" সমীরণ ঘোষের কবিতারা , কিংবা মৃৎশকট , অধিকন্তু
রক্তের সমূহ ছায়া "
এক .
যাত্রাশুরু
...............
" জীবনের
যাবতীয় পরিচিতি খ্যাতি প্রতিষ্ঠা কোনওদিনও আমাকে আনন্দিত করতে পারে নি | আসলে ব্যাপারটা ও ভাবে আমি ভাবিই না | আমি ভাবি
নির্জনতা একাকিত্ব আর প্রেমহীন প্রত্যাশাহীন শংসাপত্রহীন নির্ভার জীবনের কথা বা যাপনের কথা |
পাঠক শ্রোতা দর্শক একটা বৃত্তের বাইরের ব্যাপার | যেটা আমাকে ভাবায় না | বরংচ
ভাবায় আদি অবিকল্প আদিম কাল থেকে চলে আসা বিশ্বের কথা | তার
উৎস হয়তো আমার ভেতরে নিহিত | যেখানে অন্ধকার ক্ষয় ধ্বংস ও
রক্তাক্ত সভ্যতার বিপ্রতীপে চলা এই বিপুল নৈসর্গিক জগৎ | যে
একই সঙ্গে ত্রাতা ও বাঁচার উপকরণগুলোকে সাজিয়ে রেখেছে আমার ভেতর | প্রত্ন খননের মতো নিজেকে , নিজের ভেতরের অসংখ্য
সত্তাকে নিয়ে ভাবি | আর এই সভ্যতার প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা
রিরংসা যুদ্ধ রক্তাক্ত তিমির অবগুন্ঠন খুলে খুলে আমি খুঁজে পাই আমার নিজস্ব সাঁই |
এটা ঠিক ধর্মভীরু মানুষের কায়িক ঈশ্বর নয় | এ আমারই
অবিকল্প সত্তার ক্ষত'য় মুখ রেখে তার শুশ্রুষা ও তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা
" ...
" আমি
এই গতানুগতিক অভ্যাসের ভেতর নিজেকে খুঁজে পাই | একজন প্রাচী
ও প্রজ্ঞাবান ঋষি যেমন তার অবস্থানের ভেতর থেকে কল্পনায় খুঁজে পান নিজের
ব্যক্তিসত্তার দ্বিতীয় পৃথিবীকে | এই যে সমস্ত আমি' র ভেতর কয়েকটা মুহূর্তসমষ্টি , সেই মুহূর্তগুলোর
মধ্যেই আমার যাপন | যা অব্যক্ত প্রগাঢ় অনুভূতিময় | যা অপ্রকাশিত | যাকে নিয়ে কেটেছে আমার শৈশব ,
আকৈশোর , যৌবন এবং এই প্রান্তিক জীবনের
গোধূলীবেলা | যাকে নিয়েই আমি বিদায় নেবো | সেই আত্মখননের ভেতর নিজেকে নানাভাবে আবিষ্কার করাই আমার নেশা | এরফলে জনারণ্যের ভেতরেও আমি টের পাই নিজস্ব নির্জনতাকে | আমি ভেতরে ভেতরে জেগে থাকা পিপাসিত একজন মানুষ | মধ্যরাতে
আমার গান , কবিতা , ছবি সবই সেই আমাকে
জাগিয়ে রাখার ব্যাকুলতা | সাধনা অনেক বড়ো কথা | আমি তোতাপুরি লালন সন্ত তুকারাম কবির রামকৃষ্ণ বুনো রামনাথ নই | আমি একটি বাহ্যিক নামের আড়ালে থাকা , একজন প্রাচী
মানুষ , যে জন্মের আগে এবং মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকে অনেকের
আমি'তে ! "
" ছেলেবেলায়
প্রবল পুরুষ আমার বাবার দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখেছি | আমি ছিলাম
লাজুক , ভীরু কল্পনাপ্রবণ একজন নির্জন বালক | বাহ্যিক যাবতীয় প্রাবল্যের চাপ সহ্য করে
করে আমি
বারংবার ফিরে ফিরে গেছি নিজের কাছে |
নিজের ভেতরের লুকোনো আমি' র আশ্রয়ে |
"
" এখন
যেন নিজের অতীতের দিকে তাকালে অজস্র ঘটনা ছবি হয়ে হয়ে ফিরে আসে | এই বহরমপুরের কৃতি সাহিত্যিক ছিলেন
মনীশ ঘটক , যুবনাশ্ব | মহাশ্বেতা দেবীর
বাবা | নবারুণ ভট্টাচার্যের দাদু | ঋত্বিক
ঘটকের দাদা | পটলডাঙার পাঁচালির স্রষ্টা মনীশ ঘটক | বিজন
ভট্টাচার্যের শ্বশুরও তিনি | তাঁকে দেখেছি | মনে পড়ে তাঁর পত্রিকার নাম ছিল , বর্তিকা | মনে পড়ে উত্তাল নকশাল আন্দোলনের কথা | সেই অগ্নিময়
সময়ে আমার লেখালিখির সূচনা | খুব মনে পড়ে আমার অকৃত্রিম
অভিভাবক বন্ধু
শুভ , শুভ চট্টোপাধ্যায়ের কথা | মনে
পড়ে আবহমান শিল্পের কথা | কত গান , পথ
নাটিকা , কত নাটকের যে পোস্টার করেছি , তার ইয়ত্তা নেই | মনে পড়ে খাগড়া পার্টি অফিসের কথা |
আমাদের অগ্রজ অভিভাবক কবি সুশীল ভৌমিক , রাজেন
উপাধ্যায়ের কথা | স্বয়ম্বরের কথা |এভাবেই
একদিন শুভ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় , রৌরব পত্রিকা |
যা একসময় বাংলা লিটল ম্যাগের দুনিয়া কাঁপিয়ে
দিয়েছিলো | কত অবিস্মরণীয় কবিতা , প্রবন্ধ
, গল্প, গদ্য এতে প্রকাশিত | কবি শান্তিময় মুখোপাধ্যায় এলো প্রবন্ধ নিয়ে | উমা দা , কবি উমাপদ কর , অমিতাভ মৈত্র , প্রশান্ত গুহ মজুমদার , আবুল বাসার , সাধন দাস,
কৌশিক রায়চৌধুরী , অজয় বিশ্বাস, অনুপ
ভট্টাচার্য।
সেই
প্রেক্ষাপটেই আমার ছবি আঁকা , অজস্র নাটকের পোস্টার , কবিতা লেখা শুরু |
"
পাহাড়ের দিকে
মুখ করে বসে আছে কবি গায়ক চিত্রশিল্পী সমীরণ ঘোষ | আনমনে গেয়ে চলেছেন --
" এ
ঘনঘোর রাতে
ঝুলন দোলায়
দুলিবে মম সাথে ||
এসো নব জলধর
শ্যামল সুন্দর
জড়ায়ে রাধার
অঙ্গ বাঁশরি লয়ে হাতে ||
এ ঘনঘোর রাতে
..."
দার্জিলিংয়ের
একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম
লাটপাঞ্চার | পাহাড় কুয়াশা মেঘ বৃষ্টি রোদেলা, অজস্র পাখি , বার্কিং ডেয়ার এ সব নিয়েই লাটপাঞ্চার |
দিনটা মনে পড়ে , ২৪ মে , ২০২৩ |
আমার মতো অতি
সামান্য একজন মানুষকে ভালোবেসে আমার বন্ধুরা এই পাহাড়ি রিসোর্টে নিসর্গের কোলে আমার নবম কবিতার বই , তানাশাহী
, উদ্বোধন করেছিল সেদিন | আমার বন্ধুরা
বিভিন্ন বয়সের | কিন্তু একই আত্মার অংশ | আমরা পাঁচজন বেড়াতে বেড়িয়েছি | কবি ধীমান চক্রবর্তী ,
সমীরণ ঘোষ , প্রভাত মুখোপাধ্যায় , সব্যসাচী হাজরা ও আমি | মনে পড়ে , অনেক অনেক বছর পর বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে এসে শিশুর মতো আনন্দে আবেগপ্রবণ
হয়ে পড়েছে আমাদের সমীরণ দা | আপন মনে গান গেয়ে চলেছে কবি |
তার গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি অচেনা পাহাড়ি পাখি এক মনে ডেকে
যাচ্ছে ....দূর সুদূরে ....
