দরবারী কানাড়া
শূণ্যতায় নাকি পূর্ণতার গাঁটছড়া বাঁধা থাকে । জানেনা অতুল । শুধু মন জানে । মন আঁকতে থাকে এক ছবি । এক রঙ ওলটানো ক্যানভাস আর দরাজ বিস্তার দরবারী কানাড়ার । সে কানাড়া সোহেল গাইছে । সোহেলের স্রোত ধরে মন একটা একটা করে সিঁড়ি আর সারি সারি তালগাছ পেরোতে থাকে । পেরোতে থাকে ধানক্ষেত, শালবন , রূপলেখা নদী আর নাম না জানা নির্জন সাঁকোর গল্প । আসলে এ সব কিছুই ঘটে ঘুমের মধ্যে । যে ঘুম আসেনা । যে ঘুম আসার কথা ও নয় তবু অপেক্ষা আছে তার ।
ডাক্তারবাবু বললেই হলো !মনের নাকি অসুখ করেছে !মন জানে অসুখ নয় । আসলে অসুখ কথাটাই বেডকভারের মতো তুলে ফেলে দিতে হয় জীবন থেকে সবার আগে । তবেতো আসবে ঘুম । এটাই ডাক্তারবাবু বোঝেনা । সোহেলও নয় । মন বললে সোহেল হাসে । বাবার মতো । প্রশ্রয় দেওয়া হাসি । তার পর ওর পাশ থেকে উঠে গিয়ে ডাক্তারবাবুর কথা বলার লাইনে দাঁড়ায় । অসুখ কার নেই ? ডাক্তারের ? আরে তাদেরতো সুখ শান্তির সময়ই নেই ! সোহেলকে ওর তখন ভালো লাগে যখন গান গায়ও । ওর পাশ ফেরানো মুখ ভালো লাগে । মোটা ফ্রেমের মুখ ফেরানো চশমার কাঁচে একটুকরো রোদ উঁকি ঝুঁকি মারছে । মন জানে , সোহেল এখন ওর কথা বলবে ডাক্তারের সঙ্গে। ডাক্তারবাবু ওকে কিছু বললে ও মাথা দোলাবে ডানদিক বাঁদিক । তারপর হাতদুটো এক জায়গায় জড়ো করে কিছু বলবে। ।খুব নিচু স্বরে যাতে কেউ শুনতে না পায় । তারপর কপালের চুলগুলো পিছনে ঠেলে ফিরে এসে ওর কপালে ঝুঁকে একটা চুমু খেয়ে বেরিয়ে যাবে এবেলার মতো । বিকেলে আসবে কিন্তু রোদ্দুরটা আর থাকবেনা চশমায় । এ কদিন এরকমই হয়েছে। এরকমই হবে ,মন জানতো । তাই রাস্তা পার হতে গিয়ে সোহেলকে ডেকেছিল অতুলের নামে । সোহেল শোনেনি । অতুল শুনতে পেয়ে ওকে হাতছানি দিয়েছিল “ আয় !”
