সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সুস্মিতা নাথ


      অন্নপূর্ণার সংসার
                                                                                                                                                                   


        অন্নপূর্ণার জীবনে পূর্ণতা বলতে কিছুই ছিল না। ছেলেবেলাতেই মা-বাবাকে হারিয়ে মামার সংসারে মানুষ। এরপরে বিয়ের পরে বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি। সেখানে দিনের পর দিন শাশুড়ি ও ননদদের নিত্য গঞ্জনা ও স্বামীর উদাসীনতা সইতে সইতে নিট ফল এই হয়েছে যে, অন্নপূর্ণা হয়ে গেছে যেমন খিটখিটে তেমনি কুসংস্কারগ্রস্থ। ভাগ্যদেবীকে বশে আনতে জ্যোতিষ, তান্ত্রিক, তুকতাক, তাবিজ কবচ, পাথর, শেকড়বাকড়েই ওর চরম ভরসা

        অন্নপূর্ণার স্বামী অখিলেশ রাইটার্সে চাকরি করে। নিত্য বারাসাত থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি। অনেকদিনের চেষ্টায় সম্প্রতি কোলকাতায় একটা দুই বেডরূমের ফ্ল্যাট কিনেছে সে। অন্নপূর্ণার বহুদিনের স্বপ্ন সফল হয়েছে। কোলকাতা শহরে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির মালকিন হওয়া মুখের কথা নয়। আহ্লাদে আনন্দে অন্নপূর্ণা মাটির দু-ফুট উঁচু দিয়ে চলাফেরা করতে শুরু করেছে। এতদিনে বুঝি ওর ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল ! শ্বশুরের ঘরের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে অবশেষে মুক্তির স্বাদ।

        অখিলেশ ব্যস্ত মানুষ। অফিস-বাড়ি করেই ক্ষ্যান্ত সে। ফ্ল্যাট কিনেই তার দায়িত্ব সেরেছে। সেই চার দেয়ালের ফ্ল্যাটটাকে থাকার উপযুক্ত করে তোলার ভার সম্পূর্ণ একার কাঁধেই তুলে নিল  অন্নপূর্ণা। উৎসাহে উদ্দীপনায় বিস্তর খাটাখাটুনি করে রঙ মিস্ত্রি, ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি লাগিয়ে ফ্ল্যাট সাজাল সে। নতুন পর্দা, নতুন আসবাবে ঝলমল করে উঠল ওর নতুন সংসার। ঘরে সুখের প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রাখতে ঘটা করে যজ্ঞ করিয়েছে, পুজো করেছে, এমনকী বাস্তুবিদ ডেকে এনে সমস্ত সম্ভাব্য বাস্তুদোষ কাটিয়ে ঘরটাকে বাস্তু অনুকুল করেছে অন্নপূর্ণা। এখানেও শেষ নয়, সুখ আহ্বানকারী শতেক জিনিস, ...সদর দরজার কোনাকুনি হাসিমুখো বুদ্ধ, কাচের গামলায় বাঁশগাছ, যত্রতত্র জলকচ্ছপ-ব্যাঙ আদির মূর্তি, দেবদেবীর ছবি, ওম বা স্বস্তিকা চিহ্ন, পোর্টেবল ফাউন্টেন, অ্যাকোরিয়ামে জোড়া মাছ, ক্রিস্টাল ইত্যাদিতে ভরিয়ে ফেলেছে ঘর। হরেক শুভ-সূচক জিনিসের জিনিসের মাঝে দাঁড়িয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে অন্নপূর্ণা ভাবে, এবারে সুখ কী করে দূরে থাকে সেটাই দেখার।

       কিন্তু নতুন বাড়িতে আসার বছরও ঘুরল না, অন্নপূর্ণার শরীরে লিউকোমিয়া ধরা পড়ল। রক্তে কর্কট ব্যাধি। তখন রীতিমতো শেষ পর্যায়ে এসেছে সে রোগ। অনেকদিন থেকেই মাঝে মধ্যে জ্বরে ভুগত ও। সে জ্বর অযত্ন অবহেলায় দু-একদিন পরে এমনিই সেরে যেত। কেউ কখনও ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। যত্ন করারও প্রয়োজন মনে করেনি।  কিন্তু এবারে সেটা বাড়াবাড়ি হওয়াতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। আর এবারেই রোগ ধরা পড়ল। ডাক্তার বলে দিয়েছে, এটা লাস্ট স্টেজ, আর কিছুই করার নেই।  সে আর মাত্র দিন কয়েকের অতিথি।
       
