লেখকঃ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক : আনন্দ ,
প্রচ্ছদ শিল্পী : সৌমেন দাস
প্রচ্ছদ শিল্পী : সৌমেন দাস
আলোচনায় সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়
জন্ম ও মৃত্যু অমোঘ দুই সত্য, এই নিয়েই জীবন। সৃষ্টি হলে বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। তবুও জীবনপথের চড়াই উতরাইয়ে
মানুষ শুধু আটকে পড়ে নানান প্রশ্নের ভেতর। জীবনে প্রতিষ্ঠা পেলেও হয়ত বংশপরিচয়ের
গুরুত্ব কোনমতেই অস্বীকার করতে পারেনা সে আজো। জীবনের বীজকে খুঁজে পাওয়া ও তাকে গুরুত্ব
দিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়া, এই ভাবেই বইতে থাকে সময়। ঔরস
উপন্যাসের ভেতর এই টানাপোড়েন চোখে পড়ে। যেভাবে উপন্যাসিক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
ধীরে ধীরে উন্মোচন করোছেন জীবনের এই সত্যতা, তা পাঠককে এককথায় আটকে রাখে গল্পের শেষ পর্যন্ত।
ঔরস শব্দটির ভেতরেই জড়িয়ে আছে গাম্ভীর্য বা পিতৃত্বের দায়বদ্ধতা। নারী ও পুরুষের সঙ্গম এক চিরসত্য। যতক্ষণ না এক নারী,
পুরুষের বীজ ধারণ করে নিজ গর্ভে স্থাপন করে ততক্ষণ ঔরস শব্দটি যেন এক তরল বীর্য ছাড়া কিছুই
নয়। যেন ফলের উচ্ছিষ্ট মাত্র। বহমানতা যার ধর্ম। যার ভেতর কোন দায়িত্ব কর্তব্য
কিংবা অনিষিক্ত পিতৃহৃদয় লুকিয়ে নেই। নেই পূর্ণতা পাওয়ায় তীব্র ইচ্ছা। গল্পের
কেন্দ্রীয় চরিত্র চয়ন বসু, জীবনে স্থিতিশীলতা পেলেও সে তার
পিতার ছায়া থেকে মনে মনে কোনদিনই যেন মুক্তি পায়নি। একসময়ে এক ব্যবসায়ী চপল বসুর
পুত্র সে৷ নানান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এক দুর্ঘটনায় হঠাৎই তাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে
আসে। ব্যবসার চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। চপল বসুর একমাত্র মেয়ে তুলি মারা যায়। দিন দিন
চূড়ান্ত দুর্ব্যবহারের ফলে প্রায় অমানুষ চপলবসুকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় তার স্ত্রী ও
ছেলে।
পরবর্তীতে সরকারি চাকরি পেয়ে স্থায়িত্ব পেলেও নিজের অতীত চয়ন বসুকে
তাড়া করে বেড়িয়েছে নানা সময়ে। যখনই কোন অসহায় মহিলার ওপর অন্যায় হতে দেখত, তার মন কেঁদে উঠত। স্থির থাকতে পারত না কিছুতেই
প্রতিবাদ না করে। মনে পড়ে যেত তার মায়ের প্রতি তার বাবার কটূক্তি ও অত্যাচার।
মায়ের কঠোর জীবনসংগ্রাম।
তাই তো তার স্ত্রী ঝুমার গায়ে হাত তুলতেও সে দ্বিধান্বিত হয়নি যখন এক
বৃদ্ধাকে ঠিকঠাক রুটি না করতে পারার জন্য ঝুমা কটু কথা শোনাচ্ছিল। অথচ সেই ঝুমাকে
কেন্দ্র করেই ছিল তার পৃথিবী।
চয়নের একমাত্র সন্তান কুটুস পৃথিবীতে আসার পর চয়ন বুঝতে পারে ঔরসের
আসল অর্থ। না চাইতেও নিজের পিতার সাথে ছেলের অলৌকিক মিল তার চোখে না পড়লেও তার মা
তাকে বারবার মনে করান সেই বীজের কথা, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এই অধ্যায়।
জীবনের চাপনউতোরে তাকে বারবার সেই আয়নারই মুখোমুখি হতে হয়, যাকে সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে বারবার। যাকে সে ঘৃণা
