সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সিদ্ধার্থ রায়: শ্রদ্ধাঞ্জলি:শতাব্দীর দীর্ঘশ্বাস যাঁর রচনার পাঁজরে পাঁজরে যাঁর কলম যুগান্তর রচনা করে গেছে: সুবল দত্ত

 


শতাব্দীর দীর্ঘশ্বাস যাঁর রচনার পাঁজরে পাঁজরে

  যাঁর কলম যুগান্তর রচনা করে গেছে

 

 

প্রশস্ত কিছুটা সবুজ যদি অনেকটা প্রশান্তি দিতে পারে, তাহলে পুরো পথটা যদি সবুজ ছাঁয়াঘেরা হত এতটা অস্থির বিমর্ষ হত না এই নাগরিক জীবন তাই হয়তো তিনি হাঁটতে হাঁটতে থমকে যেতেন। কোথায় কি দেখে হত তাঁর অন্তর্গত বিষাদ? ছায়াঘন হাঁটার পথ-মাঝে ক্লান্ত পথিক খুঁজে চলতেন একটুকরো জনপরিসর, নির্দিষ্ট দূরত্ব পার হলেই পানীয় অথবা সাধারণ খাবার-ঘর ক্লান্তি ভুলিয়ে পথ চলতে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেবে। কোথায় দেখা পাবেন এমন পথের? এখানেই সেই অবাস্তব আর বাস্তবের সেই ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ সংঘাত ফুটে ওঠে যখন তিনি দেখেন নিপীড়ন ও নির্যাতনের চাকার বাতাসে সাধের শালপাতার বাড়ি উড়ে যায়!! সেই সব বাস্তবের আস্তরণ সরিয়ে, ঝরাপাতা সরাতে সরাতে ঘন জঙ্গলের মধ্যে সময়ের এক অভিযাত্রীর মত আবিষ্কার করেন নির্জনে থমকে থাকা সত্যের সেই আশ্চর্য শিলালিপিকে, যা তিনি স্পর্শ করে রচনা করেছেন অরণ্যের গদ্যগ্রন্থ যা অসাধারণ জীবনগুলির এক অনন্য চিত্রপট।

 

কেউ তাঁকে বলেন ৭০ দশকের কবি, আবার কেউ বলে থাকেন শক্তিশালী লেখক ও কবি কিন্তু আমি তাঁকে যতটুকু পড়েছি মনে হয়েছে আমাদের প্রিয় শ্রদ্ধেয় সুবল দত্ত ছিলেন নিশ্চিয়তা ও অনিশ্চিয়তার সন্ধিক্ষনের দশকের সেই কবি যিনি পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছেন এক বিশিষ্ট অনন্য সাহিত্যিক , কবি ও লেখক। যিনি ঝাড়খণ্ডের ও মানভূমের অসাধারণ চিত্রন করে এক যুগান্তর সৃষ্টি করেছেন। যাঁরা তাঁর কাব্য সংকলন - "হে মহাজীবন", " মুখোশের চোখের ছেঁদায় ", " এক এক মুগ্ধতার ছটা ",  প্রবন্ধ সংকলন - " নিঃসঙ্গতা তার " , উপন্যাস - " ট্রান্সফর্মেশন " তাঁর প্রথম গল্প সংকলন - "প্ল্যাগিয়ারিস্ট" ও অসাধারণ জীবনের বর্ণনা "প্রদাহ বোধ " পড়েছেন তাঁরা আমার সাথে বিনা দ্বিধায় একমত হবেন যে এ এক নতুন আরশির খোঁজে এক নতুনধারার জন্ম দিয়েছেন তিনি যা আমাদের বহির্বঙ্গের মানুষকে গৌরবান্বিত করেছে। মানুষে মানুষে  সম্পর্ক পার হয়ে, বাক্‌ ও অর্থের হানাহানি শেষ হবার পর একটা জায়গায় তিনি অসহায় মানুষের নিরাপত্তা ও সহজ জীবন যাপনের জন্যে শক্তির উৎস খুঁজেও নিঃসঙ্গ থেকেছেন পাশে কেউ ছিল না। তবুও আমাদের পরিচয় হল প্রাণের প্রাচুর্যভরা এক আশ্চর্য লেখনী শক্তির সাথে যে শক্তি ধূসর বিষাদের মধ্যেও ভালোবাসার কথা লিখে গেছেন। পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে হয় সুবলদার সেই আর্শিনগরে যেখানে মুক্তির খোঁজে তিনি যুগের পর যুগ ধরে হাঁটছেন।

 

