কামরুল বাহার আরিফের
সাম্প্রতিক কাব্য 'ও সর্বনাশ এসো'
পাঠের প্রতিক্রিয়া : অলোক বিশ্বাস
কবি কামরুল বাহার আরিফের নতুন কবিতার বই 'ও সর্বনাশ এসো'-তে অনেকবার সর্বনাশের ইঙ্গিতবাহী লিপিত অক্ষর দেখেও, একজন পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়, এই কাব্য আসলে এবং আদলে সামগ্রিকভাবে একটি ভালোবাসার কাব্য। একজন কবি যতো বেশি সর্বনাশকে উপলব্ধি করেন, ততোই তিনি ভালোবাসার দিকে তাঁর শব্দসমগ্রকে উন্মীলিত কণ্ঠে প্রবাহিত করে যান। এই গ্রন্থের বহু কবিতায় বহুমাত্রিক ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি। আজ পর্যন্ত ভালোবাসার চূড়ান্ত কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যায়নি। শুধু আমরা জানি, প্রকৃতির মতোই ভালোবাসার বহুরূপের কাছে নিজেদের নিবেদন করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। বহুমাত্রিক ভালোবাসার মধ্যে কামরুল বাহার আরিফের বিচরণ। তাঁর কাছে বেঁচে থাকার প্রধান রসদ মানুষের ভালোবাসা। কবি তাঁর হৃদয়ে ভালোবাসার জন্ম দেন, ভালোবাসা সৃজন করেন। ভালোবাসাকে প্রবহমান করে রাখেন জীবনে এবং সংশ্লিষ্ট সকল পার্থিব অপার্থিব জগতে
কবির হৃদয়ের ভালোবাসা সম্প্রসারিত হয়। ভালোবাসাময় হাতের স্পর্শে পৃথিবীর কতো কিছুর রূপ পরিবর্তন হয়ে যায়-- 'এই হাত ছুঁয়ে দেয় যদি/মরুভূমি হয়ে যাবে খরস্রোতা নদী'(৪২সংখ্যক কবিতা, ও সর্বনাশ এসো)।
'...ভালোবাসা লেখা থাকে চর্যাপদের অক্ষরে/সবাই কিন্তু তা পড়তে জানে না'-- এই বলার মধ্যে কবির অভিমান কাজ করে, ক্রোধও কাজ করে। আবার ভালোবাসা যে একদম সহজলভ্য নয়, তারও ইঙ্গিত দিলেন কবি। আমরা জানি চর্যাপদ সেই অর্থে তরল বা সরল চর্যা নয়। বেশকিছু ভাষ্যের রহস্য জটিলতা পার হয়ে অর্থের নিবিড়তায় পৌঁছতে হয় সেখানে। চর্যাপদের পাঠের মতোই সবাই ভালোবাসায় অবগাহন করতে সক্ষম নয়। 'ও সর্বনাশ এসো' কবিতার বইয়ে ৬০টি ছোটো ছোটো কবিতা আছে। কবিতাগুলোর পৃথক নামকরণ নেই। ১...২...৩... এরকম সংখ্যায় চিহ্নিত। মাত্র ২টি কবিতা ছাড়া বাকি সব কবিতা ২, ৩, ৪, ৫, ৬ পংক্তির। ৪৩ ও ৪৮ সংখ্যক কবিতা দুটি যথাক্রমে ৯ এবং ৭ পংক্তির। যদিও ৯ পংক্তির কবিতাটি(৪৩ সংখ্যক) সেই অর্থে ৯ পংক্তির কবিতা নয়, এই কারণে যে, একটি দুটি শব্দকে মূল পংক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রসারিত করা হয়েছে মাত্র। ৪৩ সংখ্যক কবিতাটিতে কবিসত্তার বিশেষ এক প্রবণতা বা ইন্টেনশন ধরা আছে। এর খোসা ছাড়ালে আমরা সাবজেক্টিভ অবজেকটিভ অনেক আত্মীয়তা পেয়ে যাবো। একটি বিশেষ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কবিতাটি লেখা যার সঙ্গে কবির একান্ত ইচ্ছার প্রশ্নটি জড়িত। কবিতাটির গঠনরূপ দেখা যাক :
'বহুভাষা জেগে থাকে সেই চেনা চোখে
আমি তো
জানি শুধু
মাতৃভাষা
বড়োজোর ভিনদেশি ইংরেজি কিছু
তবু কেনো
সেই চোখ
ছাড়ে না পিছু
না বোঝা ডুবুরী আমি কে আমাকে রোখে!'