করেছে মনপ্রাণ দিয়ে।
সরকারী চাকরী থাকা সত্ত্বেও জীবনপথে থামতে হয়েছে তাকে। বেসরকারী
চাকরি থেকে ব্যবসা, যা তার
রক্তসূত্রে যেন গেঁথে আছে তারই সাথে। বারবার নিজের উৎসের মুখোমুখি হওয়ার ভীতি থেকে
সে অকারণে শাসন করেছে তার ছেলে কুটুসকে। অথচ তারই অজান্তে এক অমোঘ সত্য উচ্চারিত
হয়েছে কোন এক সময়। কিছু তো মূল্যবান সময় সেও কাটিয়েছিল কোনদিন তার একসময়ের
দায়িত্বশীল পিতার কাছে৷ তবুও সময়ের কাছে মানুষ কি নিদারুন অসহায়। জীবনের খারাপ
অভিজ্ঞতা কিভাবে
তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে তার বাবার সেই সব গুণ। জীবনের লড়াইটা নিজের মা'কে সাক্ষী রেখে চালিয়ে গেছে চয়ন বসু। পরবর্তীতে ঝুমা তার স্ত্রী, জীবনে তাকে মানসিকভাবে নির্ভরশীলতা দিয়েছে।
বন্ধুর ছেলের মৃত্যু তাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল একেবারে। চয়নের ভেতর একদিকে
যেমন তীব্র হচ্ছিল দ্বিতীয়বার সন্তানের বাবা হওয়ার ইচ্ছা তেমনই তার প্রতি কুটুসের
সমস্ত ভয় কাটানোর চেষ্টাও সে করছিল প্রাণপাত করে। সে ভীষণভাবে চেয়েছিল এক
কন্যাসন্তান । হয়ত নিজের বোনকে ছোট বয়সে মনকষ্ট নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে
দেখেছিল বলে কন্যাসন্তানের ওপর তার একটা টান বরাবর ছিলই। এবং তাতে অনুঘটকের কাজ
করেছিল বন্ধু অভিষেকের আকস্মিক জেল হাজত। স্ত্রীকে খুনের অভিযোগে তাকে পুলিশ
হেফাজতে নিলে, তার জারজ
সন্তান নিশার প্রতি স্নেহের বশেই চয়ন দুর্বল হয়ে পড়ে। তারা অনাথ আশ্রম থেকে শেষমেশ
কন্যা দত্তক নেয়। নাম রাখে হিয়া। ততদিনে কুটুসেরও বন্ধু হয়ে ওঠে চয়ন, তার মন জয় করে। তাকে দেখে কুটুস আর আড়ষ্ট হয়ে থাকে না। তার বাবা ডাকের
ভেতর যে স্বর্গসুখ চয়ন আবিষ্কার করত তা মায়ের নাড়ির টানের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
হিয়া ও কুটুসকে নিয়ে ভরে ওঠে তাদের জীবন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। বিপর্যয়
নেমে আসে সেখানেও। দুর্ঘটনায় হিয়ার মৃত্যুর পর ভেঙে পড়ে চয়ন। তার শরীরেও বাসা
বাঁধে নানান রোগ। ব্যবসা বেচে দিতে হয় দুই বন্ধুর কাছে। তবুও তারা নতুন করে বাঁচতে
শেখে। কুটুস ও ঝুমাকে নিয়ে চয়নের পথচলা শুরু হয়। শুরু হয় ঔরসের সন্ধান। রাস্তায়
হকারি করতে বসা, বৃদ্ধ পিতাকে সে নিয়ে আসে নিজের কাছে। একটি
মধুর ডাকে যেন সব ধুলো ঝরে পড়ে। আয়না কথা বলে ওঠে, চয়ন ও
চপলের পারস্পরিক চোখে চোখে।
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস মানের জীবনের টানাপোড়েন। বহমানতাকে
সঙ্গে নিয়ে চলতে থাকা জীবন পথে 'ঔরস' এক অনবদ্য সৃষ্টি। সঙ্গম শুধু নারী পুরুষের
মিলনেই শেষ হয় না, কোথাও নিজেকে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা মানুষ
করতে থাকে নিজের অজান্তেই। এটাই বোধহয় সৃষ্টির মূলকথা। আর সম্পর্ককে অস্বীকার করে
বেঁচে থাকা অসম্ভব। শেষমেশ ঘৃণাকে ছাপিয়ে যায় ভালোবাসা। আর ছাপিয়ে যায় বলেই পিতা
বেঁচে থাকেন আজীবন তার সন্তানেরই ভেতর।