নৈসর্গিক
অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড,
হাঙ্গেরির ভয়ংকর সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলি দেখি। নৈসর্গিক
সৌন্দর্য কল্পনা করি সেই সব অঞ্চলের। যাঁরা গেছেন, প্রত্যক্ষ
করেছেন সেই সব অঞ্চলের সৌন্দর্য, অনুভব করেছেন প্রকৃতির
মায়াস্পর্শ-- তাঁদের সৌভাগ্যকে ঈর্ষা হয়। এক একটা পোস্টকার্ড, এক একটা ক্যানভাস... অথবা এসব কিছুই
যথেষ্ট নয়। কী বিশাল, কী গম্ভীর, ইডেন
বা প্যারাডাইস হয়ত এমনই কিছু হবে-- ছবি বা ভিডিওর দৃশ্যপট দেখে কল্পনা করি। মাঝে
মাঝে মনে হয়, খাসির মাংসের দোকানের সামনে বুভুক্ষু কুকুরের
মত বসে আছি। দীননাথ, দোকানের মালিক নাসের আলি হয়ে রাং অথবা
গর্দান থেকে কেটে ছুঁড়ে দিক। আজ নয় তো কাল, কাল নয় তো
পরশু... দোকান বন্ধ করার আগে।
লোভ, অপূর্ণতা
আর মাৎসর্যের কথা সরাসরি স্বীকার করছি। হাসপাতালের বেডে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে যা
কিছু মনে পড়ত... বা যে সব সিঁড়িভাঙা অঙ্কের ধাপে ধাপে এগনোর পথ খুঁজতাম... কিছু
কথা খুব স্পষ্ট করে দিয়েছিল মনে। সেসব এখন আর আঁকশি দিয়ে পেরে নামাতে চাই না।
কিন্তু রিপুর অস্তিত্বকে সপাটে অস্বীকার করার ওপর-চালাকিটা বিরক্তিকর লাগে। অন্ততঃ
আমি আর চাই না ওটা করতে। যা পায়, তা পায়। যা নেই, তা নেই। যা হলে ভালো হত, তা হলে ভালো হত। হাসপাতালের
সামনে সুন্দর সবুজ ঘাসে ঢাকা বাঁধানো পার্ক। অথচ ফাঁকা পড়ে থাকে। জানলা দিয়ে রোজ
সকালের রোদ নেমে আসতে দেখতাম সেই সবুজে। অথচ কাউকে দুদণ্ড বসতে দেখতাম না। এক
চিলতে সবুজ মনের কোথাও এভাবেই ফাঁকা পড়ে থাকে, পরিত্যক্ত।
আগাছা জন্মে যায়। এ যে কী বিশ্রী রকমের ব্যক্তিগত ক্ষতি, তা
অনির্বচনীয়। তেমনই জগদ্দল অসমাপ্ত কাজের ভার। অঙ্গুলিমালের মত গলায় অসমাপ্ত,
অর্ধপচ্য এবং আধখাওয়া সব কিছুর মালা পরে দাঁড়িয়ে থাকি মহাভিক্ষুর
সামনে। উনি যে আমাকে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠবেন, এই তো
স্বাভাবিক! এমনই তো প্রত্যাশিত!
মহানির্বাণের পথে
উপুড় হয়ে শুয়ে থাকেন অমিতাভ, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কম... আর
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে ওয়ারসও থেকে অশউইজের দিকে ছুটে চলে কালো রঙের ট্রেন...
ফুটে ওঠে সারি সারি নখের আঁচরের দাগ। নাসের আলির ছুঁড়ে দেওয়া মহার্ঘ্য দাঁতে কামড়ে
যুৎ পাই না। অক্ষরজ্ঞানহীন কুকুর আমি, বিস্বাদ ছুঁড়ে ফেলে
দেখি-- কারো দিনলিপির আধপোড়া অবশেষ। আমার কাছে অখাদ্যই, আধপোড়া
কাগজ, দিনান্তে দীননাথের পরিহাস!
'কিন্তু
তুই তো দিশী, রাস্তার... জন্মের ঠিক নেই! তোর খিদে পেলেই বা
অত ভাববি কেন?'
রাগ অথবা ক্ষোভ
হলেও,
এও ঠিক। পেডিগ্রীর একটা ব্যাপার থাকে, কুকুর
হলেও তার জাতের দাম আছে, সামাজিক মর্যাদা আছে। অসম, অযোধ্যা, হরিয়ানা, থর, কাশ্মীরই তো কত দূর... আমি তো বানতলা, কামদুনি,
বগটুই, মরিচঝাঁপি... এসবই নাগালে পাই না।
দার্জিলিং কালিম্পং-এর প্রসঙ্গ চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটায়, তবে
বিশেষ কারণেই। যা কিছু সুন্দর, নৈসর্গিক, মনোরম-- দেখে হ্যাংলার মত জিভের জল টেনে নিই। প্রকাশ করি না। তাদের কথা
ভেবে সত্যিই ঈর্ষা হয়, যারা সহজে বা একটু চেষ্টাতেই নাগালের
কাছে পেয়ে যায়। তারা পায় বলে আমাদেরও দেখা হয়, নাগালের
বাইরের কিছু কিছু। অজ্ঞাতে, তারাও দীননাথ নাসের আলি।
আমি অঙ্গুলিমাল, অথবা
পেডিগ্রীহীন কুকুর... ফর্ম তোলা আর জমা দেওয়ার লাইনে দাঁড়াই। রাষ্ট্র খিলখিল করে
হাসে। মহাভিক্ষুর নির্বাণের পর, আর কেউ মুক্তির প্রসঙ্গে যায়
না। মাঝে মাঝে পরে আর একদিন আসতে বলে কেউ কেউ। কেউ কেউ মৌখিক ভদ্রতা বজায় রাখে।
সেও পরম লাভ।
আমি শুয়ে শুয়ে চোখ
বুঁজে ভাবি-- অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, অথবা হাঙ্গেরির
অলৌকিক সুন্দর প্রকৃতির কথা। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের চিন্তা দুর দুর করে তাড়িয়ে
দিই, ঠিক যেভাবে তাড়া খেয়ে খেয়ে এইখানে এসেছি আমরা।
জয়দীপ
চট্টোপাধ্যায়
0 মন্তব্যসমূহ