উজান, আমি রুণি! তোর থেকে কত হাজার কিলোমিটারের দূরত্বে বসে
আছি আজ। কতদিন হয়ে গেল উজান।ছুঁইনি তোকে। তোর গায়ের গন্ধ পাইনি। আট মাস কেটে গেছে
তুই অনেক দূরে সাত সমুদ্র পারের দেশের বাসিন্দা। তারপর থেকে শুধু তোর গলা শুনেছি।
আর মোবাইলের স্ক্রিনে দেখেছি কথা কওয়া ছবিটা--।
কিন্তু সেও তো কতকাল হয়ে গেল রে। সেই যে
ভুল দিনটা এল---বিচ্ছিরি দিনটা---তার পর থেকে যখনই কল করেছি, মোবাইলটা বেজে বেজে
থেমে গেছে। একটা যান্ত্রিক গলা উপদেশ দিয়েছে যেন পরে ফোন করি। এখন নাকি তুই ধরা
ছোঁওয়ার বাইরে। যতবার ফোন করি, সেই একই কান্ড। কিন্তু তারপরেও তুই কল ব্যাক করিসনি
একবারও!
জানিস তো আজ একটা দিনের কথা মনে পড়ছে খুব। তখন তুই
সদ্য সদ্য ওদেশে গেছিস---বেদম মন কেমন করে তোর জন্যে---একদিন, অফিসে তুমুল ব্যস্ততার সময় সেটা বুঝলি। বস ডেকে
পাঠিয়েছেন। এমন সময়ে হঠাৎ হোয়টস্ অ্যাপে তোর ভয়েস মেসেজ এলো। আর আমি---আমি দেখেই সোজা
ওয়াশ রুমে দৌড়---। কানে ইয়ার প্লাগ্ গুঁজতেই গমগম করে উঠল তোর ভরাট গলা—নিদ নাহি আঁখিপাতে
তুই তো জানিস বরাবর বড্ড দুঃখু আমার। গান গাইতে
পারি না বলে। কিন্তু গান কি ম্যাজিক জানে রে! তাজ্জব বনে যেতে হয়। আমি না সব ভুলে
গেলাম। বসের ডাক, কাজের চাপ--- এমনকি এই শ্যাওলাপড়া ওয়াশ রুম, চারপাশের ঝাঁঝালো
দুর্গন্ধ, জলের দাগ লাগা আয়নাটা পর্যন্ত উধাও হয়ে গেল চক্ষের নিমেষে। আমি পৌঁছে
গেলাম তোর সাগর পারের দেশে। যেখানে নাকি তখন গভীর রাত! বৃষ্টি---বৃষ্টি---বৃষ্টি---একটানা
বৃষ্টি—ডাকিছে দাদুরি
মিলন পিয়াসে---
হ্যাঁ রে উজান---ওখানে সত্যি সত্যি দাদুরি আছে?
ডাকে তারা? দেখেছিস সুরেরই মতো শব্দেরও
কেমন ম্যাজিক--- ব্যাঙ ডাকছে বললেই মনে হয়---- এম্মা ছ্যা ছ্যা ছ্যা— ঘ্যাঙোর ঘ্যাঙ---কিন্তু দেখ যেই তার নাম দেওয়া হোল
দাদুরি---অমনি সেই ঘুম না আসা বৃষ্টির রাত---দুজন ভালবাসার মানুষের একলা থাকার মন
খারাপ---সব কিছুর সঙ্গে সেও দিব্যি খাপ খেয়ে গেল।
সেই দিনটার পরে এল আর একটা দিন। সেই বিচ্ছিরি
দিনটা। অনেকখানি নষ্ট সময়। কেন সেদিন আমাদের ঝগড়া হয়েছিল, কি নিয়ে হয়েছিল, কার
কতটা দোষ ছিল---এসব প্রশ্ন যদি আমাকে করিস---আমি না এক্কেবারে ভ্যাবলার মতো চেয়ে
থাকব বিশ্বাস কর। সত্যি সত্যি আমি সব ভুলে গেছি রে---। কি করব বল! সত্যিই ভুলে গেছি। আর তাই তারপর
থেকে রোজ রোজ অপেক্ষা করে থাকি তোর ফোন কলের জন্যে।
ফোন বাজে না। আমার খালি খালি মনে পড়ত তোর গাওয়া
সেই গান,-
প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায়---ফাগুন মাসে---কি
উচ্ছ্বাসে----ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা---ক্ষান্ত কূজন শান্ত বিজন
সন্ধ্যাবেলা---প্রত্যহ সেই ফুল্ল শিরীষ---প্রশ্ন শুধায় আমায় দেখি---এসেছে কি?---আর
আমাকে সেই একই উত্তর দিয়ে যেতে হয় বারবার,-আসেনি আসেনি আসেনি----
তুই তো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট---সব্বাই বাহবা
দিয়ে বলত, অসাধারণ স্মরণশক্তি নাকি তোর! আর তুই! তুই তো সে সব শুনে এক্কেবারে
আল্লাদে আটখানা হয়ে নাচতিস। বুদ্ধুরাম
কোথাকার! তুই কি বুঝিস যে স্মরণশক্তির মতোই বিস্মরণশক্তির চর্চা করাটাও মাঝে মাঝে
খুব জরুরি। নয়তো অনেক অনেক অনেকখানি সময় শুধু শুধুই নষ্ট হয়ে যায় রে।
শোন একটা কথা বলি। আজ কিন্তু দোল। তুই বিদেশ
যাবার পরে এই প্রথম দোল। প্রত্যেকবার সারাদিন সকলে মিলে পাগলের মতো রঙ খেলার পরে
কি রকম ভুতুড়ে চেহারা হোত আমাদের। আজ
কিন্তু খেলিনি। ওরা সবাই এসেছিল। পূর্বা, জয়, পিউ, রুরু সব্বাই। আমি বলেছি আমার
জ্বর হয়েছে। আমি খেলব না--- আর উজান, সারাদিনের হুল্লোড়ের পরে সন্ধ্যেবেলায় আমরা
গিয়ে বসতুম পুরনো শিব মন্দিরের সামনে ভাঙা বেদির উপর---তখন আর কেউ নয়—শুধু তুই আর আমি। আজ আমি এখন একলাই এসে বসেছি এখানে। আকাশে
জ্বলজ্বল করছে মস্ত চাঁদ। কি যেন একটা
ফুলের অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ বেরচ্ছে। ঠিক সেইরকম। আর তুই গাইতিস না---“ঝরঝর ঝরো ঝরো ঝরে রঙের ঝর্ণা----নিত্যনবীনবর্ণা”
এইটুকু গেয়েই থেমে যেতিস তুই। আমি তখন বলতুম
কিরে থামলি কেন! পুরোটা গা---তা তোর তো আবার বরাবরই ভাও দেখানো স্বভাব---তাই গা না
গা না—করে অনেকক্ষণ
সাধাসাধি করতে হোত---এসব মনে আছে তোর---না কি ভুলে মেরে দিয়েছিস---কতবার বলেছি
না---যা মনে রাখার মতো সেগুলোই শুধু মনে রাখবি বাকিগুলো নয়—দেখ তো আমার কি
পরিষ্কার মনে পড়ছে, নিজের প্রচুর দর টর বাড়িয়ে তুই আবার গানের শেষটুকু ধরতিস, হ্যাঁ রে সেই সুরের রেশ ভেসে আসছে এখনও---তার
কলধ্বনি ----আনন্দগান ধর্ না--
মহুয়া চৌধুরী