দুই .
অনঙ্গের
মাণিক্যমঞ্জুষা
........................................
যদি বলি তুমি
শব্দ দিয়ে ছবি আঁকো আর ছবির অনুবাদ করো কবিতায় | যদি বলি অন্ধকার বিন্দুটি ছায়া খুলে খুলে আসে
তোমার কাছে আর ছায়াবাড়ি যেভাবে ভেঙে যায় সেভাবে টুকে রাখো আলোর ট্রিগার | তোমার কবিতায় কোনও আলবিদা নেই আছে বিয়োগবিধুর মানুষের ক্ষতবিক্ষত মনের আলো
বুজে আসা পরিবর্তনশীল সর্বত্রগামী এক ক্ষয় , যে ক্ষয়ের বিষাদ আমি খুঁজে পাই গহরজানের গানে |
তুমি কী অস্বীকার করতে পারো দারুতক্ষণের দীর্ঘশ্বাস তোমার কবিতায় সংরাগ ধরেছে ধারাবিষের
মেহেক আর ঝংকৃত আরশিক্ষেতে ? মুকুরের পর মুকুর ভেঙে যায় | আখতারি বাই - এর জোছনা মেশে শহরতলীর আলোয় | সে আলো
কী বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে মনুষ্যত্বের ক্রোধ ? একদিকে এই
বিশ্ব , ব্রহ্ম , অনন্ত সময় , ও সময়ের ইতিহাস , অন্যদিকে মানুষের লোভ লালসা কামনা
বাসনার ভ্রষ্ট স্পর্ধা যা প্রগাঢ় কুয়াশায় অপসৃয়মান ক্ষণভঙ্গুর অথচ গতিশীল এক
বিশ্বাসহন্তারক পাপ যা চেতন বিন্দুতে স্তব্ধ হয়ে আছে ভাষা ও নিত্যনতুন সংঘাতের
মহাপৃথিবী নিয়ে | বলো তুমি সমীরণ দা , তোমার
শব্দ আসলে বন্দুকের বুক | দিন যায় , মাস
যায় , বছর যায় , বন্দুক লজ্জা ঘৃণা
দুশ্চিন্তার মধ্যে তবুও অপেক্ষা করে , শুধুই অপেক্ষা করে আর
শক্ত হয় ভেতরে ভেতরে | তোমার সাঁই আসলে হেমন্তকালের
রোদকুয়াশায় ছাওয়া সকালবেলায় আর একজনের মুখ যা তোমার মুখের মতো সত্যি | তোমারই অল্টারনেটিভ সত্তার ক্ষতের ব্যথাহীন ছায়াঘন গান , যে বসতে চায় সঞ্জীবনী ঝর্ণার পায়ের তলায় | কিন্তু এই
মানুষের ব্যভিচারী বাঘ বা সভ্যতার পরিত্যক্ত বাঘ যা তোমাকেই রাত্রিবেলা টেনে নিয়ে
গেছে তোমারই ঘাড় কামড়ে ! চারদিকে চাপ চাপ কালো রক্ত পাপ হননবায়ু হত্যাঋতু
বিদ্যুৎপ্রবাহী মৃত্যুশ্যামনাম , তোমাকেই যেন আত্মসাৎ করছে |
তুমিই বলেছো , মানুষ নামক ভূতের বোঝা ভূমন্ডলই
বয় | তুমিই বলছো তোমার লেখার প্রাক ও অন্তিমকথনে --
" সেই
কোন ধাঁধার পুচ্ছে শুরু | আজমাত্র ধাঁধার গর্ভে অবসান |
সমকাল কীলের চূড়ায় | ঘুরে - ঘুরে লেত্তিপথ দীর্ঘ অসীম | দিগন্ত
শূন্যের শ্লেট | মুছি
লিখি কাটি আর গনগনে শীতে ডুবে একটেরে মেয়াদিবিকেল | কী অশ্রু
গড়ালো ! কোন পারা না - পারার বোঝা গুল্মের নীচে ভেজা - কাল ! অবসাদে হাড়মাস গলে
লোহার জানলা | ক্লেদের বেগুনিআলো অন্তিমে ইশারা - ইঙ্গিতে
জেগে | তবু ,
বন্ধু অনুরাগী আত্মজনের কী প্রশ্রয় , ঠেলে -
ঠেলে ভাসাবেন | পণ | তাই এই গলনাঙ্ক |
নাকি লোভ ! কুষ্ঠ হোক | চোখেমুখে সর্বকালের
আলো নিভে যাক | ও আশ্লেষ , ও - রোদন ,
ও - কণ্টকভেলা , পিঁপড়ের পথে নাও | যে - অব্দি জগৎ পড়ছে , আমি ঘুমে ডুবে | যদি ভোর হয় , কখনও জাগিও | "
এক অমানিশা
অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ | মর্মন্তুদ
| এর মধ্যে কী হ্যালুসিনেশন আছে ?
অমূলক
প্রত্যক্ষণ বিভ্রমের একটি হালকা পর্যায় আছে যাকে আমরা ভ্রম বা অনুভূতির
বিশৃঙ্খলাও বলতে পারি। এটিও উপর্যুক্ত স্নায়ুগুলোতে ঘটতে পারে। এর উদাহরণ হিসেবে
বলা যায়, প্রান্তিক দর্শনশক্তির মাধ্যমে
কোনকিছু নড়তে দেখা, ক্ষীণ শব্দ বা ঝিরঝির আওয়াজ শুনতে
পাওয়া। ভগ্নমনস্কতা রোগে অমূলক শ্রবণ বিভ্রম খুবই সাধারণ ব্যাপার। ভগ্নমনস্ক
রোগীর এই অমূলক প্রত্যক্ষণ বিভ্রমের কল্পিত ধ্বনিটি রোগীর উপকারীও হতে পারে (যেমন,
তাকে ভাল ভাল উপদেশ দিতে পারে) আবার ক্ষতিকরও হতে পারে, রোগীকে সারাক্ষণ অভিশাপ দিতে পারে ইত্যাদি। ক্ষতিকর অমূলক শ্রবণ বিভ্রম ঘন
ঘন শ্রুত হতে থাকে। মনে হতে পারে রোগীর পেছন থেকে কিছু মানুষ অনবরত কথা বলে
যাচ্ছে। অমূলক শ্রবণ বিভ্রমের মত, শব্দের উৎসের প্রতিকৃতিও
রোগীর পেছনে থাকার অনুভূতি হতে পারে। মনে হতে পারে শব্দ করা মানুষগুলো পেছন থেকে
লক্ষ করছে বা তাকিয়ে আছে। এটাও সাধারণত ক্ষতিকর অমূলক প্রত্যক্ষণ বিভ্রম হিসেবেই
ঘটে। রোগীর এমনও হতে পারে যে, অমূলক শ্রবণ বিভ্রম এবং পেছন
থেকে কাউকে দেখতে পাওয়ার ঘটনা একই সাথে ঘটতে পারে।
তন্দ্রাকালীন
(হিপনাগজিক) এবং অর্ধজাগ্রত (হিপনোপম্পিক) অমূলক প্রত্যক্ষণ বিভ্রমকে সাধারণ ঘটনা
হিসেবেই গণ্য করা হয়। তন্দ্রাকালীন অমূলক প্রত্যক্ষণ বিভ্রম ঘটতে পারে মানুষ যখন
ঘুমাতে যায়। আর অর্ধজাগ্রত অমূলক প্রত্যক্ষণ বিভ্রম ঘটে ঘুম থেকে ওঠার ঠিক আগে।
মাদক সেবনের মাধ্যমেও অমূলক প্রত্যক্ষণ বিভ্রম ঘটতে পারে (বিশেষত চিত্তবিকারকারক
মাদকসমূহ)। এছাড়া অপর্যাপ্ত ঘুম থেকে,
মনোবৈকল্য (Psychosis) থেকে, স্নায়ুকোষ বা স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা থেকে, ডেলিরিয়াম
ট্রিমেনস (DTs-নেশাসৃষ্ট রোগ বিশেষ) থেকে।
অমূলক
প্রত্যক্ষণ বিভ্রম কথাটির ইংরেজি পরিভাষা "হ্যালুসিনেশন" শব্দটির প্রথম
ইংরেজি ভাষায় প্রয়োগ করেন ১৭শ শতাব্দীর চিকিৎসক স্যার টমাস ব্রাউন। ১৬৪৬ সনে
তিনি লাতিন শব্দ আলুসিনারি ("alucinari")
শব্দটি আনয়ন করেন যার অর্থ "মনের ভেতরে ঘুরে বেড়ানো"।
কেবল
হ্যালুসিনেশন তো কোনও সচেতন কবির কবিতা হতে পারে না ? অন্তত সমীরণ ঘোষের মতো কবির তো নয় |
অনেক
