ফকির ইলিয়াসের কবিতা : বহুস্বরের অন্বয়
প্রকৃতির সঙ্গে অন্তর্লীন যে সত্তাটি তার নাম যদি হয় বাংলাদেশ, তবে সেখানে
প্রেমিক, বাউল, সংগ্রামী, বিপ্লবী,শিল্পী, স্রষ্টা, ভাবুক হিসেবে যাঁকে বহুস্বরের অন্বয়ে বেজে উঠতে দেখি
তিনিই ফকির ইলিয়াস। হ্যাঁ, কবি ফকির ইলিয়াস। নব্বই দশক থেকে যাঁর দৃপ্ত প্রকাশ, বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রই
তাঁকে চেনেন না, জানেন না এমনটি নয়। দীর্ঘদিন নিউইয়র্কে প্রবাস জীবন কাটিয়ে চলেছেন, তবু কখনও বাংলা
থেকে নিজেকে আলাদা করে নেননি। বরং আরও গভীর অন্বেষায় পরিব্যাপ্ত করে চলেছেন সাহিত্যের মূল স্রোতকে। প্রবন্ধ, প্রতিবেদন, সমালোচনার পথে হেঁটেও বাংলা কবিতায় তিনি কতটা বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচয়
দিয়েছেন তা তাঁর প্রায় ২০টি কাব্যগ্রন্থের যদি কেউ সামান্যতমও
পাঠ করে থাকেন তাহলে বুঝতে অসুবিধা হবে না। ফকির ইলিয়াসের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি
হল : “অবরুদ্ধ বসন্তের কোরাস”, “বৃত্তের ব্যবচ্ছেদ”, “গুহার
দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ”,
“ছায়াদীর্ঘ সমুদ্রের গ্রাম”,“গৃহীত গ্রাফগদ্য”, “অনির্বাচিত কবিতা”,“প্যারিস
সিরিজ ও অন্যান্য কবিতা”, “একশ একান্ন” ইত্যাদি। প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই
আছে কবির অস্তিত্বযাপনের নিরন্তর অভিমুখের উত্তরণ । জীবনের চিরন্তন আবেগের বহুবর্ণ সমন্বিত রূপ এবং মেধাবী
আলোকের কল্পসজ্জায় প্রকৃত দার্শনিক প্রজ্ঞার জিজ্ঞাসা ও অনন্ত বিস্ময়ের শূন্যতা। তাই তাঁর বৃত্ত
ব্যবচ্ছেদের দিকে যেমন অগ্রসর হয়, তেমনই নাথিংনেস্এর প্রতিধ্বনিতে প্রত্নঅভিমানকেও সচকিত করে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্পর্ক সবকিছুই ভিড় করে এলেও নিজস্ব বোধের গভীর তর্জনীতে বার বার নির্দেশ করেন সেই গ্রাফগদ্য।
বিমূর্ত কষ্ট আর হাহাকারের স্মৃতিসিক্ত বেদনালিপির অনুপম বৈভব । বিজয়ের মাস ডিসেম্বর, রক্তাক্ত নদী, ভাষা, আগুন, মৃত্যু, ধর্ষণ, আর্তনাদ সবই কবিতার ভাষা
হয়ে যায়। উজ্জীবিত হয় শত শত ভাষাশহিদের আকুতি। তবু কবি তো ঐতিহাসিক নন, দার্শনিক বলেই “যাপনের ঘোরগুলো”কে উপলব্ধি করে একটি সনেটে
লিখেছেন :
“অনেক তো পড়া হলো বৃক্ষ লতা ঘাসের নির্মাণ
অনেক কঠিন অংক, কষা হলো জন্মের সংকেতে
অনেক প্রার্থনার হাত, পাতা র’লো শূন্য জগতে
অঙ্গারকে মণি ভেবে, কাল গেল শোকের সমান।”
শেষপর্যন্ত “শূন্য জগৎ” এবং “শোকের সমান” শব্দগুচ্ছ চিনিয়ে দিল সেই চিরন্তন
কবিকে। কেমন সেই কবি? যিনি সত্যান্বেষণ
করেও যুক্তিকে ভুলে যাননি, জীবনের বহু পর্যায়ে হেঁটেও বহুতার মধ্যে শূন্যেই অর্থাৎ এম্পটিনেস্এ তাঁর স্বাক্ষর রাখেন। ব্যক্তি মেটাফোরে সমূহ জগৎ মেটাফোর
হয়ে যায় যাঁর কাছে। এই তাৎপর্যের কথা তো বিখ্যাত দার্শনিক জাঁক
দেরিদা (Jacques Derrida) বহু আগেই উল্লেখ করেছেন :“The poet… is the man of metaphor : while
the philosopher in interested only in the truth of meaning, beyond even signs and
names, and the sophist manipulates empty signs… the poet plays on the multiplicity of
signifieds.”
