কবি
সিফাত বিনতে ওয়াহিদ ( ঢাকা ,
বাংলাদেশ )
‘ঘরের
ভেতরে ঘর নাই কাব্যগ্রন্থে’-র কবিতাগুলি মুলত তিনিটি অংশে বিন্যস্ত ‘ঘরের ভেতরে ঘর
নাই’ , ‘অ্যা সেপারেশন’ , ‘ ইন দ্য মেমোরি অব অ্যা পোয়েট’ ।
প্রাক
কথনে কবি বলেছেন –
পৃথিবীতে
পা রাখার মুহূর্ত থেকেই আমরা এক ভয়ঙ্কর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি -
কবি
একটি সুন্দর কল্পিত ঘরের বা সুস্থ জাগতিক জগতের সন্ধান এবং সাথে শর্তহীন ভালোবাসার
যাপন ইচ্ছাকে সমগ্র কাব্যগ্রন্থে খুঁজতে চেষ্টা করেছেন বা বলা যায় স্বীকারোক্তির
ধাঁচে কবিতাগুচ্ছে লিখেছেন তিন ফর্মার
কবিতার বইটিতে । প্রত্যেক সিরিজের শুরুতে সিফাত তাঁর
প্রিয় কবিদের কবিতার পংতি উল্লেখ করেছেন। মন হয়, মূলত কবিতাগুচ্ছের মুড এবং
প্রবাহের সঠিক দিক নির্ণয় নির্ধারণের উদ্দেশ্যে।
“We all live with the objective of being happy ;
Our Lives are all different and yet the same’.-
Anne
Frank
১.
ভিড়ের
মধ্যেই দেখলাম
প্রকাশ্য
বেদনা ছড়িয়ে কে যেন দাঁড়িয়েছে দূরে ।
কার
যেন ঘামের গন্ধ
গোপনে
আছাড় মারছে নেশাগ্রস্ত দেওয়াল
অথবা
কোন সে অসুখ – খুব বেশি ব্যাথিত হয় ,
কোলাহলে
নির্জনতা খুঁজে পেলে?
সে
কি কবি ? নাকি কবিতায় আড়াল পেতে চায়?
এসব
মুহূর্তের টান কি অতীত-বর্তমান ঘুরে আঁকা ?
নাকি
নিঃশব্দ অভিমান খুঁড়ে,
শেষ
পর্যন্ত যত যা- ই খুঁজি –
আমার
একলা ঘরটাই পড়ে থাকে একা !
প্রথম
কবিতাটি সম্পূর্ণ পড়লে মনে হয় কবি বিশেষ দূরদর্শিতার সাথে পর্যবেক্ষণ করেছেন সেই
মানুষকে , মুহূর্তগুলিকে এবং সার্থক ভাবে পৌঁছে গেছেন আত্মকথনে, যেখান থেকে তিনি
নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। কবিতা বহমান হয়ে চলেছে সময়ের নিরিখে আর সেই অন্তিম আর্তি
ছেড়ে গেছেন কবিতার শেষ লাইনে। এরপর একে একে কবিতাগুলি কবির প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
সংবেদনশীলতা একাকীত্বের ভার বয়ে উৎসারিত
হয়েছে তার নিজস্ব চলনে। তাই তিনি নিজের মতো করে পরপর ঘটনাক্রম দেখবার সাথে সাথে
সাজিয়ে নিয়েছেন এবং ব্যক্ত করেছেন নিজের মত করে বা নিজের সাথে ক্রমাগত কথা বলে
গেছেন। এই সিরিজের প্রত্যেকটি কবিতা পরপর পড়ে গেলে স্বয়ং কবির মনের ভিতরে প্রবেশ
করা সহজ হয়।
আমরা এবার উপরিউক্ত সিরিজ কবিতার বেশ কয়েকটি
লাইন সামান্য ছুঁয়ে দেখি –
আমার
আত্মঘাতী ফুঁৎকারে ধ্বনিত হয় তুমুল আর্তনাদ ।
এদিকে
বিশ্বাসের জরুরি সভায় , সভাসদদের মুষ্টিবদ্ধ হাত
শূন্যে
উড়ে গিয়ে বজ্রকণ্ঠে হুঙ্কার জানায়-
“মানুষ
মুলত একা! মানুষ মুলত একা! মানুষ পৃ-থি-বী-তে
ব-ড়
বে-শি এ-কা ! “
আর
একার সাম্রাজ্যে , তোমার- আমার মাঝে কয়েক
শতাব্দীর
নিরবতা !
