৃহদাস রোচকের মধ্যে। রোচক বিশালদেহী,
কৃষ্ণকায় আর বড় বড় ঈষৎ লাল আভা যুক্ত তার চোখ দুটি।
রোচকের সঙ্গে তার খেলাটি এই রকম। সে শিখিয়েছে,
রোচককে প্রথমে বিকট মুখ ভঙ্গি করে প্রবল গর্জনে তেড়ে আসতে হবে। অভিমন্যু তখন তার দিকে তির ছুঁড়বে। তীক্ষ্ণতাহীন
সেই তির গিয়ে লাগবে রোচকের বুকে অথবা পিঠে। আর অমনি তাকে
আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যাবার ভান করতে হবে। আর তখনই
অভিমন্যু তার বুকে চড়ে বসে প্রাণপণে মুষ্টাঘাত, পদাঘাত করবে তাকে, যতক্ষণ না সে
চোখ বুজে, জিভ বার করে নিথর হয়ে যাবে। অন্য বালকগুলিও মহা আহ্লাদে যোগ
দেয় এই খেলায়।
মাঝে মাঝে অভিমন্যু শয্যার উপাধানটির দিকে লক্ষ্য করে গহন জঙ্গলের মধ্যে
ব্যাঘ্র বধ খেলাও খেলে থাকে। তবে কিনা জড় বস্তুগুলি গর্জন,
হুঙ্কার নড়াচড়া কিছুই করতে পারে না, তাই রোচককে মাঝে মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে হালুম
হালুম শব্দে হুঙ্কার ছেড়ে বাঘের ভূমিকায় অভিনয় করতেও হয়। তবেই খেলার
আমোদটি জমে ভাল।
করেণু সকলকে নিয়ে অলিন্দেরর বেদিতে বসে। সামনে
বৃষ্টি-স্নান করছে উদ্যান। তীব্র বাতাস বইছে। । মাঝে মাঝে
বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে তাদের মুখে, শরীরে। করেণুর পাশ
ঘেঁষে বসেছে অভিমন্যু। করেণু তার মাথায় হাত রেখে বলে, -“তুমি অসুর দেখেছ?”
উত্তেজিত স্বরে অভিমন্যু বলে,-“হ্যাঁ রোচকই তো অসুর। অমনই কালো আর
ভয়ানক। আমি যখন বড় হব, তখন অনেক অনেক অসুর বধ করব। রক্তের নদী বয়ে যাবে আর অসুরদের মুন্ড জমে জমে পাহাড় হয়ে যাবে।” করেণু বালকের অমল মুখের দিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে। কি অনায়াসে এমন
ভয়ঙ্কর পাপকথা উচ্চারণ করছে নিষ্পাপ এই মানবক। অন্য বালকগুলিও
স্বতঃস্ফূর্ত আমোদে হেসে ওঠে।
“কিন্তু রোচক তো তোমাকে ভালবাসে, তোমার বসন, তির, ধনুক গুছিয়ে দেয়। তোমার খাদ্য এনে দেয়। যখন তুমি নদীতীরে হেঁটে গিয়ে শ্রান্ত
হয়ে পড়, তখন সেই তো তোমাকে কাঁধে চড়িয়ে বয়ে আনে।”
বালকের দল কি বলবে ভেবে পায় না। কিছুক্ষণ পরে অভিমন্যু
বলে,-“কিন্তু ও যে ঘোর কালো। আর নাকও তো নেই ওর—দেবতা ইন্দ্র যে
বলেছিলেন—”
“বাছা, কার গায়ের রঙ কালো, আর কারই বা গোরা, কে নতনাস আর কে নয়, তারই উপর
ভিত্তি করে বলা যায় না কে ভাল আর কে বা মন্দ। বসনে ঢেকে যদি
তোমার সামনে আনি একটি মণি আর একটি নুড়ি পাথর, তবে কেমন করে বুঝবে কোনটি কি?” – সে একটু থামে। বালকগুলি ভারী চিন্তায় পড়েছে। করেণু আবার বলে,-“রূপ হচ্ছে অমন
এক ঢাকনি শুধু, তার তলায় কত গভীরে বাস করে আসল মানুষটি।”
অভিমন্যু খুব উদ্গ্রীব হয়ে বলে, -“তবে কেমন করে দেখব আসল মানুষকে? তলোয়ার
দিয়ে তার বুক চিরে ফেললে কি দেখা যাবে আসল সেই মানুষকে?” –
“ওমা ওমা—এ বোকা ছেলে বলে কি?”- খিলখিল করে হেসে ফেলে করেণু। “ আমি ভাল না
মন্দ তা জানার জন্য তুই কি আমার বুক চিরে দেখতে চাস?”
