পুষ্পা বুঝতে পারে এ কথা কাউকে বলার নয়। বললে
লোকে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। আর অঙ্কুর পুরোটা মন দিয়ে শুনবে, তারপর নির্ঘাত খুব
সংবেদনশীল ভঙ্গিতে ওকে মনস্তত্ত্ববিদের কাছে নিয়ে যেতে চাইবে। অঙ্কুর এরকমই। মানুষ
খারাপ নয়, কিন্তু গোঁড়া রকমের যুক্তিবাদী। ওর নিজের বোধের বাইরেও যে কিছু থাকতে
পারে, তা মানতে রাজি হয় না কিছুতেই। গোঁড়ামি যে, কোনোদিকেই ভাল নয়, কে বলে ওকে!
অথচ পুষ্পা নিজে জানে
ওর মনের ভুল নয়। সত্যিই এই ঘটনাটা বারবার ঘটছে। আর ও আজকাল বিশ্বাস করতে শুরু
করেছে, নিশ্চয় এর পিছনে কোনো এক অজানা তাৎপর্য আছে।
প্রথম বার খুব ভোরে এমন হয়েছিল। তখনও আলো ফোটেনি। অল্প
ঠান্ডা ছিল। সবে ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু অত তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে ওঠার ইচ্ছে ছিল না।
আর এক দফা ঘুমনোর চেষ্টা করছিল ও। পাশে অঙ্কুর তখনও অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
ঠিক তখনই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটল। বিছানার তলা থেকে কেউ যেন ধাক্কা দিল ওর পিঠের কাছে। খুব জোর নয়। হালকা ধাক্কা। কিন্তু
স্পষ্ট। চমকে উঠল পুষ্পা। তাকিয়ে দেখল অঙ্কুর তেমনই ঘুমোচ্ছে। কোথাও কোনো শব্দ
নেই। বড় ইঁদুরের কান্ড নাকি? খাটের তলাটা দেখল তাড়াতাড়ি। পরিষ্কার তক্তকে। কোথাও
কিছু নেই। পালাল তবে ইঁদুরটা? কিন্তু ঢুকলোই বা কোন দিক দিয়ে। ঘরের ওপাশের গ্রিলের
জানলাটা খোলা বটে, কিন্তু আগে কখনও এমন হয়নি।
ঘুমের আমেজটা কেটে
গেছে, তবু ও আবার শুয়ে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে নিঃশব্দ সেই ধাক্কাটা আবার টের পেল ও।
খুব স্পষ্ট। ওর কিন্তু ভয় করল না
একটুও। শুধু মনে হলো এই ধাক্কাটার উৎস ওর দেখা-শোনা-ছোঁয়ার জগৎ নয়। কোনো
রহস্যময়তার ওপার থেকে আসছে এটা। কি এ? কেউ কি কিছু বলতে চায় ওকে?
আর শুয়ে থাকা যায় না।
উঠে পড়ল বিছানা থেকে। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। শহরের ঘন বাড়িঘর আর বহুতলের ফাঁকে
একটা ভাঙাচোরা পুরনো দিনের বড় বাড়ি অনেক দিন ধরে পড়ে রয়েছে সামনের দিকে। সেই বাড়ির
চৌহদ্দির মধ্যে আছে একটা ঝুপসি আমগাছ। বস্তির ছেলেমেয়েরা সে আম পাকতে দেয় না। অনেক পাখি আর কাঠবিড়ালির বাস গাছটাতে। ওই গাছের দৌলতেই পুষ্পা টের পায় এত রকমারি
পাখি এখনও থেকে গেছে শহরের এমন ভিড়ে ভরা অঞ্চলেও।
সকালে চা খেতে খেতে
অঙ্কুর বলল,-“ওই বাড়িটা ভাঙা হবে জান? শপিং মল হবে ওখানে?”
“তাই?” – পুষ্পা অবাক হলো। বাড়ির বর্তমান মালিকেরা বহুকাল থেকে বাইরে, এইটুকুই শুনেছিল
শুধু। কখনও কাউকে দেখেনি।
দীপ্তেশকাকু এখানকার পুরনো বাসিন্দা। তিনিও ছেলেবেলা থেকে এ বাড়ি
এমনই দেখে আসছেন। তাঁর বাবার মুখে
শুনেছেন, এত চমৎকার বাড়ি নাকি এ তল্লাটে আর দ্বিতীয়টি ছিল না। বাড়ির সেই সময়ের
মালিক অমরেশ রায় অকালে মারা যাবার পরে, তাঁর স্ত্রী দুই ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি
চলে গিয়েছিলেন। গত পঞ্চাশ ষাট বছর
এখানে আর কেউ আসেনি। এখন জানা যাচ্ছে অমরেশবাবুর নাতিরা বুঝি অনেক আগেই
পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে গেছে। তাদেরও তো বয়স কম হলো না। এখন নাকি তারা এক
প্রোমোটারের কাছে বেচে দিতে চাইছে।
ভগ্নস্তূপ সাফ করে বহুতল গড়ে উঠবে জায়গাটায়, এমনই শোনা যাচ্ছে।
এর মধ্যে পুষ্পার কিছু বলার নেই। তবু এই ভাঙা
বাড়ি আর এই আদ্যিকালের আমগাছটার উপর অদ্ভুত এক ধরনের টান তৈরি হয়ে গেছে তার বিয়ের
পরে এই এক বছরের মধ্যে। কাজ না থাকা অবসরের মুহূর্তগুলোতে বারান্দায় এসে বাড়িটার
দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হরেক কল্পনা গুনগুন করে ওঠে তার মনে। কারা থাকত এখানে?