ও ছুটে গিয়েছিল ডিভাইডারের মাঝখানে ওভারব্রিজের তলায় তিননম্বর স্টল লক্ষ্য করে যেখানটা বাস গুলো ঘুরছিল । এরকমই হয় । যখন মনের মন খারাপ হয় অতুল আসে । ডাক দেয় , মেঘ থেকে , রাস্তা থেকে , অচেনা বাড়ির জানালা থেকে , আর মনকে যেতেই হয় । যেমন করে হোক সব ফেলে যেতেই হবে। হবেই । মুশকিল হলো ডাক আর কেউ শুনতে পায়না । এমনকি সোহেলও নয় । শুধু মন । অতুলতো এরকমই ছিল । বরাবর ! অথচ এখন সবাই সেটা ভুলে গেছে । অতুল আজন্ম মনের পাঠক । আর মন অতুলের । যেন দুজনে দুজনের একটা করে বই , বুকের তলায় বালিশ দিয়ে খোলা জানালায় দুপুরবেলার সঙ্গী । যেন কার খোলা চুলে বৃষ্টি কুচির দুলতে থাকা , এমন ছিল ওদের সময় যাপন কবিতার মতো । কবিতার মতো ! কেন কবিতাই। মন কবিতা লিখতো তখন । মনের কবিতায় ছিল জিয়ন কাঠির ছোঁয়া । তাতে ভুঁই চাঁপা আর করমচা বনের গন্ধ । ঐ কবিতা বুনোটের ঠাসা জমিনের ওপর কল্কা তোলা এক সাংষ্কৃতিক সন্ধ্যায় সোহেলের সঙ্গে দেখা । চোখ । সোহেলের চোখ তাকে ভাসিয়ে ছিল উজান গাঙে । বাকিটা মিয়াঁ কি মল্হার ! দারুণ বর্ষার আগুনে ভিজতে পুড়তে দুজনে দানা বেঁধে গেল । পদ্মা পাড়ের সোহেল বাসা বাঁধলো মন কেমনের কোলকাতায় , কস্তা পেড়ে এলো খোঁপা এক নদীর সঙ্গে । নদীর নাম মন । তার চলন অবাধ ! তার বাঁকে বাঁকে সুরের সুরধুনী ! কাগজের অফিসে চাকরি নিয়ে দুজনের টানাটানির সংসার । তারপর অতুল ! হঠাৎ চাঁপা ফুলের গন্ধ ঢালা রাত যেন ! মন হারালো । অতুলের মধ্যে প্রাণ ঢেলে দিল মন । অতুলের মন । মনের অতুল । সোহেল তানপুরায় , সুরবাহারে , সকালের রেওয়াজে , রাতের দরবারী কানাড়ায় । সেদিনও তাই ছিল । মাঝরাতে তার গলায় বিস্তার , ক্লান্ত শহরটার ওপর আদর ছড়াচ্ছিল আবীরের মতো ! অতুলের সঙ্গে খেলছিল মন । নানা রঙের খেলা । কি হলো কে জানে , সব শেষ ! তানপুরার তার ছিঁড়ে গেল সোহেলের । চমকে উঠে ঘরে দেখে ,রক্তারক্তি কান্ড! অতুল তখন মাথা ঠুকছে বিছানায় ! না না না – চিৎকার করছে ! আর মন ! রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার কোল ! মেঝেতে পড়ে আছে নিথর। নিশ্চল ! অতুলের চিৎকার অবশ্য শুধু মন দেখছিল ! বিস্ফারিত চোখ তার চেয়ে ছিল ওর দিকে । সোহেল জানতোনা । সে শুধু মনকে দেখেছিল । কয়েকটা দিন কয়েকটা রাত অন্ধকার । তারপর শূণ্যতা ।তারপর অতুল আবার ! কয়েক মাস পর কাজে যোগ দিল মন । বুদ্ধি দিয়ে সামলে নিচ্ছিল । কিন্তু অতুল থাকতে দিল না । যখন তখন ডেকে নিতে লাগলো যে ! মন সেই থেকে – সেদিন এইট বি বাসটা ব্রেক না কষলে – ডিভাইডারে ডানা মেলে উড়ছিল দুজনে ! কেউতো দেখতে পায়নি ! এমনকি পুলিশও যখন ওকে তুললো , শুধু ওকেই , অতুল দূরে দাঁড়িয়ে, একলা ! কি করুণ মুখ !
