ডাক
চিন্তার ভেতর ঢুকে বসে
থাকি। যেন চোখ বুজে থেকে ভয়গুলো পার হয়ে যাই। তার বাইরে জেরই একটা আলাদা সত্তা সব
মানুষের কথা শোনে। একটা কথা বিশেষ আবেগের হলে ভেতরে এসে কড়া নাড়ে,চোখ
খুলি। ততক্ষণে পার হয়ে গিয়েছে সেই কথাটি। অথচ নিজের কপাটে কতদিন এমন একটা কড়ার শব্দ
পাই না। চিন্তার ভেতরে ঢুকে ভাবি কতদিন সেই পুরোনো রাস্তাটা দিয়ে যেতে যেতে মাঠের
গন্ধ বুক ভরে নিতে পারিনি। এই গন্ধের মায়ার জগত এবং বিজ্ঞানের পৃথিবীর মধ্যে তাল
মেলাতে পারি না। পুরোনো রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে মাঠের গন্ধের ভেতর পাই কয়েকটা পুরোনো
গানের জীবন।শুনে শুনে কথাগুলোর প্রতি আর নজর থাকে না,শুধু
সুরগুলো জেগে থাকে।সুর একটা ভালোবাসার মানুষের মতো।তার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে মরি অথচ
কোনদিনই পুরোটা নিজের করে পেয়ে ওঠা হয় না। একদিন আর টানে না তেমন।দূরে যাই,নতুন
করে একদিন ফিরে পাওয়ার আশাতেই।তখন প্রথম কড়া নাড়া। বসে আছি যাদবপুরের বাংলা
বিভাগের করিডোরে।অপমান এসেছে।জোরে জোরে কড়া নাড়াচ্ছে। আমি দরজা খুলে দিই। অপমান
ভেতরে আসুন। তার মুখে নিষ্ঠুর হাসি,তার চোখে রুক্ষতা।তার কথায়
কটূ স্বাদ। সে প্রতিরোধ আশা করে আরও তীব্রতার জন্য। আমি হাসিমুখে তার সামনে বাড়িয়ে
দিই একটা পাত্র। নীল তরলে ভরে ওঠে সেটি।আমি নিঃশব্দে পান করি।অপমান ফুরিয়ে গিয়েছে।
সে এখন ফিরে যেতে চায় দরজার ওপারে। তার হাতে একটা ফুলগাছের চারা দিয়ে আমি নেমে আসি
করিডোর দিয়ে নীচে।এসে
বসি সিড়ির ওপরে। ভাবি মায়ের কথা। যে কোন অপমান চলে গেলে মায়ের দু চোখ ভেসে আসে। দেখি
আমাদের শীতের জমিটায় প্রতিটি ফুল মা কেমনে নিজের বুকের রঙে রাঙিয়ে তুলেছে। দরজায়
আবার এসেছে অতিথি। অভিমান। সে একটা লম্বা আঁচড় কাটে। অভিমানে কোন কথা নেই। তার চোখের
দিকে তাকিয়ে দেখি এক সমুদ্র। সাঁতার জানি না আমি এই বেশ ভাল।মনে হয় ডুবে যাই। তাকে
একটা লেখার পালক দি। বলি,লিখো। গভীর রাতে যখন জীবনের
সমস্ত আলো ধীরে ধীরে মৃদ্যু হয়ে যায় তখন যেন শুনতে পাই তোমার কাগজের খসখস। অভিমান
সে পালক বুকে জড়িয়ে ফিরে যায়। অভিমানের গাঢ় রঙ আমি ততক্ষণে চুরি করে ছড়িয়ে দিয়েছি
জীবনে। সিড়ি বেয়ে হেঁটে চলি
পুরোনো স্মৃতির অলিগলি।সাউথ পার্ক ধরে যে মেয়েটির পাশাপাশি চলেছি বহুদিন,সে
নেই। আলোতে আমাদের ছায়াদুটো আজও পাশাপাশি হাঁটে। এখানে সেই বাড়ি।সন্ধেতে মেয়েটির
