সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

আনন্দগোপাল হালদার




বই পাড়ার চালচিত্র


সূর্যসেন স্ট্রীটের বাড়ন্ত সূর্যটা চোখ  বুঁজলেই ইলেকট্রিকের  টিমটিমে আলো গুলো তাজা হতে শুরু করে। ক্রমে অন্ধকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আলো। একে একে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় অফিস প্রেস বইদোকানের বন্ধুদের সব স্রোত এসে মিশে যায় পার্টি অফিসের গলির মোড়ে।

 বইপাড়ায় আমাদের সন্ধেটা প্রতিদিন এভাবেই ডুবে যায় রাজুদার চায়ের কাপে।

আমরা এখানেই ডুবতে ডুবতেই অস্বচ্ছ চিন্তার প্রুফ সংশোধন করতে থাকি।

বন্ধ দরজার কোনে বসে থাকা সুদীপ্ত দু'টাকার দেশলাইটি মুঠোয় পুরে পাশের জনকে জায়গা ছাড়তে ছাড়তে একসময় নিজেই উঠে যায়!

সায়নদা বেশ সরস ভঙ্গিতে সুদীপ্তর কাছে রাহুলদার কবিতা শুনতে চায়। আমরা জানি, সুদীপ্ত রাহুল পুরকায়স্থর প্রায় সব কবিতা মুখস্ত রাখে কিন্তু সায়নদার সুদীপ্তর কাছে কবিতা শুনতে চাওয়ার ভঙ্গিটি এতই সরস যে বেচারা সুদীপ্ত ফুঁসতে ফুঁসতে সায়নদাকে তাড়তে শুরু করে , মামার হাতে চায়ের ডিস দেখে একসময় দুজনেই হাত ধরে ফিরে আসে ।

আমি বলি, 'সায়নদা তো ঠিকই বলছে। সুদীপ্তর ভাঙা রেকর্ড- 'আনন্দদা তুমিও বলছো!'

চোখে লালচে কাচের চশমা লাগিয়ে লোকাল বিড়ির প্যাকেটা দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে ছিঁড়তে ভাইয়াদা সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। সুদীপ্ত ডেকে বলে
 'চা খেয়ে যান' ততক্ষণে ভাইয়াদা আরেকটু এগিয়ে যায়। বডিটা সামনের দিকে রেখেই পিছনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কোকিলের মতো আরক্ত চোখে সবার দিকে তাকিয়েই গর্বের সুরে বলে 'যৌবনে আমি স্বদেশি করেছি , সন্ধেটা এখনও বাংলা দিয়েই কাটে। এখানকার সব্বাই জানে এই সময় আমি চা খাই না।'

তারপর নিজেই ফিরে আসে । শুরু হয় -একদিন শিবরাম চক্কোতি আমাদের বাড়ির দিকে হেঁটে আসছেন আর গলা থেকে বুক হয়ে পেট পর্যন্ত নেমে এসেছে নস্যির গুঁড়ো। নস‍্যলাঞ্ছিত সেইসব প্রাঞ্জল ইতিহাস শেষ করতে করতেই যৌবনে একাই এতগুলো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মাৎ করে দেওয়ার গল্প শুনিয়ে ইউটিউবে 'পণ্ডিত --'
সার্চ করতে বলে নিজের স্বদেশী বৈঠকখানায় উঠে যান।

হঠাৎ মানসদা এসে দাঁড়ায় ,পরিস্থিতি না বুঝেই কথার মাঝখানে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে 'এক জন এসেছিলো 'মৃত্যুব্যাধী' কিনতে , দিলাম। তোমার খোঁজ করছিলো আরও কী কী সব বই লাগবে যেন বলছিলো। তখন ওই কারণেই ফোনটা করেছিলাম। তুমি বোধয় ব্যস্ত ছিলে তাই ধরতে পারোনি।' একটা পাণ্ডুলিপি দিয়ে গ্যাছে তোমাকে ,পড়ে জানাতে বলেছে।
তারপর কাল নন্দনে কী প্রোগ্রাম আছে , অবনীন্দ্র সভাঘরের কোন ছবিটি পুরস্কৃত হতে পারত অথচ হয়নি, নিজের ঔদ্ধত্যে সেসব চুলচেরা বিচারের বাণী শোনাতে থাকে। নির্বাচকদের স্বজনপোষণ এবং ঘরোয়া রাজনীতি সম্পর্কে তার নিজের ধারণা ব্যক্ত করে। 