সিফাত
সমস্ত বাঁধা অতিক্রম করে মিশে যেতে চেয়েছেন মানুষের মাঝে , গর্জে উঠতে চেয়েছেন , সংগবদ্ধ
হতে চেয়েছেন , কিন্তু সেই চিরন্তন সত্য যেন সপ্রতিভ হয়েছে অর্থাৎ মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ
হয়েও কোথাও যেন সম্পূর্ণ একা , আর একাকীত্বের এই সাম্রাজ্যে দুটি মানুষ তা মানব
মানবী হতে পারে তাদের মধ্যেও বয়ে চলেছে প্রেমের নিস্তব্ধতা। কখনো কখনো নিজের
সম্বন্ধে তিনি দ্বিধাবিভক্ত তাই তার কবিতায় এমনও বলতে শুনেছি এসব বলেই বা কি হবে ,
আবার কখনো মনে করেছেন কতটুকুই বা বলা হয় এক জীবনে অথবা কতটুকুই বা বলতে পেরেছেন । কবি
কি হতাশার ডুবে গিয়েছেন কিছু সময়ের জন্য।
আর
আট- দশ জনের মতো একটি স্বাভাবিক মৃত্যু চেয়েছিলাম আমি ,
অথচ
আমার লাশের ময়নাতদন্তের পর
কারা
যেন গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দিয়ে গেল অ প মৃ ত্যু !
অথবা
অনেক
চেষ্টা করে- একটিও প্রিয়মুখ মনে পড়েনি আমার ,
চোখ
বন্ধ করে দেখেছি শুধু-
পৃথিবীর
সবকিছু এই জেগে থাকার মতোই অন্ধকার ।
কবি
সিফাতের জীবন মৃত্যুর এই আকুতি তাকে ভিতর থেকে ক্ষয় করেছে ক্রমাগত। তিনি মৃত্যু
যন্ত্রণায় কাতর ।তিনি ভালবাসেন সেই স্নিগ্ধতাকে যা তাকে বঞ্চিত করেছে। এ মৃত্যু কি
ইচ্ছামৃত্যু নাকি লুকিয়ে আছে কোন নির্দয় ঘাতক।
আর
আমি প্রতিবারই ঘুমের ঘোরে,
অল্পবয়সী
চাঁদ ছুঁতে গিয়ে পুড়িয়েছি হাত ।
অথবা
বেঁচে
আছি বলেই সমস্ত অস্থিরতা;
মরা
ফড়িঙের ডানার যন্ত্রণা এঁকেছে বুকে
কেননা
আমার তো পুরনো অভ্যাস-
বহুদিন
পরও খুঁজে পেলে এক ফোঁটা জল
খুব
অনায়াসে বিশ্বাস করি , ঘাতকের কৌশল ।
কে
সেই ঘাতক ! এর পরপর কবিতাগুলিতে কবি প্রকৃতির ধ্বংসাত্বক প্রবণতার প্রসঙ্গকে টেনে
এনেছেন।
দুপাশে
ভীষণ দারুণ স্রোত
জলে
জ্বলে আগুনের ক্রোধ
অথবা
নদীতে
জোয়ার ভীষণ জাগে
এমন
খুন হয়নি তো কেউ আগে ।
এই
কবিতাপাঠের মধ্যে পাঠক হিসেবে আমিও একসময় নেতিবাচক হয়ে পড়ছিলাম , একটা জীবন্ত
মানুষ , সৃষ্টিশীল মানুষ কিভাবে এতটা হতাশায় ডুবে থাকতে পারেন মৃত লাশের মতো সর্ব
শরীরে বরফের দীর্ঘ শীতলতা নিয়ে। তিনি কি কবিতার মধ্য দিয়ে ফিরে আসবেন না মানুষের
মাঝে সমস্ত অন্ধকার বা একাকীত্ব কাটিয়ে। তিনি পৃথিবীর এই ভালো মন্দ মেশানো জীবনকে
কি আত্মস্থ করে এই জগত সংসারকেই প্রকৃত ঘর হিসেবে সাজিয়ে নিতে পারবেন না ।
কবি
হিসেবে সিফাত কিন্তু সফল কারন তার পাঠক একাধিক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। তিনি
তো কাজ কে ভালোবাসেন , তিনি তো বিশ্বাস করেন অন্তরেরে আধ্যাত্মিকতায় । তবে কি তিনি
কাজে বা অন্য কোন গভীর আধ্যাত্মিক বোধের মধ্যে নিজেকে নিম্মজিত করবেন।
কবিতা
সিরিজের পরপর কয়েকটি পংতি পড়ে দেখা যাক ;
এ
ঘোর ভাঙতে হবে ভেবে,
ছুটে
যাচ্ছি গভীর চোরা টানে...