গলায় কোনক্রমে দূর দ্বীপের কোন বাসিন্দার গান উঠে আসে। ডানদিকে হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ, বামদিকে
আড়াইটি চুম্বনের দুপুর পড়ে আছে।আবার দরজায় কে এসেছে,কড়া
নাড়ায়।কান্না এসেছে।তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আসি ঘরে।তার চোখের জল মোছাই।তালপাখায়
হাওয়া করি। উথালপাতাল বুকের ওপর একটি নৌকা রাখি তার।ধীরে ধীরে শান্ত হয় জল।একটি
কান্না,কান্নার ভেতরে বেঁচে থাকে।তার ভেতর কত প্রাণ আশ্চর্য সাঁতার
দেখায়।গ্রন্থাগারের রাস্তায় প্রবল বৃষ্টি।সাতটা পনেরোর এদিক ওদিক ট্রেন,ঘরে
ফিরে যাওয়া প্রয়োজন।ছাতা হাতে জলের ভেতর নামি।জলের ভেতর পা ভেজে,জল
এসে থামে দরজার মুখ অব্ধি।এপারে আসে না।এগোই,
শুধু মনে জেগে থাকে দরজায়
কড়া নড়েনি আর একবারও। আরেকটি কড়া নাড়ার অপেক্ষায় অনেকক্ষণ। ছাতার বাইরে ভিজে আরও
শুকনো করে তোলে অন্তরের সমস্ত চাওয়া পাওয়া। কান পেতে থাকি।একটি কড়া নাড়ার অপেক্ষায়।
এগিয়ে যাই আরও অনেকটা। বামদিকে যাদবপুরের মাঠ জলে ভরে গেছে,ভিজে
গেছে পিঠের জামাটা কিছু। পায়ের অনেকটা পেয়ে জল উঠে এসেছে শরীরে।অথচ কী অসম্ভব
শুকনো আমি। কী অসম্ভব শুকনো সবকিছু আশেপাশে। শুধু জল আর জল।তার কোন কড়া নাড়া নেই। পেরিয়ে
গিয়েছি মাঠ।এমন ঝাপ্সা বৃষ্টির ভেতর কেউ নেই প্রায়।ছাতা শুকিয়ে যেতে পারে ন মিনিটে
আর আরও একশো কুড়ি মিনিটে এক সরলরেখা ধরে ঘরের কাছে ফেরা। কড়াদুটো খুলে কপাটের মাঝে
দুয়েকটা হাতুড়ির বাড়ি।পথ পেরিয়ে যাই,ভালোবাসা কড়া নাড়ে না। ডানদিকে মাঠের ডানদিকে
একটা রাস্তা দিয়ে শুধু আরেকটি ছাতা এগিয়ে আসে।পা দিয়ে জল অনেকটা ছুঁয়েছে তাকে টের
পাই। ছাতাটি বুকের মাঝেতে সে বৃক্ষের মুগ্ধতায় ধরেছে। অথচ তার মুখ দেখা যায় না
অন্ধকারে।যেন এই জলের ভেতরে কোন দূর প্রেতলোক থেকে সে এসেছে,আমাকে
পার হয়ে যাবে বলে। ধীরে,খুব ধীরে কাছাকাছি আসি যেন বহু কোটি বছর পর
দুটি গ্রহ পার হয়ে যাবে,আবার যে কবে দেখা হবে সে কথা বিজ্ঞান বলেনি। দরজায় কড়া নড়েনি আর,আমিই
দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এসেছি। মুখটুকু যদি রেখে যায়,সামান্য
আলো এসে পড়ে। অথচ এমন দিনেই সমস্ত আলো স্পর্শ হারায়। জল ঢোকে শরীরে বন্যার মতো,ডুবে
যেতে যেতে উন্মাদ আমি বলি মুখ রেখে যাও,একটা
মুখের আদল। সেই মুখ অন্ধকারে পার হয়ে যায়।একটু থমকায়। ডাকে-'দীপ।'