অন্য বালকেরা শিউরে ওঠে। শতানীক জড়িয়ে ধরে করেণুমাকে। অভিমন্যু গোমড়া মুখে বলে,-“তুমি তো ভাল।” “কেমন করে
জানলি?”- ভুরু নাচিয়ে বলে করেণু। “তুমি যে আমাদের খেলনা দাও,
মেঠাই দাও। আমাদের সঙ্গে খেলা কর। আমাদের কত
কাহিনী, কত পুরাণ কথা বল।”
“যদি ঢাকা থাকে চম্পক কি, যূথী ফুল আর পয়োনালীর আবর্জনা তবে গন্ধেই তো
বুঝবি তোরা কোনটি কি তাই না? তেমনি মানুষের কথায়, আচরণের ঘ্রাণে চেনা যায় মানুষকে।”
“রোচকের মাতুলের ছেলেটি কিন্তু খুব মন্দ। জান না বুঝি, সে
বিপণি থেকে চুরি করে নিয়ে যেত চাউল আর মোদক, একদিন ধরা পড়ে গেল শেষে। তখন বিচারে হাতটি কাটা গেল তার। খুব চিৎকার করছিল নাকি!”- মানস
চক্ষে দৃশ্যটি দেখে যেন আমোদ পায় অভিমন্যু। খিলখিল করে হেসে
ওঠে। প্রিয়জনকে ঘিরে থাকে যে আতঙ্ক, সেই গাঢ় আতঙ্কে করেণু বলে
ওঠে,-“নিয়ত নিজেকে প্রশ্ন কর বাছা। কেন অপরাধ? কেন চৌর্যবৃত্তি? কেন?
কেন? কেন? কত যুগ থেকে অপরাধের এমন কঠিন সব শাস্তি প্রচলিত। তবু আজও কেন
অপরাধ ঘটে? আজও কেন অপরাধকে মুছে ফেলা যায়নি? ধৈর্য আর বোধ মন্দ মনোবৃত্তিকেও
ভালতে পরিণত করে। যেমন যত্ন পেলে আবর্জনা রূপান্তরিত হয় কৃষিভূমির সারে। শস্য পুষ্ট হয় যা থেকে। এ পৃথিবী কি বিস্তীর্ণা—কত মানুষ, কত
আচার, কত ভিন্ন সব দেবতার মন্ত্র। কত পরিচ্ছদ, কত রকম দেহের রূপ। কেউ কৃষ্ণ, কেউ পীত, কেউ শ্বেত
বর্ণের। কেউ দীর্ঘাকৃতি, কেউ হ্রস্ব, চুল ও চোখের কত বিচিত্র
বর্ণ। যে মানুষটীকে তোর নিজের থেকে আলাদা সেই তোর শত্রু হয়ে
যাবে নাকি? বহুকাল ধরে বয়ে চলা মানবধারার আসল কথা কিন্তু বন্ধুত্ব। মানুষে মানুষে মিলনেই সৃষ্টি আর বিরোধেই ধ্বংস। একথা কখনই ভুলিস
না বাছারা।”
করেণুর মনে পড়ে বহুকাল আগে সে যে সব শাস্ত্র পড়েছিল, আচার্য বীতিহোত্রের
কাছে। আবিষ্টের মতো সে বলতে থাকে,-“ সে কত কাল আগের কথা। তখন তোরা জন্মাসনি। এই যে আমরা, তোদের পিতা, মাতারা
তারাও জন্মাইনি, এমনকি হস্তিনাপুরের আমাদের ভীষ্ম পিতামহও না!”
সাদা চুল দাড়ির ভীষ্ম তাদের প্রপিতামহ হন। অমন বুড়া
মানুষটিরও সেই কালে জন্ম হয়নি শুনে ভারী হাসি পায় তাদের।
“কি হয়েছিল তখন?” প্রতিবিন্ধ্য বলে।
“তখন আমাদের পূর্বপুরুষরা, আর্যরা এসেছিলেন অনেক অনেক দূর দেশ থেকে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে।”
“কোথা থেকে এসেছিলেন?’