মাঝে মাঝে সুমহানদা (সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায়) আসেন, সবার কথাই গুরুত্ব দিয়ে শোনেন, সমাধানের পথ বাতলানোর চেষ্টা করেন। এত দরাজ হৃদয়ের সৌম্য-শান্ত মানুষ সত্যিই কম দেখতে পাই। 

পার্থদা(পার্থ আচার্য, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক), আপাদমস্তক ফিটফাট ভদ্রলোক। নিয়ম করে এবং অনিয়ম করে আমাদের মধ্যে আসে। 
আমাকে অভিভাবক সুলভ ভঙ্গিতে কখন শাসন করে করে কখন স্নেহ করে বোঝা মুস্কিল। স্বভাবতই আমাকে তার কথা শুনে চুপ করে থাকতে হয়। প্রথম প্রথম ভাবতাম এড়িয়ে চলবো কিন্তু তার গল্প উপন্যাস পড়ে বড়ো ভালোবাসে ফেলেছি। বুঝেগেছি তাকে এড়িয়ে আমিই চলতে পারবো না।

ইতোমধ্যে আমাদের শ্যামলদা একটা বিড়ি চায়, নিজেকে পিতামহ ভীষ্ম মনে করা আমাদের দাদা বিড়িটা ধরিয়ে নিয়েই শুরু করে-
'ব্যবসা জানে? শালা ৬০ কপির 'পি ও ডি' প্রকাশক! সাবঅলর্টান স্টাডিজ নিয়ে কত্ত কাজ করেছে? হিম্মত থাকেতো সারা জীবন সময় দিলাম আমার সমান একখানা 'জেলে পাড়ার সং' করে দ্যাখা!

তারপর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আমাকে ফিসফিস করে ব্যঙ্গের সুরে বলে-
 দেখো আমাদের ...স্বর রাও(নামটি গোপন রাখলাম) বন্ধুর অপমান সহ্য করতে না পেরে আনন্দবাজারের চাকরিটা ছেড়েই দিলো! বিড়িতো মুখে রোচে না ! ওঁর জন্যে বড়ো বড়ো সিগারেট কিনে দাও, সেলোটিভ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দাও।

কিস্যু হবে না ! এর দ্বারা কিস্যু হবে না!!

আমি মনে মনে সমর সেন আওড়াতে থাকি- চা আর ধূমপান নিষিদ্ধ গান।

মুখে হাত দিয়ে কথা বলা জলজদা (হারানো জনশ্রুতি'র লেখক জলজ বন্দ্যোপাধ্যায় )কানের কাছে বিড়ি ডলতে ডলতে আপশোসের সুরে বলে 'সারথী বিড়ি'  তামাকটা ভালো না, সালারের মল্লিক বিড়িটা দাও।  আমরা লক্ষ্য করি ওর কোন কিছুতেই তৃপ্তি নেই, কোন কিছুতেই শান্তি নেই! অথচ গিলে খাওয়ার মতো চোখ আছে, গর্ত থেকে ঠিকরে ওঠা শান্ত-তীক্ষ্ণ টর্চের মতো।

পাশ থেকে স্মার্টলি অথচ আস্তে আস্তে অশোকদা জর্জি গ্রোটস্কির থিয়েটার ভাবনা নিয়ে অনেকক্ষণ ভেবে দু একটা কথা বলতে যাবে অমনি আশিসদার ফোন আসে 'ও হুজুর তেরা তেরা তেরা শুরু... -

