সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

বিশ্বজিৎ বাগচী


প্রকৃতি পুরুষ বুদ্ধদেব গুহ

    গাড়ীতে বীয়ার লোড করা হল। পিছনের সীটে আমি আর বুদ্ধদেব গুহ । বুদ্ধদেব গুহকে আমি কোনও দিন লালাদা বলে ডাকিনি। বুদ্ধদেবদা বলতাম। এখন আমরা মধ্যপ্রদেশের সিংগরোলী জেলার সদর শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার পিছনে আমরোলী মোড়ে। এরপর মাঢ়া কেভের রাস্তায় আর লিকার শপ নেই। মাঢ়ার পাহাড়ে  কিছু শাক্ত গুহা আছে  আর জঙ্গল। 

     সিংগরোলীর সদর শহর ওয়াইঢ্যানকে  বাঁ হাতে রেখে আমরা এগোলাম। লোকালয় কমে

আসতেই বীয়ার খোলা হল। দুপাশে মহুয়া গাছের সারি। বুদ্ধদেবদা দুটো চুমুক দিয়েই বললেন বীয়ারটা ফ্ল্যাট হয়ে গেছে। পুরানো স্টক। নতুন বিশেষণ শিখলাম।

     স্টেট হাইওয়ে ছেড়ে সিঙ্গল রোডে ঢুকলাম। ক্রমশ জঙ্গল ঘন হচ্ছে। বিয়ারও কমছে।  হঠাত বুদ্ধদেবদা গাড়ী থামাতে বললেন। বুঝলাম না কেন, তবু দাঁড়ালাম। একটা গাছের পাতা নেড়ে , ডালপালা ঝাঁকিয়ে বললেন এখানে কাজু গাছ কী করে এল।

 

      এই রাস্তা দিয়ে বহুবার গিয়েছি। পিকনিক করতে,জঙ্গলে হুইস্কি উৎসব করতে,জানতাম না এখানে কাজু গাছ আছে। প্রকৃতি বুদ্ধদেবদার পরতে পরতে। মাঢ়া গুহা দেখালাম। খুব খুশী হলেন । এখানেও মা কালীকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছে শাক্তরা। আরো পাঁচ - সাত কিলোমিটার যেতেই, একটা পাহাড়ি ঝরনা। দাঁড়ালাম। এপাড়ে বিড়ি পাতার জঙ্গল। মহুয়াও আছে। ওপাড়ে ঘনতর জঙ্গল। স্থানীয় আদিবাসীরা বিড়িপাতা , মহুয়া ফুল কুড়াচ্ছে।                        

 - এরা কোন ট্রাইব? বুদ্ধদেবদা জিজ্ঞেস করলেন। বলতে পারলাম না। লজ্জিত হলাম। এত বছর আছি,অথচ আমি জানি না। বুদ্ধদেবদা ওদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেন। আমায় বললেন, ওরা ‘গঁদ উপজাতি।

আমরা দুজন দুটো পাথরের উপর বসে ঝরনার  ধারে বীয়ার খাচ্ছি।

এখানে কী কী জন্তু আছে?

-কিছু হরিণ , বুনো খরগোশ ,সজারু ...এইসব আর কী?

-এদিকে বাঘ নেই ?

আমি চমকে উঠলাম, আছে তো। আদিবাসীরা বলে একটা বাঘ আছে। কানে শুনতে পায় না। দেখিনি কোনোদিন তবে পায়ের ছাপ দেখেছি ঝরনা ধারে।

-কালা বাঘ ! মানুষ মারেনি কোনও দিন ? ওদের ডাকো। আদিবাসীদের দিকে দেখিয়ে বললেন।


      --ওদের সাথে কথা শুরু করলেন। আমি গাড়ি থেকে বীয়ার আনতে গেলাম। ফিরে দেখি ওঁকে ঘিরে আদিবাসীরা বসে আছে আর উনি ওদের সাথে ভাঙা ভাঙা ভাষায় কথা বলছেন।

 

