দু’টি মাত্র রঙ । সাদা আর কালো । তাতেই তার
অপার্থিব রূপমাধুরী । সাদা-কালোর বিন্যাসে, দেহের গড়নে, ওড়ার ভঙ্গিতে একটা মোহনীয় আবেশ । দেখলে মনে হয়, একেবারে রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা কোনো পাখির ছবি । মাথা গলা বুক তেল-চকচকে কালো । মাথায় কালো রঙের একটা চূড়াও দেখা যাচ্ছে । ভারি সুদর্শন । গোটা শরীর
শ্বেত-শুভ্র । নীলচে ঠোঁট । চোখের মণিও নীল । লাল একজোড়া পা । তবে যে জিনিসটা বাড়তি সুষমা এনে দিয়েছে, সেটি দীর্ঘ লেজ । গাছের ডালে বসে আছে, এমন জ্যামিতিক আকৃতিতে বেঁকে আছে লেজ, ঠিক যেন রূপকথার বইয়ের কোনো চিত্রকরের তুলিতে আঁকা ছবি ।
শ্বেত-শুভ্র । নীলচে ঠোঁট । চোখের মণিও নীল । লাল একজোড়া পা । তবে যে জিনিসটা বাড়তি সুষমা এনে দিয়েছে, সেটি দীর্ঘ লেজ । গাছের ডালে বসে আছে, এমন জ্যামিতিক আকৃতিতে বেঁকে আছে লেজ, ঠিক যেন রূপকথার বইয়ের কোনো চিত্রকরের তুলিতে আঁকা ছবি ।
দুধরাজ । সবচেয়ে সুন্দর পাখির অন্যতম দুধরাজ । এই ব্যস্ত শহরে কোলাহলমুখর
পার্কে দুধরাজ! বিশ্বাস হয় নি । কাছে গিয়ে দেখতেও ইচ্ছে করছে না । যদি উড়ে যায়! কখন
উড়বে পাখি? অনুপম ভঙ্গিতে হাওয়ায় দুলে
দুলে, স্বপ্ন ভেসে চলার মতো ।
স্বপ্ন ভেসে চলার কথাটা বলেছিল মীরা । হিমালয়ের
পাদদেশে হৃষীকেশ বেড়াতে গিয়ে প্রথম দেখা । গাইড ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘ওই দেখুন, শাহ বুলবুল । আপনারা খুব লাকি, চট করে চোখে পড়ে না এ পাখি ।
স্বর্গের পাখি, আমাদের দুনিয়ায় বেড়াতে এসেছে ।‘
শাহ বুলবুল । সত্যিই রাজকীয় ভঙ্গিমা । উড়ে গেল পাখিটা, তখনই মীরা বলেছিল, ‘দ্যাখো দ্যাখো, ঠিক যেন স্বপ্ন ভেসে চলেছে ।‘
দ্বিতীয়বার দেখা সুন্দরবন বেড়াতে গিয়ে । তখন আর মীরা সঙ্গে
ছিল না । শঙ্কর ছিল সঙ্গে । পাখি-প্রেমিক শঙ্কর । ‘ওই দ্যাখো তপনদা, দুধরাজ । প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার । ঘিঞ্জি এলাকা, শহর,
বাজার এদের পছন্দ নয় । নিরিবিলি এবং
নিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালোবাসে । জোড়াটা দেখেছ? মেয়ে-দুধরাজের চেয়েও পুরুষপাখির সৌন্দর্য অনেক বেশি । দেখছ তপনদা?‘
পাখি দুটো উড়ে গেল একসঙ্গে । মীরার স্বপ্নগুলোর মত করেই
ভেসে গেল দূর আকাশে ।
গাছের আড়ালে নিরিবিলি একটা কুঞ্জে চুপ করে বসে আছে পাখিটা ।
যদিও দুধরাজ স্বভাব-চঞ্চল ।
এসে বসেছিলেন তখনও ঠিকমতো বিকেল হয় নি । বিকেল সাড়ে চারটে
নাগাদ এসেছিলেন । এখন বোধহয় সাড়ে ছ’টা কি সাতটা । মুঠোফোন এসে হাতঘড়ি হারিয়ে গেছে । মুঠোফোনেই সময় দেখা হয়ে যায় ।
আজ অবশ্য সে উপায় নেই । চার্জ শেষ হয়ে মুঠোফোন অচল ।
সাতটা বেজে থাকলেও অন্ধকার হয় নি । এখানে সন্ধে হয় দেরিতে, সকালও । অতনুর ফিরতে দেরি আছে । আটটা তো বাজবেই । তার আগে ঘরে
ফিরলেই হল । ছেলে টের পাবে না ।
হ্যাঁ, এখন এই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে । একা একা কোথাও বেরোনো চলবে না বাবার ।
প্রথমদিন তপনবাবু হেসেই ফেলেছিলেন, ‘চিরটা কাল তো একা একাই বেরিয়েছি রে । তোর মামা-মামী এই নিয়ে কত মজা করে দেখিস না
?’