যে মাটিতে মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছে অথচ গাছের সাথে গাছের, রাস্তার সাথে রাস্তার কিংবা পাখির সাথে পাখির বা পশুর সাথে পশুর দূরত্ব বাড়ে না, সে দেশে দেখা হলে দেখা হয়, দেখা না হলে দেখা হয় না, সেই দেশ থেকে তিনি একটু দূরেই হারিয়ে যেতে চেয়ে এক নতুন দেশের ঠিকানা খুঁজেছেন। তিনি অনুভব করছেন এই সময়টা খুব একটা সুখের সময় নয়। এ সময়টাও হাত বদল হয়ে যায় মধ্যরাতে। নাহ, এটি তাঁর আত্মদর্শন নয়। বরং তার সমসাময়িক অনুভবের সেই রূপের প্রত্যক্ষ দর্শন যা অশনি সংকেত দিচ্ছে  যে বর্তমান  সমাজ ও জনজীবন সমসাময়িক আধুনিকতার  অসুখে আক্রান্ত। তিনি লড়াই করছেন এই অসুখের বিরুদ্ধে। তিনি স্বয়ং প্রকৃতির ঘরের লোক হয়ে প্রকৃতির কাছে অনুরোধ  করে ভেবেছেন যদি প্রকৃতি কিছুটা সম্পাদনা করে এক নতুন জগৎ সৃষ্টি করত, তাহলে হয়ত জগতের এত রসের  রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধান ঠিক পাওয়া যেত তা সে যত ক্ষুদ্রই হোক না সেই রূপ। তিনি জানেন একটি ঘাসফুলের মধ্যেও অনন্তের নক্ষত্র জন্ম নেয়। আবার একটি নক্ষত্রের মৃত্যুতেও ঘাসফুল বিবর্ণ হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন তো কোনওকিছুই নয়, খণ্ডও নয় কিছু। তাঁর বিশ্বাস এই প্রকৃতিই হল সেই সম্পদ, যার মধ্যে অনন্তের সত্য লুকিয়ে আছে। হয়ত সেই সত্যকে দেখতে খুব সুন্দরী রূপসীর মতো নয়। বা, হয়ত সে সামান্য এক আলো। আলো আর অন্ধকার যেভাবে একে অপরের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে, তেমন সকলেই আছে বিচ্ছিন্ন হয়ে। মুখ ফিরিয়ে। তাঁকে তো কথা বলতেই হবে, সকলের সঙ্গেই।

 

শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক, কবি ও লেখক সুবল দত্ত দীর্ঘ ৩৬ বছর নিজের কর্মজীবনে ধানবাদ - বোকারো অঞ্চলে থেকেছেন। বর্তমানে জামশেদপুর নিবাসী হলেও অতীত ও বর্তমানের প্রতিটি পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদক, সম্পাদক - মন্ডলী সহ লেখক ও লেখিকাদের সাথে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। আজ তিনি বহুদূরে চলে গেলেও সবার সাথে রয়েছেন এক পরম বন্ধু ও আত্মীয়ের মত। দুরারোগ্য ব্যাধিকে হারিয়ে তাঁর কলম আলোকিত যুগের রচনা করে গেছে। শতাব্দীর দীর্ঘশ্বাস তাঁর রচনার পাঁজরে পাঁজরে, রাতের আলেয়ার মত ছুটে গেছে তাঁর কলম আর ইতিহাসে লিখেছে কান্না- ভালোবাসা ও আনন্দের দিন ও রাতের কাহিনী। হানাহানি, মহামারী, প্রলয় ও বন্যা দেখেছে তাঁর কলম কিন্তু ধ্রুবতারার মতো স্থির থেকে তারার আলো আর চাঁদের হাসিকে সঙ্গী করে যুগান্তর রচনা করেছে।

 

তাঁর সৃষ্টিতে, মননে আমরা সমৃদ্ধ। সাহিত্য জগতে এক অন্য নিদর্শন সৃষ্টি করেছেন। সাহিত্যকে নতুন করে কী ভাবে আবিষ্কার করতে হয়, সম্পর্ককে নতুন নিরিখে দেখতে হয়, পারিবারিক গভীরতা কতটা, প্রেমকে কী ভাবে স্পর্শ করতে হয়— আমার মনে হয় তাঁর মতো দৃষ্টিভঙ্গি খুব কম মানুষের আছে।

 

'তুমি আবার ফিরে এসো। আবার অনেক কিছু সৃষ্টি করো। তুমি আমাদের গর্ব। তোমাকে প্রণাম।'




                                                                        
                                                                    সিদ্ধার্থ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. সুবল দা কে নিয়ে আপনার যথার্থ প্রতিবেদন খুব খুব ভাল লাগল। বড় প্রিয় এবং কাছের ছিলেন আমার। অসংখ্য ধন্যবাদ ও ভালবাসা নেবেন।

    উত্তরমুছুন
  2. সাহিত্য জগতের দুজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি সম্পর্কিত রচনা দুটি খুব ভালো লাগলো 🙏

    উত্তরমুছুন
  3. শ্রদ্ধেয় সিদ্ধার্থ বাবু ও সুবলবাবুর অনেক তথ্য মূলক লেখাটি ভীষন ভালো লাগলো । যদিও ফেসবুকে এর পুর্বে পড়েছি, তবু্ও নতুন করে আবার একটু পড়লাম । শ্রদ্ধাভাজন গুনিজন সমৃদ্ধ মহোদ্বয়কে আমার প্রনাম ।

    উত্তরমুছুন
  4. অসামান্য প্রতিবেদন। আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।

    উত্তরমুছুন