হয়তো এমনটাও হয়
আজ আমি খুব ক্লান্ত। আসলে ক্লান্তিটা ঠিক শরীরে নয়,মনে।
কালকের পুরো একটা দিন আমাকে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার আস্বাদ দিয়ে গেছে।
যদিও আমি আজ নিশ্চিন্ত। অনেকদিন ধরে একটা কাজ শেষ করতে
চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি।
অবশেষে গতকাল তা নির্বিঘ্নে শেষ করতে পেরেছি। হ্যাঁ
আমি আর পারছিলাম না। নিজের চাওয়ার বিপরীতে যেতে।
সে চাওয়া নিষিদ্ধ বলেই এতটা টেনেছে আমাকে। তবে কাল
আমি দেখলাম মানুষের মন কত ভিন্ন হয়। সেই মনের
চলন কত বিচিত্র। আপাত শান্ত কনকনে ঠান্ডা ঘরটার
মধ্যে যারা আছে তাদের কেন্দ্র করে তাদের পরিবার,প্রতিবেশীদের মধ্যে যে নিদারুণ
দ্বন্দ্ব চলে তা আমি নিজের চোখে না দেখলে তাদের কথা কাছ থেকে না শুনলে অনেককিছুই
অজানা থেকে যেত।
হাউহাউ করে কাঁদছে একজন মাঝবয়সী মহিলা।
এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে তার কাছে যাই।
‘শান্ত হন। এত
কাঁদবেন না। কে?’
‘আমার মেয়ে। কেন এমন
করলো জানি না। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।’
‘কীভাবে ?’ অনুচিত জেনেও কৌতূহল চাপতে পারি না আমি।
‘বিষ খেয়েছে। পরশু
রাতে একসঙ্গে আমরা মা-মেয়ে খেয়ে শুতে গেছি। তারপর
কখন যে মাঝরাতে উঠে এই কান্ড ঘটিয়েছে তা একেবারে টের পাইনি।
সকালে ঘুম ভেঙে দেখি মেয়েটা পাশে নেই। ভাবলাম
বাথরুমে গেছে। কিন্তু না।
সেখানেও নেই। তারপর দেখি রান্নাঘরের দরজা বন্ধ।
কিন্তু সে যে জম্মের শোধ দরজা লাগিয়েছে তা তখনো বুঝিনি।
শেষে লোক ডেকে দরজা ভেঙে মলিকে বের করলো। ততক্ষণে
মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরিয়ে মেয়ে শেষ।’হাউহাউ করে আবারও কেঁদে ওঠেন মহিলাটি।
‘মলি নাম ছিল বুঝি?’
‘আমি ডাকতাম মলি বলে। ও ছিল ওর
বাবার মল্লিকা। ওর
বাবার খুব ফুলের নেশা ছিল। আর সেই
ভালবাসা থেকেই মেয়ের এমন নাম। সেই
মানুষটাও আজ আর নেই। তাই এখন ও শুধুই মলি’।
‘আরে ওই ত মলির মা বসে আছে।
কি মাসীমা? বসে
বসে কাঁদলে চলবে? ভিতরে
গিয়ে তো কথাবার্তা বলে দেখতে হবে,কখন বডিটা ছাড়বে।’
চার-পাঁচজন লোক এসে বেশ চড়া গলায় ওই মহিলার সঙ্গে কথা বলে।
দেখে তো মনে হয় পাড়া প্রতিবেশী হবে।
‘মেয়ে যখন চারদিক ঢলিয়ে বেড়াত তখন হুঁশ ছিল না মায়ের।
আর থাকবেই বা কেন। দিব্যি ভালমন্দ খাওয়া,রঙবেরঙের পরা।
হুঁশ করলে তো এসব হতো না। এসব তো হবারই ছিল।
এখন নাকী কান্না কেঁদে লাভ কী!’ওদের মধ্যে একজন রাগে গজগজ করে কথাগুলো বলে ফেলে।
আমি অবশ্য শুনতে চেয়েছি বলেই শুনেছি। খারাপ
লাগছে। ওই মলির জন্য নয়।
তার মায়ের জন্য। এই বয়সে তাকে স্বামীহারা, কন্যাহারা
হয়ে একা বেঁচে থাকতে হবে।
চোখ চলে যায় লম্বা করিডোরের শেষ মাথায়। দেখি
করিডোরের শেষ মাথার দিক থেকে একজন প্রৌঢ়মানুষ হেঁটে আসছেন।
হেঁটে আসছেন বললে ভুল বলা হবে। দুজন মানুষকে
ভর দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো বিক্ষিপ্ত পা ফেলে এগিয়ে আসছেন।
ভদ্রলোকটিকে সামনের বেঞ্চে ধরে ধরে বসালো ছেলেদুটো।
‘না,
না। আমার শুভ
হতেই পারে না। তোমরা যাও।
