সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

দীপ্তেন্দু জানা



"ইন্ডিয়া" 





একেবারে সোনা মেয়ে হয়ে থাকবে ইন্ডিয়া। মোটেও দুষ্টুমি করবে না। আমি শপিং-এ যাব আর আসব। ততক্ষণ মায়ের কাছে থেকো। কেমন? কী? শপিং-এ তুমিও যাবে আমার সাথে? কি করে তোমাকে নিয়ে যাব? তুমি তো গুড গার্ল। এরকম বায়না করে? বরং আমি ফিরে এলেই তোমার সাথে ঘোড়া-ঘোড়া খেলব। কেমন? মৌসম, আমি বেরোচ্ছি। ইন্ডিয়ার খেয়াল রেখো। ইকবাল চাচা সিরাজের যাত্রাপথের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। 

   "সত্যি কথা বলতে কি, তোদের মত লোকেদের দেখলে আমার বেশ ঈর্ষা হয়।" হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সিরাজ বন্ধু জয়ন্তকে বলল।  'ঈর্ষা হয়! সে কী! কেন?' জয়ন্ত হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল। 

  --- পনের বছর। সময়টা কী কম? জীবনের আলো ঝলমলে যে সময়টায় স্ত্রী-সন্তান - পরিবারের পাশে থাকার কথা, এতগুলো বছর আমাকে কাটাতে হয়েছে বর্ডারে। নিজের পরিবার ছেড়ে। কবে কবে বাবা মারা গেল মা মারা গেল বুঝতেই পারলাম না। ওদের শেষ সময়টা খুব পাশে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মিলিটারীতে চাকরীর কারনে পারিনি। তোরা খুব লাকি রে! নিজের ভালবাসার মানুষগুলোকে ছেড়ে দূরে একা একা নিঃসঙ্গ জীবন কাটানো কী যে যন্ত্রণার বুঝবি না তোরা!

    'তা ঠিক! তোদের মত মিলিটারী ম্যানরা কাশ্মীর -পাঞ্জাবের বর্ডারে বন্দুক হাতে পাহারায় থাকে বলেই না ইন্ডিয়া শান্তিতে ঘুমোতে পারে। তোদের এই স্যাক্রিফাইস কে স্যালুট করি রে। আমারই তো তোর সাথে দেখা হলো প্রায় সাত বছর পর। তাই না, ভাগ্যিস আজ শপিংমলে এসেছিলি। নইলে তো দেখাই হতো না।'
মদের গ্লাসটা শেষ হয়ে গেছে দেখে জয়ন্ত সিরাজের গ্লাসে আরো এক পেগ হুইস্কি গড়িয়ে দিল। সিরাজের উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে বলল, 'তা তোর ছেলে মেয়ে কটি?'

    সিরাজ যেন শুনেও শুনতে পেল না কথাটা। পুরো এক পেগ হুইস্কি এক চুমুকে শেষ করে  দিয়ে পকেট থেকে লাইটার বের করে সিগারেট জ্বালাল।জয়ন্ত হুইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে খেয়াল করলো সিরাজ লাইটারটা মুখের সামনে তুলে ধরে জ্বালাচ্ছে -নেভাচ্ছে। জ্বালাচ্ছে -নেভাচ্ছে।সিরাজকে অন্যমনস্ক দেখে জয়ন্ত ফের জিজ্ঞেস করল, 'কি হল বললি না তো তোর ছেলে মেয়ে কটি?' 

     সিরাজ জ্বলন্ত লাইটারের আগুনের দিকে স্থির  দৃষ্টিতে তাকিয়েই জবাব দিল, 'আমার একটাই মেয়ে রে।"
--- কত বয়স? কী নাম?
--- সেপ্টেম্বরে পাঁচ বছর হল ইন্ডিয়ার।
--- মেয়ের নাম ইন্ডিয়া রেখেছিস।বাঃ। একেই বলে দেশপ্রেম। তা এখন খুশী তো? পাঁচ বছরের ফুটফুটে মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে চুটিয়ে সংসার কর। মিলিটারি থেকে রিটায়ার্ড করেছিস তো। 