‘আপনার পায়ের তলায় সর্ষে আছে নাকি তপনদা?’ এই সেদিনও হাসছিল ফুল্লরা ।
অতনু হাসে নি, ‘সে তুমি আগে যা করেছ, যেখানে খুশি ঘুরে বেরিয়েছ, যখন খুশি বেরিয়ে পড়েছ, কারণ কোনো দায়িত্ব নিতে হয় নি । আমার সে নিয়ে কিছু বলার নেই । কিন্তু আমি তো
দায়িত্বজ্ঞানহীন নই । আমার কাছে যখন এসেছ…’ কথা শেষ না করেই উঠে গেছিল ।
‘কিছু মনে কোরো না তুমি, আমি নিজেই আজকাল ওকে চিনতে পারি না তপন’, বিকাশদা ম্লান হেসেছিলেন ।
‘ও আমাকে আর মণিমা বলে ডাকে না, জানেন? মামী বলে ডাকে’, হাস্যমুখী ফুল্লরার চোখ
ছলছল করে উঠেছিল ।
কোনো কথাই ভালো করে কানে ঢুকছিল না তপনবাবুর । কি বলে গেল
অতনু? ‘আমি তো দায়িত্বজ্ঞানহীন
নই’... ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন নই’… অতনু দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে নয় ।
তাহলে দায়িত্বজ্ঞানহীন কে? মামা-মামীকে নিশ্চয় দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে করে না ও ।
মীরা ছোট্ট শিশুটিকে পৃথিবীতে এনেই বিদায় নিয়েছিল, ফুল্লরা কোলে তুলে নিয়েছিল ওকে ।
‘আপনি একা কি করে বড় করবেন ওকে? এইটুকু দুধের শিশু, আপনি তো কিছুই জানেন না পরিচর্যা করার কথা...’ স্বাতী আর অতনুর জন্ম তিনমাসের ব্যবধানে । নিজের গর্ভজাত
কন্যার সঙ্গে আক্ষরিক অর্থে মাতৃদুগ্ধ সেবন করিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছিল মাতৃহারা আরেকটি
শিশুকে । নিজের দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গে কোনো তফাত রাখে নি বিকাশদা ।
সায়ন আর স্বাতীও নিজেদের ভাই ছাড়া অন্য চোখে দেখে নি অতনুকে
। দাদা আর বুনু বলতে অজ্ঞান ছিল অতনুও । স্কুল-কলেজে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট, শিক্ষকদের চোখের মণি, শান্ত সভ্য বাধ্য । ছেলেকে দেখে চোখ
আর মন জুড়িয়ে যেত তপনবাবুর ।
ছ’মাস কি আটমাস পরে পরে দেখা হত । তখন এত ফোনের সুবিধে ছিল না । কর্পোরেট অফিসে
এগজিকিউটিভ পদে চাকরি করে ঘন ঘন ছুটি পাওয়াও সম্ভব ছিল না । তবে নিশ্চিন্ত ছিলেন, মামা-মামীর কাছে সন্তানস্নেহে বড়
হচ্ছে অতনু ।
অবসর নেবার পর ছেলের সাথে একসঙ্গে থাকতে পারব, ভাবনাটা ছিলই । সেই ভাবনা থেকেই