বিশেষজ্ঞ পাঠক কবি সমীরণ ঘোষের মধ্যে পরাবাস্তবতার সম্ভাবনা লক্ষ করেছেন | পরাবাস্তবতার দিকটা নাড়া চাড়া করা যাক --
প্যারিসে
থাকা লেখক ও শিল্পীদের ছিন্নভিন্ন করে দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে | এবং
অন্তর্বর্তী সময়ে, অনেকেই দাদার সাথে ( ডাডাইজম ) জড়িত
হয়ে পড়ে, বিশ্বাস করে যে অত্যধিক যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা
এবং বুর্জোয়া মূল্যবোধ বিশ্বে যুদ্ধের দ্বন্দ্ব নিয়ে এসেছে। দাদাবাদীরা
শিল্প-বিরোধী সমাবেশ, পরিবেশনা, লেখা
এবং শিল্পকর্ম নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল। যুদ্ধের পর তারা প্যারিসে ফিরে গেলেও ডাডার কার্যক্রম চলতে থাকে।
যুদ্ধের সময়, আন্দ্রে ব্রেটন , যিনি
মেডিসিন এবং সাইকিয়াট্রিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তিনি একটি
স্নায়বিক হাসপাতালে সেবা করেছিলেন যেখানে তিনি শেল-শক আক্রান্ত সৈন্যদের সাথে
সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন । তরুণ লেখক জ্যাক ভাচের
সাথে দেখা করে, ব্রেটন মনে করেছিল যে ভাচে লেখক এবং
প্যারাফিজিক্সের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড জারির আধ্যাত্মিক পুত্র । তিনি তরুণ লেখকের অসামাজিক মনোভাব এবং
প্রতিষ্ঠিত শিল্প ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞার প্রশংসা করেন। পরে ব্রেটন লিখেছিলেন, "সাহিত্যে, আমাকে
ধারাবাহিকভাবে রিমবডের সাথে , জ্যারির সাথে, অ্যাপোলিনায়ারের সাথে, নুভেউর সাথে , লট্রেমন্টের সাথে নেওয়া হয়েছিল , কিন্তু এটি জ্যাক
ভাচে যার কাছে আমি সবচেয়ে বেশি ঋণী।"
প্যারিসে
ফিরে, ব্রেটন , দাদা কার্যক্রমে যোগদান করেন এবং লুই আরাগন এবং
ফিলিপ সুপল্টের সাথে সাহিত্য জার্নাল লিটারেচার শুরু করেন । তারা স্বয়ংক্রিয়
লেখা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে —তাদের চিন্তাভাবনা
সেন্সর না করেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখা—এবং ম্যাগাজিনে লেখার
পাশাপাশি স্বপ্নের বিবরণ প্রকাশ করে। ব্রেটন এবং সোপল্ট তাদের স্বয়ংক্রিয়তার
কৌশলগুলিকে বিকশিত করে লেখালেখি চালিয়ে যান এবং দ্য ম্যাগনেটিক ফিল্ডস (1920)
প্রকাশ করেন।
1924 সালের
অক্টোবরের মধ্যে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী পরাবাস্তববাদী দল একটি পরাবাস্তববাদী ইশতেহার
প্রকাশের জন্য গঠিত হয়েছিল । প্রত্যেকেই অ্যাপোলিনায়ার দ্বারা প্রবর্তিত একটি
বিপ্লবের উত্তরসূরি বলে দাবি করেছে। ইভান গোলের নেতৃত্বে একটি দলে পিয়েরে
আলবার্ট-বিরোট , পল ডার্মি , সেলিন
আর্নাল্ড , ফ্রান্সিস পিকাবিয়া , ট্রিস্তান
জারা , জিউসেপ্পে উঙ্গারেটি , পিয়েরে
রেভারডি , মার্সেল আরল্যান্ড , জোসেফ
ডেল্টিল , জিন পেইনলেভি এবং রবার্ট ডেইলেভ অন্যান্যদের মধ্যে
ছিলেন । আন্দ্রে
ব্রেটনের নেতৃত্বে দলটি দাবি করেছিল যে সামাজিক পরিবর্তনের জন্য স্বয়ংক্রিয়তা
ছিল দাদার তুলনায় একটি ভাল কৌশল, যেমনটি যারা নেতৃত্বে ছিলেন, যিনি এখন
তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ছিলেন। ব্রেটনের গোষ্ঠীতে পল এলুয়ার্ড , বেঞ্জামিন পেরেট , রেনে ক্রেভেল , রবার্ট ডেসনোস , জ্যাক ব্যারন , ম্যাক্স মরিস , পিয়েরে নেভিল , রজার ভিট্রাক , গালা এলুয়ার্ড , ম্যাক্স আর্নস্ট , সালভা , লুইউরডের মতো বিভিন্ন মিডিয়ার লেখক ও
শিল্পীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বুনুয়েল , ম্যান রে ,
হ্যান্স আরপ , জর্জেস ম্যালকিন , মিশেল লেইরিস , জর্জেস লিম্বর , অ্যান্টোনিন আর্টাউড , রেমন্ড কুইনো , আন্দ্রে ম্যাসন , জোয়ান মিরো , মার্সেল ডুচাম্প , জ্যাক প্রেভার্ট , এবং ইয়েভেস টানগুই ।
পরাবাস্তব
শিল্পও জাদুঘরের পৃষ্ঠপোষকদের কাছে জনপ্রিয়। নিউ ইয়র্ক সিটির গুগেনহেইম
মিউজিয়াম 1999 সালে
টু প্রাইভেট আইস নামে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় এবং 2001 সালে
টেট মডার্ন পরাবাস্তববাদী শিল্পের একটি প্রদর্শনী আয়োজন করে যা 170,000 এরও বেশি দর্শকদের আকর্ষণ করেছিল। 2002 সালে নিউ
ইয়র্ক সিটিতে মেট একটি শো, ডিজায়ার আনবাউন্ড এবং প্যারিসের
সেন্টার জর্জেস পম্পিডো লা রেভোলিউশন সার্রালিস্ট নামে একটি শো অনুষ্ঠিত হয়েছিল ।
শিকাগো
পরাবাস্তববাদী গ্রুপ , লিডস
পরাবাস্তববাদী গ্রুপ এবং স্টকহোমের পরাবাস্তববাদী গ্রুপের মতো গ্রুপগুলি নিয়ে
পরাবাস্তববাদী গোষ্ঠী এবং সাহিত্য প্রকাশনাগুলি বর্তমান দিন পর্যন্ত সক্রিয়
রয়েছে । চেক-স্লোভাক পরাবাস্তববাদীদের জান ভাঙ্কমাজার চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং
বস্তু নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আসলে
পরাবাস্তব বলি বা হ্যালুসিনেশন কোনও কিছু দিয়েই একজন সৎ ও মহৎ কবিকে বিচার করা যায়
না | তিনি যদি আদি অনাদি আবিশ্বের
ইতিহাসের সঙ্গে কাঁটাতারহীন মানব মনের সভ্যতার প্রবাহ ও মানুষের মনস্তাত্বিক
দ্বন্দ্ব জটিলতা ও সর্বত্রগামী সভ্যতার ক্ষতগুলোকে নিয়ে ভাবিত হন | এক বেদনার সীমাহীন সংকটে বিক্ষত হন , তখন বোঝা যায় ,
যে কোনও মৌলিক মহৎ কবির মতো তিনি কত আর্ত ও অসহায় | একজন কবি গঠনগত ও ভাবনাগত প্রাতিস্বিকতার জোরেই সাধারণ থেকে অসাধারণ ভাবুক