     লাইটারটাকে এবার নিভিয়ে দিয়ে পকেটে রাখলো সিরাজ। রেখে বলল, 'জানিস স্ত্রী প্রেগন্যান্ট। ইন্ডিয়ার জন্ম হবে। ছুটি নিয়ে বাড়ি আসব সব ফাইনাল। কিন্তু শুরু হয়ে গেল কারগিল ওয়ার। ছুটি বাতিল। বাড়ী আসা হল না। মেয়ের জন্মের সময়ও স্ত্রীর কাছে থাকতে পারলাম না।' 
        'আক্ষেপ করে কী করবি বল।' বন্ধুকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখে জয়ন্ত বন্ধুকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। 'আক্ষেপ করবনা? ইন্ডিয়া কবে হামাগুড়ি দিতে শিখল, কবে টলোমলো পায়ে দাঁড়াতে শিখল, কবে আধোআধো গলায় প্রথম মা -পাপা বলতে শিখল---সব মিস করে গেছি রে।' বলতে বলতে বোতল থেকে আরও এক পেগ হুইস্কি গড়িয়ে নিল সিরাজ।

       রাত বাড়ছে।পুজোর মরশুম।তাই পানশালায় ভিড়ও বাড়ছে। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত বলল, 'নে এবার উঠি। আর হ্যাঁ, এখন তো এই শহরেই ফ্ল্যাট নিয়ে থাকি। পুজোর মাঝে মেয়ে-বউকে নিয়ে একদিন আয় আমার বাড়ী। আড্ডা দেওয়া যাবে।' 'এক্ষুনি উঠবি? আর ক'পেগ খেলে হত না?' সিরাজের কথায় জয়ন্ত বলল, 'নারে। এমনিতেই তুই অনেক ড্রিংক করেছিস।  আজ আর নয়।' 'ঠিক বলেছিস। মৌসম একা ইন্ডিয়াকে সামলাতে পারবে না। যা দস্যি হয়েছে মেয়েটা। পাপাকে দু'দণ্ড না দেখতে পেলেই বাড়ী মাথায় করবে। চল আজ উঠি।' সিরাজ টলতে  টলতে উঠে দাঁড়াল। সিরাজকে টলতে দেখে জয়ন্ত বলল,  "কীরে বাড়ী ফিরতে পারবি তো? এ অবস্থায় তোকে একা ছাড়া যাবে না। আমার  গাড়ী আছে সঙ্গে। চল তোকে তোর বাড়ীতে ড্রপ করে দিয়ে আসি। এই সুবাদে তোর মেয়ে-বৌ-এর সাথেও দেখা হয়ে যাবে। জয়ন্তর কথায় চমকে উঠল সিরাজ। মুহূর্তের মধ্যেই যেন তার হ্যাংওভার কেটে গেল। মনে মনে বলে উঠল, বাড়ীতে ছেড়ে দিয়ে আসবি? মেয়ে- বৌ -এর সাথে দেখা করবি? কিন্তু তা কি করে হয়!' সিরাজকে চিন্তিত দেখে জয়ন্ত বলল, ' কী রে? কী এত ভাবছিস?' সিরাজ পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে উঠল, 'না রে। তার আর দরকার নেই। শুধু শুধু তোকে কষ্ট দিই কেন? ও তুই চিন্তা করিস না। আমি ঠিক বাড়ী পৌঁছে যাব।'

       দরজার তালা খুলে বাড়িতে ঢুকেই সিরাজ তার স্ত্রী মৌসমকে বলল, 'কখন থেকে কলিংবেল বাজাচ্ছি। দরজা খুলতে এত দেরী করলে কেন?' তারপর নিজেই বলল, 'ও রান্না করছিলে? গ্যাসের নব ঠিকঠাক বন্ধ করে এসেছো তো? গ্যাসের সিলিন্ডার খুব ভয়ঙ্কর জিনিস! আমার এক বন্ধু জয়ন্ত, বহুদিন বাদে ওর সাথে দেখা হয়ে গেল। ফিরতে তাই এতটা রাত হল।' শপিং-এর ব্যাগগুলো সোফায় রাখতে রাখতেই বলল, 'এতে তোমার পাঁচটা শাড়ী আর ইন্ডিয়ার পাঁচটা ফ্রক  আছে। পুজোয় পরবে। আচ্ছা, ইন্ডিয়া কোথায়? দেখছিনা? ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?' তারপর তড়িঘড়ি ইন্ডিয়াকে ডাকতে ডাকতে তার স্টাডি রুমে ঢুকল সিরাজ।