ছেলের কাজের জায়গায় ফ্ল্যাট কিনে রাখা । অবশ্য ফ্ল্যাট কেনার পরই অতনু মামার বাড়ি
ছেড়ে চলে এসেছিল । ফুল্লরা-বিকাশদা কষ্ট পেয়েছিলেন । স্বাতীর বিয়ে হয়ে গেছে, সায়ন বিদেশে থিতু হয়েছে, অতনুই বল ভরসা । খারাপ লেগেছিল
তপনবাবুরও । মামার বাড়ি তো শুধু নয়, আজন্ম ও বাড়িটাই অতনুরও বাড়ি ।
তবে বলেন নি কিছু । ছেলে বড় হয়ে গেলে অভিভাবকদের বিশেষ কিছু
বলার থাকে না । তবে বরাবরের মতই ওবাড়িতেই এসে ওঠেন আজও । অতনুর ফ্ল্যাটে নয় ।
এটুকু সম্মান ওঁদের প্রাপ্য । তবে ছেলের সঙ্গে বরাবরের মতো থাকতে এলে অন্য কথা ।
বিকাশদা ফুল্লরা দুজনেই খুব খুশি, ‘হ্যাঁ তপনদা, এটাই সবচেয়ে ভালো হবে । আপনিই বা আর কতদিন একা একা থাকবেন? আমরাও কাছাকাছি আছি, আপনার কোনো সমস্যা হবে না । চলুন, বুড়ো বয়সে আমরা একসঙ্গে থাকি সবাই
মিলে ।‘
বাবা এসে পাকাপাকিভাবে কাছে থাকবে, সে নিয়ে একটাও কথা বলে নি অতনু । ও কি বুঝতে পারছে না? নাকি বুঝতে চাইছে না?
নাহ, আর বসে থাকলে চলবে না । অতনু ফেরার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে । একটু মজাও পাচ্ছেন
অবশ্য । বড় হয়ে ছেলে বাবা হয়ে উঠেছে । ছোটবেলায় বাবা এমন শাসন করতেন, ‘সন্ধে হলেই বাড়ি ফিরবে
তপন ।‘
বাড়ি ফিরে দেখলেন অতনু ফেরে নি । নিশ্চিন্ত । দুধরাজ পাখিটা মন
ভালো করে দিয়েছে । লবঙ্গ দিয়ে দু’কাপ চা বানিয়ে ফেললেন । অতনুও এসে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ।
‘তুমি চা বানিয়েছ কেন? এসময় আমি কফি নিই । নিজেই বানাই ।’
‘আসলে আমি তো নিজেই... আমি ভাবলাম, অফিস থেকে এসেছিস ক্লান্ত হয়ে...’
‘না, আমার জন্যে তোমায় কিছু
করতে হবে না । এখানে নিজের নিয়মেও চলবে না । সেদিনও তুমি কি একটা খাবার বানিয়েছিলে
।‘
‘আমার অভ্যেস আছে রে, তুই ভাবিস না । সারাদিন একা থাকি, নিজের মত করে সময় কাটাতে শিখে নিয়েছি ।‘
অতনু শুনল কিনা, বোঝা গেল না । ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল । সাড়ে ন’টা নাগাদ ডাব্বাওয়ালা রাতের খাবার নিয়ে আসবে । তখন বেরিয়ে
এসে খেতে বসবে ।
এই আরেক ব্যাপার । বাড়িতে দু’জন মানুষ । এইভাবে দরজা বন্ধ করে থাকার দরকার কি?