মাঝেমধ্যেই
ইচ্ছে করে বেঁচে উঠি আবার ,
নীরবতার
চেয়ে কঠিন ‘ভাষা’ নেই আর ।
অথবা
জমে
যাওয়া রক্ত থেকে মুখ ফিরিয়ে
কানের
কাছে সমস্বরে গুঞ্জন তুলবে- “ আসসলাতু খাইরুম মিনান
নাউম”।
এর
ঠিক পরেই কবি সেই ঈশ্বরের কে উৎসর্গ করেই হয়ত আরও বলছেন –
আহা
কারিগর ! একটা ঘর , মরার মতো পইড়া আছে ঘরের ভিতর।
সিরিজটির
শেষ কয়েকটি কবিতায় তিনি পার্থিব জীবনের শেষটুকু সমর্পিত করতে চান ভালোবাসার কাছে,
কারণ তিনি বিশ্বাস করেন প্রেম ই একমাত্র বিষয় যা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখাতে পারে
, যদিও সিরিজের শেষ কবিতায় সেই গতানুগতিকতার কথা বলেছেন যা জীবৎকালে কবি সিফাত বয়ে
নিয়ে চলেছেন।
কয়েকটি
পংতি পড়ে নেওয়া যাক –
আমার
প্রেম আমি দিয়ে যাব তারে;
এই
তীব্র স্পর্শ নিয়ে,
সে
ফিরে যাবে ঘরে।
তারপর
বহুদিন বিরতি নিয়ে
একদিন
হঠাৎ অচেনা হবো ।
অথবা
আম্মার
অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ শুনলাম কয়েকবার। ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ,
আল্লাহুম্মা আজিরনী ফী মুসিবাতী ওয়া আখলিফ-লী খাইরাম মিনহা’। আম্মা জায়নামাজে।
অথবা
এমনকি
একটা গিনিপিগের মতো দিনের পর দিন বেঁচে থাকার মতো মরে যেতে যেতে তৃপ্তির ঢেকুর
তুলেছি।
কবিতা
গ্রন্থের দ্বিতীয় সিরিজ ‘ অ্যা সেপারেশন ‘ । এই সিরিজের তাঁর প্রিয় কবি ও কবিতার
যে পংতিটির উল্লেখ করেছেন –
“
আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন – কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি
নাকো; - এক নক্ষত্রের নিচে তবু – একই আলো পৃথিবীর পারে
আমরা
দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়’-
জীবনানন্দ দাশ
এই
সিরিজের কবিতাগুলিতে প্রত্যেকটি কবিতাই প্রেম এবং
বিচ্ছেদের আখ্যান বয়ে নিয়ে চলেছে। কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগের কবিতা
সিরিজের পংতিগুলি অনেক বেশি তীক্ষ্ণ । আসলে হয়ত যদিও তিনি কবি, সবার উপরে তিনিও
একজন সাধারণ মানুষ। একজন সংবেদনশীল মানুষ বিরহের চোরা
স্রোতের মধ্যে যে গভীর শূন্যতা খুঁজে পান তার ক্ষত ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক বলেই বোধ হয়;
আর তাই বিচ্ছদের কবিতা মনকে অধিক নাড়া দেয়। কয়েকটি পংতির উপর আলোকপাত করি-
ছড়িয়ে
দাও বাতাসে, যতটা ঘৃণা জমিয়েছ মনে; একদিন তার পুরোটা জুড়েই গোপনে নয়, প্রকাশ্যে আমার
হাসি সুর তুলেছিল। আজ এসবই ফুসফুসে নিকোটিনের চেয়েও ভয়াবহ হয়ে ওঠে , কেননা জেনে
রেখো – লাভ ইজ মরটাল।
অথবা
একে
অপরের বুকে খুঁজেছি কাঁঠালিচাঁপা বকুল, যেটুকু পেয়েছি তাও তো ভুলে যাবার নয় ! অথচ
আমরা তো আর আমাদের নাই এখন। আমাদের পরস্পরের জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন ,
