মেলানকোলি মূহুর্তরা
(১)
চারপাশে যেন সবকিছু ভেঙে পড়ছে । বেলেঘাটা আই-ডি-র ঠিক সামনেই থেমে থাকা
অটোয় নেতিয়ে পড়ছে মুমূর্ষু রোগী । আমি তাকিয়ে দেখছি আর ভাবছি, সেই সব মানুষগুলো কতটা
অসহায়, যাদের নিকট আত্মীয়েরা এই পরিস্থিতিতে এখনো হসপিটালের আশে পাশে ঘুরছে, অথচ রোগীর
চিকিৎসার ব্যবস্থাটুকু করে উঠতে পারছে না ।
তোমার নিথর দেহ-টাকে ওরা ৩৬ ঘন্টা পরেও ছাড়তে পারবে না বলছে ! বলছে, যতক্ষণ
না অন্তত পঞ্চাশটি দেহ একত্রিত হচ্ছে, ততক্ষণ হসপিটাল থেকে বডি বেরোবে না ! হায় রে
! কোভিড প্রোটোকল ! ভারবাহী লরিতে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা, সাদা কাপড়ে ঢাকা মৃতদেহগুলো
দেখলে যে কোনো সুস্থ লোকও দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়বে । গতকালও শুনেছি, নিমতলা মহাশ্মশান
থেকে বিডন স্ট্রীট অবধি রাস্তায় শবদেহ-বহনকারী গাড়ির লম্বা লাইন লেগে গিয়েছিল । এদিকে
হসপিটালে শোচনীয় অবস্থা । রোগীর জন্য সামান্য পথ্য সংগ্রহ করে আনলেও, তা পৌঁছে দেওয়া
দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে । যদিও সবচেয়ে দুঃসহ অবস্থা সম্ভবত নার্সদের - হাজার হোক জীবন-মৃত্যুর
মাঝখানে সেতু তো তারাই ।
(২)
দু-দিন আগেও, যখন কিছুটা আশা ছিল, তখনও তোমার কাছে অব্দি কিছু পৌঁছাতে গেলে
কাউকে না কাউকে, একশো থেকে পাঁচশো টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছিল । কিছু বলার উপায় নেই,
সকলেই নিরুপায় । যারা টাকার বিনিময়েও কোভিড রোগীর কাছে যাচ্ছে, বা বলা ভালো যেতে
বাধ্য হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে তাদের যদি কিছু হয়, হয়তো তাদের টাকা দিয়েও চিকিৎসা
করা সম্ভব হবে না । রাজ্যে এখনও লকডাউন হয়নি বলে অনেকের কপালে ভাঁজ, আবার লকডাউন হয়ে
গেলে কী হবে, তা ভেবেও অনেকের কপালে ভাঁজ । জটিল পরিস্থিতি যাকে বলে । হাসি পায় শুনলে
যে, আই-পি-এল বন্ধ হয়ে গেল বলে, সৌরভ গাঙ্গুলী আক্ষেপ করেছে ! ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের
নাকি কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হয়ে গেল ! মানুষের প্রাণের চেয়ে ক্রিকেট বড়ো ? না না তা
কেন হবে ? আসলে মানুষের প্রাণের চেয়েও টাকা বড়ো - অন্তত কারো কারো কাছে ।
গতকাল বিকেলেও ঠিক এই জায়গাতে বসেই দেখে শিউরে উঠেছি, একেবারে নিকট আত্মীয়েরা-ও
কেমন কোভিড রোগীদের থেকে ভয়ে দূরে সরে থাকতে চাইছে । একটি বছর কুড়ির মেয়ে তার বাবার
বেডের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল । অস্থায়ী বেড, স্যালাইনের বোতল ঝুলছে । মেয়েটার বাবা
কেমন ছটফট করছিল আর নিজেই নিজের বুকটা ডলছিল । এসময় সহসা মাঝবয়সী ভদ্রলোকটি মেয়ের
দিকে হাত বাড়িয়ে হাতটা ধরতে চাইতেই, মেয়েটি যেন প্রচণ্ড আতঙ্কে পিছনে দেওয়ালের দিকে
সরে গিয়েছিল । এদিকে তখনও সে কেঁদে চলেছে । এই ভয়াবহতার সামনে, এই আতঙ্কের মধ্যে বসে
থাকতে থাকতে, মনে হয় সুস্থ লোকও অসুস্থ হয়ে পড়বে, একেবারে পাগল হয়ে যাবে । ভাবতে
অবাক লাগে এই অবস্থাতেও সামান্য ভোটকে কেন্দ্র করে, বহু জায়গায় অশান্তি চলছে । এমন
ভয়াবহতার মধ্যেও গোটা দেশে ভোট হচ্ছে, মিছিল বের হচ্ছে, অগুনতি মানুষের জমায়েত হচ্ছে,
আর তারপর ? এই প্রহসনের বলি হয়ে অসংখ্য অসহায় মানুষ যখন হসপিটালে বেড পাবেনা, প্রয়োজনীয়
খাবার, অক্সিজেন, ওষুধ পাবেনা, তখন কে দেখবে তাদের ? কে দাঁড়াবে তাদের পাশে ?