একদিন বলেছিলেন, ‘আয় না, একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া যাক ।‘
উত্তর ছিল, ‘আমি এইভাবেই অভ্যস্ত বাবা । আই নীড মাই প্রিভেসি । আর আড্ডা দেওয়া টেওয়া আমার
ভালো লাগে না ।‘
প্রিভেসি, মানে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকা । প্রিভেসি মানে রাতের খাবার সময় বাবার হাত থেকে
রিমোট নিয়ে ইংরেজি সিনেমার চ্যানেল দেখা । বাবা হয়ত একটা খবর দেখছে তখন, কোনো ভদ্রতাসূচক অনুরোধ না করেও
রিমোট নিয়ে নিজের চ্যানেল খুলে বসা । টিফিনবাক্স খুলে নিজের খাবারটুকু নিয়ে বসে পড়া
। বাবা খাবে কিনা, সেটুকুও জিজ্ঞেস না করা । এই অবজ্ঞা কি ইচ্ছাকৃত? ও কি চায় না বাবা এখানে থাকুক? নাকি স্ব-ভাবেই এমন? কে জানে ।
অবশ্য অতনু চিরকালই শান্ত, অন্তর্মুখী । কিন্তু একলষেঁড়ে ভাব তো ছিল না আগে ।
একটা বিয়ে থা হলেই ঠিক হয়ে যাবে । ফুল্লরা-বিকাশদা তাই বলেন
। কিন্তু ছেলে তো বিয়ে করতেই চাইছে না । ‘আপনি এসে আছেন ওর সঙ্গে, খুব ভালো হয়েছে তপনদা । এবার আমরা সবাই মিলে বিয়েটা দিয়ে
দিই’, ফুল্লরা সেদিনও বলেছে ।
সামনের রবিবার, অতনুর ছুটির দিন, এই নিয়ে কথা বলবেন তপনবাবু । অবশ্যই বলবেন । বাবার ওপর অভিমানে যদি ছেলে এমন
একলা হয়ে রইল, তা ভুলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তো তাঁরই
।
কিন্তু চাইলেই কি সব হয়? রবিবার বেলা দু’টো পর্যন্ত দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে রইল অতনু । বিকেল চারটের সময় ভাত খেয়ে কোথায়
বেরিয়ে গেল । একটা সম্ভাষণ নেই, বাক্যালাপ তো দূরের কথা । উনত্রিশ বছরের একটা ছেলেকে তো আর জোর করে কথা বলানো
যায় না ।
পায়ে পায়ে হেঁটে তপনবাবু পার্কে এসে বসেছেন তাই । একা একা
কতক্ষণ আর ঘরে বসে থাকা যায়!
মনটা একেবারেই ভালো নেই । ছেলেটা কি অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে? মামার বাড়িতে ছিল, সে একরকম । ফুল্লরা জোর করে কথা বলত, খেয়াল রাখত । আজ যদি মীরা থাকত!
ছেলেকে জোর করে কথা বলে স্বাভাবিক রাখতে পারত । মেয়েরা পারে, মায়েরা পারে ।
আজ অনেকদিন পর মীরার অভাব বড্ড অনুভব করছেন তপনবাবু । সবাই
বলেছিল... মা-বাবা দিদি-জামাইবাবু ভাইয়েরা-ভাইবৌরা সবাই, বিকাশদা-ফুল্লরাও... ’একটা বিয়ে করো, এমনভাবে একলা জীবন কাটানো যায় না ।‘
ইচ্ছে হয় নি । মীরার জায়গায় অন্য কেউ! অতনুর মাযের জায়গায়
অন্য কেউ! ছেলেটা নিজের মাকে পেল না, মাযের মতো কাউকে আনার ইচ্ছে হয় নি । উচিত ছিল কি সেটাই? তাহলে কি ছেলেটা স্বাভাবিক পরিবারের স্বাদ পেয়ে অন্যরকম হত? না,উল্টোটাও হতে পারত । নিজের মা তো নয়, হয়ত আরো কষ্ট হত ছেলের । তাছাড়া
স্বাভাবিক একটা পরিবারেই তো বড় হয়েছে অতনু ।
অন্যমনস্ক ছিলেন, সময় খেয়াল থাকেনি । বাড়ি ফিরতে সন্ধে । ছেলে নিশ্চয় রাগ করবে আবার ।
চাবি দিয়ে দরজা খুলল না । ছেলে ভেতর থেকে লক করে রেখেছে ।
তিনবার কল-বেল বাজানোর পর অধৈর্য হয়ে ফোন করবেন, ছেলে দরজা খুলে দিল । ‘আবার বেরিয়েছ?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে হেসে বলবেন, ‘রাগ করিস না রে, এই তো সামনের পার্কে বসেছিলাম’… ভেবে রেখেছিলেন । কিছুই বলল না অতনু । রাতের খাবার সময়ও কোনো কথা নয় ।
বড় অসহায় লাগছে । নিরুপায় । কমিউনিকেশনের কোনো উপায় থাকলে
তো নিজের কথা বলা! অপমানবোধও হচ্ছে । মাথা উঁচু করে বেঁচেছেন আজীবন । আত্মীয়পরিজন
বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশী সহকর্মী সবাই সজ্জন ভদ্রলোক বলেই সম্মান করে । এই অবজ্ঞা, এই অসম্মান কি প্রাপ্য? নিজের ছেলের কাছে? যাকে কিনা আত্মজ বলে?
