শিলং আর আমার রবীন্দ্রনাথ
স্বপ্ন যখন একটা একটা করে পূরণ হয় , তখন স্বপ্ন দেখার চাহিদাও যেন একটু একটু করে বাড়তে থাকে । প্রথমবারের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল
মংপুতে গিয়ে, তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু
করি শিলং-এর কারণ এই শহরটাতেও কবিগুরুর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে । এই বছর তাই পুজোর
দিনগুলোতে কাটিয়ে এলাম উত্তর- পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড় জেলার
শহর শিলং-এ। প্রতিটি পর্বত- প্রেমীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে শিলং।
প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড বলে যার পরিচিতি। কেউ কেউ বলেন দার্জিলিং যদি হয় রূপের রানি, তাহলে শিলং হল
রাজা।রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শিলং বাঙালির নস্টালজিয়ায় অনন্য।
গৌহাটি স্টেশানে কাঞ্চনজঙ্ঘা
গিয়ে পৌঁছল ভোর চারটেয়।ওখান থেকে গাড়ি করে শিলং পৌঁছলাম সকাল সাড়ে সাতটায় । তারপর
ফ্রেশ হয়েই রওনা দিলাম কবিগুরু যে সব জায়গায় কাটিয়ে ছিলেন সেই সব জায়গায় ।
কবিগুরু মোট তিনবার শিলং এসেছিলেন।
১৯১৯,১৯২৩, ১৯২৭। আমরা প্রথমে একবার গেলাম শিলং শহরের রিলবং বলে একটি অঞ্চলে। রিলবং-এর
জিগজ্যাগ রোড-এর ব্রুকসাইড বলে একটি বাংলো যেটি কিনা কে.সি. দের বাংলো বলেই পরিচিত
। এখানে মোট ১৮টি ঘর আছে। ১৯১৯ এর ১১ই অক্টোবর শনিবার দুপুরে কবি এখানে এসে পৌঁছলেন। সঙ্গে অবশ্যই পুত্রবধূ
প্রতিমা দেবী, ভৃত্য সাধুচরণ। ১৯১৮ সালে কবির অতি আদরের মেয়ে মাধুরীলতাকে হারিয়ে কবি উন্মত্ত
। সমস্ত সঞ্চিত ব্যথাকে সঙ্গে করে কবি এখানে এলেন, তখন কবির বয়স ৫৭ বছর।
কে.সি.দের স্ত্রী মিসেস দে ছিলেন কবির অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী। কে.সি. দে ছিলেন ব্রাহ্ম, তাঁর স্ত্রীর সাথে ঠাকুর পরিবারের ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক । কবির মানসিক অবস্থা অবলোকন করে মিসেস দে ' র পরামর্শে মিস্টার দে ' ব্যবস্থা করে দিলেন কবির
মনোরঞ্জনের সবকিছু , কবি যাতে সমস্ত শোক কাটিয়ে উঠে নিজের সৃষ্টিসাধনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারেন
। সেই সময় গৌহাটি থেকে শিলং-এর যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত অনুন্নত । বৈদ্যুতিক
আলো -ও ছিল না । কবি এই বাংলোতে ২০ দিন ছিলেন । তারপর চলে গেলেন গৌহাটি। সেখানে
তিনদিন থাকার পর চলে গেলেন সিলেট । তারপর গেলেন আগরতলায় । কবি সাতবার আগরতলায় এসেছিলেন।
১৯১৯ ' ব্রুকসাইট 'থাকাকালীন কবি তেমন কিছু
লেখেননি। শুধুমাত্র দুটো অনুগল্প লিখেছিলেন। তবে 'শেষের কবিতা 'র প্লট আঁকলেন শিলং-এ এসেই , কিন্তু ব্যাঙ্গালোরে বসে কবি ' শেষের কবিতা 'লিখেছিলেন।
এখানে দাঁড়িয়ে আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছিলেন বারে বারে। মনে মনে কল্পনা করে নিচ্ছিলাম
কবিগুরুর প্রতিটি পদক্ষেপ। আহা এমন মনোরম পরিবেশ !
এরপর আমরা পৌঁছলাম 'জিৎভূমি ' নামক বাংলোটিতে। যেখানে কবি
এসেছিলেন ১৯২৩ সালে। দু'মাস কবি এখানে ছিলেন । আর এই 'জিৎভূমি 'তে থাকাকালীন কবি লিখলেন তাঁর বিখ্যাত নাটক "
রক্তকরবী '।
এছাড়াও কবি লিখলেন ' শিলং-এর চিঠি ' এবং 'প্রাচী
' কবিতাটি।
কবির ভাই হেমেন্দ্রনাথের মেয়ের স্বামী ডক্টর দেবেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি ছিলেন এই বাড়ির মালিক । 'জিৎভূমি ' তে প্রবেশ করতেই লক্ষ্য করলাম
শ্বেতপাথরের দুটো ফলক। একটি ফলকে " ভারততীর্থ " কবিতাটি উৎকীর্ণ আছে , আর অন্যটিতে লেখা আছে " His famous drama Raktakarabi and Poems."