কবিতে পরিণত
হন | যেহেতু প্রত্যেক কবিতাই স্বয়ংক্রিয় এবং প্রতিটি কবিতাই
শূন্য থেকে চলা শুরু করে , তাই একই কবির দুটো আলাদা আলাদা
ভাবের কবিতা নিয়ে এক রকম মন্তব্য করা একদেশদর্শিতার পরিচয় হয়ে ওঠে | কবি সমীরণ ঘোষের মনন ও মনোবীজ কী ? তার মানসচর্চার
প্রেক্ষা ও ক্রম ও বিকাশ নিয়ে ভাবতে গেলে আমরা পাই আত্মগত সুর সীমাহীন সময়
অতিক্রান্ত হয়ে অন্তর্বাহী ভাবমন্ডল ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবনাপ্রসূত দৃশ্যকল্প
নিয়ে অজস্র শব্দগ্রন্থনার মধ্যে দিয়ে প্রাতিস্বিক এক নিজস্ব রীতির
প্রতিষ্ঠা | এরফলে সমকালীন দীক্ষিত পাঠকও অভ্যস্ত কবিতা -
সংস্কারকে অতিক্রম করতে না পেরে অনেকসময় ওপরে ওপরে পাঠ শেষ করেন বা পীড়িত হন |
কিন্তু সমীরণ ঘোষের লেখার একটা নিজস্ব যাদু আছে | তার সৃষ্টির অন্তর্নিহিত তড়িৎশক্তির অভিঘাতে পাঠক মজে যান | কিন্তু কতটা আত্মখননের মধ্যে গিয়ে তার ভাবনাপ্রসূত চিন্তনকে আত্মসাৎ করা
যায় , তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায় | কবিতার
যথার্থ মূল্যায়নের জন্য বিপুলা পৃথ্বী ও নিরবধিকালের স্থানগত ও সময়গত বিস্তৃতি
প্রয়োজন | যুগরুচির অনুমোদনে অনেক বড়ো কবির কবিতার সঠিক
মূল্যায়ন হতে বহু বহু সময় চলে গেছে | এরপরেও অনাবিষ্কৃত থেকে
গেছেন অনেকেই |
উইলিয়াম
ফকনারের একটি লেখার বিষয় ছিল , ' লেখকদের আমি বিচার করি কীভাবে ' -- সেই প্রসঙ্গে
বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন , ' অসম্ভবকে ধরতে গিয়ে তাঁদের মহৎ
বিফলতার ভিত্তিতে |' মানব অভিজ্ঞতার সূক্ষাতিসূক্ষ্ম
মুহূর্তগুলোকে শিল্প - সম্ভব করার জন্য কে কত অসম্ভব ধরনের ঝুঁকি নিতে পেরেছেন -- এরই ভিত্তিতে উইলিয়াম ফকনার বড়ো কবি আর মাঝারি কবি বা লেখকদের ভেদ নিরূপণ করতেন | তাহলে বলতেই
হয় , পাঠককে তৈরী হতে হয় , কবি '
র ধ্রুপদী ভাবনার ও মহৎ অভিজ্ঞতার অনুষঙ্গগুলোকে বুঝতে গেলে |
অভ্যস্ত পাঠক তাই অনেক সময় নতুন শক্তিশালী ও মৌলিক কবির কবিতাকে
উপলব্ধি করতে না পেরে , হয় নীরব থাকেন , না হয় বিদ্রুপ করেন | সমীরণ ঘোষের যথার্থ পাঠক
সত্যিকরেই কি প্রস্তুত ?
তিন .
ওষ্ঠবিষ
..............
কবি' র সবচে বড়ো সম্পদ তার বেদনা , তার রক্তে মজ্জা অস্তিত্বে এমন এক সর্বব্যাপী বিষাদ রয়েছে | রয়েছে এমন এক শোক , যার কারণে আর পাঁচটা মানুষের মতো দৈনন্দিন জীবনে থেকেও নিজের
মুদ্রাদোষে সে একা | কবির বোধ ও বোধের ব্যাপ্তি ব্যক্তি থেকে
বৃহতের দিকে ছুটে যায় | বিষয় বাসনা , চাকরির
উন্নতি , সংসার চালানো সন্তান প্রতিপালন সবই তাকে করতে হয় |
জনারণ্যে সে সবার মতোই ভিড়ের মানুষ | কিন্তু
বোধের তাড়নায় সে ক্রমশ একা হতে থাকে | কবিতা এমন এক আরোগ্য
আবার প্রতিবিধানহীন কালব্যাধি যে এই কাল বা সময় যা আবার খন্ড থেকে শাশ্বতের দিকে
যাত্রা করেছে , সেই সীমাহীন সময়ের মাঝখানে , দেশ কাল সমাজ সংসারের বেড়াজাল ভেদ করে কবির চেতনা সর্বত্রগামী | তাই সে গভীরে অসুস্থ ও অস্থির | নিদ্রাহীন |
সমীরণ ঘোষের
একটা বয়ান এ প্রসঙ্গে তুলে ধরি --
" নিজে
যে একলাইনও পারিনি,তা আমার থেকে কেউ বেশি বোঝেন না। বা হয়তো তাঁরাও বোঝেনও। আর তাঁদের এই
বোঝাটাই আমার চিরস্মরণীয়। প্রাপ্তি। কিছুই পারিনি, আর তাই
কোনো দশকের হুজুগেও থাকিনি। কোনো কবিসভায় পারত যাইনি। করেগোনা কয়েকজন বন্ধুকবিলেখক
ছাড়া দীক্ষাহীন খর্বুটে। আমার মফস্ সল আর আমি আমাদের নদীর চাতালে গড়িয়ে জলেকাদায় হেলেবেলে
মুহ্যমান আর আতুরআউলিয়া, যে বিচ্ছুরণে ছিলাম, তা ভাঙল
যখন প্রকাশকের আওতায় এলাম। নিজের অর্থে ছোট্টমুচ্ছো স্বাধীনতাও বরবাদ হল। তাঁদের
প্রতাপপ্রতিপত্তির ঘেরে আমার একাকীও গেল। আমার সাঁইও সঙ্গ ছাড়ল আমার। এখন
খুবনিরন্তর মনে হয় খুবএকটা ছোট্টফুরুত চা-দোকানের কুপিনিংড়ানো বেঞ্চের কোণে যদি
শেষ পাণ্ডুলিপিটা ছেড়ে আসতে পারতাম। যদি সাঁই তাতে হাত বোলান। সন্তানের অবোধ খেলনার
আবেগে শূন্যের সেল্ফে রাখেন। সেই কণাসঞ্চার আমার ফুরোনোকালের শীতে শেষের তরাই। সাঁই আমার শেষ
প্রকাশক। আমার গুজরান। সূর্যাস্ত আমার পিঠে শেষ হেলানে পড়ে। "
এই বিনয়
স্বমগ্ন ধ্যানীর | বিশিষ্ট
কবি প্রাবন্ধিক অনুবাদক রঞ্জিত সিংহ , কবির এই সার্থক বেদনার প্রসঙ্গে বলতে
গিয়ে , কবিতার জন্ম নামক প্রবন্ধের এক জায়গায় বলছেন ,"
বেদনা যেমন দুঃখের সমার্থবাচক তেমনি জ্ঞানেরও সে সমার্থবাচক | জ্ঞানই দুঃখের কারণস্বরূপ | প্রকৃত জ্ঞান মানেই
প্রকৃত দুঃখ | বাল্মীকির সেই জ্ঞানচক্ষু বা চৈতন্যের উন্মেষ
ঘটেছিলো ক্ৰৌঞ্চীর মৃত্যুতে | বেদব্যাসের মহাভারত আরও গভীর
শোকবার্তাবহনকারী মহাকাব্য | এই কাব্য আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে এই কুরু - পাণ্ডবের
আঠারো দিনের যুদ্ধ আমাদের চিত্তে আবহমানকাল ঘটিয়ে চলেছে |
ক্ষমতার লোভ
যে কত বড় দাবদাহ যা মানুষের নিকৃষ্টতম প্রবৃত্তিকে টেনে বের করে স্বসংহারে রত হয় | এই কাব্যের আগাগোড়াই শোক , কিন্তু
এই শোক কখনো দম্ভের আকারে , কখনো ঈর্ষার আকারে , কখনো নারী নির্যাতনে বা অন্ধ পিতৃত্বের মুখোশে বা প্রশ্রয়ে এক চিরকালীন