“দূর উত্তরভূমি থেকে। দীর্ঘাকৃতি, উচ্চনাসা, উজ্জ্বল
গৌর বর্ণের সব মানুষ। আসলে ক্রমশ লোক বেড়ে যাচ্ছিল আমাদের আদি ভূমিতে। বেড়ে যাচ্ছিল পশুও। পশুচারণের প্রান্তরে স্থান কুলাত
না। সকলের ক্ষিদে মেটানোর মতো শস্য ফলত না। তাই তারা অনেকেই আদি ভূমি ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়ছিল দেশে দেশে। অনেক পথ পেরিয়ে এসেছিল তারা সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে। ছোট ছোট অনেক
দলে ভাগ হয়ে অনেকগুলি পর্যায়ে এসেছিল তারা। ক্রমশ এখানকার
আদিম বাসিন্দাদের সঙ্গে বিরোধ বাধে তাদের। আর তখনই আর্যরা
তাদের নাম দেয় অসুর, রাক্ষস। তাদের সম্বন্ধে কত ভয়াল গল্প মুখে
মুখে তৈরি হয়।
এমনকি আর্যদের নিজেদের মধ্যেও এক সময়ে বিরোধ বাধে। অজস্র ছোট ছোট
গোষ্ঠী ছিল যে তাদের! ইতিহাসে আছে দাশরাজ্ঞ যুদ্ধের কথা। জানিস তো তোরা!”
শতানীক ও যৌধেয় এবার সমস্বরে বলে ওঠে,-“হ্যাঁ হ্যাঁ জানি তো সে উপাখ্যান। দশ দশ রাজা মিলে, সে কি যুদ্ধ কি যুদ্ধ—সকলে একসঙ্গে তির ছুঁড়ছে আর অত
তিরে সূর্যকেই দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে অন্ধকার---অন্ধকার—”- কলরব করতে
থাকে তারা সকলে মিলে। যুদ্ধের বিবরণ সর্বদাই খুব উত্তেজিত করে তোলে তাদের।
“সুদাস ছিলেন ত্রিৎসু-ভরত গোষ্ঠীর অধিপতি। তাঁদের সঙ্গে
যুদ্ধ হয়েছিল যদু, তুর্বশ, অনু, পুরু আরো কত গোষ্ঠীর। যুদ্ধে
জিতেছিলেন সুদাস।” – এই পর্যন্ত শুনেই বালকগুলি হর্ষধ্বনি করে ওঠে। এ তথ্য তাদের অজানা নয়। ‘কুরু’ তাদের মুলনাম বটে, কিন্তু আদতে তারা ভরত বংশীয়। তাদের গোষ্ঠীর
নাম থেকেই এই আসমুদ্র হিমাচল বিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপের নাম হয়েছে ভারতবর্ষ। ভরত কুলের আদি পুরুষ ছিলেন এই সুদাস।
তাদের উল্লসিত চিৎকার থামলে করেণু বলে,-“শেষ পর্যন্ত কিন্তু পুরাণকাহিনী
অন্য কথা বলে।”
“কি কথা? কি কথা?”- সমস্বরে জানতে চায় তারা।
“যুদ্ধে হেরে যাওয়া পুরু গোষ্ঠীর সঙ্গে কিন্তু বন্ধুত্ব হয় বিজয়ী ভরত
বংশীয়দের। আর এই মিলনে গড়ে ওঠে আমাদের কুরুকূল। তবে এ থেকে কি বুঝলি বল ছেলেরা?”-
ছেলেরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। করেণু তখন বলে,-“কুরুকূলের কত
সম্মান, কত কীর্তি। দূরে যবন দেশ পর্যন্ত কুরুকুলের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু মনে রাখিস বাছারা শুধু ভরত কুল নয়, শুধু পুরু কুল নয়। এই দুই কুলের মিলনেই সৃষ্টি হয়েছে কুরুকুল। বাছারা তোরা কি
জানিস, আসলে কি বিশাল এ পৃথিবী। এত বিশাল যে সূর্যদেব সকল দেশে
একই সঙ্গে আলো দিতে পারেন না। তাই এখন যেখানে দিন, অন্যত্র
সেখানে রাত্রি। আবার সে সব দেশে যখন সকাল হয়, এখানে তখন রাত্রি নামবে।”
বালকের দল মহাবিস্ময়ের অব্যক্ত ধ্বনি করে। করেণু তখন
স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলে,-“তবে একবার ভেবে দেখ দিকি বাছারা, মাত্র এই দুটি গোষ্ঠীর
মিলনে যদি এত শক্তি লাভ হয়, তবে প্রকান্ড এ পৃথিবীর সকল গোষ্ঠী, সকল মানুষ যেদিন একত্রে
মিলবে, সকলের কর্মে, দক্ষতায়, প্রীতিতে সেই দিন কি আশ্চর্য মহা শক্তিতে উজ্জ্বল