কেমন ছিল তাদের দিনগুলো? রাতগুলো?
ভাঙা দেওয়াল ফুঁড়ে বটপাকুড়ের অজস্র চারা।
দরজা, জানলার কাঠের পাল্লা কবেই উধাও! সামনের জমির ঠিক মাঝখানে আমগাছটা কেবল
দাঁড়িয়ে আছে অনেক পুরনো কথার সাক্ষী হয়ে। হঠাৎ কেমন মন কেমন করে উঠল পুষ্পার।
সমস্ত আগাছার সঙ্গে আমগাছটাও নিশ্চয় কেটে সাফ করে দেবে ওরা। ঝক্ঝকে শপিং মলে যারা
যাবে, তারা কোনোদিন জানবেই না ও গাছের কথা।
ঠিক তখনই---চারদিকে ফটফটে সকালের আলো---অঙ্কুর
সামনে বসে আছে---আবার একবার সেই ধাক্কা আলতো ভাবে এসে লাগল ওর পিঠে। কিন্তু
আশ্চর্য, কোনো রকম আপাত প্রতিক্রিয়া তৈরি হল না শরীরে। কারণ অঙ্কুরের মুখের দিকে
তাকিয়ে পুষ্পা বুঝতে পারল সে কিছুই টের পায়নি।
এরপর থেকে এমন হয় প্রায়ই। যখন তখন। অনেক সময়ে অন্য লোকেদের
উপস্থিতির মধ্যেও। কিন্তু কেউ কিছু
বুঝতে পারে না।
পুষ্পা ইদানীং এই
ঘটনাটার সঙ্গে খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে, কিন্তু অস্বস্তি লেগেই থাকে। সামনে কাউকে
অচেনা ভাষায় কথা বলতে শুনলে, যেমন বুঝতে চাওয়ার এক ইচ্ছে জেগে ওঠে মনে। নিজস্ব কথা বলার জন্যে পুষ্পাকেই কি বেছে নিয়েছে কেউ?
পাশের বাড়ির অমৃতা বলল,- ওই পোড়ো বাড়িটা
বিক্রি হয়ে গেছে জান? সামনের সপ্তাহ থেকেই প্রোমোটার ভাঙতে শুরু করবে। এখন তো আর
বাড়ি বলা যায় না ওটাকে, জঙ্গলঢাকা ইঁটের স্তূপ কেবল। গাছ টাছ যা আছে সবই কাটতে
হবে।
পুষ্পার মনে হলো
অমৃতা যেন খুশিই হয়েছে বাড়িটা ভাঙা হবে বলে। নিঝ্ঝুম দুপুরে সে বারান্দায় এসে
অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল ভাঙা বাড়িটার দিকে।
বাড়িটা যেন চারপাশের লোকের ভিড় থেকে আলাদা এক দ্বীপ। একটা কাঠবেড়ালী
সড়সড় করে নেমে এল গাছের গা বেয়ে। তারপর ছুটে ইঁটের ভগ্নস্তূপের মধ্যে উধাও হয়ে
গেল। পুষ্পা ভাবল এত পাখির দল কোথায় যাবে তখন?
ঠিক তক্ষুনি ধাক্কাটা লাগল আবার। কয়েক মুহূর্ত সামনের দিকে
চেয়ে রইল পুষ্পা। হলদে-সবুজ আমের বউলে গাছের মাথা একেবারে ছেয়ে গেছে। বুকের মধ্যে
হঠাৎ তোলপাড় করে উঠল রক্তস্রোত। নতুন এক ভাষা এইমাত্র শিখে নিয়েছে সে। বুঝতে পারছে
এতদিন ধরে বলে চলা গাছটার আকুতির ভাষা।
নিজের মন ঠিক করে
নিয়েছে পুষ্পা মুহূর্তের মধ্যে। যতই শক্ত হোক এ কাজ করতেই হবে ওকে। প্রোমোটারের থাবা থেকে যেমন করে হোক ওই আমগাছকে বাঁচাবেই
ও।
0 মন্তব্যসমূহ