প্রতি মুহূর্ত ; ভাবনার পুরোটা জুড়ে আছে তীব্র ঘৃণা-শ্লেষ ।
অথবা
আমরা
আদতে সংসারী নই; দুই সন্ন্যাসীতে , সংসারী হতে চাওয়ার ভুলে কিছু মুহূর্তকে সাক্ষী
রেখে এক হয়েছিলাম মাত্র। যেহেতু আমরা
প্রেমভ্রষ্ট নই; কবি জীবনের মরুভূমিতে তাই সংসারী হওয়ার যাবতীয় ইচ্ছেটুকু বেওয়ারিশ
লাশ হয়ে যায় ।
দ্বিতীয়
সিরিজের একাধিক কবিতার টুকরো পংতিগুলি ভীষণ জোড়ে আঘাত করে পাঠক মনে ; কবি সিফাত
যদিও আত্মকথনের ভঙ্গিতে কথগুলি লিখেছেন তবুও কোথাও যেন সেগুলি আম জীবনের
সাদৃশ্যগুলিকে ছুঁয়ে যায়। এই বিচ্ছেদের কথাগুলি অনেক সময় আমরা বলতে পারি না অথচ
সারাজীবন বয়ে নিয়ে চলি ; আর সেই নিদারুণ কষ্ট বিরাট পাথরের চাইয়ের মতো বুকের উপর চেপে
বসে থাকে। কয়েকটি পংতি পড়া যাক –
একটি
ভয়ঙ্কর পাথর তোমার-আমার মাঝে চাপা পড়ে যায় ,
আর
ক্রমশ আমাদের চোখগুলো মৃত হয়ে ওঠে....
অথবা
তুমি
যখন ব্যর্থ বিরোধীদলের মতো ফ্লোর ছাইড়া চইলা যাইতেছিলা,
আমার
রেড ওয়াইনের গ্লাস তখনও শেষ চুম্বনের অপেক্ষায় বইসা বইসা ঝিমাইতেছিল।
জিহ্বার
নীচে পেঁয়াজের হালকা ঝাঁঝালো স্বাদ আর কেশোনেট সালাদের
বাটি
থেইকা কিউব কইরা কাটা চিকেনগুলা – তোমার চইলা যাওয়া
দেখতে
ছিল অলস ভঙ্গীতে ।
তোমারে
দেখতে দেখতে বার কয়েক মোচড় দিল পেটের ভেতর;
পেট
থেইকা মুখ পর্যন্ত হালকা চুকা ঢেকুর উইঠা আসতেই,
তোমার
চইলা যাওয়ারে কইলাম –
টু
হেল উইথ ইউর সাসপিনশন !
টু
হেল উইথ ইউর লাভ !
কাব্যগ্রন্থের
শেষ পর্যায়ের কবিতাগুচ্ছ ‘ইন দ্য মেমোরি অব অ্যা পোয়েট’ নামক শিরোনামের
অন্তর্ভুক্ত । এখানকার প্রত্যেকটি কবিতা আলাদা
করে শিরনাম যুক্ত এবং আঠারোটি মৌলিক কবিতা দিয়ে সাজানো। প্রাথমিকভাবে কবিতাগুলি
একে একে পড়লে বোঝা যায় সিফাত বিভিন্ন মুড অনুযায়ী কবিতাগুলি লিখেছেন । তৃতীয়
পর্যায়ের এই কবিতাগুলি মুলত বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মেটাফোরিক এবং কোনোভাবেই সে অর্থে
লিমেরিক নয়, তবে কবিতাগুলিতে ছোট ছোট কিছু সাদৃশ্য আছে, যেমন অনেক কবিতায় পাখি ,
নীল রং এবং প্রকৃতির বারাবার কবিতায় ফিরে ফিরে আসার সম্ভাবনাগুলি লক্ষণীয়। আর সব
থেকে বেশি যেটা চোখে পড়ে তাতে এই পর্বের অধিকাংশ কবিতার শিরোনাম এবং ভেতরকার পংতি
ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের প্রাচুর্য। কবি সিফাত ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতক , তাই তিনি
বিশ্বসাহিত্যের স্বাদ নিয়ছেন অফুরান এবং হয়ত খানিকটা পাশ্চাত্য ফর্ম রয়েছে কবিতার
অলিন্দে। তৃতীয় পর্বের শুরুতে তিনি সিলভিয়া প্লাথের দুটি লাইন রেখেছেন পাঠকের
কাছে-
‘Dying is an art, like everything else.