হয়ে উঠবে এ ধরিত্রী। সে শক্তির আবির্ভাবে মুছে যাবে সকল রক্তপাত, হাহাকার আর
অশ্রু। কারণ মিলনেই সৃজন আর বিভেদেই ধ্বংস।” – উদ্দীপ্ত হয়ে
ওঠে করেণুর মুখ। দু চোখের দৃষ্টি বাষ্পাচ্ছন্ন। এই মুহূর্তে
সামনের বালকগুলিকে অতিক্রম করে, সমসময়ের সীমা অতিক্রম করে, তার দৃষ্টি চলে গেছে,
বহু দূরের এক অনাগত পৃথিবীতে। দীর্ঘকাল ধরে যে পৃথিবী তার
একান্ত কামনার ধন। আচার্য বীতিহোত্র তাকে যে পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে
শিখিয়েছেন।
বালকের দল কিছু বুঝে, কিছু না বুঝে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে করেণুমায়ের মুখের
দিকে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে তাঁকে। জ্বল্জ্বল্করছে
কালো চোখের তারা দুটি।
ঠিক তখনই দ্রৌপদী উপস্থিত হলেন সেই অলিন্দদ্বারে। তাঁর মুখে মৃদু
হাসি। কিন্তু স্ফটিকের ঘেরাটোপে আগুনের শিখা জ্বললে যেমন
অনুভূত হয়, তেমনই তাঁর অন্তরের আবৃত ক্রোধের তাপও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর আয়ত, ঘনপঙ্খ দু চোখের তীব্র দৃষ্টি করেণুর মুখ ঘুরে ফিরে এল, বালকদের
দিকে।
“হে কুরুকুলের বালকগণ, কুরুকুলের ভবিষ্যৎ আশা, দৃঢ়মুষ্টিতে ধারণ কর এ মহান
বংশের বিজয় নিশান। তোমাদের তেজস্বী অশ্ব অপ্রতিহত হোক, তোমাদের শস্ত্র
তীক্ষ্ণতর হোক। বিস্তীর্ণ হোক তোমাদের শাসনভূমি। প্রবল ঝঞ্ঝা
যেমন উপড়ে ফেলে মহীরুহকে, তেমনই তোমরাও উৎপাটন কর সকল বাধা। হয়ে ওঠো বেগবান,
প্রাণময় পুরুষ। পৃথিবী নতজানু হোক তোমাদের চরণ প্রান্তে। আর আপন আপন হৃদয় থেকে উন্মূলিত কর মেদুর, ছায়াময় যত ভাববিলাস। যে তোমাকে আঘাত হানার প্রয়াস করবে, তাকে দাও প্রবল যন্ত্রণা আর আতঙ্ক। ক্ষত্রিয় পুরুষের যা ধর্ম। কখনও বিচ্যুত হোয়ো না স্বধর্ম
থেকে।” – উদ্দীপ্ত স্বরে বাক্যগুলি উচ্চারণের শেষে, তিনি আবার
তাকালেন, করেণুমতীর বিমূঢ় মুখের দিকে।
কোমল হয়ে উঠল চোখের চাহনি। কাছে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন। “ ভগিনী করেণু, এই দুর্দান্ত ছেলের দল বড়ই উত্যক্ত করে দেখি তোমাকে। এই গর্ভিণী দশায়
তোমার শরীরে কি এত শ্রম সয়! কুরুকুলের শিশুটি যে তোমার আশ্রয়েই রয়েছে। তার পরিচর্যার কোনো ত্রুটি না হয় যেন।”
দ্রৌপদী বুঝি ঈষৎ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। “চল ভগিনী
তোমার জন্য ঘনপাক দেওয়া উষ্ণ দুগ্ধ
প্রস্তুত রয়েছে। সঙ্গে যবের পুরোডাশ দিয়ে তৈরি চর্পতিকা। সুগন্ধি ঘৃত মাখানো। সুস্বাদু, নরম। যা তোমার প্রিয়। চল এখন। বারে বারে আহার করতে হবে, তবেই না
শক্তি পাবে তোমার অনাগত সন্তান।” নিজের দক্ষিণ হাতটি দিয়ে তাকে বেষ্টন
করে দ্রৌপদী এগিয়ে চললেন। তখনই অলিন্দপ্রান্ত দিয়ে এক পরিচারিকাকে দ্রুত পায়ে
এদিকে আসতে দেখা যায়। সে রাজবধূদের অভিবাদন করে বলল,-“হস্তিনাপুর থেকে মহামতি
বিদুরের আগমন হয়েছে রাজসভায়। মাতা কুন্তী তাঁর কক্ষে আপনাদের
আহ্বান করেছেন।” – বিস্মিত হলেন তাঁরা। আগে কখনও বিদুর
এমন অনাহূত আসেননি। পূর্বাহ্নে তাঁর আগমনের কোনো সংবাদও পাওয়া যায়নি। সহসা কি এমন প্রয়োজন পড়ল!