তবে কি কোনো মানসিক সমস্যা? আজকাল এসব নিয়ে বেশ আলোচনা লেখালেখি হয় । এই একা হয়ে যাওয়া, কথা না বলা, উইথড্রয়াল সিম্পটম বলে যাকে, কোনো মানসিক অসুখ নয় তো? ডিপ্রেশন বা অন্য কিছু? কাল বিকাশদার সঙ্গে কথা বলতে হবে । সেইমতো কোনো
সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে ।
মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক.. কথাটা সকালে আবার প্রমাণ হয়ে গেল । সকাল সকাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে
একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন তপনবাবু । অতনু অফিস বেরিয়ে গেলে বিকাশদার বাড়ি যাবেন ।
অতনুর ঘরের জানলার লাগোয়া বারান্দাটা । কানে এল, কাউকে ফোনে বলছে অতনু, ‘সারাজীবন দায়িত্ব নেয় নি, মামাদের ঘাড়ে ফেলে
দিয়েছে । এখন আমার ঘাড়ে এসে উঠেছে । কিছু বলতেও পারছি না । বাট নো প্রিভেসি, নো ফ্রিডম... আই অ্যাম জাস্ট স্টাক
। আমি কি এইজন্যে ওই মামাবাড়ি ছেড়ে শিফট হয়েছি?‘
কার কথা বলছে? বাবাকে নিয়ে এতটা অসহিষ্ণু অতনু?
‘না না, হার্ড নাট । একটা কথা শোনে না । অ্যাপার্টমেণ্টে
থাকার সভ্যতা জানে না, যার তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করে, এতটুকু স্ট্যাটাস-কনশাসনেস নেই... সেদিন দেখলাম সিকিউরিটি ছেলেটার সঙ্গে
দাঁড়িয়ে গল্প করছে । বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে... কোথাও অ্যাক্সিডেণ্ট
ফেণ্ট বাধালে ঝামেলাটা কে সামলাবে...’