(৩)
আমার এখন একমাত্র সান্ত্বনা আর অন্যতম যন্ত্রনা সমার্থক । তোমার স্মৃতি
- অসংখ্য অজস্র স্মৃতি - দু-বছরের নিয়ম-মাফিক সঞ্চয় - সব শেষের মধ্যেও সেইগুলো আজ মাথার
মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে ।
"কিন্তু তুমি নেই বাহিরে - অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে !" - শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের
কবিতার পংক্তিগুলি মনে পড়ে যাচ্ছে । প্রায় দু-বছর আগে একদিন উত্তরবঙ্গের একটা হ্রদের
ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম । সবকিছু ওয়াশ পেইন্টিংয়ে পরিণত করে দেওয়া কুয়াশা ছিল সেদিন । অবিরাম
ভাপে গাড়ির কাঁচ অনবরত ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল । জলের উপরে শান্ত, শীতল বাতাস ঘুরপাক খাচ্ছিল
আর মাঝেমাঝেই শরীর ছুঁয়ে, কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল । অথচ সেই হাড়-কাঁপানো ঠান্ডায়, একটিবার
লেকের জলে হাত ডুবিয়েই চমকে গেছিলাম ! এমন হিমশীতল পারিপার্শ্বিকেও জলের নীচে উষ্ণতার
ওম ! কোনো কোনো মানুষ যেমন হয়... ঠিক তোমার মতো !
(8)
সেদিন সেই মুহূর্তে সহসা তোমায় দেখেছিলাম । অমন চোখ আমি কখনও দেখি নি !
যেন সবুজ ঘাস-বনে একটা ভীত কাঠবিড়ালি দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইছে - হ্যাঁ ঠিক ওমনি দৃষ্টি
ছিল সেই দু-চোখে । তারপর আমি তোমায় খুঁজে ফিরেছিলাম, গোটা ট্রিপে - এ পাহাড় থেকে ও
পাহাড় । চোখ আর স্মৃতির উপরে ভরসা ছিল না আমার । তাই ভরসা রেখেছিলাম হ্যান্ডিক্যামে,
থার্টি-টু-এক্স জুম-এ তোমার মুখখানা কাছে টেনে নিয়েছিলাম বারবার । দু-দিন ধরে প্রতিটা
সাইট সিয়িংয়ে, দর্শনীয় যা কিছু, তা দেখা মাটি করে দিয়েছিলে তুমি । একবার ঝরণার ধারে,
আর একবার নৃত্যরত পাহাড়ি নদীর বাঁকে খুঁজে পেয়েছিলাম তোমায় । বুঝতে চেয়েছিলাম কাঠবিড়ালি-টাকে
! তারপর যখন ক্যামেরায় লেন্স হয়ে মেমোরি কার্ডে বন্দী হলে, ঠিক তখনই ধরা পড়ে গেলাম
। সেই যে... লাভার মনাস্ট্রি দেখে নামার পথে ডাকলে, "শুনুন.. !"
আমি ফিরে তাকালাম আর আটকে গেলাম । সময় স্থির, সঞ্চরমান মেঘমালা স্থির, বায়ু
স্থির । কেবল হৃদয় অস্থির । এমনভাবে স্থির সময়ের সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার অনুভূতি আর কক্ষণও
হয় নি আমার ! আমার পলক যখন স্তব্ধ, তখন তোমার চোখে ছিল শাসন । আমি দেখলাম, তুমি একটা হাত বাড়িয়ে দিলে । কিছু বলেওছিলে
বোধহয় । কিন্তু আমি তো তখন মগ্ন-বধির ! শুধু মনে হয়েছিল, ওই হাতখানা একবার বুকে ছুঁইয়ে
দিলে আমি পাইন গাছের মতো শান্ত আর নির্ভীক হয়ে যাবো । আমার শিকড় গজাবে পায়ে আর শিরায়-শিরায়
বইবে প্রেমের হাওয়া । তারপর শুধু দাঁড়িয়ে থাকবো আর অনুভব করবো তোমার আশা-যাওয়া ।
পরে জেনেছিলাম, চড় খেতে খেতে কোনোক্রমে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম । কারণ তুমি
চেয়েছিলে, ক্যামেরাখানা । আমি বুঝি নি । বুঝেছিল দেবতারা । সেদিন, সেই মুহূর্তে, পাহাড়ে
তুষারপাত শুরু হয়েছিল... মরশুমের প্রথম তুষারপাত । তুমি ও নিশ্চই বুঝেছিল, ধরা দেওয়ার
সময় এসেছে !