তৃতীয়বার কবি এসেছিলেন ১৯২৭ সালে আপল্যান্ড অঞ্চলের একটি বাড়িতে। এটি ছিল সিডলীর
রাজপরিবারের গ্রীষ্মাবাস । সিডলীর রাজা অজিত নারায়ণের স্ত্রী মঞ্জুলাদেবী ছিলেন
সাউথের পৃথাপুরমের রাজকন্যা। মঞ্জুলাদেবী তখন খুব ছোট কবি তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন , কবি ছিলেন পারিবারিক বন্ধুসম।
খুব স্নেহ করতেন কবি। পরোবর্তীতে মঞ্জুলাদেবীর অনুরোধে রাজা অজিত নারায়ণ কবির
থাকার সবরকম ব্যবস্থা করে দিলেন।
এরপর বিগত কেন্দ্রীয় সরকারের ' ডোনার ' মন্ত্রী ভিনসেন্ট পালা সেটি কিনে নেন
এবং সকল ধরনের প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে বাড়িটি ভেঙে ফেলেন । কবিগুরুকে আমি যেন স্পষ্ট
উপলব্ধি করছিলাম এই বাংলোর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে । কি অসাধারণ উন্মুক্ত বাতাবরণ ।
এমন পরিবেশে শুধু কবিকেই মানায়। ঝলমলে রোদ্দুরেও কবির জন্যে মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে
উঠল।
এর পরের দিনগুলো বেড়ালাম কবিকে সঙ্গে করেই। প্রকৃতির অপরূপ সব শোভা হৃদয় দিয়ে অনুভব করলাম। শিলংকে ঘিরে
আছে গলফ কোর্স , ওয়ার্ডস লেক, লেভী হায়দরী পার্ক, উমিয়াম লেক , শিলং পিক , আর অতি আশ্চর্য এলিফ্যান্ট ফলস্ । আহা ! ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
পরদিন খুব ভোরে রওনা দিলাম
চেরাপুঞ্জী ।সেখানে গিয়ে মনে হচ্ছিল জীবনধন্য । পৃথিবীর আশ্চর্য সব জলপ্রপাত।
সেভেন সিস্টার ফলস , মকটক ভিউ পয়েন্ট , মোসমাই প্রাকৃতিক গুহা, ইকো পার্ক, খাংখারাং পার্ক , নাহকালিকাই ফলস ।
নাহকালিকাই ফলসের একটি ভয়ংকর ইতিহাস আছে , যা শুনলে শিহরিত হতে হয়। এই ইতিহাসের কাহিনী সঙ্গে
নিয়ে সবশেষে গেলাম রামকৃষ্ণ মিশন । মনটা শান্ত হয়ে গেল ।
তারপরের দিন খুব বৃষ্টি । সমস্ত বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমরা সেদিনও খুব ভোরে রওনা
দিলাম ডাউকি। চারদিকে প্রথমে তুলো তুলো মেঘ। কিছুক্ষণ পরে ঘন কুয়াশা , তারপর অঝরে বৃষ্টি । একটু পরেই
বৃষ্টি নেই , কিন্তু কিছুক্ষণ কাটতে না কাটতেই আবার বৃষ্টি । এর-ই মধ্যে কখন যে পৌঁছে গেলাম
এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম 'গ্রীণ ভ্যালি ভিলেজ " । চোখ জুড়িয়ে গেল পরিচ্ছন্ন গ্রামটিকে দেখে। সমস্ত
দারিদ্র্যকে উপেক্ষা করে কি সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রাম । একটা পাতা বা কাগজের টুকরো
বা কোনো কিছুর টুকরো অংশ কিচ্ছু পড়ে নেই । অবাক হয়ে শুধু দু'চোখ ভরে শুধু দেখতে লাগলাম ।
এরপর গেলাম " লিভিং রুট ব্রিজে '। ৪৫০ মিটার গভীর এই ব্রিজটি দুটো গাছের শেকড় দিয়ে তৈরি।
প্রচন্ড দুর্গম এই ব্রিজটি ওপর থেকে নিচে গিয়ে পৌঁছাতে যে কোনো সময়ে পা পিছলে যেতে
পারে। একটু পরেই শুনতে পেলাম ঢং ঢং ঢং , কাসরের ঘন্টা, ভাবলাম নিশ্চয়ই কাছে কোনো মন্দির আছে , তাহলে কি এখানে ঈশ্বরের দর্শন
পাব ! কিন্তু অবাক হলাম, মন্দিরের দেখা নেই । অদ্ভুত এক ধরনের পোকার আওয়াজ । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'হিমালয় ভ্রমণের ' কিছু শব্দমালা চিত্রায়িত হল সেই
মুহূর্তে ।
শিলং মানেই স্মৃতিমধুর কিছু মুহূর্ত । মেঘালয় ভ্রমণ এক কথায় অসাধারণ ।
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই এক একদিন এক একটা নতুন নতুন জায়গা পরিদর্শন। কিন্তু শেষের আগের দিন রবীন্দ্র
বিশেষজ্ঞ উমা পুরকায়স্থের সঙ্গে আলাপ আর সারাটা দিন তাঁর বাড়িতে কবিগুরুকে নিয়ে