'হ্যালো হ্যালো হ্যাঁ বলুন ও হবে হবে  'মাল্লু ছাড়ুন সব কাজ হবে', না না মাল্লু না দিলে আমি কাজ করি না।'
ফোনের ঘাম জামায় মুছতে মুছতে আশিস দা বলে, 'খালি ভ্যাজর ভ্যাজর, মাল্লু না ছাড়লে কীভাবে কাজ  হয়! যত্তসব!'
তারপর শ্যামলদার দিকে তাকিয়েই শুরু করে হ্যাঁ আমাদের 'স্ক্রিম'টা কদ্দূর এগলো যেন? শ্যামলদা ইচ্ছে করেই শুনতে পায়না। আশিসদা তখন 'কাজ' হবে না বুঝে নিজেই আবার পুরনো স্কিমে ফিরে যায়।

ফাল্গুনীদা কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে এসে বিবেকানন্দীয় স্টাইলে দাঁড়ায় । কর্কশ অথচ স্পষ্ঠ উচ্চারণে বলে, 'শ্যামলদা , একটু দ্যাখো, ঠিক পথে এগোচ্ছিতো ? নিজে কিছু একটা না করলে হবে না বুঝলে? বাংলা বাজারের যা অবস্থা! সবইতো বুঝতে পারছো!' আচ্ছা, 'পার্চমেন্ট' নামটা ভালো?
শ্যামলদা সম্মতিসূচক মাথে নেড়েই বলে-
'লড়ে যাও লড়ে যাও, হাল ছাড়লে হবে না।'

তারপর ওভাবেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই সুদীপ্তর দেশলাই জ্বালানো দেখেই সিগারেটের নেশা পায় ফাল্গুনীদার। একটা বের করে অভীকদাকে দ্যায় আর নিজের চোঁটে ধরে। তারপর মুখ এগিয়ে দ্যায় আগুনের দিকে। শলাকা জ্বলে ওঠে আবছা আলোয়।

এতক্ষণ অভীকদা সব শুনছিলো আর ফেসবুকের পেজে চোখ রেখে মিটমিট করে হাসছিলো । হঠাৎই ফাল্গুনীদার দিকে তাকিয়ে বলে, এরা আবার শুরু করেছে! পুরষ্কার লোভীদের করুণার চোখেই দেখবে যারা অমুক পুরষ্কার, তমুক সম্মান নেওয়া বা দেওয়ার গর্বে  ঢাক পেটান তাদেরও করুণাই প্রাপ‍্য।

এসব শুনতে শুনতে আমাদের কারো কারো চাপ চাপ হতাশ চিহ্ন ঝরে পড়ে মন থেকে।

আমাদের ফুসফুস থেকে ধোঁয়া গুলো একসঙ্গে  বেরিয়ে এসে ধাক্কা খায় সৎ সঙ্ঘের কার্ণিশে। গোল গোল পাক খেতে খেতে একযোগে উঠে যায় আকাশে।

মামা তলানিতে লেগে থাকা চা টুকু ফেলতে ফেলতে খালি কাপ গুলো থালায় তুলতে শুরু করে। ততক্ষণে আমরা রাজুদার চা আর সিগারেটের হিসেব শুনে নিই।

কলেজস্ক্যোয়ারের কোনের বাথরুম থেকে একে একে ঘুরে আসি আর দেখি এক বৃদ্ধ সান্ধ্য ভ্রমণে আসা যুবতীদের দেখে চশমার কাচের তলা দিয়ে রবীন্দ্র গান ভাসিয়ে দেয়-
 ' প্রাণ চায় চক্ষু না চায় মরি একি তোর দুস্তর লজ্জায় সুন্দর এসে ফিরে যায়...'
সুন্দরীরা এভাবেই প্রতিদিন কানে হেডফোন লাগিয়ে জোর কদমে হেঁটে যায় । অবশিত যৌবনের ঘড়ঘড় গোঙানির শব্দ তারা শুনতে পায় না। নব যৌবনের গানের দিকেই তাদের কান সজাগ থাকে।