শ্মশান ভূমিতে পরিণত | বেদব্যাস এই কাব্যের রচনাকার এবং এই কাব্যের অন্যতম চরিত্র | এইখানকার প্রধান চরিত্রাবলীর অনেকেই তাঁর রক্ত বহন
করেছেন | সমস্ত শোককে আত্মস্থ করে এই কবির এই বিয়োগান্ত
মহাকাব্য রচিত হয়েছে | এই মহাকাব্যে যেমন জয়ের উল্লাস নেই ,
গরিমাও নেই তেমনি যারা পরাজিত তাদের চিত্তে গ্লানিও নেই | এ এক অত্যত্ভূত শ্মশানবৈরাগ্য ||"
কি অসামান্য
বিশ্লেষণ রঞ্জিত সিংহের ! কত বড় ভাবুক হলে ,
কবিতার জন্ম ও কবির মনোভূমি নিয়ে এরকম কথা বলতে পারেন |
এই গদ্যেই
আরেকজায়গায় রঞ্জিত সিংহ বলছেন , " কবিতার জন্মমুহূর্ত বেদনদিগ্ধ | কিন্তু কী রূপে
তার প্রকাশ হয় তা হয়তো কবিও আগে থেকেই অনুমানও করতে পারেন না | মধুসূদনের বিশৃঙ্খল জীবনটাই তাঁর কবি মানসিকতা | ঐ
মানসিকতা তাঁর কবিতার জন্মমুহূর্ত | অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ যদি শৃঙ্খলাপরায়ণ সংযমী না হতেন তবে তাঁর পরিচয় হতো মহর্ষি
দেবেন্দ্রনাথের অষ্টম পুত্র | ঐ সুসংহত মানসিকতা আবার
রবীন্দ্রনাথের কবিতার জন্মমুহূর্ত | "
কবি সমীরণ
ঘোষের কবিতায় যে সমান্তরাল আদিম পৃথিবীর অল্টারনেটিভ সত্তাকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখি
| একদিকে নৈসর্গিক রিপু | যেন বিজনের রক্তমাংস | এই বিজন হলো পৃথিবীর ক্রম
পরিবর্তিত রূপ | অন্যদিকে পৃথিবীর মানুষের আদি থেকে এখন
পর্যন্ত যে শাশ্বত পরিবর্তন সেই আপাত বাহ্য এবং অভ্যন্তরের যে টানাপোড়েন , যে
লোভ লালসা রিরংসা দম্ভ অহমিকা ভোগবাসনা আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে মানুষের যে ভয়ঙ্কর
আধিপত্য যুদ্ধ রক্তের সমুদ্রমন্থন যে পাপ অনাচার দেশে দেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে ,
বারংবার অন্যায় ধ্বস্ত করছে ন্যায়ের ন্যায়দন্ড | এই ভয়ঙ্কর শক্তির পুনরুত্থান যা মানুষের মেকি ছদ্মবেশে , যার জন্যই কবির ব্যথা অনুতাপ ও মানসপটে রক্তক্ষরণ ও বিদ্রোহ | এই বেদনার কোনও শুরু শেষ নেই | নিসর্গের ভেতরে অজস্র
সময়ের ছবি , কূটাভাষ
, কেবল দৃশ্যের জন্ম দেয় না , দেয় এমন
সমস্ত দৃশ্যকেন্দ্রে কবির মনোভাব যা একই ভাবে আমাদেরকেও জ্বলন্ত অঙ্গারের আলোয়
জ্বলা ছায়ামূর্তির মতো প্রজ্বলিত করে তোলে | পৃথিবীতে মাছির
মতো সাধারণ পাটোয়ারী মানুষের ভিড় | তাদের গন্তব্য নেই কেবল
গতিপথ আছে | তারাই তাৎক্ষণিক ক্ষমতার দম্ভে মানুষকে জীবিকা
করে , জমিতে বিষ ছড়ায় | জঙ্গলের পর
জঙ্গল উড়িয়ে বহুতল খাঁচা বানায় | মূল উপড়ে পৃথিবীর নিজস্ব
গভীরতাকে ঘুলিয়ে তোলে | তারা পাথর ফাটিয়ে জমিতে ছড়ায় |
সোনার জন্য লোভের জন্য জঙ্গলের নিরপরাধ পশু থেকে শুরু করে মাটি
খুঁড়ে পৃথিবীকে ছিঁড়ে উপড়ে তোলে ... এই ঔপনিবেশিক মানব সভ্যতা যেখানেই ছুঁয়েছে
সেখানেই শুরু হয়েছে ক্ষত , যন্ত্রণা | একাকী
আর্ত কবি সেই যন্ত্রণার কথা বলেন নিজের সাইঁকে | কবির সেই
পথে আমাদের এবার যাত্রা শুরু ۔۔۔۔
চার .
সমাংসভণিতা
........................
কবি সমীরণ
ঘোষের লেখালিখি চর্চার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ,
বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে যে বহুস্তরীয় বহুরৈখিক বাঁকবদলগুলো
আমাদের চোখে পড়ে তার উৎসমুখ বা এপিসেন্টার হলো মানসিকজগৎ | আদিম
রিপু চালিত পৃথিবী এবং প্রাগৈতিহাসিক অসভ্য মানুষের থেকে শুরু করে সভ্য মানুষের
রণক্লান্ত উত্তরণ না অবনমন ? সেই ইতিহাস | যাইহোক , সমীরণ ঘোষের বইগুলোর নাম এবং কবিতার কিছু
তুলে ধরার আগে , তার এই۔ ক্রমবিবর্তিত মনের মৌল অস্থিরতা অনিশ্চয়
দ্বন্দ্ব বিষাদ প্রেম বিদ্রোহ সমকালীন সমাজবাস্তবতার খন্ড খন্ড ছবি , instincts , auto - eroticism , ego - instincts of self -
preservation , অব্যক্ত অনুভবের প্রকাশের জন্য ধারাবাহিক দৃশ্যকল্প ,
ও ভাবনার নিরাবেগ নিরাসক্তির একটা process , স্পন্টেনিটি
, একটা স্পার্কিংজোন থেকে তাৎক্ষণিক অস্থিরতাকে ছাপিয়ে
চেতনবিন্দুর আলো - অন্ধকারের ক্রসিংগুলোকে নিয়ে ভাষার নিরীক্ষাগুলোকে | কয়েকটি ভাগে ভাগ করে যা যা পেলাম তার একটা চলমান বৈশিষ্টগুলো এখানে তুলে ধরছি --
এক .
সমীরণ ঘোষ
একজন সমগ্র সময়ের শিল্পী | তিনি
শব্দ দিয়ে ছবি এবং ছবির সম্প্রসারিত আকার অবয়ব হেত্বাভাস ছড়িয়ে দেন কবিতায় |
জলস্থল অন্তরীক্ষের প্রাণীবলয় গভীর থেকে গভীরে রূপ সঞ্চারণশীল |
বহুবিচিত্র মানবিক চরিত্রের মধ্যস্বত্বভোগী ইন্দ্রিয়পতন ও
ইন্দ্রিয়াতীত অবস্থান অসামান্য শব্দে কবিতায় তুলে ধরেছেন | মানুষের
বহুস্তরীয় আত্মস্বর ভয় ও চিৎকারসমূহ উঠে এসেছে এক নির্মোহ ভয়ঙ্কর ভাষায় | যদিও সংবেদনশীল এই কবির মানবিক চৈতন্য ও অবচেতনের নানারকম ইমাজিনেশন যেন
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে অন্ধের লাঠির স্পর্শে জেগে ওঠে কেবল | যেন ক্ষণবিদ্যুতে চকিত অপাবৃত বাসনালোকের ছবি |
কেবল শূন্য থেকে নেমে আসা অন্ধকারের অবয়ব ভাঙে গড়ে | এ স্তব্ধতার ব্যথা স্বপ্নে বোনা হয় , রোয়া হয় না |
নিজেরই স্নায়ুতে কশেরুকা ভেঙে নুয়ে গেছে যে সভ্যতার বিষ সেখানে অবনত
সৃজনইচ্ছুক অথচ রোপণে
ব্যর্থ মানুষদের অক্ষমতা খরনখরে বুক চিরে দেয় | মৃত্যু ও
রমনীয়তায় ছড়িয়ে পড়ে সর্বব্যাপক অস্তিত্বে এক অনাস্বাদিত সৌন্দর্য্য |
দুই .
