আশ্বিন কি এক যাদুকরী মাস! পুজোর কথায় অপরূপ স্মৃতিমেদুর গন্ধ-শিশিরে এখনও ভিজে ওঠে হৃদয়ের আঙিনা। তার মায়াময় টান প্রবাসীকে, দূরবর্তীকে কাছে টানে, ঘরে ফেরার ডাক পাঠায় কচিধানের অক্ষরে নীল আকাশের খামে ভরে! গ্রামবাংলার পবিত্র মাটির প্রদীপ যুগযুগান্তর ধরে কত গল্পই লেখে অদৃশ্য বর্ণমালায়। আর দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলার গাছ-পাতা-ফুলেদের বুকের ভেতর বেজে ওঠে ঢাক, কাসরঘন্টা, দুলে ওঠে শুভ্র কাশ। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, অতিমারির কালেও মানুষ তার সংবেদী হৃদয়ের শঙখধ্বনি বাজিয়েছে এ আশ্বিনেও। সে ডাকে সাড়া দিয়ে বেঁধে বেঁধে থাকবার মন্ত্র বুকে নিয়ে এক হই। পৃথিবীময় এই অভাবিত প্রতিকূল সময়ে প্রত্যক্ষ করছি মানুষের প্রকৃত মানবিক মুখচ্ছবি। ঝড়ে, ঝঞ্জায়, রোগে, শোকে, করুণ মৃত্যুমিছিলে সাধারণ মানুষই পরমাত্মীয় হয়ে পরম সহায় হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা জানি দুঃখের কাল অতিক্রম করে যাবে পৃথিবী আবার। আশ্বিনের এই আশ্বাসবাণী তো আমাদের জগজ্জননী মায়েরই বার্তা।
সেই বাল্যকাল, যে সময় আর ফিরবেনা কোনোদিন তবু তারই জন্যে বিধুর হৃদয়। শরতের নীলাম্বরী আকাশে ভেসে যাওয়া সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে মনে মনে সেখানেই যে ফিরে যাওয়া!
ভরা বর্ষায় ভরে উঠত চারধারের খাল বিল মাঠ। গাল ফুলিয়ে ডেকে উঠত সোনাব্যাঙ -- জল ছপছপ মাঠে ফুটবলের আনন্দ হই-হুল্লোড়, বৃষ্টিভেজার খুশি, কলার মান্দাসে ভেসে বেড়ানো আর যৌথ পরিবারের রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা খিচুড়ির গন্ধ --- এ সবই অনন্য সঞ্চয়। তারপর বর্ষা শেষের ভরন্ত নদী নালা খালবিলে রূপোলি মাছের ঝাঁকের চঞ্চলতা, দিগন্তবিস্তারী সবুজ ফসল খেতের সাদা পাড় হয়ে দুলতে থাকা কাশের বন। টুপটাপ ঝরে পড়া শিউলি আর চাঁদের কিরণ, নারকেল নাড়ুর গন্ধ, কমলারঙ রোদের মাদকতা, ঘামতেলে চকচকে মায়ের মুখ, ধূপধুনোর গন্ধ, কাটাফলের গন্ধ, প্রদীপের সলতে পোড়ার গন্ধ, শিউলির গন্ধ হ্যাঁ, সবমিলিয়ে পুজোর গন্ধ।
অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যাওয়া, কচি-বুড়ো সবমিলিয়ে জনা বারো। ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় কে ভাসে, কে হৃদ- মাঝারে ঘুরেঘুরে মায়াবী সুরে বাঁশি বাজায়! আদিগন্ত সুরে ভাসে জীবনের মাঠ। নাঃ! তখন বিজ্ঞাপনের যাদু, ওই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা হয়ে সবাইকে ঝকঝকে দোকানে বা শপিংমলের পেটের ভেতর টেনে নেয়নি। তখন আমজনতা সামান্যতেই খুশি, অল্পেই তুষ্ট। মাটিলগ্ন গ্রামীণ মানুষের প্রয়োজন তো আরও সামান্যই। দিনমান শ্রমের বিনিময়ে তার অন্নসংস্থান। সন্ধ্যেয় খোলা আকাশের নিচে গালগল্প বা খোল করতাল সহযোগে পালাকীর্তন, গানের আসর। আসন্ন পুজোর জন্যে যাত্রা, থিয়েটারের রিহার্সাল। প্রকৃতিমায়ের ময়ূরকন্ঠী আঁচলের নরম উত্তাপে শরীর, মন সবই যেন পুকুরভরা শাপলার অত্যুজ্জ্বল আনন্দসাগরে ভাসছে!