ঊণবিংশ অধ্যায়
আমার কিই বা রাত্রি, কিই বা দিন! হে পুত্র, দেখিনি তোমায়। জানি না দৃশ্য কি! শুধু কত কাল হয়ে গেল, প্রথম স্পর্শ পেয়েছিলাম তোমার কোমল
শিশু দেহের। আমাকে ঘিরে থাকা অন্ধকার বাতাসে ভাসছিল সুঘ্রাণ। শুনেছিলাম তোমার প্রথম ক্রন্দনধ্বনি। জন্মমুহূর্তের
সেই আদি যন্ত্রণার অনুভব। আমার রক্ত প্রবাহিণী এই শিশু দেহে। প্রথম জনক হয়ে
ওঠার গৌরব, আনন্দ আপ্লুত করেছিল আমাকে।
গান্ধারীর দীর্ঘ গর্ভাধান কালে এক মহা আতঙ্ক জেগেছিল মনে। আমার পুত্র যদি আমার অন্ধতার দুর্ভাগ্য পায় জন্মসূত্রে! তোমাদের জন্মবার্তা
শোনামাত্র ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করেছি বারবার, ধাত্রীকে, রাজবৈদ্যকে – “শিশুগুলির
চোখের দৃষ্টি আছে তো? আশ্বাসবাণী শুনেও যেন সম্পূর্ণ শান্ত হয়নি মন। সকল পুত্রের মধ্যে তুমি আমার অধিক প্রিয়। হে জ্যেষ্ঠ
পুত্র আমার। আমার আত্মজ। তোমাদের মাতুল শকুনি বলেছেন তুমি
নাকি অসুস্থ হয়েছ। আমি হাত রাখি তোমার বাহুতে, স্কন্ধে, গ্রীবায়। ঈষৎ শিথিল মনে হয় তোমার মাংসপেশী। অস্থিগুলি বুঝি
সামান্য প্রকট! কৃশ হয়েছ তুমি, দুর্বল। শকুনির মুখে শুনি তোমার গৌরবর্ণ
মুখে বুঝি কালিমার ছাপ। কিন্তু আমি তো জানি না বর্ণ কি! রূপ কেমন!
“রাজবৈদ্যকে আহ্বান কর হে শকুনি।”
উদ্বিগ্ন স্বরে বলেন ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু এক
ইন্দ্রিয় বিকল হলে, অন্যগুলির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।অন্ধের অনুভব শক্তি
অতি তীক্ষ্ণ তাই। দুর্যোধন, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বসে আছে কাছে। নীরব। কিন্তু তাঁর মনে হয় সে যেন এক অগ্নিগর্ভ কক্ষ। রুদ্ধবাতায়নদ্বার, কিন্তু তার ক্রোধের উত্তাপ এসে লাগে তাঁর মুখে। মনের সকল আবিলতা দেহে স্বাক্ষর রাখে। নিকৃষ্টতম রিপু
মাৎসর্য। কাম, ক্রোধ, লোভ সকলই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ঈর্ষায়। প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ নিশ্চিত হয়ে যান, তাঁর পুত্রকে গ্রাস করেছে মাৎসর্য। পান্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞের উদ্যাপন শেষে ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে ফিরে আসার পর
থেকেই তার এমন ভাব পরিবর্তন। পুত্রের একটি, দুটি কথা থেকেই
বুঝে নিয়েছেন তীক্ষ্ণধী পিতা।
হায় মানব মন, হায় ভাগ্য! দীর্ঘশ্বাস পড়ে তাঁর। মনের অগোচরে
থাকে না কিছু। তিনি অন্ধ বৃদ্ধ। আর কতকালই বা
আয়ু তাঁর। তবু ভ্রাতুষ্পুত্রদের গৃহে মহা আড়ম্বরের আখ্যান শুনে,
তাঁরই কি ঈর্ষা জাগেনি! ক্ষত্রিয় মাত্রেই স্বভাবে বুঝি প্রতিযোগী। শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হবার তীব্র আকাঙ্খাতে তার উত্তরাধিকার!