পাঠক হিসেবে আমি একজন ডুবুরীর ধারাবাহিক সন্ধানের কাজটিকে পেলাম এখানে। কবির সন্ধান সেই ডুবুরীর মতোই। তাঁকে রোখা যাবে না বিভিন্ন ভাষার সন্ধান কর্মে। তিনি তাঁর সীমা কতোটা তা জানেন। মাতৃভাষা ছাড়া আর কিছু ইংরাজি বাক্যগুচ্ছ তাঁর অর্জনে। কিন্তু তারপরেও বহুভাষার সন্ধান চলে তাঁর। এই বহুভাষা আসলে পৃথিবীর বহু কণ্ঠস্বর, বহুরূপ, অস্তিত্বের বৈচিত্র্য। সেই সবের বহু ভাষার খোঁজে রত কবিকে রোখা যাবে না কোনোদিন। অনন্তকাল ধরে চলে আসা মানুষের সন্ধানের উদ্দেশ্যে জার্নির কথাই উঠে এলো এখানে। ননস্টপ জার্নি, বহু ভাষার খোঁজে, কবির।
সাম্প্রতিক কালে অণুকবিতা, অণুগল্প অনেক বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই শতাব্দীর শুরুর দশকেও এবিষয়ে এতো উন্মাদনা, এতো নিরীক্ষা ছিল না। যদিও সকলে জানি, কথাকার বনফুলের হাতে, অণুগল্পের টার্মটি ব্যবহৃত না হলেও, ব্যাপকতা পেয়েছিল বহুকাল আগেই। পশ্চিমবঙ্গে শ্রুতি আন্দোলনের কোনো কোনো কবির চর্চায় অণুকবিতা বিশেষ চিহ্নসংকেত হয়ে উঠেছিল, যদিও সেখানে অণু শব্দটির ওপর তাঁরা আলোকপাত করেননি। ৬০/৭০ দশকের কোনো কোনো কবিকে আমরা ওয়ান লাইনার লিখতে দেখেছি। এব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গে ষাটের কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তর নাম খুব মনে পড়ছে। বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে অণুকবিতার বা ছোটো কবিতার ব্যাপক অনুশীলন চলেছে। মনে পড়ছে কবি মাহমুদ কামালের ছোটো ছোটো জীবন নিয়োজনের কবিতাগুলো। কামরুল বাহার আরিফের উল্লেখিত গ্রন্থভুক্ত লেখাগুলো আমার মনে হয়েছে ওপেন-এনডেড।একেবারে মুক্ত মনের লেখা, মুক্ত চিন্তার লেখা। অনুভবের প্রগাঢ়তায় লৌকিক জীবনের স্বাদে ভরপুর এইসব কবিতায়। অণুকবিতা হওয়ায় কবিতাগুলো বাক্য বিস্তারি নয়, শব্দবহুল নয়, কিন্তু বহুবিস্তারিত সময় খণ্ডের অসীম প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-যন্ত্রণাময় জীবনকে আতস কাচ দিয়ে বিন্দুতে বিন্দুতে ধরেছেন কবি, যে বিন্দুগুলো অ্যাটমের মতো ভাঙতে থাকলে সীমাহীন বিশ্বপরিক্রমায় যেতে পারবো পাঠক হিসেবে। কবিতাগুলোর মধ্যে আউল-বাউল ফকির ক্ষ্যাপা জীবন দর্শনের অজস্র রঙ মাখানো। ৭ সংখ্যক কবিতাটিতে আমরা সেই স্বাদগন্ধ উপভোগ করতে পারি-- 'নির্মোহ এক ভালোবাসার/আকাশ ওড়া পাখি/তোরে এই জীবনের জটিল বেলায়/কোথায় আমি রাখি।' চোখের মণিকোঠায় অসীমের রূপরসগন্ধস্পর্শ আয়ত্ত করতে চান কবি অণুকবিতা নির্মাণের সময়। অনুভূতির তীক্ষ্ণতায় মেতে উঠতে চান। বাক্যস্থিত