        দুপুর সাড়ে তিনটে বাজে। প্রচুর বীয়ার আর কাজু খাচ্ছি। লাঞ্চ হয়নি। রাস্তায় কোনও ধাবাও নেই যে ওঁকে খাওয়াব।  উনি তখন বাঘে মত্ত ,বুঝলে বিশ্বজিৎ বাঘটার বয়স হয়েছে তাই কানে শোনে না।  এই প্রথম কালা বাঘের কথা শুনলাম। আরেকদিন আসতে হবে এখানে।

-আপনার লাঞ্চের দেরী হয়ে যাচ্ছে? আমার কোয়ার্টার তো আমলোরীতে। আপনার গেস্ট হাউস তো আরো তিরিশ কিলোমিটার ,খাবেন কখন?

-কেন তোমার বাড়িতে খাব। আরো বীয়ার লাগবে তো।

-‘ভালো খাবার নেই কিন্তু।

       আরো বীয়ার কিনে নিয়ে আমরা পৌছালাম কোয়ার্টারে।  আমার বাড়িতে তখন দুই বড় শালী ও এক ভায়রা।  বুদ্ধদেবদা ঢুকতেই  হল্লা শুরু হয়ে গেল।  আমার ভায়রাও বীয়ার নিয়ে বসল। বুদ্ধদেবদার তখন প্রেমিক রূপ। বললেন, এরকম বউ ,দুই শালীকে নিয়ে তো খাসা আছ এখন? এরা সবাই তো স্বপ্নময়ের বোন। আমি কিন্তু এদের সাথে প্রেম করব। আমার বড় শালী গান করলেন। বুদ্ধদেবদা টপ্পা ধরলেন। ‘ভালো বাসিবে বলে

 

    খাবার টেবিলে তখন আড় মাছ , চিতলের পেটি আরো অনেক কিছু। আমার ভায়রা মিহিরদা ভীষণ ভোজন রসিক। এসব বাজার তারই করা। বুদ্ধদেবদা খাবারের প্রশংসা করতে করতে বললেন , বিশ্বজিৎ যে বলল  ভালো খাবার নেই। আসলে আমাকে বাড়িতে আনতে চাইছিল না।

আওয়া,আমার বউ বলল, এই মাছগুলোর একটা পিসও ও খাবে না। ও মাংসাশী প্রাণী। মিহির’ দা জিজ্ঞেস করল ‘ আপনি কচ্ছপের মাংস খান?

-কোথায় পাবে  তুমি কচ্ছপ ? আমি খুব ভালোবাসি। 

-এখানে পাওয়া যায়? নিয়ে আসি তাহলে?

-তুমি যেদিন কচ্ছ আনবে সেদিন তাহলে আমার নেমন্তন্য।

সবাই তো হো হো করে হেসে উঠল।

ইতিমধ্যে  আমার  ‘দুর্বাসা’ এর বন্ধু বান্ধব উদয়েন্দু দাশ, প্রণব চৌধুরীরাও।

 

        আবার একদিন মাঢ়ার জঙ্গলে গেলাম । আবার বুদ্ধদেবদা কালা বাঘের খবর নিলেন। আদিবাসীদের সাথে কথা বললেন। এই জায়গাটার নাম ঝিঙ্গাঝরিয়া।  কয়েকদিন খুব হুল্লোরে কাটলো। অফিসার্স ক্লাবে বুদ্ধদেব দাকে সম্বর্ধনা দিলাম । দর্শকদের সাথে প্রশ্নোত্তর হল। , প্রচুর গান শোনালেন। রাত্তিরে ডিনার পার্টিও ছিল। নর্দান কোলফিল্ডস –এর চেয়ারম্যান , ডাইরেক্টার ও ছিলেন ওখানে।

 

    দুর্গা পূজার আগে আমাকে চিঠি লিখলেন , বিশ্বজিৎ , শারদীয়া বর্তমান কিনো ? এখানে লিখেছি ঋজুদার উপন্যাস । ‘ঝিঙ্গা ঝোরিয়ার মানুষখেকো’। সিংগরোলীতে তখনও মোবাইল আসেনি।