আর শোনা সম্ভব হল না । সিগারেট ফেলে দিয়ে ঘরে ঢুকে এলেন ।
ঘর আর কোথায়, এটা অতনুরই ঘর । রাজ্যের জিনিস ডাঁই
করে রাখা । বাবা থাকবে বলে আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই । বিকাশদাই একটা সিঙ্গল বেড পাঠিয়ে
দিয়েছেন ।
চলে যাব । চলেই যাব আমি । ছেলে বাবার এই থাকতে আসা যখন ভালো
মনে নেয় নি, এখানে থেকে ছেলেকে অসুবিধেয় ফেলার
দরকার নেই । সারাজীবন একা একা কেটেছে, শেষজীবনও একলাই কাটুক । পাখিদের তো ঘরসংসার থাকে না । ওই একলা দুধরাজ পাখিটা
যেমন । ওর সঙ্গেও তো মেয়ে-পাখিটা ছিল না । একা একাই উড়ে বেড়াচ্ছে দেশ বিদেশ । সারাক্ষণ
গাছে থাকে । মাটিতে নামে না কখনও । উড়ন্ত পোকামাকড় ধরে খায় ।
তপনবাবুও তাই থাকবেন । না-ই বা হল ছেলের সঙ্গে গৃহস্থালির
সুখ । একটেরে বাসস্থানটা তো আছেই । আর আছে পায়ের তলায় সরষে । এই ভালো হল । শুধু
শুধু ছেলের ওপর দায় চাপানোর কোনো মানে নেই । তবু এক ঝলক জল এলো চোখে । এই হয়েছে
এখন । বুড়ো বয়সের দোষ । কথায় কথায় আবেগ ।
বাবা মা, কাকা কাকিমা । পিসিরা, তাঁদের ছেলেমেয়েরা । নিজের সাত বোন, তিন ভাই । সবাই ‘তপন’ বলতে, ‘মেজদা’ বলতে অজ্ঞান । সবার পড়াশোনা, বিয়ে, চাকরি, সংসার । সবার জীবনে অবদান । ওই পাখিটার মতই রক্ষা করেছেন
সবাইকে । শুধু রূপ দিয়ে তো চলে না, কঠিন দুনিয়ায় বাঁচতে হলে বুদ্ধি আর সাহসও থাকা চাই । তা পর্যাপ্ত আছে দুধরাজের
। শত্রুভাবাপন্ন কেউ বাসার কাছাকাছি এলে যেমন বাজ ফিঙে
বা অনেক বড় পাখিকেও এরা তাড়িয়ে বেড়ায় । সে কারণে অনেক নিরীহ পাখি এদের বাসার কাছে
বাসা তৈরি করে । তপনবাবুর জীবনের মতই । সবাইকে জড়িয়ে, তাদের ভালোমন্দের দায় নিয়ে এতদিনের
যাপন ।
আজ জীবনের নিয়ম মেনেই সবাই যে যার বৃত্তে । কিন্তু মেজদার
প্রতি সম্মান, ভালবাসায় ঘাটতি দেখায় নি কেউ । আজ
নিজের ছেলে এতখানি অপমান করল!
কখন বেরিয়ে গেছে অতনু । প্রথমদিকে যাবার সময় একবার বলে যেত
। আজকাল সেটুকু ভদ্রতাও করে না । তৈরি হয়ে নিজেও বেরোবেন তপনবাবু । টিকিট কাটতে
হবে । ফেরার টিকিট । কাল পরশু যত তাড়াতাড়ি টিকিট হয় । বিকাশদা-ফুল্লরাকেও জানিয়ে
যেতে হবে ।
দরজা খুলছে না কেন? টানাটানি করেও কিছু হল না । অ্যাপার্টমেণ্টের নিচে একটি
সিকিউরিটি গার্ড থাকে । নামেই সিকিউরিটি, ঢাল তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার । আসলে দারোয়ান । তাকেই ফোনে কল করলেন । বাইরে
থেকে যদি খোলা যায় ।
ছেলেটা বলল, ‘বাইরে থেকে তালা লাগানো আছে স্যার । চাবিটা ব্যালকনি থেকে ফেলুন, আমি দরজা খুলে দিচ্ছি ।‘
বাবাকে তালা বন্ধ
করে রেখে গেছে ছেলে । বাবা যাতে বাইরে বেরোতে না পারে, তার সংসারের ছন্দ ভেঙে ফেলতে না পারে । মুখে বলে হয় নি, আজ তাই বন্ধ করে রেখে গেছে । ছেলে
জানে না, বাবার স্বভাব পাখির মতো । দুধরাজ
পাখির মতই চঞ্চল
স্বভাব । একদণ্ড স্থির হয়ে বসার জো নেই । বাবার স্বভাব না-ই জানুক, যে ছেলের নিজের ফ্রীডম
নিজের স্পেস নিয়ে এত জোরালো দাবি সে অন্য একজন স্বাধীন মানুষকে তালা বন্ধ করে আটকে
রেখে যেতে পারে?
এই তো গড়পড়তা জীবন । তারপর স্বর্গের পাখির
স্বর্গের দিকে যাত্রা । এইটুকু জীবনে এত অপ্রাপ্তিও ছিল!
