—Vladimir Nobokov,
'Lolita']
অসুখ বেজে
ওঠার শব্দ শুরু হওয়া মাত্র বীজ সেঁধিয়ে যাচ্ছে যত্রতত্র; হরিধ্বনি আরম্ভের দিন
নেমে এল। এক জরা থেকে অন্য জরা অবধি প্রব্রজ্যায় আমাদের পোষ্য প্রাণীসমূহের
মৃত্যুদৃশ্য ভোগ করা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। নেই রক্তের লবণ জিভে রেখে
মাংস-সাধনায় হিম হয়ে ওঠা; অসুখ বেজে ওঠার শব্দ শুরু হওয়া মাত্র যম ও জরায়ু
একাকার হয়ে গেল, যে-ই পালাতে যাবে পথ তার শত্রু হয়ে যাবে এই দশায়। এভাবে পাথর
হওয়া শুরু হয়, কীটদষ্ট হওয়া শুরু হয়, যে-যার জন্মকুণ্ডলীর মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে
পাঁক স্পর্শের শিহরন আরম্ভ হয়, আর হরিধ্বনি... বীজ সেঁধিয়ে যাচ্ছে যত্রতত্র, আর
কঙ্কালগুল্মে ভরে যাওয়া চরাচরের ভিতর আমাদের পুত্রেষ্টি যজ্ঞের কাঠ তুলে খিলখিল
করে হাসছে মেয়েদের আয়ু। হাসির মন্থনে এত বিষ ছিল বুঝিনি কখনও।
মন্থন বিষের
শুরু; স্তম্ভন আপাত সমাধান
পুত্রেষ্টি
যজ্ঞের ধোঁয়া হু হু করে আকাশ ছাড়িয়ে
যে-মুহূর্তে
ঢুকে গেল অরুন্তুদ কৃতান্তনগরে
কোটি হরিধ্বনি
ভেঙে নারীহাস্য জেগে ওঠে, আর
অসুখ বাদ্যের
মতো ক্ষয়স্পর্শে আর্তনাদ ক’রে
কঙ্কালগুল্মের
গর্তে বীজ ঠুসে লয় পেয়ে গেল
লয় কঁকিয়ে
ওঠার শব্দে আয়ু গরল হয়ে যাচ্ছে; “মুখে নাও সর্বনাশ! মুখে নাও দর্পদণ্ড!” আওড়াতে
আওড়াতে আমাদের শুভাশুভ বিবাহগুলি সুসম্পন্ন হয়েছিল বলে যে ভ্রান্ত ধারণা
শান্তিকল্যাণের মতো পেলব ছিল, আজ তাও শুকিয়ে যেতে দেখলাম আমরা। দুঃসময় বলে একে
চিহ্নিত করা বা না-করায় আর কিছু যায় আসে না, দুর্ঘটনা বলে এতে শোকাহত হওয়ায়
ক্ষতিদহনের সম্ভাবনাও এক চিলতে কল্কে পায় না আর। অথচ আয়ুর গরল হয়ে যাওয়া
থমকানোর ক্ষমতা নিয়ে আমরা জন্মাইনি যেহেতু, স্থির দর্শকের মতো আমরা জোড়হাতে
ক্যাথারসিস ভিক্ষা করছি মৃদু সুরে। দূরে গোরস্থানের ভিতর একটি কালা ফকির
কঙ্কালগুল্মের ফুল ওপড়াতে ওপড়াতে গান গাইবার চেষ্টা করছে সারারাত। লয় কঁকিয়ে
ওঠার ঘটনার সাথে এর কী তুখোড় সাদৃশ্য, দীননাথ!
একটি গান ঠিক
গজিয়ে উঠবে শীতের আরম্ভে—এটুকু আশ্বাস যে-যার সংসারে বিছিয়ে রাখতে পারছি বলেই
এখনও অতীত মুচড়ে যায়নি আমাদের।
কঙ্কালগুল্মের
গর্তে বীজের করোটি ফাটে, শোনো!
জরাধন্য
ইহকাল; বেঁচেবর্তে থাকো শব্দ নিয়ে
প্রত্যাগমনের
চিন্তা ধুয়ে দিয়ে চলে গেছে যারা
প্রত্যাগমনের
চিন্তা ফাড়াই করেছে যত মেয়ে
তাদের ঈর্ষায়
রেখে কেঁপে উঠছি আদিম অসুখে
আমিই
নৃহত্যাকামী, স্বমাংস ভক্ষণকারী, একা...
