শব্দের বিবরে বোধের শিল্পিত প্রকাশই কবিতা।
দ্বীপের ভাঙনে ঢেউয়ের শব্দ কাঁপে। শব্দ শুনি। কবিতা
কতকগুলো শব্দের সমষ্টি। কিন্তু শুধু কতকগুলা শব্দের সমষ্টিই কি কবিতা? ‘কবিতা তো
মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার’- মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার কি কবিতা?
অথবা কবিতা নয় কি? এই কবিতা পঙক্তি একটি মিথ্যে বাক্য। তবে কি মিথ্যে বাক্য অথবা মিথ্যে
বাক্যসমষ্টিই কবিতা? আমার বোধে ও মননে যে চির বিশ্বাস লুকায়িত তা প্রকাশ করি কিছু মিথ্যে
বাক্যের আশ্রয়ে। এই আশ্রয়ের নামই সম্ভবত কবিতা। মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার
কবিতা নয়। কিন্তু এই মিথ্যে বাক্যটি কবিতা হয়ে এমন এক সত্যের দিকে ক্রমাগত নিয়ে যায়
যেখানে পাঠক অথবা কবি অনির্বাণ সত্যের মুখোমখি হয়ে অনিমেষ কষ্টের নিরব
যন্ত্রণার স্মৃতি বয়ে বেড়ায়। এই মিথ্যে বাক্যের মধ্যে লুকায়িত সত্য আয়েশা আক্তার, আয়েশা
আক্তারের খোলা চুল। সময় বয়ে চলে সময়ের হাওয়ায়। তবু কবি মক্তবের সেই আয়েশা আক্তার, আয়েশা
আক্তারের খোলা চুল, তার প্রতি প্রেম ও কাম ভুলতে না পারার যন্ত্রণায় লুকায়িত সত্যকে
বুকে নিয়ে আজো স্বপ্ন আঁকে। ফলতঃ কবিতা কিছু মিথ্যে বাক্যসমষ্টির মধ্য দিয়ে এক চরম
সত্যের ম্যাসেজ পাঠককে তুলে ধরে। কবি এই মিথ্যে বাক্যসমষ্টির আশ্রয়ে তার যাবতীয় গোপন
বোধের সত্যকে লিপিবদ্ধ করেন কবিতার প্রতিটি পর্বে। তাই কবিতা চির যৌবনা, সুন্দরের,
বিষাদের এবং আনন্দের।
আমি বেড়ে উঠেছি সবুজের মাঝে। আমাকে ঘিরে ছিল ভাদ্রের
খাল, আশ্বিনের বিল। সাগরবেষ্টিত নোনা জলের দ্বীপে আমার শৈশবকৈশোর। আমি দ্বীপপুত্র।
দ্বীপের ভাঙনে ঢেউয়ের শব্দ শুনি। শব্দের যে ভাষা- ভাষা ও বোধের চমৎকার সংযোজনই কবিতা।
দ্বীপের ওপারে যাবার খোয়াবে সাঁকোভর্তি মানুষ, অসহায় মানুষের আর্তনাদ, মানচিত্রের বদল
আর আলোহীন বাতিঘরে নিখোঁজ স্বজনের চিৎকারের কম্পমান দৃশ্যই কবিতা। বোধের অমিত সম্ভাবনার
পুষ্পক স্বপ্নগুলোই কবিতা।
তাই স্বপ্নের সহযাত্রীকে খুঁজি আমার ‘দ্বীপপুত্রের
বধূ’ কবিতায়। আমার কবিতার খাতায় এসে ঊঁকি দেয় ‘কীর্তনখোলার মেয়েটি’। তাকে
কবিতার মতো ভালোবেসে লিখি ‘বিষণ্নতা একটি মেয়ের নাম’ অথবা ‘মনজুর কাদের’র
কবিতা’য় ভাবি- ‘নখের আঁচড়ে নিজেকেই প্রথম জানিয়ে দেবো আমার অস্তিত্ব’।
মনজুর কাদের ’র কবিতা
কীর্তনখোলার মেয়েটি
০১.
জলের নিষেধ ভাঙে কীর্তনখোলার
ঢেউ;
আঁধারের বাঁকে-
তুমি তো ঐ একটাই মেয়ে
ভাঙনের ইতিহাস পাঠ করো :
অন্ধকার ভরে যায় ক্লেদে ও অপসংবাদে;
সঞ্চিত রাত্রির ঘরে বেঁচে থাকে
স্যাঁতসেতে জীবনের দীর্ঘশ্বাস
কীর্তনখোলার জলে-
এতগুলো ক্ষত নিয়ে কতদূর যাবে-
যন্ত্রণাগ্রস্ত
সময়;
বেদনা ছোঁয়াচে নয়...
তবুও কেনো যে আমরা বেদনার্ত হই!
০২.
রোদেলা আকাশে শুনেছি মেঘের গল্প;
দূরাগত স্বপ্নে আমরা তখন
মেঘময় হয়ে উঠতাম...
বোধের ভেতর শূন্যতা ঘুমালে
বিষণ্নতা জেগে থাকে
স্বপ্নগুলো ভোরের বাতাসে-
বেদনার
ভারে... একা
প্রেমের আড়ালে উৎসব চেয়েছি কখনো
কীর্তনখোলার
জলে;
এখন শূন্যতা নিয়ে বসে আছি
রোদ ও মেঘ তৃষ্ণায় ক্লান্ত
০৩.
চারিদিকে এতো আগুনের কোলাহল
জলের
পতন...
মাকড়শারা জাল বোনে সমস্ত নির্জনে
আজো কীর্তনখোলা নদীর ত্বকে ঘাম
ঝরে;
তুমি তো দহনপ্রিয় নও-
তবু মাকড়শার বুনন দেখো :
ঘামের বিষণ্ন ক্রোধে যন্ত্রণার
গুচ্ছগ্রাম;
ক্রমাগত জল জমে
মেঘের
শরীরে...
চাঁদের ছায়ায় একা একা খোঁজো
:
বিগত রাত্রির অভিমান, কীর্তনখোলার
ঢেউ
0 মন্তব্যসমূহ