সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

জয়তী ধর (পাল)





অশ্রুভেজা মহাসংগীত


পূর্ণিমার দুধ সাদা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। গঙ্গা নদীর দুই তীরের দৃশ্য মায়াবী আলোমাখা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে , আর নদী সে যেন এক অপরূপা নারী... কলকল ধ্বনিতে কথা বলে চলেছে তার দয়িত আকাশের সাথে। নদীর বুকে ভেসে চলেছে একটা ছোট্ট নৌকা, যে নৌকায় মাঝি ছাড়া রয়েছে আরও দুজন যাত্রী - দুটি ষোড়শবর্ষীয় কিশোর । তাদের মধ্যে একজনের গাত্রবর্ণ চাঁদের আলোর মতোই মনমুগ্ধকর, নিবিড় কালো কেশরাশি কাঁধ ছুঁয়েছে, দীর্ঘ কৃশ দেহটি যেন কোন শিল্পীর তুলিতে পরম যত্নে আঁকা, উন্নত নাসিকা , দৃঢ় প্রত্যয় যুক্ত ওষ্ঠ, আর মায়াবী দুটি বড় বড় চোখ ... সে চোখে বুদ্ধিমত্তা , করুণা আর স্বপ্নের ত্রিবেণী সঙ্গম ঘটেছে । অপর কিশোরটি মাঝারি গড়নের, অতি সাধারন চেহারা , কিন্তু তার চোখ দুটি তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে। দুজনে নবদ্বীপের টোলের মেধাবী ছাত্র। এই সুন্দর সন্ধ্যায় দুই বন্ধু বেরিয়েছে গঙ্গাবক্ষে নৌকাবিহারে।

এই সন্ধের প্রকৃতি যেন বিধাতার লেখা একটি কবিতা । দুই বন্ধুর মধ্যেও চলছিল কাব্যালোচনা। তাদের আলোচনায় প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের অগাধ পাণ্ডিত্য আর তীক্ষ্ণ পর্যালোচনা শক্তি ।দীর্ঘদেহী কিশোরটির নাম নিমাই, মাঝে মাঝেই সে উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করছে কোন শ্লোক। কিন্তু তার আবৃত্তি বন্ধু ও সহপাঠী রঘুনাথের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও মর্মে প্রবেশ করছে না । রঘুনাথ নিজেও মেধাবী ছাত্র, নানা কাব্যের রসবিচারে দক্ষ। কিন্তু কাব্যের রসাস্বাদনে তার মন নেই। তার মন এক বিচিত্র জটিল পথে আবর্তন করছে । নিজের মনের তুলাদন্ডে সে বিচার করে চলেছে নিমাই আর তার পান্ডিত্যের ওজন ,আর বারবার তার মনে হচ্ছে নিমাই-এর দৈহিক উচ্চতা তার থেকে দীর্ঘ হলেও পাণ্ডিত্যে জ্ঞানে সে নিমাইয়ের থেকে অনেক উঁচুতে। এই দুরন্ত নিমাই পুঁথি পাঠের থেকে দস্যিপনা করে অনেক বেশি । কিন্তু সে পুঁথি পাঠকেই করেছে জীবনের একমাত্র তপস্যা।

ক্রমশ ন্যায় শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। নবদ্বীপে ন্যায়শাস্ত্রের চর্চা ঘরে ঘরে চলছে , প্রতিটি অধ্যাপক ছাত্র পণ্ডিতের ন্যায়শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা বাদ্-বিতন্ডা তর্ক- বিতর্কে নবদ্বীপের আকাশ-বাতাস মুখরিত। নিমাই এর এই বিষয়ে অগাধ জ্ঞান। এই বয়সেই সে ব্যাকরণের টিকা টিপ্পনীর একটা বই লিখেছে। ছাত্রদের মধ্যে তা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। তার খ্যাতির সুরভি নবদ্বীপের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে ছড়াতে শুরু করেছে । আর এখানেই এক তীব্র বঞ্চনা অনুভব করে রঘুনাথ। তার মনে হয় নিমাই তার প্রাপ্য থেকে অনেক বেশি খ্যাতি পাচ্ছে , ভাগ্য তার সহায় বলে। সুযোগ পেলে সেও দেখিয়ে দেবে পাণ্ডিত্যে সে নিমাইকে অনায়াসে হারাতে পারে । কুটিল এক অসূয়ার কুয়াশায় আচ্ছন্ন তার মন, তার মস্তিষ্ক । সম্বিৎ ফেরে নিমাইয়ের উচ্ছ্বাসে,"জানো রঘু, ন্যায়শাস্ত্রের উপর আমি একটি বই লিখবো ঠিক করেছি। বেশ কিছুটা লেখাও হয়ে গেছে ।তুমি শোনো ।তুমি যথার্থ বোদ্ধা। তুমি এর ঠিক বিচার করতে পারবে ভাই।" সচেতন আর সতর্ক হয়ে ওঠে রঘুনাথ। নিমাই তার প্রিয় বন্ধু রঘুনাথ কে উৎসাহের সাথে শোনাতে লাগলো ন্যায় শাস্ত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ... নিজের বোধ বুদ্ধি আর জ্ঞানের আলো তার ব্যাখ্যার প্রতিটি ছত্রে , ন্যায় শাস্ত্র যেন এক নতুন মাত্রা পাচ্ছে তার বিশ্লেষণে। অসম্ভব স্মৃতিশক্তি নিমাইয়ের। পাশে রাখা ঝোলায় অসমাপ্ত পুঁথিটি রয়েছে, কিন্তু সে সেটি হাতে না নিয়েই অনর্গল বলে যেতে লাগলো পুঁথিটির প্রতিটি বাক্য। বন্ধু রঘুনাথের বিচার বুদ্ধির উপর তার অগাধ আস্থা । যদি রঘুর এই ব্যাখ্যা ভালো লাগে তাহলে সে নিশ্চিত হবে জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিদের কাছে তার এই বই সমাদর লাভ করবে ।