       'ও তুমি ড্রয়িং করছ? দেখি। দেখি কি ড্রয়িং করেছ?' মেয়ের ড্রয়িং খাতাটা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে  সিরাজ বলল, 'বাঃ। মা-পাপা আর তোমার ছবি এঁকেছ? খুব সুন্দর হয়েছে সোনা।'
 'আচ্ছা।, আজ আর ড্রয়িং নয়। তোমার জন্য কী সুন্দর সব ফ্রক এনেছি দেখবে?' কথাটা বলেই মেয়ের ফ্রকের ব্যাগ থেকে একে একে জামা গুলো বের করে মেয়েকে দেখাতে লাগল। 

        রাতের খাবার শেষ। সিরাজ শোবার ঘরে এসে মৌসমের পাশে শুয়ে পড়ল। মৌসুমের ঘুমন্ত হাতটা নিজের হাতে নিল। মনে মনে বলল, ঘুমিয়ে পড়েছো মৌসম?' স্ত্রীকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে হলনা তার। স্ত্রীর হাতটা ঠান্ডা দেখে স্ত্রীর গায়ে সে সাদা বিছানার চাদরটা টেনে দিল। কিন্তু ঘুম আসছে না সিরাজের। ইন্ডিয়াও পাশের রুমে শুয়ে আছে। প্রতিদিনের মত সিরাজ টেবিলের ড্রয়ার থেকে চিঠির গোছাগুলো বের করল। চিঠিগুলো মৌসুম লিখেছিল সিরাজ যখন কাশ্মীরে পোস্টেড ছিল। সব আজ স্মৃতি। একে একে চিঠিগুলো পড়তে শুরু করল সিরাজ..... 


প্রিয় সিরাজ, 


          উনিশ দিন আট ঘন্টা একুশ মিনিট আমাদের বিয়ে হয়েছে। তারই মধ্যে তুমি ডিউটির তাগিদে আমাকে একা রেখে চলে গ্যাছ। এই অল্প কয়েক দিনেই তুমি আমায় এত ভালোবাসা দিয়েছ যে তোমাকে এক মুহূর্তও ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারছি না। কোন কাজে মন দিতে পারি না। সব ভুল হয়ে যায়। এমন যাদু-টোনা করে গ্যাছ! সেদিন তো রান্নার সময় প্রেসার কুকারে চাল দিতে ভুলে গেছি। সিটি বাজতেই কুকার খুলে দেখি ভাত নেই। টগবগ করে জল ফুটছে। এ কথা শুনে তুমি নিশ্চয়ই খুব হাসছো? বিশ্বাস করো এখন তোমার লম্বা শরীর, চওড়া কাঁধ, ছোট চুল, উজ্জ্বল মুখ আর ধারালো নাক ছাড়া আমি কিছুই দেখতে পাই না। যেন অন্ধ হয়ে গেছি। রাত্রেও আমার ঘুম আসে না। কখনো বিয়ের অ্যালবাম খুলে বসে থাকি। কখনো তোমার  গায়ের গন্ধ লেগে থাকা শার্ট পরে শুয়ে পড়ি। আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমারও কি কষ্ট হয়? আমি তো প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠি এই ভেবে যে তোমাকে দেখতে পাব। কিন্তু উঠে দেখি তুমি নেই। জানো সেদিন স্বপ্নেও তোমাকে দেখলাম। আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছো। আর বলছ -চাকরিটা করতে আর ভালো লাগছে না মৌসম। মনে হয় এইভাবে অনন্তকাল তোমাকে ছুঁয়ে থাকি। সময় পেলেই আবার চিঠি লিখব। ভালো থেকো। কেমন? তোমার অপেক্ষায় রইলাম। 
        
                                           ইতি 
                                       তোমার মৌসম 

পড়া শেষ করে চিঠিটার শরীরে হাত বোলাতে লাগল সিরাজ। প্রতিটা অক্ষর যেন অক্ষর নয় মৌসমের আত্মা। চিঠিটা তারপর খামে ভরে রেখে আবার একটা চিঠিতে চোখ রাখল।