তার কবিতায় , চির কুয়াশা নিকোনো রাস্তায় দোল খায় আবহ শব্দ ,
আবহ বিষাদ , আবহ দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর ,
আবহগান | তার দুঃখ জমে গাছ হয়ে আর দীপ্রশাখায়
যার ঝুলে আছে সুনিশ্চিত ফল| স্পর্শযোগ্য খাতায় শব্দের
শব্দক্রন্ধনে বোনেন কবিতা | একদিকে ভালোবাসার আকুল অস্ফুট
বৈরাগ্য ব্যাধি অন্যদিকে সময়ের শাশ্বত বহুরূপী | যা
মর্মমূলের উৎকেন্দ্রে গিয়ে আমাদের ভাবায় | আছে নগর বা
গ্রামকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিপন্নতা যার নাগপাশে দিনান্তে ' কলের
বাঁশির ' মতো তীব্রভাবে বেজে ওঠে মানুষের অপ্রাপ্তির অন্ধকার | দুনিয়াদারির লোভে ক্ষমতাবান মানুষের আহ্লাদ আর তার বিপ্রতীপে আদুল শরীরে
দাঁড়ানো বুভুক্ষ | ছেঁড়া রুটির পাশে দেশের ব্যর্থ পিছিয়ে পড়া
মানুষ | এদিকে সাবল্টার্নের জগৎ নিয়ে গবেষণা করেন উচ্চকোটির
পন্ডিত !
তিন .
আছে জলযাত্রা
| বড়ো ক্যানভাস | মানসিক ভূ পর্যটন | যেখানে অদৃশ্য টাইম ম্যাশিনে করে কবি সময়হীন সময়ে
যাত্রা করেছেন পৃথিবীর পথে | আছে আলো - অন্ধকারকে ব্যবহার
করার নিপুন দক্ষতা | কখনো আলোর ইশারায় জলের নিচে অতলস্পর্শী
স্বচ্ছতার কাছাকাছি এসে মনে হয় কখন যেন খাদের সীমায় দাঁড়িয়ে আছি | কখনো শব্দের রঙ ক্যাটকেটে লাল | মিশকালো শ্যামার
শ্মশানভৈরবীর মতো গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ | কখনো বিষণ্ণতার সঙ্গে মিশেছে উদাসী ধূসর রঙ | আবার মৃদু সবুজ ক্রোধ আক্রোশ রিরংসা ঘৃণা | আবার
ক্রমশ নিষুপ্তির
মধ্যে ডুবে থাকা শান্তির আধারটি কারুবাসনার রঙে ছায়াচ্ছন্ন | কোথাও আবার এমন শূন্যের মাথায় মানুষের বিমূর্ত ঘর যেখানে ঝড়ের বিক্রমও
হেরে যায় প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় | তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুদ্র
অসহায় মানুষের ঘর কংক্রিটের বেঁটে পালোয়ানের মতো মাটি আঁকড়ে অসম শক্তিধর
প্রতিদ্বন্দ্বীকে আটকে রাখে |
চার .
সমীরণ ঘোষের
শব্দ প্রয়োগ ও শব্দের ভান্ডার বৈচিত্রময় |
বহুস্তরীয় | কোনও কোনও শব্দের অর্থটাই তার
অস্তিত্ব | মূর্তি তার প্রায় নেই | আবার
কোনও কোনও শব্দ উচ্চারণমাত্র তার মূর্তিটাই আগে এসে দাঁড়ায় | মূর্তির আলোছায়ার হাতছানিতে তার অর্থ অনেক দূরে দূরে চলে যেতে পারে |
প্রদোষের দেশে , রহস্যের দেশে চলে যেতে পারে |
স্থির অর্থের বাঁধনে বাঁধা শব্দগুলো যুক্তির , বুদ্ধির , ব্যবহারিক কাজের | আর
মূর্তিধরা শব্দগুলো কবিতার | শব্দ বোধ হয় এইভাবেই বর্ণ ও
ধ্বনির মধ্যে এসে ব্রহ্ম হয় | নিজের বাইরে বিচ্ছুরিত হয় ,
আবার নিজের কেন্দ্রে সংহত হয়ে আসে | শব্দ
ব্রহ্ম হতে পারে , ভাষা কিন্তু ব্রহ্ম নয় | না হলে ভাষা কি করে পরিবর্তিত হয় , দোআঁশলা হয় ?
এই ভাষাবৈচিত্রের একটি স্রোত আপাতপ্রতীয়মান | আবার
কখনো গূঢ় রহস্যের আড়ালে সদাপ্রবাহিত | খুব স্বাভাবিক ভাবেই
অতিপ্রাকৃতিক রহস্য , আধিবিদ্যক ও সাঁই অবলম্বনে কবিতা কবির
মানসিক আশ্রয় ও জীবনরসের পক্ষে খুব প্রয়োজনীয় | প্রকৃতির মতো সাঁই , অধিবিদ্যা
, প্যারাসাইকোলোজি , অকাল্ট ও নানাবিধ
দার্শনিক ভাবনা মিলেমিশে অধিকার করে আছে আমাদের উপস্থ থেকে সহস্রার অবধি সম্পূর্ণ
দেহ | শরীর ও মনের এইসব আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা ছড়িয়ে আছে
পৃথিবীর নানা দেশের গূঢ় কবিতার মধ্যে | এই চমৎকার দৃষ্টান্ত
হিসেবে ষটচক্রের অবস্থান ও দেহতত্বের অবস্থান নির্ণয় তার অনেক কবিতায় আমরা পাই |
পাঁচ .
অভিজ্ঞতা , তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও মহাবিশ্বের ইতিহাস উপলব্ধি প্রথম
থেকেই সমীরণের মনে শ্রেণীসংগ্রামের চিন্তা রোপণ করেছে | পরবর্তীকালে
, শহরতলিতে জমে ওঠা দুর্ভর , আবর্জনার
মতো জীবন তার অস্তিত্বকে নিয়ে গেছে অসহায় আত্মলাঘবতার দিকে , কিছু কিছু লেখায় | কিন্তু এই সব ক্ষোভ প্রতিআক্রমণ
কিংবা বিপর্যয়ে নয় , সমীরণের কবিতা সত্যিকারের মহত্ত্ব পায়
যখন তিনি প্রত্যক্ষনিষ্ঠ নিকট - বাস্তবের উপর ভর করে , ইতিহাসের
উপলব্ধি দিয়ে , দ্রষ্টার মতো অতীত থেকে ভবিষ্যতের অনাগত অনেক
দূর দেখতে পান | ক্রমশ বক্তব্য সীমিত হয়ে গেল , তাৎপর্য হারালো , নানান প্রতীকে হয়ে উঠলো ব্যঞ্জনাময় |
এই প্রবৃত্তির ফলে স্বভাবতই তার কোনো ভাবের কোনো বিশিষ্ট প্রতীক নেই
, তারা তাদের স্থির ব্যঞ্জনা ও নির্দিষ্ট মূর্তিরূপ হারিয়ে
হলো গলানো কাঁচা মালের মতো | এবং সেইজন্যেই , মেদ মাংস , শিশ্নরক্ত , চর্বি ,
রক্তঅস্ফুটঅবরোহ , অগ্নিসেদ্ধজিভ , বমনউদ্গার যোনিকেশময় মেয়েদল , খুলির পাত্র ,
ধর্ষিত
মাংসের আলেয়া , টাটকা
রাং , এরম কত শব্দ !
