রবিবারের
দুপুরের বুকে শুয়ে আছে দীঘি। আমার চেতনার ভেতর থেকে একটা পথ সরাসরি সেই দীঘির
তলদেশে যায়। দীঘির তলদেশে স্মৃতির পাহাড়।দুয়েকটা মুখ জমে থাকে পাহাড়ের
পাদদেশে।নিজের অথবা অন্যের। শুয়ে থাকার ভেতর দিয়ে আমি অসুখের দীর্ঘ মরু অতিক্রম
করি।আমার আত্মা এমন সময় জল।আমার আত্মা জলের কাছাকাছি পাথর। পাথরের ভেতর শুয়ে থাকে
স্বজনের আঘাত।স্বজনের ভেতর থাকে নির্জনতা।নিজেকে নিজে জানা। তাদের মুখ আতা ফলের
স্বাদের মতো। তাদের ঘরের বারান্দায় রোদ গায়ে শাল জড়িয়ে বসেছে প্রথম খন্ড
হাতে।জীবনের প্রথম খন্ড। ছাদ ফিরে পেয়েছে পুরোনো বান্ধবী ঝরে যাওয়া পাতা। পাতার খসখস,পাতার
আঁচল উড়ে যাওয়া তার বুকের তলদেশ থেকে উড়িয়ে নিয়ে যায় হাওয়া। হাওয়াগুলো এসে বসেছে
সকলে বাগানের ছায়ায়। তাদের চোখ দূর ছাদের দিকে চলে যায়। এক অন্ধ গান গেয়ে গেয়ে ঘোরে
চাঁপাডালি থেকে কালিকাপুর,কাজিপাড়া। এক ভিখারিনী সকলকে অভিশাপ
দিতে দিতে ঘোরে নবপল্লী থেকে উদয়রাজপুর।তাদের বুকের মধ্যে আতা বীজ পুঁতে দিয়েছে
কারা?গাছ হয়নি শুধু গর্ভযন্ত্রণায় তাদের এই গান,তাদের এই চিৎকার।আমি ছাদ থেকে ছাদে নিজেকে দু দশ টাকায় বিক্রির আশায় ঘুরে
বেড়াই।কিনে নেবে কোন ছাদ আমাকে?আমার ভেতর আগ্নেয়গিরির মতো
উঠলে উঠেছে কামনা,আমার মধ্যের সমস্ত রাগ আমি বৃষ্টির থেকে
বাঁচিয়ে রেখেছি।তবু কেন হৃদয়ের মধ্যে এই বোধ জেগে থাকে কাউকে পাবে না তুমি। কাউকে
পেলে তার থেকে নিজেকে আড়াল করে নিতে হবে। তাকে বাঁচাতে।কারণ আমি সেই ইচ্ছেসাপ যার
ছোবল আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই।মানুষ সাপের ছোবল দেখে,বিষ
দিয়ে মনে রাখে মানুষ সাপের নাম। অথচ কেউ দেখেনি রবিবার দুপুরে এক সাপ মফসসলের
রাস্তা দিয়ে বিক্রি করতে করতে যায় তার আত্মা।গর্তের জীবন সে অতিক্রম করে যেতে
চায়।একটি ছাদের জীবন তার সরীসৃপ অভিশাপ কাটিয়ে পাখি করে দিতে পারে। পাখির ভেতর শুয়ে
থাকে আকাশ,আকাশের গভীরে দীঘি।দীঘির ভেতর পাহাড়। পাহাড়ের
পাদদেশে অসংখ্য মুখ পড়ে আছে।পড়ে আছে অস্ত্র ও ফুল। পড়ে আছে পুরুষ ও নারীর অন্তরের
পোশাক।পড়ে আছে কবির জন্য বিশেষ অভিশাপ সমূহ।
তার
ভেতর শুয়ে থাকে কেবল দুটি হাত।মৃত তবু স্পর্শহীন নয়। একটি হাত আদর ছুঁতে পারে,অপর
হাতে লেগে থাকে রক্ত।
রক্তের
ভেতর প্রবাহ,প্রবাহের চারিদিকে মাঝিদের ঝুপড়িগুলো। সেখানকালে কোন এক
কিশোর রবিবারের দুপুরে নৌকার গলুইতে বসে বসে আকাশ দেখে।তার ঘরে রাতের বেলা টিমটিম
করে জ্বলে দু:খ।
কবির
বিশেষ অভিশাপসমূহের মধ্যে জ্বলে থাকে এই আলো। এই আলোর ভেতর মাঝে মাঝে ভোরবেলার আলো
দেখা যায়।এ আলোয় একটা মুখ এসে রবিবারের ছাদে দাঁড়ায়।
আমার
দাম নিয়ে দরাদরি করে সে।নিজের একটা পুরোনো সুতির শাড়ি দিয়ে দেয়। ওজন করে মেপে নেয়
আমাকে।রেখে দেয় ঘরের সবথেকে পুরোনো কোণায়।
ঝুল পড়ে,মাকড়সা
বাসা বাঁধে। মাঝে মাঝে বুকের আঁচল দিয়ে তা পরিস্কার করে সে দক্ষিণহাতে ঠিক করে নেয়
চোখের কাজল।
2
চেনা
পথের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একেকদিন মনে হয় ঘুম থেকে জেগে উঠলাম
এইমাত্র।পৃথিবীটাকে খুব অন্যরকম আশ্চর্য লাগে। আমাদের বাড়ির উত্তরদিকে জমিতে একটা
