সবার ছোটবেলাই শুরু হয় আকাশ এবং নক্ষত্রের যৌথসুরে। গানআঁকা সঙ্গীতের
পঞ্চম দেয়ালা। এসোজন বসোজন আর প্রিয়জনের সাঁতার ঘেরা। ডানা ফোটে চোখের। পলকগুলি
ধীরে ধীরে মেলতে শুরু করে পাখিদের আবাস। আমরা চিনে নিতে শিখে যাই মা-মুখ বাবা-হাসি
দাদু- লাঠি আর ঠাকুমার ছড়াগল্প। এক্কাদোক্কার স্নেহখড়ি। প্রথম অ আ, প্রথম বানার-ভুলের ব্যাকরণ। কুমোরপাড়া গরুর গাড়ি,
ছন্দের বউবসন্তী, হাতছানির লুকোচুরি। সবকিছুই
কেমন নতুন রঙে সাজানো। যেন আশ্চর্য-দেবতার অবাক-গন্ধর্ব জগত।
রূপে-স্বরূপে খোদাই ছয়টি ঋতু আর মেঘবজ্র বিদ্যুতের দেদার বৃষ্টিনৌকো। এইরকমই ছিল আমার শুরুবেলা, মেয়েবেলাটি। প্রথম তুলাইপাঞ্জি চালের মতোই সুগন্ধ
জড়ানো দিন যাপন। মা-বাবা দুজনেই বেরিয়ে যেতেন চাকুরিতে, আমি
দাদু-আম্মার কাছেই প্রথম চিনতে শিখে যাই হলুদগাঁদা, বেগুনী
অপরাজিতা, কমলা কলাবতীফুলের গঠন-সৌকর্য। আম্মার হাতের
খুশবুদার আচার জিভে নিয়ে আসে প্রথম স্বাদের মিঠেবাহার।
দাদুই আমার প্রথম হাতেখড়ি। হাল্কা সাদা আর তুমুল সবুজের ভিত। প্রথম
দোলনা। নামতার মিঠেবোল, দাদুই
আমার প্রধান দীক্ষার অধিক বল্কল। দাদু আমাকে চোখে হারাতেন। আমি দাদুকে, পলকের
পালকে। ভর্তি হলাম শিশুস্কুলে। দাদুর হাত ধরেই প্রথম স্কুলে যাওয়া, স্কুলে না যাওয়ার জন্যে প্রথম কান্নাটিও দাদুর চোখ দিয়েই। যতক্ষণ আমি
স্কুলে ততোক্ষণ দাদু স্কুলের বাইরে বসে থাকতেন। এখন ভাবি , কী
জ্বালাতনটাই না করেছি দাদুকে ...
এইভাবে ঠিক এইভাবে ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যায় শিশুকাল। আমার গা থেকে মুছে
যায় কাঁকন রাজকুমার শঙ্খ রাজকুমারের গল্পআঁকা শিশুকাহিনীর অবনরাজ-আলোফুল্কি।
রাক্ষস খোক্কসের সেনাকাহিনীও নিভে যায়। বড় হতে শুরু করি ... হাল্কা
হতে শুরু করে জল্পাই-কুল আর তেঁতুল আচারের সৌরভ। ভারি হতে শুরু করে বুক। একদিন
শুরু হয় বোঁটা ফোটার কাহিনী। ব্যথা করে খুব। দাদুর হাত ছেড়ে ছুটে যাই মায়ের কাছে।
হয়, হয় এরকম হয়। সব্বার হয়, বড় হচ্ছ যে এখন ...
আমি উত্তরে মোটেও সন্তুষ্ট হইনা। বরং কাতর হই বুকব্যথায়। বুক? নাকি আমার মন-ই ব্যথা-ব্যথা করে কেবল? এখন ভাবলে খুব অবাক লাগে এইব্যথাগুলি মোছার জন্যে কিন্তু দাদুর কাছে যাই
না, তখন মায়ের কাছেই আশ্রয় পেতে চাই ...
স্নান করি যখন নিজের কাছে নিজের শরীরের প্রাকারটি অচেনা ঠেকে। আমার
দেওয়ালগুলি এমন পাল্টে যাচ্ছে কি করে? দুমড়ে মুচড়ে উঁচু উঁচু হচ্ছে কি কোরে ? আমি অবাক হয়ে
তাকাই ... নিজেকে চিনতে পারি না ...একটু একটু করে যেন হাজার সমুদ্রিক ঢেউ জড়ো
হচ্ছে বুকের চারদিকে, ছলছল করা মার শরীরে এখন এতোবড়
বিস্তীর্ণ জলরাশি, এইসব সাঁতার সাম্লাই কেমন করে ...