বিভিন্ন পদকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে এবং তাদেরকে তীব্র ভূমিকা পালন করতে দিয়ে কবি আত্মিক আনন্দ পান এধরণের সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তিতে। আমাদের জীবনে অজস্র অনুভবময় মুহূর্ত আসে, যেগুলোকে ক্ষণিকের ভাবলেও সেগুলো ক্ষণিকের নয়। সেইসব মুহূর্তকে লিপিত করতে পারলে দেখা যায়, তারা বিশ্বপ্রবাহের অজস্র যাপনকে, বেদনাকে, অসহায়ত্বকে এবং আঁধার সংক্রমণের উত্তর আলোক পর্বকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। কবি কামরুল বাহার আরিফ অসীমকে সম্মুখ প্রত্যক্ষের মধ্যে আয়ত্ত করছেন একান্ত সংবেদনশীলতায়। কবির নিজস্ব ভালোবাসায় দেখা অসীমকে একেবারে আপন চর্যার ভেতরে, নিজের দোরগোড়ায় আনতে চাইছেন। অসীমের খেলাগুলো, অসীমের নৃত্য, কবির আয়ত্তাধীন হয়ে পড়ে। কবির সৃষ্ট রঙছবি পাঠকের মধ্যে সবাক ধ্বনিতে, সঙ্গীতে ও নৃত্যে ঝনঝনিয়ে ওঠে। দেখা যাক ১০ সংখ্যক কবিতাটি। লেখাটির চলন, সম্মুখে প্রত্যক্ষ বস্তুকে মিশিয়ে দিচ্ছে অসীমতার সঙ্গে। তারপর সেই অসীমকে টেনে নামাচ্ছেন নিকটে প্রত্যক্ষিত প্রাণবস্তুর ভেতরে। এরপর খেলাটি আরো জমে উঠলো যখন সেই সুদূরের অসীম নিকটে প্রত্যক্ষিত মাছদের সঙ্গে মেতে উঠলো নৃত্যে। কী অসাধারণ মানবীয় ভাবনার প্রকাশ চিহ্নিত হলো ১০ সংখ্যক কবিতায়-- 'একটা উজ্জ্বল মাছ আমার চোখের সামনে/স্বচ্ছ জলের আয়নায় ভেসে চলে যায়/জলের আয়নায় দেখি নীল আকাশের রং/আকাশের নাচ কখনো অসীমনীলে দৃশ্যমান হয় না/শুধু জলে নেমে এলেই তাকে দেখি,/মাছেদের সাথে নৃত্যে মত্ত হতে/আকাশও নৃত্যপ্রিয়।' কবিতাটিতে কি আমরা মেটাফিজিক্সের কোনো চিহ্ন খুঁজে পেলাম !! সেভাবেই ভাবতে থাকি। কবি আমাদের ভাবার অনেক স্পেস দিচ্ছেন এভাবে, এই গ্রন্থের বহু কবিতায়। অণুকবিতায় সমস্তটা বলে দিতে চান না একজন কবি। বলার চেয়ে ইঙ্গিতগুলো বেশি থাকে। সেই ইঙ্গিতসকল অবলম্বন করে আমরা পাঠকরা ইচ্ছা করলে আরো কিছু, স্বনির্ভরতায় স্বচিন্তনে জুড়ে নিতেই পারি। প্রতিটি অণুকবিতা যেন বিশ্বআত্মার প্রতি এক একটি নিবেদন। সেই নিবেদনে কোনো অসূয়াবোধ নেই, কার্পণ্য নেই, আছে শুধু নিবেদনের আনন্দ। নিবেদনের আনন্দ কবিকে মনের অতলে নিয়ে যায়। ২১ সংখ্যক কবিতায় লৌকিক দার্শনিকতা ধোঁয়াশা ছাড়াই প্রয়োগ হতে দেখি উপমার মাধ্যমটিকে আপন করে-- 'এক মনের জালের জেলে এসে জাল ফেলেছে জলে/ও মন পড়বি ধরা সেই জালেতে মনের অতলে।'
