সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

ঋভু চট্টোপাধ্যায়




  সাইকেল   


            

ঘরে ঢুকতেই মালতির ছোট মুখটার দিকে কানাইএর চোখ গেল।কানাই তখন বাটিতে মুড়ি নিয়ে বসে ছিল।  মালতি সঙ্গে আনা কাপড়ের থলিটা থেকে একটা টিফিন কৌটো বের করতেই কানাই জিজ্ঞেস করল,‘খাবার দিয়েছে? ভাত না অন্য কিছু?’ 
অন্য কিছু আর কি দেবে? ভাত তরকারি ডাল।এখন খাবে?
-না, দুপুরের দিকে এক জায়গায় খিচুড়ি খেলাম।সবাইকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছিল। 
কিছু ক্ষণ চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করল,‘ওরা কিছু বলল?’ একটা বড় শ্বাস ছাড়ল মালতি।না, কিচ্ছু না।
-তুমি তাহলে ভালো করে বলতে পারো নি। 
মাথাটা গরম হয়ে গেল।মানে! কেমন ভাবে বলতে হবে? তুমি কাল আমার সাথে গিয়ে ওদের পা ধরে বলবে। যেভাবে বলা যায় সব ভাবেই বলেছি।  
কানাই আর কোন  উত্তর না দিয়ে মুড়ির বাটিটা থেকে মুড়িগুলো কৌটতে আবার ঢেলে রাখতে যেতেই মালতি   চিৎকার করে উঠল,‘ও কি করছ, খাওয়া মুড়িগুলো আবার ঢেলে দিচ্ছো?’ 
খাবো তো তুমি আর আমি, এগুলো ফেলে দেবো?এই দুর্দিনের বাজারে একটা ভাত বা মুড়ির দানা মানে এক ফোঁটা রক্ত।আজ একজন এক প্যাকেট মুড়ি দিল, কিন্তু কতদিন এরকম ভাবে মুখে মুখে ভাত মুড়ি তুলে দেবে বলো তো? তার থেকে খেতে না পারলে রেখে দেওয়াই ভালো।এখন আর খাওয়া আধ খাওয়ার কথা ভাবলে চলে না।
মালতি আর কিছু না বলে পিছনের দিকে হাত পা ধুতে গেল কানাই  সেই সময় বাইরে যেতেই মালতি চিৎকার করে ওঠে,‘বাইরে বেরোবে না, এই মাত্র পুলিশের ভ্যান দেখলাম। 
কানাই কোন উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে যায়।মালতির নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। মানুষটা তো কোন দিন কারোর কাছে কিছু চায় না।এমনকি বিয়ের সময় বাবার কাছেও কিছু চায় নি বাবা জোর করে একটা সাইকেল দিল সেটাই যা কপাল খারাপ কয়েকমাসের মধ্যেই সাইকেলটা কিভাবে চুরি হয়ে গেলব্যবসাটাও বদল করতে হল সাইকেলটা থাকবার সময় দিনের বেলা কোন দিনই ঘরে ভাত খেত নাসারাটা দিন সাইকেল চেপে বিভিন্ন জায়গায় জামা কাপড় বিক্রি করে বেড়াত।সাইকেলটা চুরি হয়ে যাবার পর কিছুদিন বাধ্য হয়ে বসে থাকতে হল। তখনই মালতিকে কয়েকটা বাড়িতে রান্নার কাজ নিতে হলতারপরে কানাই সব্জি বিক্রি করতে আরম্ভ করলেও মালতি আর রান্না ছাড়তে পারে নি, অবশ্য বলা ভালো মালতিকে কেউ ছাড়ায় নি। অবশ্য এতে কানাই রাজি নয়প্রতি রাতে শোওয়ার পরেই বলে,‘আমাদের একটা বাচ্চা হলে আর কিন্তু কাজে যাবে না। 
প্রতিবারই মালতি হ্যাঁ বলে অন্ধকারে ডুব দিত। কোন দিন আবার কানাই এর মুখে তার স্বপ্নের কথা শুনত। কানাই আরেকটা সাইকেল কেনার কথা বলত, আবার আগের ব্যাবসা আরম্ভ করবার কথাও বলত, মালতি সেই স্বপ্নটা দেখার আগেই হঠাৎ করে কি যে নেমে এলো কেউ কোন কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না।সব সাইকেলের দোকানও বন্ধ।সবাইকে বলেও রেখেছে।মালতি যে বাড়িগুলোতে রান্না করতে যায় সেখানেও সাইকেলের কথা বলেছে।কিন্তু কেউ দিতে চায় না। ঘরে সাইকেল পড়ে পড়ে নষ্ট হবে তাও কেউ দেবে না।সব ব্যাটা খুব বদমাস।
মালতি হাত পা ধুয়ে ঘরের ভিতর এসে সব খাবারগুলো এক এক করে আলাদা করে রাখতে যাবে এমন সময় পাশের ঘরের রমা এসে বলল,‘ও মালতি দি, পার্টি অফিস থেকে আজকেও চাল দিচ্ছে, তুমি আনতে যাওনি?’ মালতি একটু অবাক হয়েই উত্তর দিল,‘আমি তো এই এলাম, জানিনা, কি কি দিচ্ছে কিছু জানিস?’ 