নতুন পরিবার এসে বাড়ি উঁচু করে গেঁথেছে। বিকেলে যে বরফওয়ালা পরিচিত সুরের মধ্যেই
বেঁচে থাকার নরম এক পথ রেখে যেত তাকে আর দেখতে পাই না।তবু তার গলা পাই,এমনই
হয়ত জীবনের শেষভাগটা।দক্ষিণের পুরোনো বাড়ির কলতলায় সামান্য আড়ালে বৃদ্ধটি কোনক্রমে
স্নান করে। সে জানে না তার যে ভাইঝি পুড়ে মারা গিয়েছিল বছর দশ আগে সে এখনও জানালায়
বসে গান শোনায় হারমোনিয়ামে।তার গান শুনি। নতুন কলোনির মোড়টায় একটা সভা
বসেছে।যথাসম্ভব সততা জড়িয়ে বামপন্থী আন্দোলনকে আবার প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চায় একটি
গলা।দুচোখে তার ভাসে বড় বড় অট্টালিকা,দোকান,বাজার,সে সবের ওপরে ধীরে ধীরে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে
একটা রক্তচক্ষু পতাকা। অথচ যে উন্মাদ পথে পথে স্লোগান দিতে দিতে নগ্ন একা,আমি দেখি সেখান থেকে এক শূন্য কি জাদুতে এক হয়ে যায়। দেড় বছর আগে যে
শ্রমমন্দিরে নিজের জীবনের সর্বস্ব দিয়েছিল বাবা সামান্য এক অবসর তাকে দূরে নিয়ে
গেছে।সেখানে নতুন এক চমক হবে,পুরোনো ধসিয়ে বসবে বাজার।
আমাদের
জমির পূর্বদিকে মেয়েটির স্নানে যাওয়া নিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন ঝগড়া
বাঁধতো। এখন যে ও কার সঙ্গে ঝগড়া করে,কাকে সব ছেড়ে চলে যাওয়ার
ভয় দেখায়। একেকদিন ও জানালায় বসে আকাশ দেখতে দেখতে ওপারের জানালায় সেলাই যন্ত্রের
সামনে মায়ের চুপ করে থাকা দেখে দেখে কেমন ফুরিয়ে যাই। মানুষের কথা ফুরিয়ে যায়
সবথেকে বেশি,তার থেকেও বেশি ফুরিয়ে যায় মানুষ নিজে।
একটা
গলির পর আরেকটা গলি ফুরিয়ে যেতে থাকে। খসখস করে নিজেদের প্রাণের কথা বলে যায় ঝড়ে
যাওয়া পাতা। একটি কিশোরী মুখ আলো আঁধারের মধ্যে জেগে ওঠে এমন,তার
কোন তল খুঁজে পাইনা। নিজের বিভিন্ন বয়স এভাবে অনেক পথ হয়ে যায় ঘুরে মরবার জন্য।
ধীরে
ধীরে একেকটি ভুলে খুব অস্থির হয়ে পড়ি। বারবার ডায়েরিতে লিখে রাখি কতদূর যাওয়া
প্রয়োজন।পর্দার সুতোর কারুকাজ খুলে যায়,তা অসুখের সমস্ত ঢেকে
রাখে।
অথচ
এমনই বৃষ্টির দিনে মনে হয় ভালবাসি। মনে হয় নিজের কাছে বসে একটু ছুঁয়ে দেখি জীবনের
মানেহীন মানে। এমনই একেকদিন প্রাণের ভেতর দোলা রেখে যায় একটি নতুন মুখের আদল।
সে আদলে
একটা পুরোনো বেহালা বাজানোর ঘর খুঁজে পাই।বড় বড় ঝোপঝাড় পেরিয়ে একটা কাঁচের জানলা
দিয়ে কিছু যেন বৃষ্টিতে ভেজা রোদ আসে।অথচ সে মুখের পিছুপিছু যাওয়া স্বভাব
নয়। প্রাণের গভীর কালো জ্বলে তা ভাসিয়ে রাখি।একদিন ডুবে যায় স্বভাবে,আমি
তো সাঁতার জানি না।
অথচ
এমনই একেকদিন খুব গোপনে কিছু কথা রেখে যাওয়া যায় চিঠিতে। মনে হয় কাউকে গোপন করে
রাখি।
মনে হয়
পুরোনো চিঠিগুলো ডাকে ফেলে আসি। কোন ঠিকানা নেই তাই কোনদিন হয়ত খুঁজে খুঁজে একদিন
কেউ এসে দেখা দেবে
তাকে
বলি,অনেকটা আঘাত আমি লুকিয়ে রেখেছি বৃক্ষের মেধায়। বর্ষার জল পেলে তাতে ফুল
হয়।বিশ্বাস পেলে সে ফুল গন্ধ ছড়ায়।
গায়ের
শালে জড়িয়ে সে যদি বুকের গন্ধ পাঠায় তাকে বলি ভালবাসা,তাকে
বলি হেমন্তের ঘরে ফেরা
দৃশ্য
ফুরিয়ে যায়,তারপর বিশ্বাস,তারপর মানুষ,তারপর গন্ধ…
কবিতা
শাদা খাতায় চুপ করে থাকে আর তার ভেতরে চাপা পড়ে যায় এইটুকু জানতে চাওয়া
- সে ভালো আছে?
দীপ শেখর চক্রবর্তী