মনে হয়েছিল ভাগ্যের চক্র কি আশ্চর্যভাবে নিয়ন্ত্রিত করে মানুষের জীবনকে। নয়তো তাঁর ভাই অক্ষম পান্ডুর, নিয়োগপ্রথায় উৎপন্ন অসহায় পুত্রগুলি, কোথা
থেকে এত শক্তি সঞ্চয় করে অজেয় হয়ে উঠল। জম্বুদ্বীপের অন্যতম প্রধান
রাজশক্তি পাঞ্চাল তাদের সহায়। তাদের সহায় যদুকুল। দেশের শ্রেষ্ঠ কূটনীতিবিদ কৃষ্ণ তাদের পরামর্শদাতা।
এই মুহূর্তে কে তাদের বিরুদ্ধে যাবার সাহস রাখে? ধৃতরাষ্ট্রের তীক্ষ্ণ
বুদ্ধি, তাঁকে সংযত হবার শিক্ষা দিয়েছিল। নিজের চিন্তার
মধ্যেই তলিয়ে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ। সহসা গর্জন করে উঠেছিলেন দুর্যোধন।
“অসুস্থ! হ্যাঁ অসুস্থ আমি পিতা, কিন্তু রাজবৈদ্য এ রোগের নিদান দিতে
পারবেন না। যেদিন পান্ডবদের অধিকৃত সমগ্র ভূমি, তাদের সকল ঐশ্বর্য
আমার করতলগত হবে, সেই দিন---একমাত্র সেই দিনেই আমার রোগমুক্তি। কি উপহাস করেছিল তারা আমাকে। তাদের সেই বিচিত্র প্রাসাদে
স্ফটিকের বন্ধ দ্বারকে শূন্যস্থান ভেবে মাথায় জোর আঘাত লাগল আমার, আবার দীঘিকে
স্ফটিক নির্মিত কৃত্রিম ভেবে জলে পড়লাম আচমকা—আর কি উপহাস তখন—হাসতে লাগল
পান্ডব ভাইগুলা—তাদের অনুগত রাজারা, কে নয় এমনকি--দ্রৌপদী সহ পুরস্ত্রীরা পর্যন্ত-- ”
সকলই বোঝেন বৃদ্ধ পিতা। নিঃসীম অন্ধকারে আচ্ছন্ন তাঁর
দৃষ্টি। কেমন সে সুবর্ণরাজি, মণিরত্নশোভিত প্রাকার, অশ্ব, গজ,
শ্বেতগাভীর সম্ভার, মনোরম বস্ত্র, রূপবতী তরুণী, স্ফটিকনির্মিত দ্বার, কেমন সে
বৈভবরাশি? কোনো দিনই জানবেন না তিনি তা ইহজীবনে। তবু এই
জরাগ্রস্ত শরীরের অতল থেকে উঠে আসতে থাকে লোভ---অন্তহীন লোভ শুধু। জীবনব্যাপী নিরাশা তাঁর। দীর্ঘ দিনের সঞ্চিত সে নিরাশা
আর্তনাদ করে ওঠে! তাকে দমন করতে চেয়ে বৃদ্ধ বলেন,-“হে পুত্র, মনোস্তাপ কোর না। কিসের অভাব তোমার? সুবর্ণ স্থালীতে সুস্বাদু অন্ন ভোজন কর তুমি। মনোরম প্রাসাদ, উদ্যান বাটিকায় সুন্দরী স্ত্রীসহ বিচরণ কর, দুর্লভ কত রত্ন
রয়েছে তোমার ভান্ডারে, তুমি মহার্ঘ বসন পরিধান কর, তেজস্বী দ্রুতগামী অশ্বগণ
তোমাকে বহন করে নিয়ে যায়, তবু পরিতাপ কেন বৎস? শান্ত হও। শাস্ত্রবিদেরা
বলেছেন সন্তোষ পরম ধন। হস্তিনাপুরের রাজলক্ষী তোমার প্রতি প্রসন্না।”
তীব্র বিদ্বেষে বিকৃত হয়ে ওঠে দুর্যোধনের সুদর্শন মুখ।
“শাস্ত্র?শাস্ত্র? পিতা, শাস্ত্র কারা রচনা করে? ভিক্ষান্নজীবি, ক্ষীণ দেহ
ব্রাহ্মণগণ। সে শাস্ত্র সামান্য জনের পালনীয় হতে পারে,কিন্তু
রাজপুরুষের জন্য তা নির্ধারিত হয়নি পিতা। তেজস্বী
