মাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম সূর্যাস্তের আগে
মাঠে একটাই গাছ, পাখি নেই
গাছ থেকে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক, ধূতি পরা
আমি বললাম: বেশ রোগা
হয়েছেন, তখন ছিলাম
ক্লাস এইটের ছাত্র, অল্প মাইনার দিন আপনার
দিদির নিয়ে অশান্তি , ঝগড়া। এখন আমরা
বেশ আছি, সামনের মাসে
বাড়ি দেখে উঠে যাচ্ছি
চলুন পারলেÑমা’র সঙ্গে মজা করে আলাপ করিয়ে দেব,
চিনতেই পারবেন না। (সুবোধ সরকার: মৃত্যুদিবস : বাবাকে)
কোনদিন লেখালেখিতে আসব কিনা জানি না। তবে বাবা যেহেতু গ্রামীণ লোক উৎসব
বা গান-বাজনা পছন্দ করতেন-- ছুঁটে যেতেন আসরগুলোতে সেহেতু আমার মধ্যেও ছোটবেলা থেকে
জন্ম নিয়েছে গ্রামীণ এই বিষয়-আসয়। কবিতা লিখব একথা না ভাবলেও
কবিতা যে একদিন নিজের ঘেটি ধরে দূরে নিয়ে যাবে হয়তো এটা বুঝতে পেরেছিলাম বলেই ছন্দ
মিলিয়ে কবিতা লিখতাম। সন্ধ্যার আকাশে নিজেকে বিলিন করে বসেছি বড়বিলের মাঠে। এই মাঠের
কোণেই উড়িয়েছি কত আকাশ ঘুড়ি। পুকুরের জলে কত লিখেছি কবিতা। এই কবিতায় আজ আমার সর্বদা
গ্রাস করছে। এই কবিতার কারণেই দিনকে দিন বিসর্জন দিতে হচ্ছে নিজের আপনজন, সময়, শরীর। কবিতা তো নিজে নিজে চলে না সে অনেককিছুই কবির
কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। অনেককে বলতে শুনেছি অন্যকিছু লিখার সময় পাই না
বলেই তারা কবিতা লেখে। কবিতা লিখতে নাকি অল্প সময় লাগে। কবিতা লেখা এত সহজ কাজ--পৃথিবীতে এর মত সহজ কাজ নাকি নাই। জীবনকে পুড়িয়ে নিঃশেষ
করে করে কবিতার জন্ম হয়-- আরাম কেদারায়
বসে উদরপূর্তি করে কে কবে কবিতাকে কবিতা করতে পেরেছেন। তবুও আমরা লিখি-- বলি অভিনয় কলা এক স্বপ্নবাজ পাখি। ভোর হলেই উড়ে যায় অসীমের
দিকে.. ভাল্লাগে না-রবির কিরণ, পুকুরের জল। মাঝে মাঝে পুজামণ্ডপের প্রতিমা হতে ইচ্ছে হয় আর সুবোধ সরকারের
(জ..
১৯৫৮ ) কবিতার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে
করে-একটা সুন্দর ঝলমলে সবুজ রবিবার
ছিল/ আমি সেই রবিবারের জাতক।/একটা অসামান্য বাসন্তী রঙের রবিবার ছিল/ আমার বাবা সেই
রবিবারের ভোওে আমাদেও নদীতে/স্নান করতে নিয়ে যেতেন। কেন বা কিসের
জন্য জানি না। ধানের চারায় কৃষকের জৈবিক মিলন দেখেছি চাষাদের হাতে। শহরে এসে প্রকৃতির
নয়ন জুড়ানো সাজ দেখি না, দেখি ভণ্ডামীর ষোলকলা। পতিতার মত সেজে
খদ্দের খুঁজি হাত বা দৃষ্টি ঈশারাই। বাবা, তুমি বলতে নাহ-- গ্রাম আমার মা, গ্রাম আমার অস্তিত্ব।
সেদিন না বুঝলেও আজ বুঝি, শহরের যান্ত্রিকতা। শহরের মানুষ বুঝতে
চাইনা মানুষের বিবেকের কথা, বুঝতে চাইনা বাবা কিংবা মা হারা সন্তানের
দুঃখের আখ্যান সদৃশ্য নকশিকাঁথা। উঠোনে বসে অলসবেলায় গল্প শুনেছি ঠেকিয়ে দু”হাত গালে। তবু ভ্যানগঘ, পল গঁগা কিংবা পিকাসোর চিত্র
সাজিনি। মাঝে মাঝে সুলতানের চাষা সেজেছি মাথায় গামছা বেঁধে। বেলেজোস্নায় কুমার নদের
