বিজন হাসপাতাল থেকে প্রায় দিন সাতেক পর বাড়ি ফিরল। ফিরেই
লম্বা একটা স্নান ঘষাঘষি মোছামুছি করে নিজেকে পরিষ্কার করতে লাগে টানা দেড় ঘণ্টা।
বিজন পেশায় ডাক্তার। বর্তমানে একটি কোভিড হাসপাতালে ডিউটি করছে। টানা সাতদিন
ডিউটি করে চোদ্দো দিন ডিউটি অফ। তার পর আবার সেই মরনপন সংগ্রাম। এই গরম দেশে
আপাদমস্তক পিপিইতে ঢেকে বিপদসংকুল ডিউটি করা যে কত কঠিন তা একমাত্র স্বাস্থ্য
কর্মীরাই জানে। ডিউটির আগে ওই মস্ত ধড়াচুড়োটা পরতে গিয়ে বিজন অনেক সময় ভাবে যে
ডাক্তার না হয়ে পর্বতারোহী হলেই তো ভালো হতো। অল্প
বয়সে তার পর্বতারোহী হওয়ার শখও খুব ছিল। কিন্তু নিম্ন বিত্ত প্রান্তিক পরিবারের
ছেলে সে। এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ লোকের যা হয় তারও তাই হয়ে ছিল। শখ শখের জায়গায়
রেখে জীবনে ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার দৌড়ে সামিল হতে হয়েছিল তাকে।
ডাক্তার হওয়ার জন্য দিবারাত্রি পড়ার চক্করে পড়ে গিয়ে ঐ সব শখের কথা কবে ভুলে
মেরে দিয়েছিল সে। তবে এখন এই করোনা লড়াইটা লড়তে গিয়ে ওই ইচ্ছেটা বার বার মনের
মধ্যে ঘাই মেরে যায়। মনে হয় ধুস কি হবে শালা এই দিনগত পাপক্ষয় করে। একটিমাত্র শখ
না মিটিয়েই যদি তুমি শালা বিজন মিদ্দে পেশায় ডাক্তার যে কোন দিন করোনায় ফুটে যাও
তবে মরেও শান্তি পাবে না তুমি। কিন্তু ওই ভাবাই সার। বিজন এর পরেও ওই মস্ত পিপিইটা
যত্ন করে পরে মন দিয়ে ডিউটি করে। ভুলে থাকে নিজের সম্পর্কে যাবতীয় ভাবনা।
হাসপাতালে অজস্র রোগ নিয়ে কাল কেটে গেছে কিন্তু তখন তেমন কিছু সত্যিই মনে হতো না।
এখন এই অতিমারীর সময়টা যেন সবকিছুর থেকে আলাদা।
বাথরুম থেকে বের হয়ে একা একা কথা বলেন বিজন
------তুষার সাম্রাজ্যের একা অধীশ্বর ডাক্তার
বিজন মিদ্দে। ব্যস এবার করোনা তার থাবা বসাবে কাকে? জনপ্রানী
বর্জিত তুষার দেশ।
নিজের মনে একা একা হাসেন। টানা ডিউটির কষ্টটা একটু লঘু করে নিতে চেষ্টা করেন। ঘরে ঢোকে বিনীতা।
ডাঃ বিনীতা মিনা। বিজনের স্ত্রী বিনীতা।
----কোভিড পিরিয়ডে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে
বিজন।
----ঠিকই বলেছ। আমার মত এক সপ্তাহ ডিউটি করে এস।
দেখবে তুমিও ভুল বকছ।
-----ওই দুঃখে তো সরকারের চাকরি নিইনি। ডিগ্রি