ছয় .
সীমাহীন
সময়ের পর্যটন আমরা দেখি সমীরণ ঘোষের কবিতায় |
বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত অবিমিশ্র ঘটনা পরম্পরায় বসিয়ে তাদের
পরিণাম নিয়ে নির্বিকার নিরাসক্তির আসক্তি নিয়ে দার্শনিক নিরীক্ষণ | ট্রায়াল এন্ড এরার পদ্ধতিতে সংশোধন | গ্রহণ - বর্জন |
অশিক্ষিত পটুত্বের প্রতি তীব্র উদাসীনতা থেকে পরিশ্রমলব্ধ সচেতন
প্রস্তুতি | এর সঙ্গে স্কিল , সাপলনেস , স্ট্রেংথ ও স্পিরিট
| সঙ্গে মানসিকতা | এরসঙ্গে কখনো কখনো
এসেছে তন্ত্রানুষঙ্গ
| তা কখনো সাত্ত্বিকের দিব্যজ্ঞানের উপলব্ধি থেকে নয় |
এসেছে মানুষেরই অস্তিত্বসংকটের ভীতিকর আশ্রয় থেকে | তন্ত্র এখানে মৃত্যুভীতিকর দ্বারা পীড়িত হওয়া এক দুর্বহ আশঙ্কা , একটি মনস্তাত্বিক প্রবণতাও | আদিম অনাঘ্রাত পৃথিবীতে
, মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ যে অহং পাপ ও অনাচারের ঘোরে বশংবদ
হয় , পৃথিবীর এই ভীতিকর বিনষ্ঠিতে মানুষের তাৎক্ষণিক মোহ ও
সভ্যতার পরম্পরায় যে বাসনার উদগ্রতা তার ফলভোগ মানুষকেই করতে হয় | এই ফলাফল ও আতঙ্কের শিহরণ দিয়েই তার কবিতায় তন্ত্রবোধ প্রকাশিত |
সাত .
সাধারণ
মানুষের চেয়ে কবিরা হন বেশি সংবেদনশীল |
যদি তিনি সৎ , তীব্র মানবিক
হন , তাহলে তো এই ভ্রষ্ট সময়বহনকারী ব্যক্তি হিসেবে তার
স্বপ্ন এবং ঘুম লোপাট হবেই | ফিলিং অফ স্পন্টেনিটি ও
সত্যনিষ্ঠ সমাজসচেতনতা প্রয়োজনীয় এই ইনভল্বমেন্টের সঙ্গে আবেগসঞ্জাত মেধানির্ভর
ধাক্কাগুলো ভেতরে ভেতরে চাড়িয়ে দেবে এই ' এলিয়েনেশনের ' বিরুদ্ধে |
এই চলমান চূড়ান্ত সভ্যতায় গ্রামীণ প্রেক্ষা ও নাগরিক অনিকেত অরক্ষিত
মরণোন্মুখি ছুটে চলা শহুরে মানুষের প্রারব্ধ ও গলিত জীবনবৃত্ত যা নগ্ন রাজনৈতিক
বাহুবলি ক্ষমতা ও অর্থের কাছে প্রায় সমর্পিত ,তার
একের পর এক শব্দের ছবি দিয়ে কবিতার সাউন্ড ট্র্যাকে বাজিয়েছেন কবি | তার ক্যামেরার লেন্স ৩০০ লং ফোকাসে বিশেষ এঙ্গেলে যে বিশেষ এফেক্ট তৈরী
করেছে তাতে দেখছি সমস্ত কিছুই অবিমিশ্র | যেখানে রাজনীতি ,
ফাঁসবাঁধা জন্তুর ভাসান গান , মিডিয়া - বন্দনা
, ঘরের পরবাস , পাখিবর্জিত শহুরে গাছের
লৌহ কলেবর , লক্কা কসাই , বিশ্বায়নের
স্বপ্ন , শিল্পউন্নয়নের পরোক্ষ রাজনীতি , খোলা বাজারের ছুরি , ছায়াবণিকের পথ , সুফিবেদনার জোব্বা , জেনানামজুর ও কুঠরোগী , আলোর কুদ্দুম ও তারার ভেয়ান ,ফকিরি - চিরাগ , ভ্রান্তি
নিশি ও মোহের কামান , গান্ডুদিনলিপি , প্রাইমুলা , গুপ্তকূপ ,
গরিবগঞ্জের আলো , নগরশ্মশান , মুদ্দোফরাশ , বর্ষাসঙ্কুল দিন , ভেজা চর্যাকাল , মানবীমোহন , দেহলতিকার
বেড়া , নক্ষত্রচূর্ণভরা জল , কালের
পুকার , কবন্ধ নদীপাড় , হদ্দহুতুম
বাঁকাপথ , শ্রমণসম্ভাষ , কুরঙ্গঘোর ,
গ্লানির গাঁটরি কাঁধে কবির বাজার , অন্ধ সীমান্তের চাঁদ ,
শূন্যে ঝাপান দেয় উদ্বাস্তু কলোনি , ডোম নারী
ও আধ খাওয়া খোট্টা প্রেমের গান , অনচ্ছনাকাব , বীজরূপ , মাংসজটিলঅবকাশ ,
প্রায়ান্ধমুকুরে
জতুঘর , ব্রহ্মমরীচিকা , গৃহযুদ্ধের খেপাষাঁড় , বনসাই রাজার প্রেম ও
উলুখাগড়ার অন্তিম শয়ান , ধূসর অধরা ভুট্টারাশি , সত্যের জিলেটিন , বোবাজুম খুলির আকাশ ও বাহুবলী
অস্ত্রের পরিহাস , ঘটনানিহিতে এক হামবড়া শতাব্দীর হরবোলা ,
অলীক পাঁচফোড়ন যা দিয়ে তৈরী এই জগৎ - ঘূর্ণি , রক্তহিমমরু ও এক চক্ষু খরগোশের গর্ত , চোঁয়া ঢেকুর ও
আত্মরতি , পথে পথে রুপেয়া পয়মাল , আমূল হিরামন
ছুরি বিঁধেছে পিঠে , ছেঁড়া জামা জুতো পাথর খাদানের পাশে ,
সাঁই ঠান্ডা কুঁজোই বলো সেকের রুমাল , জিভ ও
বঁড়শির ছলে অনেক জানালা , তারাদল মাধুরীফেরৎ , বিন্দুপ্রধান বাড়ি সাঁই , পায়ের পাতায় ভরা চাঁদ ,
লজঝড় ঊনসন্ধির
ভাষা , উড়ানখাটালা , উপজীবিকার টিলা ,
নিজেই লবঝে কাটি দেবী - অঙ্গুলি , স্বর্ণগোধিকার
আলখাল্লা , ঝরোকামুখ অববাহিকার দেশে ঝাঁজিশ্যাওলারও বড়ো জেদি
, প্রপিতামহের নৌকা অনির্দিষ্ট অতল জলের , বহুপ্রজ রক্তকমল উগড়ে দিচ্ছে স্ফীতযোনি ....
লাখ লাখ এরম
উদাহরণ দেওয়া যায় | সমীরণ
ঘোষের রত্নপেটিকায় অফুর
শব্দের খাজনা | যদি মানুষের জীবনে শব্দের মূল্য অর্থের
মূল্যের মতো অর্থময় হয়ে উঠতো তাহলে গুমখুন হয়ে যেতেন সমীরণ | কিন্তু পোস্টকলোনিয়াল কন্সেপ্টে বড়ো হওয়া সভ্য মানুষ নিজের তৈরী অর্থের
অনর্থে এমন ভাবে চরকিপাকে
নাজেহাল যে শব্দের যথার্থ অর্থমূল্য তাদের কাছে অনর্থক !