I do it exceptionally well’-
এমন
শাশ্বত সত্যকে পাথেয় করেই তার কবিতার পথ চলা। যে কবিতাগুলি এই পর্যায়ে বেশি
সপ্রতিভ লেগেছে তার মধ্যে অন্যতমগুলি যথাক্রমে ‘হ্যালুসিনেশন’, এই কবিতার সামান্য
কয়েকটি পংতি-
তারপর
বহুযুগ ধরে ,
একলা
ছাতিমগাছের নিচে স্থির হয়ে থাকা নোনতা অবসাদ
উন্মাদ
কবিকে চুমু খেয়ে বলে ওঠে –পালকের নিচে যতটুকু পুড়ছে,
পুড়ুক।
একদিন
ঠিক থেমে যাবে হ্যালুশিনাশান ! জোয়ার –ভাটার যাবতীয় স্রোত !
তৃতীয়
পর্যায়ের কবিতাগুলির মধ্যে ‘‘ইন দ্য মেমোরি অব অ্যা পোয়েট’ মৌলিক কবিতাটি কবির এই
পর্যায়ের অন্যতম প্রিয় বলে মনে হয়েছে , তাই প্রথমে পুরো কবিতাটি এখানে দিলাম ।
মাতালের
মৃত্যুর আগে ; বেলা এগারোটা তেত্রিশ মিনিটে
ফার্মগেট
টু বিজয় সরণী মোড়ে সারিবদ্ধ নির্জনতা নেমেছিল।
নীল
আকাশ খুঁড়ে খাচ্ছে কালো আইসক্রিম
আর
দিনের আলোতেই সেখানে ঢাউস বাদুড় !
মাতাল
শূন্যে হাঁটে , চোখ বুজে শুকনো ক্ষয়ে যাওয়া দু’ঠোঁট চোখা করে
শিষ
দেয়-
‘ইফ
ইউ মিস দ্য ট্রেন আই’ম অন / ইউ উইল নো দ্যাট আই’ম গন /
ইউ
ক্যান হেয়ার দ্য হুইসেল ব্লো অ্যা হান্ড্রেড মাইলস...”
মাতাল
থেমে যায় ;শুন্যে তাকায় , হাসে !
দু-এক
ফোঁটা জল চোখে পড়ে কালো আইসক্রিম গ’লে।
তীব্র
হুংকারে মাতাল চীৎকার করে –
স্টপ
ইন দ্য নেম অফ লাভ ! স্টপ!
ডু
ইয়্যু নো মি ! আমি অমিট রয় ! লাবন্য কোথায়?
শহুরে
নির্জনতা ভেঙ্গে মাতালের কান জুড়ে তীক্ষ্ণ খিলখিল হাসি ,
যেন
লাল নখে ছিঁড়ে দিয়েছে কেউ কানের দড়ি !
নির্জন
দুপুরে মাতালের শুকনো ঠোঁট ছিঁড়ে খুঁড়ে খায় এক ক্ষুধার্ত শকুনি !