প্রিয় সিরাজ, 
                 আজ আমি পার্লারে গিয়েছিলাম। ম্যানিকিওর,পেডিকিওর, সাথে ভ্রু-প্লাকও করিয়েছি। এই দ্যাখো হাতে পায়ে নেলপলিশ পরেছি। মিষ্টি লাল। যে রংটা তুমি পছন্দ কর খুব। তুমি নেই ইস। পনের দিন কাশ্মীর চলে গ্যাছো। আমাকে কেমন লাগছে কে বলে দেবে। কাল আব্বু-আম্মির কাছে যাব। কোন্ শাড়ীটা পরবো? রাণী কালারের যে শাড়ীটা গত ঈদে তুমি পছন্দ করে এনেছিলে,ভাবছি সেটাই
 পরবো।  দু'দিন ওখানে থেকেই চলে আসবো। নইলে বাড়ীটা ফাঁকা হয়ে পড়ে থাকবে। তুমি খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো করছো তো? এমনিতেই তোমার সর্দির ধাত। ঠান্ডা লাগিও না। সর্দি-জ্বর বাঁধালে আমি কিন্তু তোমার সাথে ঝগড়া করব খুব। তুমি আমাকে কী ভুলে গ্যাছো?পনের দিন হয়ে গেলো একটাও এস.টি.ডি. নেই। ইকবাল চাচাকে বলেছি উঠোনের গন্ধরাজ গাছটায় সার-জল দিতে। ফুল ফুটলেই তোমায় জানাবো। এই জানো, এ মাসে আমার পিরিয়ড হয়নি। মন বলছে তুমি বাবা হতে চলেছ। আচ্ছা, আমাদের ছেলে হবে না মেয়ে হবে? যাইহোক যেন তোমার মত দেখতে হয়।তোমার মত নাক। তোমার মত চোখ। তোমার মত সব। বাড়ীর পেছনের জামরুল গাছটায় টুনটুনি পাখীর বাসাটা তো তুমি দেখে গিয়েছিলে। কাল দেখি ওদের তিনটে বাচ্চা হয়েছে। তুমি আবার কবে বাড়ী আসবে? আমার ভীষণ মন খারাপ করছে।

                                            ইতি 
                                            তোমার মৌসম 

   চিঠিটা যত্নে খামে ভরে আবার একটা খাম খুলে পড়তে লাগলো সিরাজ। কতবার চিঠিগুলো পড়েছে সিরাজ। তবুও বারবার পড়তে ইচ্ছে করে।   


  প্রিয় সিরাজ, 
                     খবরে শুনলাম যে কোন মুহূর্তে  
ভারত -পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হবে। তুমি ঠিক আছো তো? আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তুমি ছুটি নিয়ে আসছো তো? 'মাস প্রায় হয়ে গেল। ডাক্তার বলেছে যে কোনোদিন তুমি সন্তানের বাবা হতে পার। তুমি নেই এই সময়। আমি কী করে সবকিছু ম্যানেজ করব। তোমার আমার সন্তান পৃথিবীতে আসতে চলেছে। তুমি কী চাওনা তোমার সন্তানের জন্মের মুহূর্তের স্ত্রী-সন্তানের পাশে থাকতে? আমি তোমার পথ চেয়ে বসে আছি। কলিংবেল বাজলেই দরজা খুলতে ছুটে যাচ্ছি, ভাবছি তুমিই হয়তো বাড়ী এলে। জানো আমার খুব ভয় করছে। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে যদি কোন অঘটন ঘটে, যদি আমি মারা যাই আমাদের সন্তানের কী হবে? তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ী এসো।
                                              ইতি
                                      তোমার মৌসম 


    চিঠি পড়তে পড়তে চিঠিটা বুকে জড়িয়ে কখন যে সিরাজ ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারেনি।

     আজ বিজয়া দশমী। সিরাজ মুসলিম হলেও ধর্মগোঁড়া  নয়। ঈদও যেমন ওর কাছে খুশীর উৎসব। দুর্গাপূজোও তেমনি। ইন্ডিয়াকে নতুন একখানা ফ্রক পরিয়ে দিয়ে ঘরটা সিরাজ বন্ধ করে শোবার ঘরে স্ত্রীর কাছে গেল খুশী মনে। তারপর ব্যাগ থেকে দশমীর জন্য তুলে রাখা শাড়ীটা বের করে ডাক দিল, 'মৌসম। মৌসম।আজ দশমী। ওঠো, তোমাকে নতুন শাড়ীটা পরিয়ে দিই।' তারপর সিরাজ মৌসমকে সযত্নে শাড়ীটা পরিয়ে দিতে লাগলো ঘর বন্ধ করে। বাড়ীতে কাজ করতে এখনো ইকবাল চাচা আসেনি। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল।কে এল আজ হঠাৎ? ইকবাল চাচা ছাড়া সচরাচর বাড়ীতে কেউ আসে না। সিরাজ মনে মনে ভাবল স্ত্রীর হাতে চুড়ি, কপালে টিপ পরিয়ে দিতে দিতে। বেলটা আবার বেজে উঠল পাড়ার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা পুরানো আমলের জরাজীর্ণ বাড়ীটাতে। স্ত্রীর কপালে একটা চুমু খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সিরাজ। তারপর রুমটাতে তালাবন্ধ করে নিচে নেমে এল।