ক্ষত্রিয় পুরুষ চিরকাল নিজস্ব শাস্ত্র লিখেছে, ভিন্ন বর্ণমালায়। তীক্ষ্ম আয়ুধ তার লেখনী। রক্ত তার মসী। যুদ্ধক্ষেত্র তার ভূর্জপত্র। আর শত্রুহনন তার অক্ষর। কিন্তু দুর্বল আমি, মহা শক্তিধর
পান্ডবগণের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারছি না। সেই গ্লানিতে
ক্ষয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন। যে ক্ষত্রিয়ের মনে সন্তোষ জন্মেছে সে তো মৃত। সন্তোষ ক্ষাত্রতেজের পরিপন্থী এ সত্য কি আপনার অজ্ঞাত আছে পিতা? আর
রাজলক্ষ্মীর কথা কি বলছেন? আমি যেদিন থেকে যুধিষ্ঠিরের দীপ্যমানা সালাঙ্কারা রাজলক্ষ্মীকে
দেখেছি, সেদিন থেকে হস্তিনাপুরের রাজশ্রীকে আমার মনে হয় গতযৌবনা, লোলচর্মা এক
ভিখারিণী। জীর্ণ বসন যার অঙ্গে, নিঃস্ব যার থলিকা।”
শুভ ও অশুভ, লোভ ও বিবেকের টানাপোড়েনে এতগুলি দিন চলে গেল ধৃতরাষ্ট্রের
জীবনে। লোভই জিতেছে বার বার। কত অন্যায়! কি
গভীর সব পাপ খোদিত আছে তাঁর জীবন ফলকে। যুগযুগান্তরেও ধ্বংস হবে না
সে শিলালিপি। অনাগত দিনের
মানুষ জানবে সত্য ইতিহাস। ধিক্কার দেবে তাঁকে। পান্ডবদের
বারণাবতে পাঠিয়ে জীবন্ত দগ্ধ করার পরিকল্পনায় তাঁরও সায় ছিল। ছিঃ ছিঃ অসহায়
ওই বালকগুলি, দুর্ভাগিনী বিধবা ভ্রাতৃবধূ। তবু তো নিবৃত্ত
করেননি আপন পুত্রকে। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রেরা জননীসহ দগ্ধ হয়েছে এই ভুল সংবাদ
এসেছিল যখন প্রাথমিক নিশ্চিন্ততার শেষে ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠেছিল পরিতাপ। নিদ্রা আসত না কতকাল। মহার্ঘ শয্যা কন্টকবৎ। উপাদেয় অন্ন বিস্বাদ হয়ে উঠেছিল দিনের পর দিন। শেষে আবার—। থাক সে কথা।
কিন্তু এখন পুত্রের খেদোক্তি শুনতে শুনতে তাঁর ভিতরের যে দানবটাকে ঘুম
পাড়িয়ে রাখতে চেষ্টা করেন, তন্দ্রা ভেঙে জেগে উঠছে সে। তার নিঃশ্বাসে
আগুনের হল্কা! নর রক্তের গন্ধ পেয়ে লোভাতুর সে।
আতঙ্কিত স্বরে তিনি বলেন,-“হে পুত্র! লোভের পরিণাম ধ্বংস। বাস্তবের ভূমিতে নেমে এসে সুবুদ্ধি প্রয়োগ করে সর্ব দিক বিবেচনা কর বৎস। মহাবলী ভীম,
ধনুর্ধর অর্জুন, শ্রেষ্ঠ কূটনীতিজ্ঞ কৃষ্ণ সম্মিলিত হয়েছেন যেখানে, সেখানে
দেবতারাও অসহায়। এই বিরোধিতার ফল যে কি ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা কি তুমি
অনুমান করতে পারছ না? পরস্বাপহরণের চিন্তা ত্যাগ কর বাছা। আপন সম্পদ নিয়ে
সুখী থাক।”
চতুর হাসি ফুটে উঠল দুর্যোধনের মুখে। তিনি
বললেন,-“অকারণেই উদ্বিগ্ন হচ্ছেন পিতা। সকল জীবের মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ
কেন? তার চিন্তা করার ক্ষমতার আছে বলেই তো?