পুজো আসছে পুজো আসছে-- ' আনন্দধারা বহিছে ভুবনে' পরিপূর্ণ, ভরভরন্ত প্রকৃতির রূপ, ভালবাসার জনেরা ঘিরে রয়েছেন চারিধার, বড় নির্ভার ও সুখের সময়, নিটোল নিভাঁজ। আত্মজন, বন্ধুজন, পাড়াপ্রতিবেশি সবাই জড়িয়ে নিতেন হৃদয়ের নিরুচ্চার উষ্ণতায়। সে প্রীতির সরোবরে অবগাহন কালে মনেই পড়েনা, কোন সে 'মহার্ঘ্য পোশাক, আসবাব বা পার্থিব ধন' আমার নেই। অনন্য হৃদয় ধনে ধনী ছিলাম আমরা। দশমীর মেলা, ধনী-দরিদ্র গ্রামসুদ্ধ লোক ধুলিময় মেলারমাঠে আনন্দকণা কুড়িয়ে নিতে হাজির। কাচের চুড়ি, বেলুন, খেলনা গাড়ি, খেলনা বন্দুক, হরেকরকম পুতুল, হরেকরকম মিষ্টি, নোনতা, গজা, খাজা; আহা কেমন সব সামান্য জিনিসে কত যে অসামান্য মজা! ভেঁপু, বাঁশি,ঢাক,কাসর সবমিলিয়ে যেন শান্তপুকুরের জলে ঢেউ উথলে উঠলো। পুজোর ক'টাদিন হঠাৎ রাশিরাশি আনন্দের ফুলঝুরি জ্বালিয়ে দিত কেউ। মাইকে বাজে 'নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায়... ' নবমী শেষে বুকের কিনারায় কেমন কষ্ট কষ্ট, ' ইস পুজোটা ফুরিয়ে যাচ্ছে!'
দশমীর সন্ধ্যায় গানের আসর বসে পুজো মণ্ডপের সামনে, সামিয়ানার নিচে। রাতে স্থানীয় অন্নপূর্ণা যাত্রাদলের যাত্রাপালা দেখতে ছেলে বুড়ো গাঁ সুদ্ধ লোক হাজির। কনসার্টের আওয়াজ, যাত্রার কুশিলবদের সংলাপ ওই নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকার পেরিয়ে দূরে দূরে ভেসে যেতে থাকে। দুর্গামা বুঝি তখন সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে প্রিয় বাহন সিংহটির পিঠে সওয়ার হয়ে লক্ষ কোটি তারার কোমল আলোর পথ ধরে কৈলাশের দিকে যাত্রা করেছেন! যাত্রাপালা শেষ হয় মাঝরাত পেরিয়ে, ঘরের পথে পা বাড়ায় দর্শক। মায়ের শূন্য মন্ডপের কোনের প্রদীপ নেভে।
এই মায়া-আশ্বিনের সবুজ সবুজ ফসলের মাঠ, সোনারঙ রোদ্দুর স্মরণ করায়, মানুষ মানুষের জন্য। স্মরণ করায় প্রকৃতি মায়ের চেয়ে এমন আপন আর কে আছে? তার কোলের পাশটিতে, সহজ যাপনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সেরা আনন্দের চাবিকাঠি! এই জগতের প্রতিটি প্রাণকণার ভিতর গভীর প্রীতির সুবাস অস্ফুটে জেগে থাকে। ভালবাসাই প্রকৃত জিয়নকাঠি, একমাত্র তারই ছোঁয়ায় সম্পূর্ণ বিকশিত হতে পারে মানুষের অনিন্দ্য সুন্দর হৃদ-কমল।
0 মন্তব্যসমূহ