    পুজোয় কলকাতায় পৌঁছে শারদীয়া বর্তমান কিনলাম। ঋজুদার উপন্যাস পড়ে তো অবাক। আমি বিশ্বজিৎ বাগচী নামেই উপন্যাসের একটা চরিত্র হয়ে গিয়েছি।

পূজোর পর একদিন বুদ্ধদেবদার অফিসে গেলাম। সেক্রেটারী বললেন , অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ? আমি না বলতে বললেন তাহলে তো দেখা করা যাবে না।

আমি কী করব তখন বুঝতে পারছি না। আমি সেক্রেটারিকে বললাম আপনি কাইন্ডলি ওনাকে  বলুন সিংগরোলী  থেকে বিশ্বজিৎ বাগচী এসেছে। উনি দেখা না করতে চাইলে আমি চলে যাব ।

সেক্রেটারি কিছুটা নিম রাজি হয়ে ভেতরে গেলেন। ফিরে এলেন হাসি মুখে, আপনি কে মশাই ? আপনাকে ভিতরে ডাকছেন আর আজকের সব অ্যপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল করে দিলেন।

 আমি ভিতরে যেতেই উনি হৈ হৈ করে উঠলেন, শারদীয়া বর্তমান পড়েছ? কেমন লাগলো?  তোমার চরিত্রটা তুমি যেমন তেমনই লিখেছি। আমি হাসলাম।  - তুমি আমার আরো লেখাতে থাকবে। তোমার মত চরিত্র তো আমি খুঁজে বেড়াই। এবার চলো নীচে, ভদকা খাওয়া যাক।  নীচেই 'সাগর' বার। দুজনে বসলাম। প্রচুর গল্প হলো। এত জানেন, এত বিভিন্ন বিষয়ে।আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি শিকার করেন এখনো? হাসতে হাসতে বললেন, যবে থেকে গভর্নমেন্ট ব্যান করে দিয়েছে, তবে থেকে আর করিনা।         

-রাইফেলগুলো কি করলেন, এখনো আছে?  

 - না, না, সব ভিক্টর ব্যানার্জিকে দিয়েছি। ও মুসৌরির ওপরে কোথাও একটা থাকে, ওখানে লুকিয়ে চুরিয়ে শিকার করে হয়তো। 

 যখনই ওনার সাথে দেখা হতো, দামী পেন, বই আর ড্রিংকস এর বোতল দিতেন। ঘড়িও দিয়েছেন কয়েকবার। এতটাই উদার মনের ছিলেন যে সবসময় ওনার সাথে ড্রিংকস নিয়ে বসতে হতো, সে বাড়িতেই হোক বা অফিসে। এরপরে আবার একবার পূজোসংখ্যায় লিখলেন উপন্যাস, 'পামরি'। সেখানেও আমার চরিত্র, স্বনামেই।

            প্রচুর আড্ডা দিয়েছি ওনার সাথে। একবার আমার সামনেই ফোন এল অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তীর ।  মাসাইমারা জঙ্গলে যাওয়ার আমন্ত্রণ।   বুদ্ধদেবদা একপায়ে খাড়া। 


             বুদ্ধদেবদা যখন চলে গেলেন, আমি তখন ব্যাঙ্গালোরে। অবশ্য কলকাতায় থাকলেও ওনাকে অন্তিম বিদায়  জানাতে যেতাম না। ওইরকম একজন জীবন্ত মানুষকে মৃত দেখতে পারতাম না। এইরকম মাপের মানুষরা যখন চলে যান হৃদয়ের ভিতরে একটা শূন্যতা তৈরী হয়, যা কোনোদিনও ভরাট হওয়ার নয়।




 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব আন্তরিক হয়েছে লেখাটা। তোমার সিংগরোলীর দিনগুলো সুন্দর ফুটে ঊঠেছে। বুদ্ধদেব গুহর সাথে তোমার এতো আন্তরিক সম্পর্ক, সেটাও আমার অজানা ছিলো। খুব ভালো লাগলো।

    উত্তরমুছুন