সুতরাং এই কবিকে “অনন্তের অনুবাদ কোষ” পড়ে দেখার দরকার হয়নি। একাকী নিঃসীম
জীবনকে শূন্যের
ভেতর বিস্তৃত করেছেন। নদী স্রোত বায়ু সূর্য
চাঁদ নক্ষত্র সকলেরই তাঁর জীবনের পরিধিতে মেটাফোরিক
কণ্ঠস্বরে ডাক শুনেছেন। স্রোতগুলো সমস্বরে বলেছে :
“তুমি কবি হও
আমরা তোমাকে দেবো আরও কিছু শব্দ, আজীবন ৠণ।”
তখন সেই কথাই তো প্রতিধ্বনিত হয় “The man of metaphor” কবি অনন্তকে চেনেন
। দুপুর ও রাত্রিকে চেনেন। জীবনকে চেনেন । সকলের কাছেই কবির আবেদন ও নিবেদন পৌঁছে যায়। কবি
নদীকে দেখেন :
“ভেতরে শূন্যতা নিয়ে দুলে ওঠে নদী”
সভ্যতাকে দেখেন :
“আহা সভ্যতা! আহা নগ্নতার ভোর, তুমি কী দেখাচ্ছ
আদিমতার ছায়া!”
রোদের দক্ষিণায় মানুষ জীবন কাটায় যদিও, সেখানে শুধু “চুমু ও চিতা” ছাড়া
কিছুই থাকে না।
আদিমতা থেকে সভ্যতার
বিকাশের পথে যে উত্থান ঘটে চলেছে তা বস্তুতান্ত্রিক উত্থান। কিন্তু সেই প্রকৃত আদিম প্রবৃত্তির পরিবর্তন হয়নি। কবি বলেছেন :
“একটা পালিত পাঁজর সম্বল করে বেছে নিয়েছিলাম
বেদনার তৎসমপর্ব”
সেই গুহাজীবন থেকে উত্তরণ ঘটলেও দ্বিতীয় জীবনে “দ্বেষ ভর্তি দেশ” কবি
লক্ষ করেছেন। প্রকৃতি কবির
কবিতায় দ্বিতীয় সত্তা হয়ে উঠেছে :
“পথকে আগলে রেখেছেন পৃথক ঈশ্বর
আমি কাছে যেতে চাই
একটা নদী হয়ে, একটা গোলাপ হয়ে
যে মাটি আমাকে সাজায়, তার প্রতিমূর্তি হতে
হয়ে কোনো নরম প্রবর।”
তখন আর এক দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) এর কথাও মনে পড়ে যায়
: “The
imagination (as a productive facility of cognition) is powerful
agent for creating, as it were, a second nature out of the material supplied to it by actual
nature.” (The critic of pure reason). এই চিত্রকল্প ব্যাপ্তিময় শিল্প হয়ে ওঠে কারণ এর সত্তায়
কবিও মিশে যান। প্রকৃতির বিনির্মাণে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। আর একটি সনেটে এর সমর্থন পাই :
“যে জীবন আলো হয়ে চারিদিকে ছড়ায় ঝলক
আমি তার সাথি হয়ে চলি, আর সাজাই দক্ষিণ
উত্তরে জমিয়ে রাখি প্রজন্মের জন্য কিছু দিন
নদীদের জলে জলে এঁকে রাখি সবুজের ত্বক।”
এই প্রেম, এই উপলব্ধির ভেতর অবিরল বিন্যস্ত হওয়ার মধ্যেই ফকির ইলিয়াস
যে দীক্ষা ও মোহের বাতাবরণ বিনির্মাণ করে চলেন তা বাংলা কবিতায় আবহমান দীক্ষকের মুখ হয়ে জেগে ওঠে।
তাঁর কাব্য সাধনা সেই উচ্চতায় বিরাজ করে, যেখানে মর্মরিত হয় আমাদের চিরন্তন মানবীয় আবেগের
উল্লাস ও নীরবতা। সর্বোপরি তিনি মেধাকে কল্পনার অলংকার করে
তোলেন। স্বাভাবিকভাবেই কবিতা মানবীয় অনুজ্ঞার পরিশীলিত সুচারু শিল্প হয় ওঠে।
|
0 মন্তব্যসমূহ