পাশেই গ্রিলের ফাঁকে আকটা যাওয়া প্রেমিক যুগল কাছে ঘেঁসতে ঘেঁসতে জোড়কলমের মতো আটকে যায় এক ডালে , তখন তারা পৃথিবীর আর কোনও ঘরে ফেরা পাখিদের কথা শুনতে পায় না। 

এক মাঝবয়সী অধ্যাপক 'তাঁর কবিতার বই প্রকাশ করলে বাংলাবাজারে দাঁড়াবে না' - ছোকরা-প্রকাশকের এই কথা শুনে ধ্বজভঙ্গ পাণ্ডুলিপি ভরা ব্যাগের প্রথম চেনে হাত দিয়ে আনমনে আসতে আসতে ঘুঘনির ডেক্সে ধাক্কা মারে। 
অ্যাকোয়ারিয়ামের রঙিন মাছ দেখা আর কুকুর গুলোর সঙ্গে খেলতে থাকা ধুলোবালি মাখা মানুষ ও কুকুরের বাচ্চা গুলো একসঙ্গে ফুটপাথে পড়ে থাকা ঘুঘনি আর তেতুল জল চাটতে থাকে।

 দুহাতে সুইমিং পুলের গ্রিল ফাঁক করত করতে নধর বাচ্চা গুলো দুচোখ ভরে দেয় বেড়ার ওপারে। সাঁতার পটিয়সী ত‍্যালাপিয়া মাছের ঝাঁক দেখে ঈর্ষা করে, আফশোস করে নিজেদের অক্ষম শরীরের বহরের প্রতি।

বাথরুমের সামনেই ভুট্টাগুলো খাড়া করে বেচতে থাকে রাত পর্যন্ত। সে পাঁচ মেয়ের বাপ! ডান হাত দিয়ে  জোরে জোরে পাখার বাতাস  দিতে দিতে বৃদ্ধা-মাসিমাদের দিকে তাকিয়ে ভুট্টাওয়ালা সারাবছরই বলে থাকে 'কচি মাল কচি মাল, একদম নরম'

সামনেই মন্দিরের চাতাল ছেড়ে কোমর ও হাঁটুতে ব্যথাধরা মাসিমারা বাংলা সিরিয়ালের গল্প করতে করতে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। 

রাস্তার পাশে ত‍্যানা গায়ে দিয়ে পড়ে থাকা পাগলীটা প্রতিদিনই ট্রামের ড্রাইভারকে গালি দেয় আর বারবার বলে 'একদম গায়ে তুলে দেবে যে এখানেও শান্তি নেই!  আরেকটু সরিয়ে আরেকটু সরিয়ে নিয়ে যা ওদিক দিয়ে নিয়ে যা। একদম গায়ে তুলে দেবে যে শালা! 
অনিয়ন্ত্রিত গাঁজা টেনে যৌবন ফতুর করে দেওয়া পঁয়ত্রিশের বৃদ্ধ তখনও রাতের খাবারের কথা ভেবে যায়!

কলেজস্ক্যোরারের সাইডের চাতালে বাসকরা পরিবার গুলি এক হাতে স্টোভ ধরে অন্য হাতে পাম্প করতে থাকে জোরে জোরে , ততক্ষণে মুরগির ঠ্যাং গুলো গরম জলে সেদ্ধ হয়ে ছাড়তে ছাড়তে ভারতবর্ষের মানচিত্র হয়ে যায়। 

আমরা ভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়াই,মোবাইলে রাত এগারোটা বাজতে যায় । 34B এলে শ্যামলদা বলে ' চলো শ্যামবাজার অব্দি একসঙ্গে যাই তারপর দেখা যাবে...





                                                         আনন্দগোপাল  হালদার