জলে একবার আমি আর তুমি ভিজিয়ে ছিলাম রোমাঞ্চিত শরীর বানভাসিদের মত ডুবে ডুবে গিয়েছি
অনেক দূরে। হ্যাচাং জ্বলা মাঠে জোনাকির আগমনে দাঁড়ি, গোঁফ লাগিয়ে
জুলিয়েট, জুলেখা সাজিয়েছি পাশের বাড়ির তোমাকে। তোমার কপাল জোড়া
লাল টিপে অবারিত মাঠক্ষেত আর শরীর ভাঁজে চিত্রকলা... জীবনের অবারিত
আনন্দ খুজে নিয়েছি কবিতার কাছে। বিভিন্ন সময় আশ্রয় নিয়েছি এই কবিতার কাছে। কবিতায় আমার
বেছে থাকার সঞ্জীবনী শক্তি। সুবোধ সরকারের কবিতা যেন আমাদের আবার বাস্তবতায় বাচার তাগাদা
ভিতরে জাগিয়ে তোলে। তার কবিতা পড়তে পড়তে সচেতনভাবে বাচার অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকি। এই
যে সব কথা বললাম-- এসব সুবোধ
সরকারের কবিতার সারকথা বললেও ভুল বলা হবে না। নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য সুবোধ সরকারের
কবিতার সাথে সম্ময় করার চেষ্টা করেছি মাত্র। এবার নিজেকে বলতে চাই ব্যর্থ মানুষ। যেমটি
সুবোধ সরকার বলেছেন আপাদমস্তক এক ব্যর্থলোক। তার কবিতায় তো মানুষের কথা বলে--বলে ব্যর্থতা, নিরাশা আর
হতাশাগ্রস্ত মানুষের জীবনের কথা।
কবি সুবোধ সরকারের কবিতা পাঠে এক অন্য রকম আনন্দ পাই। নিজের অজান্তেই
হৃদয়ের মধ্যে এক ধরনের ভাবাবেগ ঘটে। একেই বলে বুঝি কবিতা। কবিতার তো নিদিষ্ট কোন সীমারেখা
জানা নেই। কবিতা তো চলে আাপন গতিতে। কবি নিজেই যেন বাংলা কবিতায় এমন এক ধারা সৃজন করে
চললেন যেন কবিতার দিক থেকে এক অসীমতার জায়গা তৈরি হলো সুবোধ সরকারের হাত ধরে। কবিতা
তো আমাদের অন্যায়ের প্রতিবাদী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। যে সমাজে পুঁজিবাদ মাথাচারা দিয়ে
উঠছে দিনকে দিন-- গ্রাস করছে আমাদের চারিপাশ।
অস্থির সময়ের মধ্যে আমরা জীবন-যাপন করছি। মানবিকতা দিনকে দিন শূন্যের কোটায় এসে ঠেকেছে-- সে সময় বলা যায় সুবোধ সরকারের কবিতায় হয়ে ওঠে একান্ত
জনসাধারণের দাবির কবিতা। সে সমাজের যে অন্যায় অসঙ্গতিগুলো আমাদের অন্তরে ক্ষরণ তৈরি
করে, ক্লান্ত করে বিধ্বংস্ত করে তোলে--সেই অন্যায় আর অসঙ্গতির ভাষায় যেন প্রাণ ফিরে পাই সুবোধ
সরকারের কবিতা। তার কবিতায় আমরা একজন মানুষের লড়াই সংগ্রাম এবং প্রতিনিয়ত হেরে যাওয়ার
কথোপকথন লক্ষ্য করি। কবির কবিতায় আছে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও মানবিকতা, যা কখনো শ্লেষাত্মক, কখনো সরাসরি
সংবেদনশীল। তাছাড়াও তার কবিতায় স্বদেশ প্রেম, মানবতাবাদ কিংবা
মানুষের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো অসীম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
সব সময়ই উচ্চবর্ণের মানুষেরা নিম্নবর্ণের মানুষদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করে থাকে। এই সংকীর্ণ মনের মানুষেরা সব সময় নিজেদের
স্বার্থে অন্যদের ব্যবহার করতে চাই- আমি ফিরোজা, একটি ভারতীয় মেয়ে’