কিন্তু এই পূর্ণিমার রাত্রে রঘুনাথের মুখমণ্ডলে যেন জমে উঠতে লাগলো অমাবস্যার আঁধার । সে যেন এক অমূল্য রতন হারানোর আশঙ্কায় ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছে । এ রতন যে তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষার ধন, বহু বিনিদ্র রাত্রি সাধনা করেছে সে একে পাওয়ার আশায় ।সে একান্ত গোপনে রাতের পর রাত জেগে ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যায়ন করে লিখে চলেছে তার টীকা, আর স্বপ্ন দেখেছে তার লেখা ন্যায় শাস্ত্রের টীকা দেশে দেশে সমাদর পাবে, ন্যায়শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ টীকাকার হিসাবে তার নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে । বহু পরিশ্রমে সে গ্রন্থটি প্রায় শেষ করে এনেছে । আর গোপনে হৃদয়ে লালন করে চলেছে তার তীব্র বাসনা - বইটির প্রকাশ তাকে খ্যাতির শীর্ষে স্থান দেবে, প্রমাণ করে দেবে নবদ্বীপের চোখের মনি নিমাইয়ের থেকে পাণ্ডিত্যে সে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু সে আজ একী শুনছে! নিমাইয়ের এই বিশ্লেষণের পাশে তার পুঁথিটি যেন নিজের মহিমায় উজ্জ্বল সূর্যের পাশে ম্রিয়মাণ কৃষ্ণা দ্বাদশীর চাঁদ মাত্র ।‌ নিমাই যদি ন্যায় শাস্ত্রের এইরূপ অনুপম ব্যাখ্যা সম্বলিত পুঁথি প্রকাশ করে, তাহলে তার গ্রন্থটি তো কেউ পড়বে না, সেটি পড়ে থাকবে অনাদরে অবহেলায়। তার এতদিনের আকাঙ্খার স্বপ্নের অপমৃত্যু সে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ।‌ তার সমস্ত যন্ত্রণা পুঞ্জীভূত হয়ে অশ্রুধারা রূপে অনর্গল ঝরতে লাগল তার গাল বেয়ে । চাঁদের আলোয় সেই অশ্রুধারা দেখে নিমাই বিস্মিত হলো। সে একমনে ন্যায় শাস্ত্রের আলোচনা করছিল, হঠাৎ রঘুনাথের চোখে জলের ধারা দেখে সে বিচলিত হলো , বন্ধুর কষ্টের কারণ জানার জন্য সে আকুল হয়ে উঠলো । সে রঘুনাথের দুহাত ধরে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগল , " রঘু কি হয়েছে তোমার? আমাকে বলো।" রঘুনাথ লজ্জায় মাথা নামিয়ে রাখে। তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে নিমাই বলে , " তোমার কষ্ট যদি আমি দূর করতে না পারি , তাহলে আমি তোমার বন্ধু হলাম কেন ? আমাকে বল রঘু , কিসের জন্য আজ তোমার চোখে অশ্রু ?" একসময় নিমাইয়ের বন্ধুত্বের দাবির কাছে হার মানে রঘুনাথ । বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে," ভাই বহু পরিশ্রম করে আমিও ন্যায় শাস্ত্রের একটি টীকা লিখেছি । কিন্তু তোমার টীকা শুনে বুঝতে পারছি, তোমার গ্রন্থ সম্পূর্ণ হলে, আমার গ্রন্থ আর কেউ পড়বে না ।" কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করলো নিমাই। তারপর হাসতে হাসতে রঘুনাথ কে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল ," এই জন্য তোমার চোখে জল ! আমি বলছি , তোমার গ্রন্থটি বিদ্বান সমাজে অতি আদরণীয় হবে। " পাশে পড়ে থাকা ঝুলি থেকে অসমাপ্ত পুঁথিটি বের করে গঙ্গাবক্ষে ফেলে দিল নিমাই । আর্তনাদ করে উঠল রঘুনাথ," একি করছো নিমাই ! এই মহামূল্যবান রত্ন তুমি এইভাবে বিসর্জন দিও না। " নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়ে জলে ভেসে যাওয়া অসমাপ্ত পুঁথিটি বাঁচাতে চায় রঘুনাথ । নিমাই তাকে বুকে চেপে ধরে বলে , " ভাই , আমার কাছে ওর থেকে অনেক মূল্যবান তোমার বন্ধুত্ব , তোমার স্বপ্নপূরণের আনন্দ । কোন কিছুর বিনিময় তা আমি হারাতে চাই না ।" নদীর জলে পারিজাতের পাপড়ির মতো ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য হয়ে যায় পুঁথির পাতাগুলি। আগের থেকে দ্বিগুন বেগে অশ্রু নামে রঘুনাথের দুই চোখে... আর সেই অশ্রু বন্যায় ধুয়ে যেতে থাকে তার সকল অহংকার... সকল অসূয়া...। নদীবক্ষে সেই অশ্রুপতন ধ্বনি সৃষ্টি করে এক মহাসংগীত । কয়েক যুগ পরে সেই মহাসংগীতকে ভাষা দিলেন আরেক মহাকবি... ' সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে ...। '