মাতুল পরিকল্পনাটি খুলে বলুন তবে?”
শকুনি মৃদু স্বরে বললেন,-“হে রাজন, যুধিষ্ঠিরের ব্যাসন বলতে একটিই, দ্যূত
ক্রীড়া। কিন্তু উৎসাহ যত তার এক দশমাংশও নৈপুণ্য নাই। আর অহঙ্কার ক্ষমা করবেন, আমার তুল্য কুশলী অক্ষবিদ এ ভারতভূমিতে দ্বিতীয়টি
নাই। তাকে আহ্বান করুন পাশা খেলায়। রাজধর্ম অনুসারে
এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না সে। আর তখনই”---কথার
মাঝে কুটিল হাসেন শকুনি। “তখনই অক্ষ-বলের প্রয়োগে জিতে নেব তার ভূমি ও সকল
ঐশ্বর্য। আপনি অনুমতি দিন আর্য।”
অনেকক্ষণ নৈঃশব্দ বিরাজ করে সেখানে। তারপর
ধৃতরাষ্ট্র ব্যাকুল হয়ে বলেন,-“কিন্তু বিদুর আমাদের মন্ত্রী, তাঁকে খুলে বলি সব কথা। তিনি দুই পক্ষে মঙ্গল অমঙ্গল বিবেচনা করে যথার্থ মন্ত্রণা দেবেন আগে। তাঁর অমতে আমি কেমন করে—” – তাঁর চিরকালীন সেই লালসা প্রবল হয়ে উঠেছে, তবু স্বল্প
অবশিষ্ট কিছু বিস্মৃতপ্রায়, নীতিবোধ দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে তাঁকে।
ক্রুদ্ধ বিদ্রূপে ফেটে পড়েন দুর্যোধন,-“মহামতি বিদুরের কথা বলছেন!
ক্ষাত্রধর্মের কি বোঝেন তিনি? স্পষ্টতই অকৃতজ্ঞ। তিনি আপনারই
অন্নে প্রতিপালিত, তবু পান্ডবভ্রাতাদের প্রতি তাঁর গভীর দুর্বলতা, এ তথ্য আপনি কি
জানেন না। আবাল্য দেখে এসেছি, অন্যায় পক্ষপাত তাঁর স্বভাবের
বৈশিষ্ট। পিতামহ ভীষ্মেরই মতো। আমি জানি, তাঁরা
নানাবিধ কুযুক্তিপূর্ণ বাক্য দ্বারা আপনাকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু মনে রাখবেন আর্য, যদি আপনি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যান, তবে সেই
মুহূর্তে আমি অগ্নিতে প্রবেশ করে আত্মপ্রাণ আহুতি দেব। ভাল!তাই ভাল!
তখন থাকবেন আপনি আপনার হিতৈষী বন্ধুবর্গের সাহচর্যে। এই হতভাগ্য
পুত্রের সংসর্গ ত্যাগ করে বড় আনন্দে কাল যাপন করবেন।”
অন্ধ বৃদ্ধের ভুবন কেঁপে ওঠে। হায় অবোধ যুবক, নিয়তি তোকে কোন
জটিল ভীষণ পথে নিয়ে চলেছে! তার আভাস পাই আমি প্রতিদিন, বায়সের কর্কশ ডাকে। সন্ধ্যায় শ্মশানের দিক থেকে দলবদ্ধ শৃগালের রব ভেসে আসে। ভেসে আসে চিতাধূমের কটু গন্ধ। রাক্ষস জেগে উঠেছে রে! নর মাংসাশী
রাক্ষস! বাতাসে রক্তের গন্ধ পেয়েছে সে। ছুটে আসছে। তার প্রবল
পদদাপে কেঁপে উঠেছে এ প্রাচীন প্রাসাদের ভিত্তিতল।
ক্রমশ
0 মন্তব্যসমূহ