যে কবি প্রতি মুহূর্তে বিশ্বমানবতার সঙ্গে সান্নিধ্য লাভে চঞ্চল, তাঁর কাছে ধর্মগত, ভাষাগত, সম্প্রদায়গত কোনো সংকীর্ণ ভেদাভেদ থাকে না। কবিরা মুক্ত মনের মানুষ। কবির পরিচয় সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ গণ্ডিতে সীমায়িত নয়। মানবতার প্রশ্নে তাঁর কোনো কম্প্রোমাইজ নেই। মানবতার বিভাজনে তিনি প্রতিবাদী সকল সময়। খণ্ডিত, বিভাজিত, ধর্ষিত মানবতায় কবির কোনো আস্থা নেই। ২৭সংখ্যক কবিতাটি আমাদের চোখকে ধূসরতামুক্ত হতে নাড়া দিয়ে চলে ক্রমশঃ-- 'যারে তুমি মানব বলো সে কি মানব ভাই ?/দ্বন্দ্বটা তো লুকিয়ে আছে মানবহীনে, হিন্দু-মুসলিম তাই।/মানব কোথাও নাই, মানব কোথায় সাঁই ?/শুধু হিন্দু হলাম, মুসলিম হলাম মানব কোথা পাই?' পাঠকের চোখ কি জলে ভরে উঠবে না এই লিরিক শোনার পর? মনে কি পড়বে না আমাদের লালনকে, তাঁর হৃদয় সিক্ত করে যাওয়া বেদনাবিধুর মানব মনের অজস্র উদ্বেগকে ?
'ও সর্বনাশ এসো'-র ২ সংখ্যক কবিতাটি পৃথিবীর সমস্ত সর্বনাশী স্বভাবের নির্যাস ধারণ করে আছে। এতো গদ্যময় কবিতার ভাষায় এমন তীব্র কবিতা সাম্প্রতিক কালে অন্য কোথাও পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। কবিতাটির বিষয় পৃথিবীর কোনো মানুষের কাছে অজানা নয়। কিন্তু এভাবে এমন বিষয় নিয়ে এতো পরিমিত এবং পরিণত ভাষ্যে একটা কবিতা হতে পারে, হয়তো আমাদের অনেকের কাছে অজানা ছিল। সর্বনাশের প্রকৃতি এবং উৎস কতো গভীরভাবে উপলব্ধি করলে একজন কবি এতো জাগতিক ভাষায় এমন কবিতা লিখতে পারেন। মাত্র ২টি পংক্তিতে লেখা ২ সংখ্যক কবিতাটি আমাদেরকে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ করে রাখে। পৃথিবীর যাবতীয় পরাজয়, পৃথিবীর যাবতীয় মৃত্যুর গন্ধ, অতিমাত্রিক হৃদয়-বিদারক শক্তি, টানটান মেলে ধরা আছে ২ সংখ্যক কবিতায়-- 'যে বিষের নাম সায়নাইড/তার পরিমাণ জানা খুব জরুরী নয়।' গর্বিত মানব সভ্যতা এই দুই পংক্তির সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে, এই আমার বিশ্বাস। ৪ সংখ্যক কবিতায় কবি প্রশ্ন করেছেন-- 'হতাশার বাড়ি কোন দিকে?/নর্থে না ইস্টে ?/কোন ঋতুতে বেশি আসে ?/উইন্টার সামার না রেইনিতে ?--- এইটুকু পাঠের পর মনে হয়, কবি এইসব প্রশ্নের ভেতরে যে স্পেস রেখে দিয়েছেন, আমরা যারা নগ্ন সভ্যতার শিকার, আমাদের সত্তাকে সেইসব স্পেসে রেখে সুস্পষ্ট জেনে নিতে পারি আমরা কোথায় আছি, কিভাবে আছি।