চাল, পাঁচশ ডাল, একটা তেলের বোতল একটা একটা বিস্কুটের প্যাকেট দিচ্ছেআর উল্টোদিকে ক্লাবটা থেকে একটা ছোট পেলাস্টিকের বোতলে কি স্যানিটাইজার না কি দিচ্ছেসঙ্গে দুটো করে সাবান আর দুটো মুখে বাঁধার সেই ফেটিগুলো।সবাইকে কিন্তু মুখে ঐ ফেটি বেঁধে যেতে হবে, না হলে কিন্তু কিচ্ছু দেবে না বলছে।
-তোর সব আনা হয়ে গেছে?
-সেই দুপুর থেকে দিচ্ছে, আমি দুপুরেই সব নিয়ে নিয়েছি। আমি তোমাকে ডাকতেও এসেছিলাম, কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। 
মালতি আর কথা না বাড়িয়ে নিজেই একটা বড় ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরোতে যাবে এমন সময় একটা কথা মনে পড়ে গেল।রুমার দিকে তাকিয়ে বললহ্যাঁরে তোকে যে সাইকেলের কথা বলে ছিলাম, খেয়াল আছে?’ 
পাচ্ছি না গো,আমি দুটো বাড়িতে বললাম।ওদের সাইকেলগুলো পড়েই থাকে, তাও দেবে না। 
-আমিও তো বলে বলে হয়রান হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই একটা সাইকেল দেবে না।বুড়ো বুড়ি খুব বদমাস।আমি ওদের কত মায়া করি,এই অবস্থাতেও একটা দিনের জন্যেও কাজ কামাই করিনি, ওরা কিন্তু ভাবে না।
-ব্যাগটা দিলে কানাইদা এনে দিতে পারত, গেল কোথায় ? 
-কোথায় গেছিল জানি না, এসে দেখলাম মুড়ি চিবোচ্ছে, তারপর তো কোথায় বেরিয়ে গেল। 
মানুষটাই বা কি করবে? দিব্যি প্রতিদিন হাট থেকে সব্জি কিনে বাসে চাপিয়ে শহরের বাজারে বিক্রি করছিল মোটামুটি ভালোই কামচ্ছিল।বছর দুইএর বিয়ের পরেও অবশ্য এখনো কোনো বাচ্চা না হলেও আপাতত দুজনে বেশ ভালোই ছিল
মালতি ব্যাগটা নিয়ে পার্টি অফিসের কাছে যেতেই একজন বলে উঠল, ‘হ্যাঁরে, তুই নাকি বাবুপাড়ায় এখনও কাজে যাচ্ছিস?’ 
মালতি প্রথমে একটু থতমত খেলেও  উত্তর দিল,‘কি করব সবাই যে বুড়ো বুড়ি, আমি না গেলে কি খাবে বল?’ 
কিন্তু ওপাড়াতেই তো শুনলাম কয়েকজন বাইরে থেকে এসেছেতাদের শরীরে কোন রোগ আছে কিনা কি করে জানবি ?