নিজেকে ভয় পেতে শুরু করি ... নিজের শরীরকে খুব ভয় করে ... আমি যেন
কেমন পাল্টে জাছছি। ইস্কুলে দেখছি আমার বন্ধুদেরও সব এক অবস্থা ...
মা ফ্রক বানিয়ে দ্যান। বুকের কাছে ফ্রিল দেওয়া। কুঁচি কুঁচি
বেগমবাহার দিয়ে প্রজাপতির সৌন্দর্যকে আড়াল রাখার সে এক ব্যর্থ চেষ্টা। মোমবাতি
দিয়ে মহাসাগরকে নিভিয়ে দেওা কি সম্ভব? পাহাড়ের অপরিমিত জ্যামিতি কি মুছে দেওয়া সম্ভব ওড়নার কম্পাস বুলিয়ে?
সম্ভব নয়। অতএব মাথা উঁচু করে বুক। সানরাইজের নক্সায় শোভিত হয় তুমুল
সানশাইন। টেপফ্রকে আর আটকে রাখা সম্ভব হয় না দ্যুতিময় হাইটাইডের জোয়ার।
ব্রেসিয়ারের গদ্যশৈলী দিয়ে বেঁধে রাখা হয় অপার কবিতার কাব্যসমগ্র। ভাবি, বড় হয়ে গেছি বেশ। জেনে গেছি সব। মা-মাসিদের মতোই বলা
যায়। কিন্তু আসলে তা নয়। আরও বড় হওয়া বাকি ...
ইস্কুলে বন্ধুদের মধ্যে ফিস্ফিস, অনেকগুলি চুপিচুপি। অনেকের শরীর ঘিরে আরও যেন কি কি ... অনেক অনেক রহস্যের
নেশা বুঝি এই শরীর ... বন্ধুরা বলে, কিরে তোর হয়েছে? আমি বলি, কি হবে? আর কি কি হবে
... তারা হেসে গড়ায় ... এখনো বড় হোসনি তুই?
আর কতো বড়ো হবে, বুঝে উঠতে পারি না। মাকে প্রশ্ন করি, আর কি কি হলে
আমি বড় হবো মা? পাপিয়া কুহেলী অনিন্দিতা ... ওরা যে সবাই বড়
হয়ে গিয়েছে ... আমি কবে, কবে?
মা ততোক্ষণে কাছে টেনে নিয়েছে আমাকে, শোন ... মেয়েদের প্রতিমাসে পাঁচদিন ধরে রক্ত বের হয়
... আমি আঁতকে উঠি ... কোথা দিয়ে মা? কোথা থেকে হয়?
...
মা ফিসফিস করে ওঠেন, হিসুর জায়গা দিয়ে ... তুমি কিন্তু ভয় পাবে না ... যখনই দেখবে প্যানটিতে
রক্ত, কাউকে বলবে না ... সোজা আমার কাছে আসবে ... আমি সব
শিখিয়ে দেব ...
আমি ততক্ষণে একটু ঘাবড়ে গিয়েছি ... পাঁচদিন ধরে শুধু রক্তই পড়বে
হিসুর জায়গা দিয়ে? তাহলে
হিসু কোথা দিয়ে পড়বে? মা যেন একটু বিরক্ত। অতসব তোমাকে জানতে
হবে না ... আমার হয় আম্মার হয় কুট্টির হয় ... তোমার স্কুল ক্লাস সমস্ত মেয়েদেরই হয়
...
মা রান্নাঘরে চলে গেলেন ... আমি মাঝে মাঝেই বাথরুমে যায় আর চেক করি
... রক্তের তো ছিটেফোঁটাও নেই ... আমি বড় হছছিনা কেন রে বাবা ...
ইতিমধ্যে স্কুলে অনেকেরই হয়ে গেছে। তবে আমার মতো দুর্ভাগাও আছে কেউ
কেউ। যারা সৌভাগ্যবান তারা এসে আমাদের কাছে নানারকম গল্প করে ... কার অইসময় পেটে
ব্যথা, কারোর আবার কোমর। কেউ সারাদিন
গা-বমি , কেউ আবার অই পাঁচদিন বিছানা থেকেই উঠতে পারে না ...
আমি ভাবতে শুরু করি... আমার কি কি হতে পারে? ব্যাথা কতদূর, স্কুলে আস্তে
পারবো কি নাকি গল্পের বই মুখে সারাদিন বিছানায় থাকতে হবে নাকি ... এরমধ্যে একদিন
ঋতুপর্ণা স্কুলে আসা বন্ধ করে দিল ... আট দিন বাদে সে যখন আবার এলো, তার মুখে অনেকখানি আলো ... টিফিনটাইমে ফিসফিস করে বলল, আমারও হয়ে গেছে রে রত্নদীপা ... কী ব্যথা রে ...