তেমনি একটি রাজনৈতিক কবিতা। আবার ফিরিয়ে দিন আমার ছেলেকে, কবরখানা ও সেক্স এলিজি কবিতাতে কবি বলছেন মেরুদণ্ডহীন রাষ্ট্র তথা স্বার্থবাদীরা
ক্ষমতার উপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের লাশের উপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতার মসনদে বসে। এজন্যই বিধবা
মায়ের একমাত্র সন্তানকে ফিরে পাবার জন্য আক্ষেপ করে ফিরতে হয় দ্বারে দ্বারে আর বিলাপ
করে বলতে হয়--পৃথিবীতে ভগবান এখন আর কথা
বলেন না-- কথা বলে এ.কে
ফরটি সেভেন।
কবি সুবোধ সরকাররের কবিতা যেন রাজনৈতিক কবিতার ভাষা হয়ে ওঠে--তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার সত্য কথায় যেন এক একটা
বুলেট হয়ে বিদ্ধ করে প্রতারক আর ভণ্ডদের অন্তরে। সুবোধ সরকার উচ্চারণ করেন রাজনৈতিক
শব্দের। যে রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তার কথা ভাবে না আমাদের নিশ্চয়তার কথা বলতে পারে
না। যেখানে প্রতিনিয়ত লাশ হয়ে ফিরতে হয় সেখানে কবি দীপ্ত কণ্ঠে বলতে পারেন--আমরা বাচ্চাদের নদীর ধারে কাঁদতে দেখেছিলাম।পৃথিবীতে এত খারাপ সময় এলো তবু আমরা
এর বাবার ওর বাবার তার বাবার ডেডবডি নিয়ে রাজনীতি করে চলেছি।
এই বোধ আমাদের সবার। এই উচ্চারণ রাজনৈনিক উচ্চারণ নয় এই কথা আমাদের সবার কথা। এই আহাজারি
সাধারণ জনগণের। আর কবি তাদের কথায় কবিতায় বারবার বলার চেষ্টা করেছেন। আজ একথা বলার
সময় আসেনি তবু বলি, হাসপাতাল নয়, পৃথিবীতে
আরো অনেক কবরখানা দরকার। রাষ্ট্র পরিচালনা সহজ কথা না-- মানুষের কথা ভাবতে হয়--তাদের আপন করে বুকের কাছে টেনেনিতে হয়। শুনতে হয় তাদের
কথা; ভাবতে হয় তাদের কথা। রাষ্ট্র পরিচালক
তাদের কথা কি ভাবার সময় পান? না তাদের কথা ভাবার সময় কোথায় তাদের-
তো ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রে লাশের সংখ্যা বাড়বে,
নারী ধর্ষিত হবে সন্তান হারানো মায়েদের লাইনও দীর্ঘ হোক তাতে কার কি
আসে যায়। থাকতে হবে ক্ষমতায়। যৌনতা এবং রাষ্ট্রপরিচালনায়, কেউ
চায় না কেউ উপরে উঠুক,কিন্তু কাজটাতো একজনকে করতেই হবে ওপরে উঠেই,সারাদিন মদ খেলেই যেমন শক্তির মতো লেখা যায় না,সারাদিন
ভ্যারেন্ডা ভাজলেই রাষ্ট্র চালানো যায় না
ড. অভিজিৎ গঙ্গোপাদ্যায়
তার সুবোধ সরকারের কবিতা: সময়, স্বদেশ ও
রাজনীতি প্রবন্ধ বলেছেনÑ‘বর্তমান বাংলা
কবিতার জগতে সুবোধ সরকার এক বিতর্কিক কবি। ব্যর্থ বামপন্থার দৃষ্টান্ত তাকে স্বাধীন
মতামত প্রদানের সেই অধিকার দিয়েছে ততখানিই, যতখানি দিয়েছে বির্তক।
কবি দেখেছেন খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র,
বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার
মতো মৌলিক অধিকারগুলো মানুষকে পৌছে দিতে ব্যর্থ হয়েছে বামপন্থীরা আর তাই নতুন প্রতিশ্রুতি
আর উদ্দীপনাময় নবগঠিত সরকারকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। বামপন্থী সমালোচনা মুখরিত হয়ে