আমি দেখতে পারব না।’প্রৌঢ়
বলে উঠলেন।
‘আচ্ছা মেসোমশাই,আপনি বসুন।
আমরা আগে একটু কথা বলে দেখি।’
তাকিয়ে দেখি ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলে
যাচ্ছেন। পাশে গিয়ে বসি আমি।
শিরা ওঠা রোগা আঙুলগুলোর ওপর আলতো করে হাত রাখি।
হয়তো সে ছোঁয়ায় কোন ভরসা ছিল।
‘আপনি বলুন,এ কখনো শুভ হতেই পারে না।
কিছুই হয়নি। ও বাইক চেয়েছিল।
ওর মা বলেছিল এখন তো সম্ভব না। তোর
জামাইবাবু মাস দুয়েক পর লোনের ব্যবস্থা করে দেবে।
তখন কিনিস।’
‘তাতে শুভ রাজী হয়েছিল?’ নিজের প্রশ্নে নিজেই অবাক হই।
যেন আমি শুভকে চিনি। তার মা, বাড়িঘর
সবটুকু যেন পরিচিত।
‘না বাবা। রাগে
চিৎকার করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে শুভ। কিন্তু
তা বলে ও এই কারণে রেললাইনে মাথা দেবে !!’
অপরিসীম বিস্ময় প্রৌঢ়ের চোখেমুখে।
তাঁর জীবন দর্শন তো বলে না যে এত তুচ্ছ কারণে কেউ তার জীবনে এত বড় বাজী ধরবে।
‘বাবা,এ আমাদের শুভ নয়। আপনি
চলুন এখান থেকে।’
‘বলেছিলাম আমি তোমাদের।
শুভ এমন কাজ কক্ষণো করতে পারে না।’
শেষ মুহূর্তে হারা বাজি জিতে যাবার উচ্ছ্বাস প্রৌঢ়ের
চোখেমুখে।
‘চুপ একদম। মুখ বন্ধ
করে বসে থাকবি সব। যখন বাড়ীর বউকে মেরেছিলিস তখন মনে ছিল না ?’
একদল পুলিস। মহিলা
পুলিশও আছে সঙ্গে। একটি ছেলে,আর বাকি দুজন সম্ভবত তার বাবা-মা
হবে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বুঝলাম
বধূ নির্যাতনের কেস। আসলে আমার নিজের মধ্যেও তো ছটফটানি
কিছু কম নেই। তা সত্বেও সেই অস্থির অবস্থা যেন কারোর চোখে
না পড়ে সেই চেষ্টাও ধরে রাখতে হচ্ছে। তাই
স্থির হয়ে কোথাও বেশিক্ষণ বসতেও পারছি না। ছেলেটা কাঁদছে।
কিন্তু তার বাবা মায়ের চোখে জল নেই। বরং বেশ
নির্বিকার।
‘কী করে হলো মা ? পল্লবী তো বেশ সাবধানী মেয়ে।’
‘কী করে বলি বলতো বাবু ? আমরা তো আমাদের ঘরেই ছিলাম।
হঠাৎ ভীষণ রকম আওয়াজে আমরা ঘরের বাইরে এসে দেখি বৌমা সিঁড়ির মুখে পড়ে আছে।
কিন্তু একটা কথা বল তো। এতে আমাদের দোষ কোথায়? বৌমার
দাদা,মা
আমাদের এভাবে ফাঁসিয়ে দিল।’
‘মা,আমরা
দোষ করিনি যখন ঠিক ছাড়া পেয়ে যাব। কিন্তু পল্লবীকে
আমি সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেললাম। এখন মনে
হচ্ছে আমি ট্যুরে যাবার সময় ও বাপেরবাড়ীতে গিয়ে থাকতে চেয়েছিল।
সেটা হলে আজ এমন . . ’ ঘনঘন মাথা
নাড়ে ছেলেটা।
ভাসা ভাসা কথা আর মানুষগুলো কে দেখে মনে হয় ছেলে তার বউয়ের
মৃত্যুতে কাতর হলেও তার বাবা মা নয়। হয়ত
ছেলের অনুপস্থিতিতে পল্লবীর মৃত্যুতে তাদের কিছু হাত আছে।
‘দাদা,একটু শক্ত হও। বৌদির
কথাটা ভাবো।’
‘কী করব বল রবি, আমাদের প্রথম সন্তান মণি।
তার এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছি না।’
‘নিয়তির ওপর আমাদের কারোর কোন হাত নেই।
আমাদের ধরেই নিতে হবে মণি ঠিক এই কটা দিনের জন্য আমাদের সঙ্গে থাকতে এসেছিল।’
‘ফুটফুটে ছেলেমেয়ে দুটোর কথা ভাব।
এই বয়সে মাকে হারিয়ে কিভাবে থাকবে ? সমীরের এত কম বয়স।
সে কি পারবে শুধু মণির স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকতে ?’