উক্ত
কবিতাতে কবি সিফাত মাতালের জবানিতে বসিয়ে দিলেন একটি কালজয়ী গান এবং অপরদিকে অন্যতম
চিরায়ত আধুনিক সাহিত্যের প্রেমের আখ্যানকে। যে মাতাল আসন্ন মৃত্যুর
একেবারে দুয়ারে এসে গাইছেন সেই বিখ্যাত গান যা কখনো ষাট ও সত্তরের দশকে সারা ইউরোপ
আমেরিকাকে মাতিয়ে রেখেছিল। গানটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এইরকম – দক্ষিণ আমেরিকার থেকে
ব্ল্যাক আমেরিকান শ্রমিকরা অর্থের জন্য বা কাজের জন্য শহর থেকে বহুদূরে যেতেন ,
এবং রোজ ঘরে ফিরে আসা তাদের পক্ষে ছিল খুব কঠিন ব্যপার। তারা তাদের এই দুঃখগুলিকে
ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে গানের মাধ্যমে বলতে চেয়েছিলেন এবং ষাটের দশকে তা কথায়
বেঁধেছিলেন Heady West. পরবর্তীকালে গানটি ইতিহাসে পরিণত
হয়েছিল এবং আজও গানটি কালজয়ী। অপরদিকে মাতালের জবানবন্দিতে খুঁজে পেলাম রবিঠাকুরের
‘শেষের কবিতা’র অমিত এবং লাবণ্য চরিত্র দুটিকে । উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজের
উচ্চস্তরের এক যুবক প্রেমে পড়ে যান লাবন্যের মতো একটি সাধারণ রুচিশীল এবং মার্জিতা
সেবিকার। পরবর্তীকালে দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে সক্ষতা ও প্রণয়। কবি কিসের ইঙ্গিত
দিলেন , সেই ঘরের যেখানে আমরা দিনের শেষে ফিরতে চাই , যে ঘর দিতে পারে দুদণ্ডের তৃপ্তি
এবং অবসর। যে ঘর কবি সিফাত খুঁজে চলেছেন এই কাব্যগ্রন্থে । অন্যদিকে কবি কি সেই
লাবন্যের মতো একজন সাধারণ মেয়ে হতে চেয়েছেন , যে তাঁর স্বপ্নের পুরুষকে নিজের মতো
করে সাজিয়ে নেবেন। এরপর মাতালের কাঙ্খিত মৃত্যু হল এবং পরাবাস্তবতায় ডুবে গেল
নির্জন দুপুর ।
এর
পরবর্তী কবিতাগুলির মধ্যে ‘নির্বাসন’ কবিতাটি ইম্প্রেসিভ লেগেছে। বাকি কবিতাগুলি
সাধারণ মানের বলেই মনে হয়েছে।
‘নির্বাসন’
কবিতার কয়েকটি পংতি –
আমরা
কি স্থির অমাবস্যায়
সারসের
ঠোঁট ভেবে
চুমু
খেয়েছিলাম অভিমানী ঝড় ?
নাকি
রক্তজবা দেখে
মৃত্যু
ডেকে এনেছি ঘরের ভেতর ?
“
ঘরের ভেতরে ঘর নাই” কাব্যগ্রন্থের লেখিকা কবি সিফাত বিনতে ওয়াহিদের কাব্যসুষমা
নিয়ে একজন কবিতার পাঠক হিসেবে ব্যক্তিগত মূল্যায়ন কে পাঠকের দরবারে রাখছি এবং এ
কাজ করতে পেরে ভালো লাগছে এই কারণে , প্রথমত একজন বিদগ্ধ কবির অনুমতি সাপেক্ষে এই
কাজের দায়িত্ব পেয়েছি এবং সর্বোপরি এই মূল্যায়ন করবার সুযোগে প্রতিবেশী দেশের একজন
তরুণ কবির কাব্যগ্রন্থে নিলাম নিখাদ ভালোবাসার স্বাদ। কবি সিফাতকে তাঁর কাজ এবং
কবিতা লেখার প্রতি এই দায়বদ্ধতাকে আগামীদিনের জন্য শুভেচ্ছা জানাই।
“ ঘরের ভেতরে ঘর নাই” কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক
প্রিন্ট পোয়েট্রি , পরিবেশক মেঘ এবং কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদটি করেছেন মঞ্জুরুল
আহসান ওলী। ব্যক্তিগতভাবে তিন ফর্মার বইটি হাতে নিয়ে মনে হয়েছে সামগ্রিকভাবে আর
একটু যত্ন নিয়ে বইটি করা যেত , প্রোডাকশন মন মতো লাগলো না , বিশেষ করে বইয়ের
প্রচ্ছদ আরও অনেক বেশি মনোযোগ সহকারে করা উচিত। আজকাল প্রচ্ছদের উপর প্রচুর
ভাবনাচিন্তা হচ্ছে কারণ প্রচ্ছদ শিল্পীর কাজের উপর বইয়ের বিপণন অনেক অংশে
নির্ভরশীল। শিল্পের দিক মাথায় রেখেও বিপণনকে অস্বীকার করবার জায়গা নেই। খুব সত্যি
হল ভাল বিপণন অবশ্যই পুরো টিমকে উজ্জীবিত করে ।
0 মন্তব্যসমূহ