লইট্যে,
শঙ্কর, গাংবোগো, সারডিন – এই সব নোনা মাছ কিনতেই, কুলীন বাজার ছেড়ে, এদিকটায় আসা। চলতি
নাম ‘ক্যাম্পের বাজার’। দু’একজন মাসি
নীচে বসে মৌরলা, আমোদি, চিংড়ি বিক্রি করলেও মিতালি উঁচুতে বসে। তার দোকানে বরফ
দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। সঙ্গে তালাচাবিও।
ফলে, দরাদরিতে কমা বাড়ার প্রশ্ন নেই। আজ সে পরেছে, নীল রঙের টাইট লেগিংস আর
হাতাওয়ালা ফুল ছাপ কুর্তি। কুরূপা হলেও ব্যক্তিত্বময়ী। তটিনীর কেনা লইট্যেগুলো
ছাড়াবার সময়, একটি ঘরোয়া বউ ঘেঁষে দাঁড়াল, মুটে-পাড়া বস্তির বাঁদিক থেকে এসে। মাছ
কিনতে নয়, গল্প করতে। মাছ কোটা শেষ করে ,
ভাগে ভাগে গুছিয়ে তুলছে মিতালি, এরই মধ্যে
বোমা ফাটাল অন্য বউটি। কান করে শুনল তটিনী। কার কথা বলছে, সৌগতদার না? মুখের
ভিতরটা বিস্বাদ হয়ে এলো। ছোট ছোট সবকটা পুঁটলি আরও একটা প্যাকেটে
ভরে গাড়ির দিকে হাঁটা লাগাল তটিনী। তার ফ্ল্যাটে যাওয়ার রাস্তাতেই সৌগতদা আর
সুনীপার বাড়ি। বাঁহাতি একটা নার্সিং হোমের উল্টো দিকেই, হলুদ রঙের তিনতলা। ঘাড় না
ঘুরিয়েও তটিনী দেখতে পেল, সুনীপার সেই লাল অল্টো গাড়িটা, তাদের তালা বন্ধ গ্যারাজে
, ধুলোর আস্তরণ পড়া। বছর পাঁচেক হবে,
সুনীপা মারা গেছে, স্কিন ক্যান্সারে। সিক্সটিসের হলিউড নায়িকাদের মতো চেহারা। গোলাপি
ঠোঁট, ফরসা রং আর ছিপছিপে শরীর। খুবই প্রাণবন্ত ছিল। আসানসোলের পাবলিক ইশকুলে পড়া। সম্বন্ধ করে সুযোগ্য পাত্র
সৌগতদার সঙ্গে বিয়ে। দুই ছেলে আর বরকে নিয়ে জমজমাট সংসার। কর্মসূত্রে তটিনীদের ইশকুলে কিছুদিন পড়ালেও, পরে
হেড মিস্ট্রেস হয়ে অন্য ইশকুলে চলে যায়।
তাই তার সুনীপাকে মনে আছে।
সুনীপার
আকস্মিক অসুস্থতার কথা তটিনী জেনেছিল তারই আর এক সহকর্মী রঞ্জনার কাছে। টিচার্স মিটিঙের এক ফাঁকে কানের কাছে মুখ এনে
বলেছিল, ‘সুনীপার খবর ভাল না, দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তবে সৌগতদা ওকে ঠিক সুস্থ করে
তুলবে’। আজ মাছের দোকানের বউটি যখন বলছিল, ‘ ক্যান্সার অবস্থাতেও তো বউটা গাড়ি
চালিয়ে ইশকুল যেত’। তটিনীর চোখেও ভেসে উঠল উইগ পরা সুনীপার, স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে
বেরিয়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য। মনে এলো সৌগতদার মুখটাও। রূপবান না হলেও
আকর্ষক ব্যক্তিত্ব। ব্যবহারে চাপা অহংকার আছে। এই সাত পাঁচ ভাবনার মধ্যে দিয়ে,
তটিনী যে ঠিক কি চাইছে তা সে নিজেও বুঝতে পারলনা। আজ মাছের দোকানে দাঁড়িয়ে যা শুনল,
সেটাই কি কাউকে বলতে চাইছে, নাকি অন্য একটা অঙ্ক মিলে যাওয়ায় গোপনে একটু সুখও বোধ
করছে!