গল্পটা এখানেই শেষ । যদিও গল্পের মধুরেণ সমাপয়েত্ হয় নি
। পরের দিনই ফিরে এসেছিলেন তপনবাবু । কাউকে কিছু বলেন নি । ছেলেকে নয়, বিকাশদা ফুল্লরাকেও নয় । বিকাশদা
অবাক হয়েছেন, ফুল্লরা অভিমানী । তপনবাবু নি:শব্দ
থেকেছেন । কি বলবেন! স্নেহ যে নিম্নগামী । একা একাই পাখি উড়ে বেরিয়েছে ।
তারপর একটা পুনশ্চ । অতনুর অফিসে একটা মস্ত সম্মান পাওয়ার
কথা জেনেছেন ফুল্লরার কাছে । পুরষ্কার পাবার অনুষ্ঠান টিভিতে দেখেছেন । আজ সেই
অনুষ্ঠানটাই পুন:সম্প্রচারিত হবে ন্যাশনাল একটি টেলিভিশন চ্যানেলে । টিভি খুলে
বসেছিলেন । স্নেহ যে নিম্নগামী ।
দরজা খুলে ঢুকে এল কে! ও, টুকু । খুড়তুতো এই ছোট বোনটা ‘মেজদা’-কে বড্ড ভালোবাসে । প্রায়ই হাতে করে নিয়ে আসে টুকটাক রান্না, মোচা দিয়ে ছোলার ডাল-ধোকার
ডালনা-ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক । আনারসের চাটনি-তালের বড়া-সুগন্ধি পায়েস ।
‘কি রে? আজ কি এনেছিস?’
উত্তর না দিয়ে হাসল টুকু । দরজার দিকে
তাকিয়ে বলল, ‘আয়, আমি বলছি তো কিছু হবে না ।‘
অতনু । মাথা নিচু করে এসে দাঁড়িয়েছে সেই ভুলে যাওয়া
ছেলেবেলার মতো ।
‘কাল অনেক রাতে এসেছে । আমি তো অবাক । কি হয়েছে
জানো মেজদা? একটা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল না? তুমি বলেছিলে, আমরা সবাই টিভিতে দেখলাম । সেদিন ওর সঙ্গেই অ্যাওয়ার্ড পাবার কথা একটি ছেলের... কি যেন নাম বলল... সে ছেলেটা নাকি অমন
প্রেস্টিজিয়াস অ্যাওয়ার্ড পাবার দিন সব ছেড়ে বাড়ি চলে গেছে । মাযের অসুস্থতার খবর
পেয়ে । এমনটা যে কেউ করতে পারে, মাযের জন্যে অমন একটা অনুষ্ঠান, লাইফটাইম অ্যাচিভমেণ্ট ছেড়ে যেতে পারে! ভাবো একবার! আজকের দুনিয়ায় এমন ছেলেও
আছে!’
আবেগটা সামলে নিল
টুকু, ‘যা বলছিলাম । আসলে... তারপর
থেকেই আমাদের ছেলেটা....’
কোন গভীরে যে
বাসা বেঁধে থাকে সংস্কার, পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষা, জিনগত উত্তরাধিকার ।
বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারছে না । ছেলেবেলার
অতনুর মতই । দুষ্টুমি করে ধরা পড়লে এমনিই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকত । চিরকালই কম
কথা বলে, ভাষার ব্যবহারে ক্ষমা
চাইবার ক্ষমতা নেই ওর ।
একটি লম্বা লেজওয়ালা মরিচা লাল রঙের পাখি । নবীন দুধরাজ । ডিম থেকে ফোটার পর হালকা গোলাপী রঙ । শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যখন সে যুবক, তখন বদলে যায় । সাদা-কালোয় হয়ে ওঠে স্বর্গীয় কান্তিমান । এই রূপটি পেতে হলে পুরুষ-দুধরাজকে অন্তত তিনটি বছর পার করতে হয় ।
এবার দুধরাজের স্ব-রূপে ফেরার সময় হয়েছে ।
আইভি চট্টোপাধ্যায়