‘দাদা, এখনই এত কিছু ভেবো না।’
‘কে ? ও রিনি ? হ্যাঁ বল।
‘না রে সময় লাগবে। মিটে
গেলে আমি কল করছি তোকে।’
ওপ্রান্তের কোন রিনির সঙ্গে কথা হয় রবি নামক ব্যক্তির সঙ্গে।
তারপর তার মুখে একটা আলো খেলে যায়।
‘তুমি চিন্তা কর না দাদা।
আমি সবটুকু ঠিক যাতে থাকে তার আপ্রাণ চেষ্টা করব।’
বুঝতে চেষ্টা করি। রিনি কী
মণির বোন? না,না।
এভাবে সব অঙ্ক এত সহজে মেলানো যায় না। আমাকে
যারা এতদিন ধরে দেখে আসছে তারা কী কোনদিন অন্যারকম কিছু ভাবতে পারবে আমার সম্বন্ধে? আজ যেন
কনফিডেন্সটা লস করছি। অথচ গত কয়েকমাস ধরে একটু একটু করে
প্ল্যান করেছি। তার টোট্যাল ইমপ্লিমেন্ট করেছি।
‘কীরে তুই কোথায় কোথায় ঘুরছিস?তোকে আমরা
ফোনে ট্রাই করে যাচ্ছি। তোর ফোন বেজে যাচ্ছে।
ধরছিলিস না কেন ?’
আমার বন্ধুরা এসে গেছে।
ওরা আমায় ফোনে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে গেছে। সদ্য
আমার পত্নীবিয়োগ হয়েছে। তার বডি এখনো পোস্টমর্টেম করে
হাতে পাইনি। তাই আমার এত চিন্তা।
‘পোস্টমর্টেম হয়ে গেছে।
বডি দিয়ে দিয়েছে। আর দেরী করা ঠিক হবে না।
চল।’
কাঁধে হাত রাখে তরুণ।
সহানুভূতির স্পর্শ পাই আমি। বড়
করে শ্বাস ছাড়ি। যাক্, তাহলে কাজটা কোনরম ভুল না করে
সুচারুরূপে করতে পেরেছি।
আসলে ওদের বলি কি করে? এই সহানুভূতি আমার প্রাপ্য নয়।
ফোন তো আমি সাইলেন্ট করে দিয়েছি আগেই। নানা
লোকের কথা আর তাদের দেখার মাঝে আমি মুক্তির নিঃশ্বাসটা একটু একটু করে নিতে
চাইছিলাম।
অবশ্য এখন আমাকে শোকাচ্ছন্ন থাকতে হবে।
তপতীর শেষক্রিয়াটুকু মন থেকেই করতে চাই। তারপর
সমস্ত সম্পত্তি হাতে পাবার পর আমি আর তনয়া
. . .হাল্কা হাসি ফুটে বেরোবার আগেই লুকিয়ে নিই।
এখন আমার চারদিকে শুধুই স্বপ্ন, নানা রঙের ভেসে বেড়ানো সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন . . .
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়