ব্যথা? আমি
স্পষ্ট দেখলাম তার মুখে আলাদা একটা জ্যোতি... অন্যরকম রঙের একটা ঘূর্ণি ঘোরাফেরা
করছে তার চমৎকার চিবুকে ... ...হোক না কেন একই ক্লাস, সে এখন
আলাদা একটা শ্রেণী ... তার পিরিয়ড শুরু হয়ে গিয়েছে, আমার
হয়নি। নিজের শরীরের ওপর নিজেরই খুব রাগ হল ... এ আমি কেমন আমি ... বড়ই হছছিনা ...
আসলে আমার বয়েস হয়েছিল দেরী করে...
যখন সমস্ত আশা হারিয়ে ফেলেছি ... সেই রকম একদিন বাদলাদিন। হঠাৎ করেই এলো সেই
সুবর্ণধ্বনি ... দু দিন ধরে গা-ব্যথা আর বমি-বমি ... সন্ধ্যেবেলা বাথরুমে গিয়ে
শুনি কলকল শব্দের নিনাদ ... ধ্বনিময় শরীর আমার, এই প্রথম জাগছে। অবিশ্রান্ত খোদাইয়ের পর রক্তভূমে বেজে উঠছে বোশেখির
মিড়...
রক্ত। লাল নয় শুধু। অদ্ভুত কালো আর খয়েরির মিশেল। তরল নয়। সামান্য দানাদার। চাকামতো
আগুন। ঝিনুকের ঢাকনা খুলে বেরিয়ে আসা আদি-মৃৎপাত্র।আমি রক্তগমকে লীন, নিজেকে পূর্ণ লাগে। আর কিশোরী নই। নারী ... আমিই
সেরাসৃষ্টি। আমার শরীর ধাতুময় ব্রোঞ্জঘেরা। আমার পরনে অদ্বিতীয়া রূপালী অবয়ব। আমার
দুই বুকে মণিপদ্মের চূড়া।
আকাশে সেদিন ছিল খুব বর্ষা। অনন্ত বর্ষায় সেদিন অনেক তীর। তীরের ফলায়
সীমাহীন নদীতীর। আমির রক্তে ভেসে যাচ্ছে যোনির আঙিনা ... এত রক্ত থাকে
একটি মেয়ের শরীরে।
এমন ঘন-গহন রক্তপ্রপাত ...চোখের পিদিম দিয়ে মুছি, পিদিমের চোখ দিয়ে ধুয়ে দিই দুলন্ত সিঁড়ির চাবিকাঠি
... বড় হতে চাই না আমি বড় হতে চাই না মা ...
অচিন বুটিতে ছল্কে উঠি। বুঝে উঠতে পারিনা ... নারী হওয়ার আনন্দে হেসে
উঠবো? নাকি চিৎকার করে কান্না করবো ...
হরিণশূন্য মহাকাশের রক্তফিনকি, আমার দুবলা-পাতলা মহাধমনী
ফেটে যেন, পাথরকুচির হ্রদটি ঝাঁকালেই তারারক্তের প্রস্রবণ
... রক্ত কুঁদে কুঁদে তৈরি হচ্ছে অপার ভাস্বর এক নারী-জোনাকির অফুরান ভায়োলিন...
বেলা যায়। তরুবেলাও চলে যায়। বৃক্ষবেলায় এসেও চিনতে পারি না আমার
রক্তের শঙ্খপালা বিস্তৃত কতদূর ... নদীনালা আর তোর্সাজগতের কন্দর-তরাই কতোখানি
আল্পনার আর কতোখানি অপ্সরাবৃত কল্পদিগন্তের ...
ধ্রুবতারাদের ঋতুসংখ্যা বেড়ে যায় আপনমনে। শাওন-রক্তের গোধূলি, স্তনচামেলির গন্ধটি কিছুতেই নেভে না। রক্তের সুতোয়
হালকা হালকা সূচের পাপড়ি। অচেনা গভীর ফালাফালা। রক্তদিনের পাতাগুলি পৃষ্ঠার আবডাল।
নতুন নতুন সাপ যেন সৃষ্টির উল্লাসে। ফণাদার জ্যোৎস্নার রাগ-কোটাল।
এইসব গহনা-সমস্ত বেলা কাটিয়ে, ঋতুবন্ধের প্রাক্কালে একজন কিশোরী-বলাকা। তৃপ্তি-অতৃপ্তির অলঙ্কার সমেত
কেবলি বেজে উঠছেন কাল-ঘুঙুরের ত্রিতালছন্দে।
রত্নদীপা দে ঘোষ