বাড়ি
এসেই মাছগুলো ধুয়ে, জল ঝরিয়ে ফ্রিজে তুলে রাখল। আজ ইশকুল ছুটি নিয়েছে, ব্যাঙ্ক
সংক্রান্ত কিছু কাজ সারতে। একটু বাদেই আবার বেরোতে হবে। হাতটা ভাল করে ধুয়ে, একটা
নাইটি গলিয়ে, আগে খেয়ে নিল। অনেক সময় নিয়ে স্নান করল আর ভাবল। ঘরে এসে আয়নার সামনে
বসে অনেকক্ষণ দেখল নিজেকে। পঞ্চাশ পার করা ভার, তার শরীরে। নিঃসন্তান তটিনী একদিকে যেমন ঝাড়া হাত পা, অন্যদিকে তেমনি একটা
খালি খালি ভাব। তিন কামরার এই আস্তানায়
ঘুরে ফিরে সে আর সমীর। দু’জনেরই বাবা মা অন্যত্র থাকেন। আত্মীয় বন্ধুদের যথেষ্ট
যাতায়াত থাকা সত্ত্বেও তটিনী ও সমীর কিসের যেন অভাব বোধ করে। তাই কোনও বিবাদও নেই,
কারণ যে যার বৃত্তে । সমীরের দেরি করে ফেরা বা তটিনীর একা একা বেড়াতে চলে যাওয়া নিয়ে, মান বা অভিমানের অযথা কচকচি নেই। দু’জনের আলাদা আলমারি,
আলাদা সেলফোন, আলাদা ল্যাপটপ। হাঁড়ি আর বিছানাটা অবশ্য এক আছে। এক আছে দু’জনের
পছন্দের খাবার, দেওয়ালের রং, আর মাঝে মাঝে প্রত্যাশার অতীত স্পর্শ সুখ। এই
নিবিড়তাতেই তারা কাজ ভাগাভাগি করে সংসার
চালায়, নাইট শো দেখে হেঁটে ঘরে ফেরে, বই কেনে, গান শোনে, গল্পও করে। তটিনীর মা তবু বলেন
যে, মাঝে মাঝে নাকি যাচিয়েও নিতে হয়, কারণ সব কিছু ঠিক আছে এটা ধরে নেওয়াটাই নাকি মস্ত ভুল। তার আশি পার করা মা আর নব্বই ছুঁই
ছুঁই বাবা এখনও চুরমার তছনছে ঝগড়া করে দু’জনেই বলেন যে, একজন ভাল উকিল পাওয়া গেলনা
বলেই ‘ডাইভোরসটা’ হলনা। বাবা ফোন
করে বলেন, ‘তনু তুমি আপত্তি করলেও আমি এবার সত্যি সত্যি একা থাকবার
ব্যবস্থা করছি’। কয়েক ঘণ্টা পরেই মায়ের ফোন আসে, ‘ একা থাকবেন উনি! সকাল থেকে
বাক্যি যন্ত্রণা কাকে দেবেন তাহলে’? মা বলেই চলেন, ‘ তোমার বাবা তো আর আমার বাবার
মতো নয়, যে স্ত্রীকে মাথায় করে রাখবেন! তো , আমি সেই বাপের মেয়ে বলেই এই আখাম্বা
ঝগড়ুটের সঙ্গে ঘর করছি। নইলে, শত্রু নাশ করে কবেই আশ্রমে চলে যেতাম’। এই তীব্রতা তটিনী বা সমীরের মধ্যে সত্যিই নেই। আজ
ড্রেসিং ইউনিটের সামনে বসে মনে হল, সমীর কি লক্ষ্য করেছে এই অ্যান্টি এজিং বা
অ্যান্টি রিঙ্কলস ক্রিমগুলো! লিপস্টিকের রং ও যে বদলে ম্যাট ব্রাউন বা আই শ্যাডো
বাদ দিয়ে শুধুই লাইনার ! দু’হাত মাথার ওপরে তুলে দেখল, কাঁধের নীচে থেকে ভারি হয়ে
আসছে , মানে মোটা হওয়ার প্রথম ধাপ। অল্প অল্প রুপোলী রং ধরা চুলগুলোকে চুড়ো করে
ধরে, আয়নার আরও কাছে এগিয়ে আনল মুখটা। দাঁত, ঠোঁট, ঘাড় খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে মনে হল, ইদানীং সে ও তো সমীরকে আর খুঁটিয়ে দেখেনি।
আয়নার মতো রোমান্টিক আর কি আছে, ভাবল
তটিনী! কোনও কথা নেই, শুধু দেখা, পাহাড়ি নদীতে পা ডুবিয়ে, মুগ্ধ বসে থাকবার মত। আলো
আঁধার গায়ে মেখে দীর্ঘ চুম্বনের মতো। মুখ