-তাতে আমি কি করব বল? টাকাও তো চাই।  
সঙ্গে যাওয়া রমাও কোন কথা বলে না, শুধু শুনে যায়।
-আমরা তো সব দিচ্ছি তাতে তোদের চলছে না? কি অত খাস, ঘরে তো বাচ্চা কাচ্চাও নাই
কথাগুলো মাথায় ভিতর বাজের মত লাগলেও খুব শান্ত ভাবেই উত্তর দেয়,‘নিজেরা তো আছি টাকা না পেলে কাঁচা চাল চিবিয়ে খাবো, রান্না করতে হবে না?’ 
রাতে এখানে রান্না করে খাওয়াচ্ছি, চলে আসবে, এখানেই খাবে। 
-আর সকালটা!তার জন্যেও তো টাকা চাই।
ক্লাবের ছেলেগুলো আর কিছু না বললেও মালতি চাল নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তাদের দিকে তাকিয়ে বলে,       আমার লোকটাকে একটা সাইকেলের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে? বলছিল এদিক ওদিক সাইকেলে চাপিয়ে সব্জি বিক্রি করতে পারবে। 
সব্জি বিক্রি! হেঁটে হেঁটেই করতে বলো। 
-একদিন বেরিয়ে ছিল।এখানে অনেকেই বিক্রি করছে, তারাই বারণ করে অন্য জায়গায় যেতে বলে 
-সাইকেল কোথায়, আমাদের কারোর সাইকেল নেই।একটা বাইক আছে, চালাতে পারলে নিতে বলবেদিনে দুশ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
এখানে সবাই মজা পেয়েছে। পেটের ক্ষিধেটা যেমন মজা নয়, তেমনি হাতের টাকা পয়সাগুলোও মজা নয়
 মালতি কাউকে কোন উত্তর না দিয়েই ঘরের দিকে পা বাড়ায় 
                                             

সন্ধে ছাড়িয়ে অন্ধকার এখন রাতের দরজায়।কিন্তু মানুষটা গেল কোথায়? আবার আগের মত নেশা করতে চলে গেল না তো? মালতি মাঝে বেশ কয়েকবার বাইরে বেরিয়ে দেখেছে। আস্তে আস্তে চারদিকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। আশে পাশের ঘরের সবাই ক্লাবে খেতে গেছে। কয়েক জনের মুখে শুনল বেশ ভালো খাওয়াচ্ছে।মালতির ওরকম ভাবে খেতে ভালে লাগে না। বাবার ছোট একটা দোকান ছিল, কিন্তু কোন দিন কারোর কাছে চেয়ে চিন্তে কিছু নিতে বা খেতে একদম পছন্দ করত না।মালতি এখনও সেটাই মেনে চললেও জানে না কত দিন সব কিছু করতে পারবে?এদিকে রাতের অন্ধকার বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে মালতির মনের অন্ধকারও আরো বেড়ে ওঠেমানুষটা সত্যি সত্যিই কোথাও পালিয়ে গেল না তো? মাথার ভিতর দুঃশ্চিন্তা হাতুড়ি মারতে আরম্ভ করেছেচাল আনতে যাবার রাস্তায় রমা বলল,‘কোথায় যেন একজন এই অবস্থায় ছেলে বউয়ের খাবার জোগাড় করতে না পেরে নিমগাছে গলায় দড়ি দিয়ে দিয়েছকিন্তু মালতি তো মানুষটার কাছে কোনদিন কিছু খোঁজে নি।এমনকি ওর সাইকেলটা চুরি হয়ে যাওয়ার পরেও বাবাকে যেমন আরেকটা সাইকেলের জন্য বলেনি তেমনি কোনদিন কানাইকেও  রোজগারের জন্যেও কিছু চাপ দেয় নি।কানাই যেভাবে যতটুকু পেরেছে এনে দিয়েছে, সেটাতেই সুখি থাকবার চেষ্টা করেছে মালতি। তারপরে নিজে রান্নার কাজ আরম্ভ করেছে। বিকালে ঐ কথাগুলো কি বলা ঠিক হয় নি? 