আলোচনা , সত্যি
এক কথায় চোখে জল আসার মতো । এমন অভ্যর্থনা - এমন আন্তরিকতা ভাবা যায় না । মনে হচ্ছিল কখনো আমি আমার মায়ের সাথে কথা
বলছি ; কখনো
বা মৈত্রেয়ী দেবীর সামনে বসে আছি। শ্রীমতী উমা পুরকায়স্থ একের পর এক কবিতা আবৃত্তি
করছেন , কখনো
আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছি । কখনো তিনি কবিগুরুর শেষের শেষ দিনের গল্প শোনাচ্ছেন ।
কখনো কবির কর্ম জীবনের কথা বলছেন । কখনো আমার চোখে জল , কখনো তিনি ঝরঝর করে কাঁদছেন ।
সে এক অদ্ভুত বাতাবরণ যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না ।
" যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই
যা দেখেছি যা পেয়েছি
তুলনা তার নাই ।"
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ শ্রীমতী উমা পুরকায়স্থের অগাধ জ্ঞানের ভান্ডার। জীবনে কিছু
মুহূর্ত আছে যা কোনোদিন ভোলার নয় ; এমন কিছু মানুষ-ও জীবনে দেখা মেলে যাঁকে হাজার চেষ্টা
করলেও স্মৃতি থেকে সরানো যায় না । এমন- ই একজন বন্ধু মেঘালয়ের শিলং-এ বসবাসকারী
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ শ্রীমতী উমা পুরকায়স্থ । আমার মাতৃসম ।
শিলং এ বেড়াতে গিয়ে ঈশ্বর আমার কাছে তাঁকে কিভাবে মিলিয়ে দিলেন যেন
। শিলং-এ যে গেস্ট হাউসটিতে উঠেছিলাম সেই গেস্ট হাউসের মালিক নিজেই উপযাজক হয়ে
শ্রীমতী পুরকায়স্থের সাথে দেখা করার কথা বললেন এবং তাঁর ঠিকানা দিলেন। আমি ঠিক
পৌঁছে গেলাম তাঁর দেওয়া নির্দিষ্ট ঠিকানায়। এমন ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা খুব কম দেখেছি
, এমন
উদাত্ত কণ্ঠস্বর আমি খুব কম শুনেছি।
সেদিন যে সময় টুকু কাটিয়ে ছিলাম
তা আমার জীবনের চরম পাওয়া । কবিগুরুর আলোচনার মুহুর্তেই তিনি চোখ বন্ধ করলেন । তারপর
একনাগাড়ে বলতে শুরু করলেন কবিগুরুর জীবনের মর্মস্পর্শী দিনগুলোর কথা । একের পর এক ঘটনা
আমার চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠছিল । কখনো গান , কখনো কবিতা , কখনো মৃত্যুর শেষ দৃশ্য ।
কতো করুণ স্বরে , কখনো চোখের জলে সেই স্বর আমার
হৃদয়ের দ্বার খুলে দিচ্ছিল ক্রমাগত । আমি যেন পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি কবিগুরুর
শেষের শেষদিনের দৃশ্য । সেকি যন্ত্রণার , সেকি কষ্টের ।
আমার চোখের জল কখন আমার চিবুক স্পর্শ করেছে আমি জানি না। এক অসাধারণ মায়া জড়ানো
ব্যক্তিত্বময়ী মহিলার হাত তখন আমার মাথার ওপর , পিঠের ওপর এক স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে চলেছে ক্রমাগত । তাঁর বেশ কিছু বই-এর মধ্যে
উল্খেযোগ্য স্মরণীয় " TAGORE AND PINELAND
SHILLONG "
কিভাবে কেটে গেল মুহূর্তগুলো । ফিরে আসার সময় মনটা কেঁপে উঠল । আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে
ফিরতে ফিরতে আমার শুধু একটা কথাই মনে পড়ছিল , লাবণ্যকে ঠিক কোন জায়গায় আবিষ্কার করেছিল অমিত ?
কবিগুরুর শেষের কবিতার 'লাবণ্য ' না রক্ত করবী'র নন্দিনী কার আভিজাত্য একটু
বেশি ? ব্যক্তিত্বে
ভরপুর কে বেশী ? নন্দিনী ? নাকি লাবণ্য ? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে অনেকটা পথ শিলংকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছি , তা খেয়াল-ই করিনি ।
কিভাবে যাবেন ----
শিয়ালদা থেকে গৌহাটি-
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ।
হাওড়া থেকে গৌহাটি - সরাইঘাট
এক্সপ্রেস।
মণিজিঞ্জির সান্যাল