উঠেছে তার কবিতা। সেই সঙ্গে হিন্দুইজম এর নামে হিন্দুত্বের শাসানির রাষ্ট্রীয় কৌশলকেও
বিরোধিতা করেছেন তিনি। তার কবিতার মধ্য দিয়েও তার প্রকাশ ঘটেছে।’ সাধারণ একটা মেয়ের জীবনে কত সংগ্রাম লড়াই থাকে। এই সংগ্রাম-লড়াই স্বার্থান্বেষীদের হৃদয়ে কোন উদ্বেগ তৈরি করে না। তারা তাদের স্বার্থেই
ফিরোজাকে ব্যবহার করতে চাই। কিন্তু এদের অন্তরে থাকে ভারতবর্ষ। সারাজীবন ধরে অন্তরে
লালন করে ভালোবাসা। এদেশের আলো-বাতাস গায়ে মেখে তারা বড় হয়। তবু
এই বিভীষিকাময়তার মধ্যেও টিকে থাকতে হয় একজন নারীকে।
...আমি আরবি শিখিনি, ফারসি শিখিনি,
উর্দু শিখিনি/ বাংলাই আমার ভাষা, এই ভাষা আমার ভাত, আমার রুটি/ আমার
চোখের কাজল, আমার পায়ের ঘুঙুর।/ এই ভাষা
আমার গোপন চিঠি, যার অক্ষরে অক্ষরে লেগে আছে/ আমার চোখের জল।/ আমরা যেদিন বিয়ে করি/ সেদিন কফিহাউস গিয়েছিলাম, ও সেদিন/ আমাকে ঝোলা ভর্তি করে রবীন্দ্রনাথ কিনে দিয়েছিল/ হাওড়া
স্টেশনে পৌঁছে কানে কানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন/ ফিরোজা,
তুমি আমার মৃন্ময়ী, তুমি আমার লাবণ্য/ তুমি আমার সুচরিতা।/ সেদিন রাত্রে কি হয়েছিল জানি না/
কি ঘটেছিল ওদের বাড়িতে, কি ঘটেছিল ওদের পাড়ায়,
কি করেছিল ওদের/ বাবাকাকÑসেটা আজও আমি জানি না/ কিন্তু তার পরের দিন ওকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি/
ও কোথায় চলে গেল আমি জানতে পারিনি।/ এই আপনাদের
ভারতবর্ষ?/ এই আমাদের ভারতবর্ষ?/ আমি একজন
সাধারণ মেয়ে/ অথচ বাড়িতে পাড়ায় অফিসে পুজোর প্যান্ডেলে/
বিয়ে বাড়িতে অন্নপ্রাশনে এখনো আমাকে নিয়ে ফিসফাস/ ডাক্তারের কাছে যাই--ফিসফাস/ কলেজে ঢুকি- ফিসফাস/ বাজারে যাই- ফিসফাস/ যে হাউসিং-এ থাকি সেখানেও চলতে থাকে অবিরাম লুকোচুরি।/ ওটা লুকোচুরি নয়, ওটা ফিসফাস নয়/
ওটা আপনাদের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক-একটা সুপ্ত গুজরাট।/
যদি আপনাদের হৃদয়/ বড় না করেন/ আকাশের দিকে আপনারা যদি না তাকান/ এই পোড়া দেশে আরো,
আরো, আরো/ অনেকগুলো পোড়া
গুজরাট তৈরি হবে। (কাল্লু, আমি ফিরোজা, একটি ভারতীয় মেয়ে)
২.
তুমি যেদিন প্রথম এসেছিলে আমার কাছে/তোমার হাতে মায়াকভ্স্কি/আর চোখে/সকালবেলার
আলো|/বিহার থেকে ফিরে এসে তুমি আবার এলে/গলা
নামিয়ে, বাষ্প লুকিয়ে/তুমি বলেছিলে বিহারের কথা/খুন হয়ে যাওয়া
বাবার কথা/আমি দেখতে পেলাম তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ণতা|/আবার এলে একদিন, আবারও এলে, আবার,
আবার/একদিন চিন নিয়ে কথা হল/একদিন ভিয়েৎনাম/একদিন কম্বোডিয়া/একদিন কিউবা/তোমার
চোখে সকালবেলার আলো/তুমি চে-গুয়েভারার ডায়েরি মুখস্ত বলেছিলে|
কিন্তু কী হল তোমার ?/আসা বন্ধ করে দিলে কেন ?/একদিন ফোন করেছিলাম,
তোমার বাড়ি থেকে/আমায় বলল, তিনদিন বাড়ি ফেরনি
তুমি/এরকম তো ছিলে না তুমি ? কী হয়েছে তোমার ?