চিন্তায় মালতির হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করে। কিছু সময় পরেই অবশ্য প্রায় হন্ত দন্ত হয়ে কানাই ঘরে আসে। মালতি সেইমাত্র রাস্তা থেকে ঘরে ঢুকে রাতের খাবার গরম করবার জন্যে স্টোভটা জ্বালাতে যাচ্ছিল। কানাই ঘরে এসেই এদিক ওদিক তাকিয়ে মালতিকে বলে,‘চাল হবে?’ 
অবাক হয়ে যায় মালতি।চাল! কি হবে?’ 
দরকার, খুব দরকার। তিন চার কিলো হলেই হবে। 
মালতির তখন চৌকির নিচে থাকা সেদিনেই ক্লাব থেকে আনা চালের থলির দিকে চোখ যায়।পাঁচ কিলো চাল আছে।কানাই জানে না।মালতি একটু গম্ভীর ভাবে উত্তর দেয়,‘না, চাল নেই। খাবার গরম হচ্ছে, খেয়ে নাও। 
একটু পরে খাচ্ছি।বলেই কানাই ঘরের এদিকে ওদিক  হাঁটকাতে আরম্ভ করে।রেগে ওঠে মালতি, কানাইকে কিরকম যেন সন্দেহ হয়কাছে যেতেই মুখে মদের গন্ধ আসেআরো রেগে উঠে বলে,‘আবার মদ গিলেছো? তোমাকে না বারণ করেছি, এমন কি ডাক্তার বাবুও বারণ করেছেন 
একদম অল্প, বিশ্বাস কর, একজনকে খাওয়াতে হল, তাই একটু খেলাম
মালতির কথাগুলো বিশ্বাস হল নাবেশ কড়া ভাবেই উত্তর দিল,‘আমাকে কি বোকা পেয়েছ ? তুমি সত্যি করে বলতো চাল নিয়ে কি করবে? কারোর থেকে টাকা ধার করেছ?’ 
একটা সাইকেল পেয়েছি 
-সাইকেল! কোথা থেকে? 
ঐ কথাটাই বলছি।পাশের কোন এক পাড়া থেকে একটা মাতাল মদের দোকানের খোঁজে এসেছিল।তাকে মদ খাওয়ালাম।তাই আমিও একটু খেলাম।ব্যাটার এমন নেশা চাল কেনার টাকাতে মদ খেয়ে নিল।এখন বাড়িতে চাল না নিয়ে গেলে খেতে পাবে না।সেই আমাকে বলছে ওর সাইকেলটা রেখে কিছু চাল দিত।শেষের কথাগুলো বলেই  কানাই হেসে উঠল।তারপর এদিক ওদিক দেখে তক্তার নিচে থলিটাতে চাল দেখতে পেয়ে বের করে এনে মালতির দিকে তাকিয়ে বলে,‘এই তো চাল, কত আছে কিলো তিন হবে? এটাই দিয়ে দি কি বল।তারপরে নিজেই বলে গেল,‘কাল থেকেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। রতনদার সাথে সকালে কথা বলে নেব।এক এক দিন এক এক জায়গায়। 
মালতির কথাগুলো শুনে ভালো লাগে না।আহা রে লোকটার বাড়িতে কে কে আছে কে জানে।বেচারারা চালের জন্য বসে আছে। আর লোকটাও অদ্ভুত তো চালের টাকাতে মদ খেয়ে নিল! কানাই এর মাঝেই চালের থলিটা বাইরে বের করতে যাবে এমন সময় মালতি বলে ওঠে,‘শোনো, চাল দিচ্ছ দাও, কিন্তু ঐ সাইকেল নিতে হবে না। 
কেন! চমকে ওঠে কানাই। 
-কি করে বলছ তুমি, একটা বদ লোক চালের টাকায় মদ গেলে, তুমি তার সুযোগে সাইকল নেবে? আমি কালই  ওদের সবার কাছে কিছু টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা করব। কিন্তু তুমি কোন অবস্থাতেই কাউকে ঠকিও না। তবে চালটা তুমি দিয়ে দাও।ওনার পরিবারেও...... 
কানাই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, বাইরে সেই সময় সাইকেলের বেলটা বেজে উঠল, ‘ক্রিং ক্রিং।


ঋভু চট্টোপাধ্যায়