জীবনের কোনো প্রান্ত নেই আর। একদিন প্রান্ত খুঁজতে বেরিয়েছিলাম আমরা। আজ আর খুঁজি না প্রান্ত, প্রান্তিকতা, আগের মতো। বিষাদ সর্বত্র সমান। ভালোবাসা সর্বত্র সমান। বিষাদ মুছে দিয়েছে সব মানচিত্র। বিষাদ এক পরম্পরা, প্রেমের পাশে। প্রেমেই বিষাদ, বিষাদেই প্রেমের পরবর্তী ঠিকানা। ৬ সংখ্যক কবিতায় কামরুল বাহার আরিফ লিখছেন-- 'তাহলে কৃপা ছাড়াই বৃথা যাক/কোজাগরী চাঁদ/অনন্ত রাতের শূন্যপ্রেমে হোক/জোছনার অবসাদ।' আমরা কি রাধার বিরহ ব্যথার কোনো ছায়াপাত অনুভব করলাম এই ভাষ্যে ? কবি সর্বনাশকে আহ্বান করেছেন এটাই দেখার জন্য যে, সর্বনাশ আরো কোন কোন ধ্বংসের ঠিকানায় আমাদেরকে ঠেলে দিতে পারে সেটা প্রত্যক্ষে আনার জন্য। ১৫ সংখ্যক কবিতাটা কি উন্মার্গগামী নাকি আমাদের প্রতিদিনের প্রাণের জীবন্ত ইচ্ছার প্রতীক ? সর্বনাশের সামনে কবি নিজেকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন, এটাই দেখার জন্য, সর্বনাশ আর কতো সর্বনাশ করতে পারে তাঁর সত্তাকে। তুলে আনি সেই কান্নাময় পংক্তিগুলো ১৫ সংখ্যক কবিতার-- 'ও সর্বনাশ এসো!/খুলেছি এ'লো খোঁপা/লেগেছে চাঁদের রতি!/কালো বাওড়ের জলে/প্রেমে কেড়ে নাও/হাজার নিলাজ যতি!'
করুণ লিরিক লেখা হয়েছে এই কাব্যে। এটা যেমন সত্য, তেমনি, রোমান্টিক আবেগের পরমানন্দের শিহরণ টের পাই আমরা পর্বে পর্বে। ২৩ সংখ্যক কবিতায় পড়ি-- 'জল ধরেছে সোনার রঙে/নন্দিনীটা কে ?/সোনার বসন অঙ্গে তাহার/রঙ্গিনীটা যে!' একি শুধুই প্রত্যাশিত নারীর রূপের উদ্দেশ্যে আনন্দময় ইমেজারি ? এই ইমেজারি কি দেশমাতৃকার সোনার বসনের কল্পনায় নির্মিত নয় ? কবিতাগুলোতে গদ্যময় আর পদ্যময় ভাষা মিলিতভাবে একাকার হয়ে আছে। মরমী ভাষার সুরে লেখা আছে মনোবেদনা এবং আত্মবিশ্বাস। আছে পারস্পরিক সেতুবন্ধনের সম্পর্কবোধ-- 'আমি যদি এক আনা ভালোবাসা তার থেকে পাই/তাকে ষোলো আনা পূর্ণ করে দিতে চাই(৫৩ সংখ্যক কবিতা)। একজন কবির সবচেয়ে বড়ো নিবেদন এখানেই। আর আত্মবিশ্বাসের পরিচয় পাই ৪৮ সংখ্যক কবিতার শেষ পংক্তিতে-- 'ফেরারী জীবন পুড়ে পুড়ে তবু নিঃশেষ হয় না।' একটি কবিতার বই যদি পুনঃপুনঃ পাঠ করা যায়, পুনঃপুনঃ নতুন নতুন প্রতিক্রিয়া চলে আসে। নতুনতর প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয় পরবর্তী পাঠে। আর যখন উৎসর্গ পত্রে নিজের নামটি উজ্জ্বল ভাবে লিপিতি থাকতে দেখি, তখন কবির সঙ্গে আত্মিকতায় নিবিড় হয়ে ওঠে আমার পাঠক সত্তা। অনেক ক্ষত আছে আমাদের জীবনে। কোনোদিন সব ক্ষত নিরাময় হবে না। তাহলে ? কী হবে মানব জনমের ? ৪৭ সংখ্যক কবিতায় দৃষ্টি পড়তেই আমাদের দীর্ঘশ্বাসের কিছুটা প্রশমিত হয়-- 'কখনো কিছু বুকের ক্ষত নিরাময় হতে নেই/বারবার সুখ হয়ে ফিরে আসে বাঁচার তাগিদে।' এই তাগিদ সঙ্গম সুখের মতো নিরবচ্ছিন্ন, নিবিড় হয়ে আছে কামরুল বাহারের কবিতায়।
0 মন্তব্যসমূহ