এইমাত্র জানতে পারলাম/তুমি আমূল বদলে গেছ/তুমি আর আমাকে সহ্য করতে পার
না/মায়াকভ্ স্কি পুড়িয়ে ফেলেছ/ভারতের গো-বলয় থেকে গ্রাস করতে ছুটে আসা/একটা দলে তুমি নাম লিখিয়েছ|/আমি কোন দোষ করিনি তো ?/লিখিয়েছ, লিখিয়েছ|/তুমি কেন আমার বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলে
?/আমি কি তোমাকে জোড় করে/কার্ল মার্কস পড়াব ?/ ঘোড়াটিকে পুকুর পর্যন্ত ধরে আনা যায়/তাকে কি জোড় করে জল খাওয়ানো যায়
?/ওগো সকালবেলার আলো, তুমি একদিন/আবার কাছে ফিরে
আসবে, দরজা খোলা থাকবে আমার/ভালোবাসা নিয়ো। ( ছাত্রকে লেখা চিঠি: সুবোধ সরকার )
3.
মারাঠি ব্রাহ্মণেরা আপনার তিনশো কবিতা পাথর বেঁধে নদীর জলে/ফেলে দিয়ে
বলেছিল, "শূদ্র, শূদ্রের মতন থাক্/কবিতা লেখার এতই যখন শখ ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মালেই পারতিস্।/কিন্তু
সারা মহারাষ্ট্রের মানুষ বিশ্বাস করে/আপনার তিনশো কবিতা/একবছর বাদে জল থেকে উঠে এসেছিল।/একটি
ব্রাহ্মণ কন্যা একবার স্বপ্নে দেখেছিল আপনাকে/বিছানায় উঠে বসে সে তার স্বামীকে জড়িয়ে
ধরে বলে ফেললো/'জানো কে এসেছিল স্বপ্নে, তুকারাম'/সেই রাতে স্বামী নতুন বৌকে বেদম পিটিয়ে বাড়ি
থেকে বের করে দেয়/মেয়েটি কি পেরেছিল আপনার গ্রামে পৌঁছতে?/এই
মেয়েটি মারাঠি ভাষার প্রথম মহিলা কবি।/তুকারাম, আপনার কবিতা জল
থেকে উঠে এসেছিল কিনা জানি না/তবে মেয়েটি স্বামীর হাতে মার খেয়ে বাড়ী ছেড়েছিল/সে চোখ
বন্ধ করে মুখস্থ বলতো আপনার তিনশো কবিতা/৩৮ বছর বয়সে, তুকারাম,
আপনাকে হত্যা করা হলো/কিন্তু ব্রাহ্মণেরা একটা ছোট্ট সত্য বুঝতে পারেনি
সেদিন/কবিতার পান্ডুলিপি জলে ফেলে দিলেই, কবিতা ডুবে যায় না।
( তুকারাম : সুবোধ সরকার )
সুবোধ সরকার
রাজনৈতিক ব্যক্তি, মন্ত্রী,
আমলা, বামপন্থিদের ব্যর্থতার কাহিনি, নারীদের অধিকারে পাশাপাশি পুরুষদের অধিকার নিয়ে নির্মিত হয় তার কবিতার
ভূবন। কবির কবিতায় কাহিনি ও রুপকল্পের মিশেলে তৈরি হয় কবিতা। তিনি টানা গদ্যে বলে
যেতে পারেন কবিতা। কবিতাকেই যেন নতুন আঙ্গিকে বয়ান করে চলেন কবি-এযেন কবিতার অন্য
এক ফর্ম। যা সুবোধ সরকারের কবিতার করতলে এসে মাথাগোজে-একটু ভালোবাসা পেলেই উড়ে যায়
দিগন্তে। এই অন্যায় আর অসঙ্গতিই যেন সুবোধের কবিতার বড় জায়গা দখল করে আছে। তিনি
বলতে চান তাই তো বলেন। কবিতার ফর্মে বলেন কিন্তু কবিতার কোন নিয়ম মেনে নয়-নিজেই
নির্মাণ করে নতুন পথ-এটাই সুবোধ সরকারের সফল্যতা।
কবি সুবোধ সরকার শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন-- আমি একটা জেদ নিয়ে বেঁচে আছি যে কবিতার শরীর থেকে সব গহনাগাঁটি
খুলে ফেলবো। তাতে যদি কবিতা মার খায় খাক। এ কাজ আমার আগের অনেসকে করে গেছেন। আমি আর
একবার করব। কবিদের মধ্যে একটা লক্ষণ রেখা আছে সেটা মেনে চলতে হয়। কিন্তু কেন মেনে?