বাড়িয়ে ক্লিনিক খুলেছি।
বিনীতা গাইনোকোলজিস্ট। বিজন পাতি এমবিবিএস। চাইলে হায়ার ডিগ্রি
করতে পারত সে। কিন্তু কেন যেন ও রাস্তায় হাঁটেনি বিজন। সরকারের চাকরি আর অল্প
কিছু প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে দিব্যি আছে সে। তার মত গরিব পরিবারের ছেলের জন্য
এই তো অনেক পাওয়া। লোকজন ডাক্তার বাবু বলে কিঞ্চিৎ মান্য করছে।
রোজগার হচ্ছে। ব্যস বিজন খুশি।
প্রথম জীবনে বিয়ে থা পর্যন্ত করতে চায়নি সে। একা একা বিন্দাস জীবন কেটে যাচ্ছিল। বাবা মা বিয়ের
কথা বলতেন অবশ্য কিন্তু বিজন ওসবে পাত্তা দিত না। বয়স গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে চলছিল।
হঠাৎই বিনীতা এসে গেছিল সামনে। এক আত্মীয়ের সংগে
বিনীতা র ক্লিনিকে গেছিল কয়েক দিন। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে জীবনের
দিকবদল হয়েছিল। বিজন প্রেমে পড়েছিল। ওদিকের সাড়াও এসেছিল প্রায় সংগে সংগেই। কিন্তু
প্রেম আসা আর বধূ হিসেবে সেই প্রেমিকাকে পাওয়া এই দুয়ের মধ্যে এক সমুদ্র ব্যবধান।
বিনীতা অবাঙালি বিনীতা নামী গাইনোকোলজিস্ট বিনীতা তার ডাক্তার বাবা মায়ের একটি
মাত্র সন্তান এসব ব্যাপার যে বিজনের থেকে কত যোজন দূরে অবস্থান করে তা বিনীতা না
বুঝতে পারলেও বিজন খুব ভালো অনুভব করতে পেরেছিল। তাই ঝোঁকের মাথায় আই লাভ ইউ বলে
ফেলে পরের দিকে সাংঘাতিক পস্তাচ্ছিল বিজন। বিনীতা কে বার বার বোঝাতে চেষ্টা করেছিল
------বিনীতা এবার বোধহয় আমাদের সরে আসা দরকার।
তুমি যতটা ভাবছ আমি বা আমার ফ্যামিলি কখনো ই ততটা নয়। আমার কোয়ালিফিকেশন তো জানো। আমার বাবা মা সুন্দরবনের
ওদিকে গ্রামে থাকেন। লেখা পড়া তেমন জানেন না। চাষাবাদ করেন বাবা। এই রকম একটি
ফ্যামিলি তোমার স্টেটাসের সংগে একেবারে মানায় না। সরে যাও তুমি। আমি খুব বুঝতে
পারি যে এ বিয়েটা একটুও হ্যাপি হবে না।
বিনীতা বিজনের কথা শুনে হেসে ফেলেছিল।
-হাসলে যে?
---তোমার কথা শুনে হাসলাম বিজন। তুমি ও আমি
দুজনের কেউ আর কচি খোকা খুকু নই। আমরা দুজনেই থারটি ফাইভ ক্রস করে গেছি। আমার বাবা
মা বেঁচে নেই। আমি তোমার বাবা মা কে আমার বাবা মা বানিয়ে নেব। দেখো তুমি। আমি ঠিক
পারব। কোন কিছু বাধা হবে না। তুমি প্লিজ আমাকে একটি চান্স দাও। কি দেবে না?
