পুরাতন জামায় ঈদের আনন্দ
এমনিতেই আমার একটু রাত
করে ঘুমানোর অভ্যাস! হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করার ফলে এই রাত জাগার বদভ্যাসটি তৈরি
হয়েছে! সারাদিনের পেশেন্ট দেখার ব্যস্ততায় নিজস্ব পড়াশোনার ফুরসতই মেলে না! তাই
রাতের নির্জনতায় নিজের পেশাগত পড়াশোনা করার পাশাপাশি অন্যান্য সাহিত্য বইয়ের পড়াশোনা
না করলে আমার ঘুমই আসতে চায় না! আজকে ছুটির দিন ছিল! তাই ঈদের নতুন জামা কাপড় কেনার
জন্য মার্কেটিং এ গিয়েছিলাম! শীততাপ নিয়ন্ত্রিত শপিং মল থেকে কেনাকাটা সেরে ফেরার
পথে, হঠাৎ মনে পড়লো ছেলের জন্য গেঞ্জি কিনতে ভুলে গেছি! আবার শপিংমলে ফিরে না গিয়ে
রাস্তার পাশে ফুটপাতের একটি দোকান থেকে গেঞ্জি কিনতে গিয়ে অদ্ভুত এক ঘটনা আমার চেতনায়
অদ্ভুত ধাক্কা দিল! বছর-দশেকের একটি মেয়ে দোকানের ভেতর নতুন একটি জামা আঁকড়ে ধরে
বসে রয়েছে! হেঁচকি তুলে কাঁদছে আর চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরে পড়ছে! মেয়েটির বাবার
কেনাকাটা শেষ হয়েছে এবার তিনি দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছেন! কিন্তু মেয়েটির নতুন
জামা না কিনে কিছুতেই দোকান থেকে বেরোতে রাজি ছিল না! মেয়েটির বাবা তার মাথায় হাত
বুলিয়ে দিয়ে খুব আদরের সঙ্গে বোঝাচ্ছিল, মা এবারের রোজার ঈদে তোর ছোট ভাইয়ের জন্য
জামা কিনেছি! বকরি ঈদে তোর জন্য নতুন জামা কিনে দেবো! লোকটির কথা শুনে বুঝতে পারছিলাম
মেয়েকে জামা কিনে দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তার সেই মুহূর্তে সামর্থ্য ছিল না! নিজের আর্থিক
অসহায়ত্বে লোকটি অদ্ভুত বিষন্ন ভাবে মুখ নিচু করে বসেছিলেন! আর ছোট্ট অবুঝ মেয়েটি বুকের কাছে জামাটি পরম মমতায় আঁকড়ে রেখেছিল! আমি
লক্ষ্য করছিলাম দোকানদার কিংবা মেয়েটির বাবা কেউই মেয়েটির কাছ থেকে জোর করে জামাটি
কেড়ে নিচ্ছিল না! আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না এরকম পরিস্থিতিতে ঠিক কি করা উচিত!
নিজের ছেলের গেঞ্জি কেনার কথা ভুলে গিয়ে আমি অবাক বিস্ময়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে
ছিলাম! এরকম এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতিতে দোকানদারটি মহানুভব হয়ে দেখা দিলেন! তিনি
একটি জামার টাকার বিনিময় দুটি জামা মেয়েটির হাতে তুলে দিয়ে চূড়ান্ত মানবিক লাঞ্ছনার
হাত থেকে বাঁচালেন এই আর্থিকভাবে অসহায় দরিদ্র পিতাকে! দোকানদারটি জানালো কত পয়সাওয়ালা
মানুষই তো ধারে জামা কাপড় কিনে নিয়ে গিয়ে আর সে টাকা ফেরত দেয় না! আপনার তো দেওয়ার
সামর্থ্য নেই! আপনার মেয়েকে আমি ভালোবেসেই জামাটি দিলাম!আমি চোখের সামনে দেখলাম নতুন
জামা হাতে পেয়ে মেয়েটি চোখের অশ্রু মুছে হাসতে হাসতে বাবার হাত ধরে দোকান থেকে বেরিয়ে
গেল! ফুটপাতের এক সাধারন দোকানদারের মানবিক সহমর্মিতায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম! কোনরকমে
ছেলের গেঞ্জি কিনে নিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচলাম! কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে কেন জানি
না কিছুতেই বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি পাচ্ছিলাম না! ফুটপাতের দোকানদারের পাশে সারাক্ষণ
নিজেকে খুব ক্ষুদ্র এবং নিচু স্তরের মানুষ হিসেবে মনে হতে লাগল! রাতে স্ত্রী ও সন্তানকে
পাশে বসিয়ে নিজের মানসিক যন্ত্রণার কথা খুলে বললাম! স্ত্রী নিলুফার সবকিছু শুনে বলল
এবার ঈদে আমাদের যে নতুন পোশাক কেনা হয়েছে সেগুলি সকাল হলেই প্রতিবেশী গরিব মানুষদের
হাতে তুলে দেব! আমার ছেলেটাও দেখলাম মায়ের কথায় হাততালি দিয়ে সমর্থন জানালো! অন্যকে
দানের মধ্য দিয়ে যে এত আনন্দ পাওয়া যায় এই প্রথম নিজের মনে তা অনুভব করলাম! পরের
দিন সকালে ঈদগা ময়দান থেকে পুরনো পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ছেলে এবং আমি যখন রাস্তা দিয়ে
হেটে বাড়ি ফিরে আসছিলাম, তখন প্রতিবেশী ছোট ছেলে মেয়েদের নতুন জামা কাপড় পড়ে আনন্দে
কলরব করা দেখে এক অপার্থিব পবিত্র অনুভূতিতে হৃদয়ের মন ভরে উঠছিল!
আবু রাইহান