ঘুরিয়ে নিজের বিছানায় এলিয়ে পড়ল তটিনী। ঘণ্টা খানেক বাদে উঠে, ঝটপট একটা প্রিন্টেড
পালাজো আর লম্বা ঝুলের সাদা কামিজ পরে, গলায় একটা স্কার্ফ জড়িয়ে নিল। ব্রাউন
পেন্সিলে চোখ এঁকে, ঠোঁটে লিপগ্লস লাগিয়ে, কানে দুটো ম্যাচিং ফুল পরে প্রসাধন
সারল। বড় ক্লাচারে চুল আটকে, লম্বা ব্যাগ কাঁধে, দরজার লক টেনে বেরিয়ে পড়ল সে। চারটের মধ্যে সব কাজ শেষ করে কি মনে হল, ড্রাইভার মিঠুনকে বলল লেকে নিয়ে যেতে। শীতের নরম
বিকেল। বাঁধানো রাস্তায় খানিক হেঁটে , জলের দিকে মুখ করে সিমেন্টের বেঞ্চে বসল তটিনী
। আবার তার মনে এলো আয়নার কথা, মনে এলো সুনীপার কথাও। ভাবল, সৌগতদা কি বরাবরই এইরকম, নাকি সুনীপার মৃত্যুতে
শূন্যতাই এর কারণ ! সূর্যাস্তের সময় এই লেক গার্ডেনস ফ্লাই ওভার ধরে ফেরাটা মোহময়।
অনেক বছর আগে এখানেই দাঁড়িয়ি, সে স্কেচ করতো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
বাড়ি
ফিরে, দরজায় তালা দেখে বুঝল যে সমীর এখনও ফেরেনি। ঘরের পোশাক ছেড়ে, এক কাপ চা
বানিয়ে খাতা দেখতে বসল সে। খান কয়েক দেখা হতে না হতেই সমীরের বেল; তটিনী চেনে। তার
জীবনে কোনও আগন্তুক নেই। সৌগতদাকে ঘিরে ওই
গল্পটাই কি আজকের আগন্তুক? সারাটা দিন বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে তটিনী। উপভোগ
করছে তার দায়, তার দায়িত্ব, তার সময়, তার সংসার আর বেডরুমের ওই আয়নাটাকে। হাত মুখ
ধুয়ে, চেয়ারে চা নিয়ে বসেই সমীর বলল, ‘ইশকুল ছুটি নিয়ে বেশ ফুরফুরে হয়ে আছ,
সুগন্ধি ছড়িয়েছে ঘরময়’! চা শেষ করে আবার বলল, ‘নাসিরুদ্দিন শাহের অটোবায়োগ্রাফি
শেষ?’ তটিনী বলল, ‘তারিয়ে তারিয়ে পড়ছি, শেষ হয়ে গেলে মন খারাপ হবে’। আয়নার
প্রতিফলনে, অপাঙ্গে সে দেখতে লাগল সমীরকে। মধ্যবয়সী ভারি সারি সুখি চেহারার আড়ালে,
এক ছটফটে যুবক। মনে পড়ল, বেড়াতে গিয়ে আলাপ হওয়া মধুরার কথা। তটিনী জানে যে, সেই থেকে আজ এই বছর পাঁচেক
ধরে, তাকে বাদ দিয়েই সমীরের নিয়মিত
যোগাযোগ মধুরার সঙ্গে। প্রথম প্রথম অবাক হতো, সঙ্গে মান অভিমান এবং কষ্ট। এখন গা
সওয়া হয়ে গেছে। সম্পর্কটা আর যাই হোক অপমান করেনা তটিনীকে। আর এ নিয়ে কোনও রসালো
আলাপ আলোচনাও কানে আসেনি তার। একবার ভাবল, সৌগতদার সম্পর্কে যা শুনেছে সেটা সমীরকে
বলে। পর ক্ষণেই ভাবল, কি লাভ সুনীপাকে ছোট করে! তালপাতার ঝুলন্ত ল্যাম্প শেডটার
দিকে তাকিয়ে রইল তটিনী।
ভোরবেলা
ঘুম ভাঙল শান্ত নিঃশ্বাসে । রাত্রিবাস
ছেড়ে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসে বসল। এসময়টা সে চুপ করে বসে থাকে আর গান শোনে। সাতটা নাগাদ
সীতা এলে শুরু হয় বাড়ি বাড়ি খেলা। গান চললেও, মনের মধ্যে আজ শুধু সুনীপাই যেন ঘুরে ফিরে আসতে লাগল । পাঁচ বছর হল সে আর নেই, অথচ
এখনও তাকে মনে রেখেছে কত সাধারণ মানুষ! তার