       ছোটবেলা থেকেই সমস্তরকম না-পাওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল অন্নপূর্ণা। কিন্তু এবারে বড্ড অভিমান হল। সেদিন, ফাঁকা ঘরে হাসিমুখো বুদ্ধ, সমস্ত দেব দেবী, জলকচ্ছপ, ব্যাঙ, অ্যাকোয়ারিয়ামে সোনালী মাছ, --- সবাইকে একসঙ্গে জড়ো করে ঝাঁঝালো স্বরে বলল, এই বুঝি তোমাদের ক্ষমতা? তোমরা সবাই থেকেও আমার কপালে এই ছিল !

হাসিমুখো বুদ্ধ  আর নৃত্যরত গণেশ, দেবদেবীরা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। তারপর প্রায় সমস্বরে বলল, আমরা গৃহস্থের মঙ্গল করি।
      --- হুঃ মঙ্গল ! অন্নপূর্ণা খেঁকিয়ে ওঠে। মঙ্গল করলে আমার এই দশা?
     --- তুমি কে হে? তোমাকে তো চিনি না। এবাড়ি যার, আমরা তাঁর। হাসিমুখো  বুদ্ধ বলে।
     --- বারে ! আমি সারাদিন বাড়িতে থাকি, আর আমাকেই চেনো না?   
      --- না চিনি না। বাড়িতে তো কত লোকই থাকতে পারে, অতিথি, কাজের লোক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, কত কী। আমরা শুধু চিনি মালিককে, সদর দরজার বুকে যার নাম লেখা। আর মালিকের বুকে যাদের নাম ধুকপুক করে, তাদেরও চিনি। তোমার নাম তো ভাই এসবের কোথাও নেই। দরজায় কেবল এ বাড়ির মালিকের নাম লেখা, আর মালিকের বুকে রয়েছে অন্য আরেক নারী। যাকে সে সবসময়ের জন্যে কাছে পেতে চায়। সেজন্যেই পথের যারা কাঁটা তাদের সরে যেতে হবে ভাই।

     --- কী বলছ তোমরা? এই যে আমি তোমাদের এনে ঘর সাজালাম, রোজ ঝেড়ে মুছে তোমাদের সুন্দর করে সাজিয়ে রাখি, এর কোনও দাম নেই? যে তোমাদের আনল, তাকেই উপেক্ষা করছ? মরিয়া হয়ে বলে অন্নপূর্ণা।
      এ কথা শুনে ভাবলেশহীন মুখে হাসল গৃহদেবতা। বলল, রাজার বাগিচায় কাজ করা মালির কি ফুলের অধিকার থাকে? তুমিও যে এ বাড়িতে মালিকিন নয়, মালির মতোই রয়েছ, সে কি আজও বোঝোনি?   
      
       এর মাসখানেকের মধ্যেই অন্নপূর্ণা চোখ বুঁজেছিল। তারও মাস দুয়েক যেতে না যেতেই অফিস কোলিগ চন্দ্রাকে বিয়ে করে ঘরে তুলল  অখিলেশ। অন্নপূর্ণার সাজানো সংসারে সুখেই আছে চন্দ্রা। হাসিমুখো বুদ্ধ, নৃত্যরত গণেশ, জলকচ্ছপ, সোনালী মাছ, জলের গামলায় বাঁশগাছ ইত্যাদি অটুট রেখেছে ওর সুখের প্রবাহ। শুধু অখিলেশের বুকেই নয়, সদর দরজার বুকেও অখিলেশের নামের পাশে  আরও একটা নাম এখন জ্বলজ্বল করে। চন্দ্রা।



 সুস্মিতা নাথ
                                                                                   
সুস্মিতা নাথসুস্মিতা নাথ
সুস্মিতা নাথ