আমার রবীন্দ্রনাথ
প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিলো – কে তুমি?
মেলেনি উত্তর।
জল পড়ে পাতা নড়ে থেকে হাঁটতে হাঁটতে চাঁপাগাছে লুকোচুরি, তারপর মায়ের ঘরে বসে পড়া পড়া খেলা খেলতে খেলতে একদিন
জানলাম – জল মানে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন, আর পাতা দেখালো সালোক-সংশ্লেষের সৌর-রান্না।
সত্তরের গোড়া। মূর্তির কণিষ্ককরণের হিড়িক শেষঅঙ্কে। ইশকুলের উঁচু
ক্লাশে পড়ি। মধ্যরাতে একদিন সহসা মেঘ ডাকলো – ঋ। দৌড়ে বারান্দায় এলাম। দাঁড়িয়েই রইলাম। ‘না জানি
কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ’। ভোর
এলো বাঁশি হাতে। সুর তুললো – চিরনূতনেরে দিলো ডাক ...
ঈশ্, ভুলেইছিলাম।
দৌড়ে বেরিয়ে পড়িমরি বাসে উঠে হাওড়াস্টেশন। জোড়াসাঁকো কোনদিকে? একদল লালপাড় সাদাশাড়ি আর ফুলখোঁপার পিছুপিছু দোতলা বাসে চড়ে গণেশ টকীজ -
কালো ধোঁয়ার মেঘ সরতেই দেখি সামনে ইয়াব্বড়ো রূপ-কি-রাণীর হোর্ডিং। কিন্তু কোথায়
ফুলখোঁপারা? কোনোখানে জনমানব নাই – ধু
ধু করে যেদিক পানে চাই। হাঁটতে হাঁটতে - দূরে দেখি একটা পানবিড়ির খোলা পাল্লায় জল
ছেটাচ্ছে এক প্যাংলা। নিমেষে ট্রামলাইন পেরিয়ে মুখোমুখি।
আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের
বাড়িটা কোনদিকে?
বেজায় বিরক্ত টিকিধারী ত্যারছা চোখে ঘাড় কাত করে থলথলে গালভর্তি
খয়েরজল পাশের দেয়ালে ফুচ্ ছুঁড়ে উর্ধমুখে বললো – রবিন্দর্? ইয়ানি ওমপোর্কাস্কা
ভানজা?
ছিটকে ফিরলাম বাসস্টপে, ধুত্তোরি চোখে ওপরে তাকাতেই রূপ-কি-রাণী মূর্ধন্য ণ-এর মতো বললো – চুপ করো, কথা শোনো।
আমি বাধ্য ছাত্র হয়ে ঠোঁটে তর্জনি ঠেকিয়ে ফুটপাথে বসতেই নেমে এলেন
রূপ-কি-রাণী। নাটকীয়ভাবে শুদ্ধ বাঙলায় বললেন –
‘এই-যে রে মরুস্থল/ দাবদগ্ধ ধরাতল,/ এখানেই
ছিল পুরাতন-/ একদিন ছিল তার/ শ্যামল যৌবনভার/ ছিল তার দক্ষিণপবন।’
লাফ দিয়ে উঠলাম – কড়ি ও কোমল। কবিতার নাম ম্ম্ম্... নূতন।
এক রোদ হেসে রূপ-কি-রাণী বলে চললেন – ‘যদি রে সে চলে গেল,/ সঙ্গে
যদি নিয়ে গেল/ গীত গান হাসি ফুল ফল,/ শুষ্ক স্মৃতি কেন মিছে/
রেখে তবে গেল পিছে/ শুষ্ক শাখা, শুষ্ক ফুলদল!’
বললাম – কিন্তু
তুমি তো শুনেছি তামিল না তেলেগু?
আমি ভারতীয়। আর উনি পৃথিবীর।
তারপর গলা ঝেড়ে ফের বললেন –
‘ফোটা নব ফুলচয়,/ ওঠা নব কিশলয়,/ নবীন বসন্ত আয় নিয়ে।/ যে যায় সে চলে যাক-/ সব তার নিয়ে যাক,/ নাম তার যাক মুছে দিয়ে’।।
ফুড়ুৎ। হাওয়া। চেয়ে দেখি, হোর্ডিঙে আবার নাচমুদ্রায় স্ট্যাচু।
‘রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে/...পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে
নাচা’-র কলেজজীবন। হোস্টেলের রুমমেট এসে ধরলো – একটা ঘ্যাম্ প্রেমপত্র লিখে দে গুরু, যাতে ...।
অমনি কানের পাশে ফিসফিস আর আমি শ্রুতিধর গণেশ – ‘আমার সকল
নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়/ আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যেজন ভাসায়/’...
দুপুরে চুলে টেরি কেটে সে চিঠি পকেটে বন্ধু বেরোলো – সন্ধ্যায় ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে
রে’...
রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ব্যাস্ -‘দুই হাতে দুই দাঁড় ধরে সে আমাকে তুফানের নদী পার করে দেয়; বুনো ঘোড়ার কেশর ধরে আমাকে বনের ভিতর দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে যায়; লাফ-দেওয়া বাঘের দুই ভুরুর মাঝখানে তীর মেরে সে আমার ভয়কে উড়িয়ে দিয়ে
হা-হা করে হাসে’। চোখ খুলতেই ‘দেখি সেথা কলকলরবে/ বিপুল জনতা চলে/ নানা পথে নানা
দলে দলে/...রাজছত্র ভেঙে পড়ে, রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে’...
যাব্বাবা, কে তুমি? এখানেও?
ইতিমধ্যে ‘বেতন পঁচিশ টাকা, সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি’-র ক্ষেত্রে ‘মেয়েটা তো রক্ষে পেলো, আমি তথৈবচ/ ঘরেতে এলো না সে
তো। মনে তার নিত্য আসা যাওয়া’...
সত্যি বলো তো –
তারপর খ্যাপার মতো পরশপাথর খুঁজে ফিরতে ফিরতে ‘আলো-আঁধারের ঘটল সংগম,/ দেখা
দিল রূপ,জেগে উঠল রস;’ – প্রলয়সন্ধ্যায়
জপ করতে বসলাম –‘কথা কও, কথা কও’
‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে’...
সেই পথে ‘রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা’। এখানেও? আমার
শেষযাত্রার অবেলায়? হ্যাঁ, ‘রাতের সব
তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’ বলে একজনকে তো নামিয়ে দিলাম
পরের স্টেশনে। আর তুমি? তোমাকে নিয়ে এখন কী করি? বৎসর বৎসর চলে গেল।/দিবসের শেষ সূর্য/ শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল/
পশ্চিমসাগরতীরে/ নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় –
কে তুমি?
কোনো উত্তর নেই – ধ্যুস্!
পল্লববরন পাল