চাকরি, গাড়ি চালানো, ক্যান্সার হওয়া, এবং
পরিপাটি সংসার করা। এমনকি তার দুই ছেলেই যে বাইরে থাকে, সেকথাও তারা জানে। হয়তো
সেই আক্ষেপেই বলেছে, ‘বরটার কি স্বভাব!’ ওদের কথা অনুযায়ী, কাজের মাসিই এখন
গিন্নী, তার সঙ্গেই সংসার। সৌগতদার
সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতার কারণেই নাকি, কাজের মাসিকে তার নিজের সংসার থেকে ছেলে বউ
তাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি সেই মাসির বর মরে যেতেও,
সে বাড়িতে তাকে আর ঢুকতে দেয়নি তারা। মিতালীর
ফোড়নটাও মনে পড়ল তটিনীর , ‘নষ্টামি তো
করবি বটেই, বউ মরেছে বলে কি শুকিয়ে থাকবি! তবে যা করবি নিজের জাতে কর, না হয়তো
বিয়ে কর, বউয়ের মানটুকুও রাখলিনা!’ তটিনীর মনে খচ খচ করতে লাগল ‘মরা বউ’ কথাটা।
আসলে যারাই সুনীপাকে চিনত তাদের সকলেরই যেন নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে। সুনীপার এই
বারে বারে হেরে যাওয়াটা কেউই যেন নিতে পারছেনা। সৌগতদার এমন ঝুঁকে পড়া স্বভাবটা
সুনীপা নিশ্চয় জানত। শেষ একবছর তো সে শয্যাশায়ী ছিল, তাই হয়তো ভেবেছিল, বর যা করবে
ঘরেই করুক; আর যা হোক, কাজের মাসিকে তো আর বউ করে ঘরে তুলবে না! যার গান চলছে, তটিনীর মনে পড়ল যে, এই শিল্পীই তো সুনীপার স্মরণ বাসরে গান গেয়েছিল! হঠাৎই মনে হল
যে, তখন এই অনামা শিল্পীকে কোথায় পেল সৌগতদা? যারা এত ব্র্যান্ড সচেতন , তারা তো খ্যাতিমান শিল্পীকেই ডাকবে। তবে কি ওই মেয়েটির সঙ্গেই জড়িয়েছিল সে সময় ! মনে পড়ল,
রঞ্জনা বলেছিল যে, স্মরণ সভায় যে গান গেয়েছিল, সে মেয়েটিই নাকি সুনীপাকে সাজিয়ে
দিয়েছিল, শেষ যাত্রায়। বলেছিল যে সুনীপার বেশ কিছু ব্যবহার্যও নাকি, খুশি হয়ে তাকে উপহার দিয়েছিলেন সৌগতদা। গানটা
শুনতে শুনতেই সি. ডির কভারে ছাপা শিল্পীর ছবিটার ওপর হাত
বোলাল তটিনী। এটা সাম্প্রতিক ছবি, গোছানো
সাজানো আত্মবিশ্বাসী এক মুখ। সুনামের খ্যাতিতে এখন সে ওপরে উঠে গেছে, রিটায়ার্ড
সৌগতদাকে কেনই বা আর পাত্তা দেবে! তার ওপর বিপত্নীক, মেলামেশার ঝুঁকিও তো কম নয়!
ফলে সবদিক বিচার করে সৌগতদার সিদ্ধান্তেই আস্থা রাখল তটিনী। ভাবল, কাজের মাসি
অন্তত তাঁর বেসিক নিডগুলো মেটাবে, আর ছেলেরাও শান্তিতে থাকবে, তাদের মায়ের
জায়গাটায় নতুন আর কেউ না এসে পড়ায়। তবে মাসিটির ভবিষ্যৎ ভেবে, বেশ খানিক অপমান ধেয়ে এলো মনে। কত
রকম সমঝোতা যে সংসারে হয় ! তার নিজের এবং সমীরের মুখটাও ভেসে উঠল । সমস্ত বিদ্বেষ
যেন মন থেকে চলে গেল। সরে গেল সুনীপার মৃত মুখটাও।
ভোরবেলার
আকাশটাকে আয়না বলেই মনে হল তার। যেন নির্ভার তটিনীর পাশে এসে বসল ঝলমলে সেই সুনীপা,
যখন আয়োজন করে আর মিথ্যে সাজাতে হয়না। এই সমাবেশ এক নতুন প্রতিশ্রুতি। চেয়ারে বসেই
ঘুমিয়ে পড়ল তটিনী, সীতার বেল বাজানোর অপেক্ষায়।