(৫)
তারপর আমরা সমতলে ফিরে এলাম । প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিষ্কারের
ঢঙে তুমিও আবিষ্কৃত হয়ে আবার হারিয়ে যেতে পারতে বিস্মৃতির কুয়াশায় । কিন্তু তা হলো
না । মনে আছে, বাড়ি ফিরে সিঁড়ির ঠাকুরঘরে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত একটা প্রার্থনা করেছিলাম,
"ঠাকুর, এই মেয়েটাকে যেন আমি ভালোবাসতে পারি !"
তারপর ! নবমীর পূজা-মন্ডপে দুম করে তোমার দর্শন পেয়ে গেলাম । মঞ্চে ছিলেন,
শিবাজী চট্টোপাধ্যায় ও শকুন্তলা বড়ুয়া । আরেকজন লাস্যময়ী জাজ্-কে চিনতে পারিনি । কে
কত ভালো প্রেম নিবেদন করতে পারে, তারই রাউন্ড চলছিল, ‘পুজোর প্রেম’-নামে । একটা স্ট্যান্ড
করা বাইকে ঠেস দিয়ে দর্শক হয়ে গেলাম । প্রতিযোগীদের মধ্যে একটি ছেলে একটি মেয়ে-কে প্রপোজ
করছিল, অমিতাভ বচ্চনের গলা নকল করে, চেনা সংলাপ বলে । মেয়েটি হাসতেই থাকে । তার কেমন
লাগলো জিজ্ঞেস করায় মেয়ে-টি হাসি মুখে বলে, — “এটা স্পোর্ট । আমার মা নীচে বসে আছেন
। সুতরাং... আর কে-না জানে যে, পুজোর প্রেম বিয়ে অব্দি গড়ায় না ।” ঠিক তখনই মুখখানি
দেখতে পেলাম আর অবাক হলাম । কারণ কাঠবিড়ালি কখন যেন হরিণী হয়ে গিয়েছে । তার কন্ঠের
ঠাট্টায় তখন খুরের শব্দ । শিবাজী বাবু তখনই গেয়ে উঠলেন, “খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে, মনটা কেন
এত কাছে টানলে ?"
আমি অপেক্ষা করছিলাম । মায়ের চোখের পেরিমিটার থেকে তুমি দূরে সরে যেতেই
আমি নৌকা ভাসিয়ে দিলাম । সোজা গিয়ে বললাম, "ওই গানটা কিন্তু আমিও পারি... শোনাবো
?"
তুমি আমায় চমকে দিয়ে বলেছিলে, "ভাববেন না, এইবার কলকাতায় বরফ পড়বে
আর আবারো বেঁচে যাবেন !"
আমি বললাম, "বুকের ভিতরটা বরফ হয়ে জমে আছে সেই সেদিন থেকে । রোজ হাতুড়ি
পেটাই, তবু ভাঙে না । একবার ছুঁয়ে দেবে ?"
ভাবি নি, কুয়াশা কেটে রোদ উঠবে ! তারপর তো কতো কতো দিন এইভাবে কেটেছিল আমাদের
! তোমার ঠোঁটের কোণে ছিল আশকারা-মাখা হাসি, আর আমার প্রতি দৃষ্টিপাতে, তোমায় ভালোবাসি
! মনে আছে, লোক্যাল ট্রেনের কামরায় তোমায় কিম কি-দুকের প্লট শুনিয়েছিলাম ?
(৬)
শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, "পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে
!" প্রসঙ্গ যাই হোক্, আজ আমার তেমনই মনে হচ্ছে । যেন নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে আর আমি
দাঁড়িয়ে ভিজছি । তুমি চলে যাবে ! আর দেখা পাবো না কোনোদিন ! সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে যেমন
মনে থাকে না নিজের অস্তিত্বের কথা, কেবল শরীরে একটা সূক্ষ্ম দোলা জেগে থাকে; তেমনি
তোমার চোখের দিকে চেয়ে, পায়রার ডানা ঝাপটানোর সশব্দ সংকেত বেয়ে, আমার মন দিব্যি আমাকেই
ভুলে থাকত । তুমি চুলে হাত বোলালে, আমি মনে করার চেষ্টা করতাম, কবে শেষবার কেউ আমায়
সস্নেহে বলেছিল, "আর জল ঘাঁটে না, এবার ঠান্ডা লেগে যাবে ।"
আমি জানি, এখন পরিচিত পেয়ারাতলায়, কোনো পূজা-মন্ডপে, কলেজ স্ট্রীটে বা, কোনো বিষণ্ন আলো-মাখা মায়াবী হ্রদের ধারে - কোত্থাও তোমায় খুঁজে পাবো না আর ! কোভিড নামক বিভেদরেখা ঠিক মধ্যিখানে দূরত্ব এঁকে দিয়ে গেছে, চিরতরে ।
--------------------------------------
ছবি ঋণ: গুগল
0 মন্তব্যসমূহ