আশ্বাস আর ভরসা দু চোখে মাখিয়ে বিজনের দিকে এক দৃষ্টি তে
তাকিয়ে ছিল বিনীতা। বিজন এর পরে আর পিছিয়ে আসতে পারে নি। বিয়ের পর বিনীতাও কথা
রেখেছিল।
বিজনের বাবা মাকে দু হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিয়ে ছিল সে।
বিজনের বাবা নিত্য গোপাল মিদ্দে যুক্ত করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিল
----আমার ছেলেটার জীবন ভরিয়ে তোল ঠাকুর।
ঈশ্বর প্রার্থনা শুনে ছিলেন। বছর ঘুরতে মা হয়ে ছিল বিনীতা। নাতি কে একটু বড় করে দিয়ে গ্রামের বাড়ি তে
ফিরে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ বৃদ্ধা।
আর তার পরেই শুরু হয়েছিল এই সর্বনাশা করোনা সংক্রমণ আর বিজনের
কোভিড ডিউটি। বিনীতা ইদানীং বাচ্চার জন্য অনেকটাই কম কাজ করে কিন্তু বিজন যেন
পাল্লা দিয়ে তার কাজ বাড়িয়েই চলেছে। ডাক্তারকে মারী ভয় অতিক্রম করতে হয়। তবুও
বিজনের জন্য বিনীতা সর্বদা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। কখন যে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে যায়
বিজন কে জানে!!
বিজনের বাবা মা সবসময় গ্রাম থেকে ফোন করে ছেলে বৌমার খোঁজ খবর নেয়।
বিজন ও বিনীতা দুজনেই ওদের কলকাতায় আসতে বারন করে দিয়েছে। বুড়ো বুড়ি দের সংক্রমনের
ভয় বেশি।
শেষ পর্যন্ত বিনীতা র আশংকাই সত্যি হলো। বিজনের করোনা পজিটিভ
রিপোর্ট এল। বিজন ব্লাড সুগারের পেশেন্ট। চট করে পরিস্থিতি খারাপের দিকেই গেল।
ভেন্টিলেটরে দিতে হলো বিজনকে। অজস্র অশ্রু ফোঁটা হাতড়ে বিনীতা তখন শুধু একটা নরম
বুক চাইছে যেখানে মুখ গুঁজে সে তার কান্নার বাঁধটা নিশ্চিন্তে খুলে দিতে পারে।
কিন্তু কোথায় কি? বিজনের বাবা মা বার
বার ফোন করে চলেছে কিন্তু ছেলে মৃত্যু শয্যায় জেনেও একবারটি ছুটে চলে আসছে না।
বিনীতা হতবাক হতেও ভুলে গেল। এত মৃত্যু ভয় ওদের? এই যে
সারাক্ষন বলে যে বিজন ওদের সর্বস্ব? ওগুলো কি তাহলে সব
মিথ্যা কথা?
বিনীতা র হিসাব মেলে না। সে শুধু বুক বেঁধে করনীয় কাজটুকু করে
যায়।
ডাক্তার বিজন মিদ্দে
মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলে। বয়ে চলে আশংকার স্রোত।
ওদিকে সুন্দর বনের এক গ্রামে নিত্য গোপাল মিদ্দের বৃদ্ধা স্ত্রী অন্নপূর্ণা মিদ্দে হাহাকার করে
-----আমাকে ছেলেটার কাছে পাঠিয়ে দাও গো। এর
পরে গেলে আর যদি দেখতে না পাই। তুমি মরনের ভয় করছ করো। আমি কোন ভয় করি না।
নিত্য গোপাল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে
-----মরনের ভয় আমিও করি না গিন্নি। আমি শুধু জমি
জিরেতগুলোর টানে ছুটে যেতে পারছি না। আমি করোনায় মারা গেলে ছেলে বৌমা বা নাতি কেউই
এ সম্পত্তির কিচ্ছুটি পাবেনা। আদালত খুললে এ জমি গুলোর সঠিক বিলি ব্যবস্থা করে
তবে আমার ছুটি।
অন্নপূর্ণা কেঁদে ওঠে
----যদি ছেলেটার কিছু হয়ে যায়!!
------ নাগো ঈশ্বরের ওপর আমার বিশ্বাস আছে। ছেলে
ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে। আর না হলে----
---না হলে? অন্নপূর্ণার
ঠোঁট কেঁপে ওঠে।
---না হলে বৌমার নামে-----