কালা ফকিরের
কানে সপ্তকের হাড় ফেলে আসি
এক হাসিমন্থন
থেকে অন্য হাসিমন্থন অবধি যেতে যেতে দুনিয়া নিরেট। আমরা সজলধারা হাতড়িয়ে যা
কিছু স্পর্শ করতে পারছি, তার কিছুই আমাদের ব্যক্তিগত হয় না কোনোদিন। শুধু ছড়িয়ে
ছিটিয়ে থাকা কালা ফকিরের কাটা অঙ্গগুলি বেয়ে যে বিষ তার সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে
গড়িয়ে পড়েছে শেষরাতে, তার নিকৃষ্ট গন্ধটুকুই অন্তিম সেবাদাস। অসুখ বেজে ওঠার
শব্দে অভ্যস্ত জনপদের গর্ভে হরিধ্বনি উত্থানের দিন ঘনিয়ে আসছে, আর সরলবর্গীয় যুবতীদের
হাসিগুলি উজ্জ্বল পোয়াতিদের মতো অপেক্ষা সাজাচ্ছে পাশাপাশি। শুধু পোষ্যশবের দৃশ্য
দেখে দেখে আমাদের প্রব্রজ্যায় বিকলন ছড়িয়েছে এত যুগ, আজ শেষমেশ আমরা হাসির
শব্দ, হরিধ্বনির শব্দ শুনতে শুনতে টের পাচ্ছি বিষক্রিয়া খুব স্বাভাবিক। আরম্ভের
দিঘল যন্ত্রণা পেরিয়ে যেতে পারলেই অনন্ত শুশ্রূষা...
কালো
শুশ্রূষার মধ্যে যুবতীর সাদা সাদা নখ
এমন আঁচড়
দিচ্ছে ত্বক থেকে মায়া খসে পড়ে
হরিধ্বনি খসে
পড়ে; বিষক্রিয়া ঊরু বিস্তারের
মতো ইশারায়
আজ টেনে নিচ্ছে ঘর, পরিবার
কালো
শুশ্রূষার মেঘে সাদা সাদা বিদ্যুৎ বাজিয়ে
ফকিরের বধিরতা
কেটে যাবে—এ-আশায় জল
তুরীয়
বুদ্বুদ রেখে কুহক ভাসিয়ে নিয়ে গেল
কুহক ভেসে
যাওয়ার পর আর অসুখ বাজবে না, টের পাই। পুত্রেষ্টি যজ্ঞের কাঠ শান দিতে দিতে
সরলবর্গীয় মেয়েগুলি অস্ত্র প্রণয়নে এত পারদর্শী হয়ে উঠেছে, হননভয়ে সিঁটিয়ে
আছি সবাই। আরম্ভের যন্ত্রণাটুকু সহজেই অতিক্রম করা যাবে ভেবে যতবার আমরা
বিষক্রিয়ায় দেহ ঢলিয়ে দিয়েছি, ততবার বেজে উঠেছে কালা ফকিরের গান! আমরা
যন্ত্রণায় কাতরানোর অধিক কিছু পেরে উঠছি না, দীননাথ!
যে-যার মন
আঁচড়াতে আঁচড়াতে যত বেশি বিষকুম্ভের উৎস খুঁজে পাচ্ছি, তত নারকীয় লাগছে এই
হাসিমন্থনের চরাচর। পালাব ভেবেছিলাম, কিন্তু পোষ্যশবের দৃশ্যের পৌনঃপুনিক আক্রমণে
গুল্ফ ক্ষয়ে যাওয়ার লীলা আমাদের দৌড় ধ্বংস করে দিয়েছে কতকাল! আপাতত ঘাড়
দুমড়ে বসে কবন্ধে হাত বোলানো ছাড়া কোনো মায়া নেই। যেটুকু বিষের স্থিতি, সেটুকুই
মহা, জাগতিক।
যত্রতত্র বীজ
ছড়িয়ে যাওয়ার ঘটনায় যে দীন ভয়ের সঞ্চার,
তা থেকে দ্রুত
গার্হস্থ্য উঠিয়ে নিচ্ছি আমরা। পুত্রেষ্টি যজ্ঞের কাঠে
জোঁকের বসতি
দেখে যুবতীগুলির হাসি থামে না আর।
হরিধ্বনি থেমে
গেছে; পোষ্যের মৃত্যু থেমে গেছে; শুধু প্রতি রাতে
কালা ফকিরের
কশ বেয়ে বিষ নেমে আসার ঘটনায় বিরতি নেই কোনও।
গোরস্থানের ভিতর যে
কঙ্কালগুল্মের অবিমিশ্র জাগরূক থাকা, তার
গূঢ়ার্থ
উদ্ধারে আরও অনেক সময় লাগবে। ততদিন বিষকুম্ভের
উৎস হিসাবে
ঘরে ঘরে মনঃ পূজিত হওয়া জায়েজ়।
হাসি মন্থনের
সমস্ত প্রতিক্রিয়া থিতিয়ে আসার পর শোক লালনের
ক্রিয়া খুব
স্বাভাবিক লাগবে জানি। অসুখ বেজে ওঠার শব্দ
গড়িয়ে পড়ছে
সরলবর্গীয় মেয়েগুলির ছায়া বেয়ে।
যেমনই বিষাদ
হোক, তার যেন প্রতিলিপি থাকে।
1 মন্তব্যসমূহ
এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম অপূর্ব লেখাটি!
উত্তরমুছুন