কেন আমি অন্যের জামা পড়বো। কেন আমি অন্যের থালায় খাবো? ভিখিরিরও একটা নিজস্ব থালা থাকে।’ কবি নিজের কবিতা নিরীক্ষায়
নিজেকে বিজয়ী করে তুলতে পেরেছেন; যে কারণে নিজেই নিজের কবিতার
দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি তার কবিতায় পক্ষ নিয়েছেন গরিব-দুঃখী
আর বঞ্চিত মানুষের। এতে করে তাকে বিদ্রোহী-সত্যের পক্ষের মানুষদেরন
থাকতে হয় থানায়। সত্যের পক্ষ্যের মানুষদের রাষ্ট্র ভয় পায় কিন্তু আমার মায়েরা আর জেল
জুলুম কিংবা বুলেটে ভয় পায় না। যে কারণে সুবোধ সরকার বলতে পারেন-আমার মা বাসন মাজে, আমার বাবা থানায়/আমার মা কাঁদে
না আর, রাত্রে ঠোঙা বানায়। কবি বাস্তবতার কথা বলেন কোন অলিক কল্পনায়
তিনি কবিতার কাঠামো তৈরি করেন না। তিনি ব্যর্থ বামদের তিরস্কার করতেও ছাড়েন না। যারা
একদিন সাধারণ মানুষকে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়েছিল; হাজার হাজার
মেধাবীদের ভিড়িয়েছিল তাদের দলে--কিন্তু শেষমেষ কি হল তাদের স্বপ্নের স্বদেশে। তারা বার বার ব্যর্থ হয়ে
ফিরে এসেছে দেশদ্রোহী কিংবা নকশা বা চরমপন্থীর লেভেল গায়ে লাগিয়ে। এখানে শেষ হলেও হত; এখানেই শেষ নয়-তাদের আবার বলতে হয় তোমরা রিভলবার চাও না আমাকে? কিন্তু এরাই একদিন পড়ে শোনাত কিটসের চিঠি/ চে গোয়েভারার ডায়েরি, মায়াকোভস্কির কবিতা। সুবোধের কবিতা
একদিকে যেমন বিস্ময়ের অন্যদিকে তেমনি আনন্দের। আনন্দ এই অর্থে যে তিনি অধিকারের কথা
বলতে জানেন। স্বদেশকে ভালোবাসেন বলেই তিনি তার কবিতায় নানাভাবেক ভারতবর্ষের কথা বলার
চেষ্টা করেছেন। তিনি ব্যক্তির মধ্য দিয়ে বৃহৎ অর্থে মানবতার জয়গান করেছেন- চেয়েছেন এই মানুষেরই মুক্তি। অরুণ মিত্র নানা জায়গায়
বলেছিলেন তার কবিতা বুঝতে হলে রাজনৈতিক ইজমের বাইরে এসে কবিতার রস্বাদন করতে হবে। তেমনি
আমি বলতে চাই কবি সুবোধ সরকারের কবিতা বুঝতে হলেও রাজনৈতিক ইজমের বাইরে এসে তার কবিতা
বুঝবার চেষ্টা করতে হবে। কেননা তার কবিতা আমাদের সময় বাস্তবাকেই প্রদর্শন করে; সেই সাথে প্রত্যহ জীবনে ঘটে যাওয়া সত্যকেই ধারণ করে বর্ণিত
হয় জীবনচক্র মর্মান্তিকতা আর এ চক্রের গোলকধালায় মর্মান্তিকতা সৃষ্টি হয় কতিপয় সুবিধাবাদী
ক্ষমতা লিপ্সু মানুষের হাতে। এজন্যই বাস্তববাদী গণচেতনামুখর হতে হয় কবিকে কবিতায়। যা
আমাদের উজ্জীবিত করে স্বাতন্ত্রদৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে; রাষ্ট্রিক
ও সামাজিক সত্যগুলো বোঝার উপায় বাতলে দেয়--‘প্রত্যেক মানুষের মাঝে একজন হারামী বাস করে’ এর চেয়ে সত্য কবিতা কিইবা হতে পারে আর একথা সুবোধ সরকার ছাড়া কেই বা আছেন বলার।
0 মন্তব্যসমূহ