সোহেলের জন্য কষ্ট লাগে । ও অতুলকে চেনে না। মন অনেকবার ভেবেছে বলবে কিন্তু বলা হয়নি । অতুলই বারণ করে । চোখে হাসে ! কি সুন্দর হাসি ! ওরা একসাথে কবিতা ওড়ায় প্রজাপতির মতো । আকাশের জামা টেনে ধরে ডানা ঝাপটায় মেঘ ছোঁয় ! কবিতাবেলা ! এ তাদের নিজস্ব সময় । ডাক্তারবাবুকে বলতে হেসে বললেন , উঁহু ! ওরকম বেলা সারাদিনে নেই । কারণ কবিতাতো সারাদিনের । সেরকমই নাকি লিখেছেন সব কবিরাই ! কাজের ফাঁকে , চলতে চলতে । কবিতাবেলার সময় নাকি চাওয়া যাবেনা আর । কি বলে লোকটা ! ডাক্তারবাবু যখন বলছিল ,অতুল তখন ঘার দুলিয়ে হাসছিল তার পিছন থেকে ! মনকে দেখে ইশারায় ঠোঁটে আঙুল রাখলো । চুপ করে গেল মন । অতুল ওর কানে কানে বললো “বলতে দাও ! কবিতাবেলা আমাদের ।ওরা কি জানে তার কথা !” আজকাল এটাও হয় ।দূরে থেকেও অতুল কানে কানে কথা বলে তার সাথে । সোহেলকেও বলেনি মন । যদি ডাক্তারবাবুকে বলে দেয় সোহেল ! অতুলের নাম শুনলেই কেমন যেন চুপ করে যায় ও । মন ওকে দুঃখ দিতে চায়না।
বিকেলবেলা সোহেল দেখলো , কেবিনের জানালার পাশে মন দাঁড়ানো , ওর খোলা চুলে বাতাস খেলা করছে ! সাদা লম্বা ফ্রকের ওপর সন্ধ্যেবেলার বিভা ফুলের পাপড়ির মতো ছড়ানো ওর গায় ! বিলাসখানি টোরী ! ভাবলো সোহেল ! কবে মন আবার ঝলমল করবে , বকবক করবে , রাগ , উল্লাস করবে আগের মতো ! নিচে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লো ও । আজ বিকেলের ভিসিটিং আওয়ারে খুব শান্ত ছিল মন । একদম চুপচাপ । কথা বলছিলনা প্রায় । ওষুধের ডোজ বেড়েছে ওর ।হয়তো সেই জন্য ! ভাবলো সোহেল । রাতে নাকি ঘুমোয়না ! “আমাকে দরবারী কানাড়া শোনাবি ? “ওর কথায় চমকে উঠলো সে । কতকাল গায়নি প্রিয় রাগ ! সেদিনের পর ! একটু চূপ করে থেকে , চোখ বুঁজে অল্প আলাপে বিস্তার ধরলো সোহেল ।সময় শেষ হয়ে আসছে ভিসিটিং আওয়ারের । কেবিনে যতক্ষণ ছিল মন একদৃষ্টে জানালা দিয়ে দূরের শহরের আলো জ্বলে ওঠা দেখছিল । গান শেষ হতেও আচ্ছন্ন হয়ে ছিল । সোহেল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে এসে ফিরে দেখলো জানালায় মন !
ঘড়িতে রাত একটা ! এরকম সময় কেউ আসে ? সিস্টার ঘুমোচ্ছে ডেস্কে । মন তখনো জানালায় । অতুল এলো । গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে গলা জড়িয়ে বললো , “দেখতে পাচ্ছনা ? বিকেলের বিস্তারে কষ্ট হচ্ছে আমার ? সেই কখন থেকে ডাকছি ! আমাকে ছোঁবে কি করে যদি সুর হয়ে যাই ?”
“তার চেয়ে কবিতা হও । পড়তে পারবো !” মন বললো ।
“নাঃ আর হবেনা । ঐ দেখ শহর ঘুমোলো এবার । আমাদের কবিতা বেলা শেষ ! এবার আমায় যেতে হবে । সঙ্গে যাবে ? ডানা মেলো – এস একসাথে – “ অতুল জানালায় উঠে হাত বাড়ালো –
দুজনে ডানা মেলে দিয়েছে ।শহরের তুচ্ছাতি তুচ্ছ আলোগুলো সরে যাচ্ছে জোনাকির মতো । হঠাৎ মনের মনে হলো ঐ শহরে সোহেল আছে । ওকে খুঁজবে ! দরবারী কানাড়ার স্বরলিপিগুলো উড়ছে । ওদের কাছে চিঠি দিলে ও পাবে ঠিক ! খুব কি কাঁদবে তার জন্য ? অতুলের হাত ধরে দশতলার জানালা থেকে আকাশে পা রাখলো সে !
সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
0 মন্তব্যসমূহ