     দরজা খুলতেই যাকে দেখল, দেখে খানিকটা থতমত খেয়ে গেল সিরাজ। মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, 'আরে জয়ন্ত তুই?' ঘরে ঢুকেই ড্রয়িংরুমে পেতে রাখা সোফায় বসতে বসতে জয়ন্ত বলল, 'পুজোর মাঝে তোর মেয়ে-বৌকে নিয়ে আমার বাড়ীতে এলিনা, তাই বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাতে আমিই চলে এলাম। ভালো করিনি বল?'  উত্তরের কোন অপেক্ষা না করেই জয়ন্ত হাসিমুখে বলল, 'তা তোর মেয়ে মানে ইন্ডিয়াকে দেখছিনা? সেই সাত বছর আগে তোর বিয়েতে এসেছিলাম। মৌসম কোথায়? ডাক ওদের।' 

     কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না সিরাজ। সে হঠাৎই বলে বসল, 'ইন্ডিয়াকে নিয়ে কালই মৌসম বাপের বাড়ী গ্যাছে রে। ওদের সাথে দেখাই হলো না এমন দিনে তুই এলি।' 

     বাচ্চাদের ট্রাইসাইকেল, টেডিবিয়ার, বার্বিডল-এ ভর্তি রুমটা। দেখতে দেখতে জয়ন্ত বলল, 'সে কী! ইস! আর কী করা যাবে তাহলে? তুই বরং এই মিষ্টিগুলো রাখ। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম দেখা করে যাই। কিন্তু..... যাক তাহলে আমি উঠি। অন্য কোনদিন তোর বউয়ের হাতে চা খেয়ে যাবো।' 

      জয়ন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই স্বস্তি পেল যেন সিরাজ। তারপর দরজা বন্ধ করে উপরে উঠে গেল। 

জয়ন্ত সিরাজের ঘর থেকে বেরোতেই বয়স্ক করে একজন লোক বলল, 'আপনি সিরাজ বাবুর বন্ধু? আমি ইকবাল। সিরাজের কাজের লোক।' তারপর ইসারায় একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, 'আপনি সিরাজকে বাঁচান বাবু।'

--- সে কী? কেন? সিরাজের কী হয়েছে?
--- এভাবে চলতে থাকলে হয়তো ও একদিন পাগল হয়ে যাবে!  
---পাগল কেন হবে? মেয়ে-বৌ নিয়ে বেশতো আছে। 
---তাহলে শুনুন। আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে সিরাজবাবু আর্মি থেকে রিটায়ার্ড করে। যেদিন সন্ধ্যায় ও বাড়ী ফিরল, ঠিক সেই মুহুর্তেই.... 
---সেই মুহূর্তেই কি? 
---সেই মুহুর্তেই গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট করে সিরাজবাবুর স্ত্রী আর ছোট্ট ইন্ডিয়া আগুনে জ্বলে পুড়ে মারা যায়।

     কথাটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল জয়ন্ত। তারপর উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, "কি বলছেন আপনি? তবে যে সেদিন শপিংমলে মেয়ে -বউয়ের জন্য শাড়ী আর ফ্রক কিনলো সিরাজ? আর আমাকে মিথ্যেই বা বলবে কেন?"

     "সে কথাই তো বলছি বাবু।সিরাজ আজও বিশ্বাসই করে না যে ওর স্ত্রী আর মেয়ে মারা গেছে। একাকিত্বে ভুগতে ভুগতে ও মনে মনে এতটাই অসুস্থ হয়ে উঠেছে যে ও কবর থেকে তুলে বাড়ীতে এনে রেখেছে স্ত্রী আর মেয়ের কঙ্কাল!" চোখের জল মুছতে মুছতে ইকবাল আবার বলল, 'বাবু, সিরাজবাবুকে বাঁচান।' 

       সব শুনে জয়ন্ত কোন কথা বলতে পারলো না। যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গ্যাছে ওর। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে ইকবালের কাঁধে হাত রেখে শুধু অসহায়ের মত বলে উঠল , "মৃত স্ত্রী আর মেয়েকে সিরাজ বাঁচিয়ে রেখেছে যখন আমি তাদের মেরে ফেলি কী করে, বলো ইকবাল? থাক না। ওর মৌসম, ওর ইন্ডিয়া ওর হৃদয়ে বেঁচে থাক।"



 দীপ্তেন্দু জানা