তাই
শব্দকুশলী সমীরণের শব্দ কখনো অব্যর্থ স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতার মতো | আবার কয়েকটি শব্দ মিলে একটি ব্যাপ্ত সম্ভাবনাময়
কবিতাকে বহুস্তরীয় রসায়নে প্রতিভাত করতে পারে | তার
নির্বাচিত শব্দ এতো দৃশ্যময় ও বাগ্ময় যে ধ্বনিগুণ ও দৃশ্যগুণ নিয়ে প্রলয়পয়োধি জলে
গিরিগোবর্ধনের কনিষ্ঠায় আবিশ্ব ধরতে পারে | এতো সম্ভাবনাময়
নতুন আবার ক্ল্যাসিক বা ধ্রুপদী যে এটাই প্রমাণ করে , বিশ্বের
যেকোন মহাকাব্য যেমন চির আধুনিক তেমনি কোনও কোনও লেখায় বারংবার মহাকাব্যিক ইশারায়
চিরকালীন ও আবহমান সময়ের নিরিখে সময়হীন এক সময়কে ছুঁয়ে রেখেছে তার কবিতা | বিচিত্রবিদ্যা ও বিশ্বায়নের ঔদার্যে তার কবিতাকে যেভাবেই দেখি না কেন ,
আন্তোনিও গ্রামসির মতে তার কবিতাকে আমরা মেধা শ্রমিকের কবিতাই বলি
বা শব্দকুশলতার সঙ্গে মেধা ও বিশেষ মননের মধু মিলিয়ে কল্পনার ঔদার্য্যে ও
বুদ্ধিবৃত্তির ক্রিয়ায় এক সময়হীন জীবনের আততি মেশে যার সঙ্গে | তাকে কোনও এক অবস্থানের কৌলিন্য দিয়ে বিচার করা মূঢ়তার সমান হয় | তার মেধা কখনোই মেকি নয় , মননশীল চিরজীবীতের বুদ্ধি
ও বোধের পথে এক কবির মানবিক যন্ত্রণার ছবি যেন | আদর্শহীন
ভোগবাদের অতিকৃতির বিপ্রতীপে চলা এই কবিতা ধ্রুপদী ভাবনা ও নবীন ভাবনার অনিবার্য
সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে প্রাণের দীপায়নে সভ্যতার নিহিত উপকরণের সার্থক চিত্র তুলে ধরা
এক আবশ্যিক দলিল |
পাঁচ .
সাঁই আমাকে
ওড়াও
.................................
বিশিষ্ট কবি
ও আলোচক সমরেন্দ্র দাস | সত্তর
দশকের " আত্মপ্রকাশ " নামক লিটল ম্যাগের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক |
আমার অত্যন্ত
প্রিয় একটি কবিতার বই ,
" চাঁদলাগা
চৌষট্টি আসমান " কবিতার বইয়ের কবিতাগুলো নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন ,
" অবিনশ্বর বিশ্বব্রক্ষ্মণ্ডের ভিতর যেন প্রস্তরপ্রমাণ মহাকাশ ঘুমিয়ে পড়েছে৷ শূন্য
শ্যাম,হ্লাদিনীর ভেলা,রূপরাঙা
অষ্টকুসুম৷ আর চতুর্দিকে এক মরিয়া ঘুর্ণি৷ ঘনযামিনীর কূলে মায়া-সর্পের অরণ্য৷বনে
বনে অগ্নি আহ্বান৷ সেইখানেই কি তবে কবিতার পদ্মরাগ মণি? সেইখানেই
মায়াকণিকার আলো! কবি কি বারবার অতিক্রম করতে চান চাঁদলাগা চৌষট্টি আশমান!
সমাধিস্তম্ভের ক্ষীণ আলোয় কীভাবে দেখা যায় তবে রজমুগ্ধ লাল কাপড় অথবা যোগিনীর
চৌষট্টি পোষাক !
আশির এই কবির
আয়ূধ, প্রলয়প্রবল ভাষা৷ তিনি শুধু
পুড়ে যাওয়া স্মৃতি ও সময় ধরে কাগজের ঝিলে চিত্রকল্প ছড়িয়ে দিয়েছেন৷ এ যেন এক
বোধিবৃক্ষতলে অনন্তের আঙুলে বাজছে চিহ্নহীন মৃতের রবার৷ সেই তো কবির নিখিলনিশান৷
সমীরণ তত্ত্ব
লেখেননি, তন্ত্রকে কবিতার রসে জারিত করে
এক নতুন উড়ান দিতে চেয়েছেন; যেখানে একজন কবির কাব্যদর্শন,
শিল্পবোধ, মননচর্যা ও শব্দবন্ধের নবনির্মাণ
সৃষ্টির আলোকে প্রতীকী দ্যোতনা এনেছে৷ এ এক অপূর্বকল্পিত পরম প্রাপ্তি৷"
এখানে বাড়তি
একটি শব্দও আমি বসাবো না | আমরা
যারা দীর্ঘদিন ধরে কবিতা ও কাব্যিক আলোচনা পাঠ করে আসছি , তারা জানি
সমরেন্দ্র দাসের কাব্যিক বোধ ও চিন্তন কতটা গভীর ও নেয্য | তার
এই মতামতকে খুব গুরুত্বের সঙ্গেই গ্রহণ করেছি আমি | তাই এ
প্রসঙ্গে আর কিছুই বলবো না |
ছয় .
কিছুটা বনের
রং দিয়ে আঁকা নীলকণ্ঠ পাখি
.................................................................
লেখাটি শেষ
করবো একটু অন্যভাবে | অনেক
সিনেমায় আমরা দেখি যে সিনেমা শুরু হয়ে গেলো একদম শেষে টাইটেল কার্ডে অভিনেতা
অভিনেত্রী নায়ক নায়িকা পরিচালক প্রযোজক , ক্যামেরাম্যান
, সম্পাদনা , গীতিকার সুরকার , গায়ক , গায়িকার নাম পর্দায় ভেসে আসে কোনও মিউজিক বা
গান সহ | এখানে
সামগ্রিক ভাবে সমীরণ ঘোষের কবিতা পড়ে আমার যা যা মনে হয়েছে , তার কবিতা নিয়ে তাই লিখলাম | শেষে পাঠকের জন্য তার
কিছু কবিতা তুলে ধরছি |
মোটামুটি যে
যে বই আমি পড়েছি , সেগুলো
হলো যথাক্রমে , হে বদ্ধ কাপালিক , কাঞ্চনবেড়
থেকে কলকাতা , তলোয়ার পোহাচ্ছে রোদ একা একা , মিয়া কী মল্লার , নূহের জাহাজ , পর্যটকের ডানা , সাঁই আমাকে ওড়াও , সব নিঃশেষে নামছে , পেন্সিলের শ্রুতিধর , সান্ধ্য বৈঠক , চাঁদলাগা চৌষট্টি আসমান , ভাঙা ডাকের হাশিশ |
কিছু কবিতা
ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরছি ---
এক .
দুঃখ আমার
জমে গাছ হয়ে আছে
আমি তার নীচে
পাষাণ - পুরুতের মতো বসে
যেন দুহাত
বাড়ালেই
নীল ডালপালা , ফুলেল শরীর ...
যতদূরে যাই , ওই অনুভূমিক ছায়া হাত চেপে ধরে
যতদূরে যাই , তৃষ্ণা আমায় শুধু
ঋজু দুঃখের
দিকে টানে
দুঃখ আমার
জমে আয়ুষ্মান গাছ --
তার গূঢ়
সচেতন বাকলে রাখি হাত
নিটোল
গ্রন্থি ছিঁড়ে জলপান করি
দীপ্রশাখায়
যার ঝুলে আছে সুনিশ্চিত ফল
আর সুষম
পত্রালি
আমি ওই ফল
ভেঙে , বল্কল , বাৎসরিক
চক্র - সমাহার
তুলে আনি
কবিতা নামক স্পর্ধাভার সামান্য খাতায় ( পাষাণ - পুরুত )
দুই .
মাথার বালিশ
ফেটে
চর্বি হয়ে
বেরিয়ে পড়েছে তুলো, যখন
ঘুম ভেঙে, উঠোনের আলোয় এসে দাঁড়াও
তুলোভর্তি
মাথা দেখে মনে হয়
তোমার বয়স
অনেকটাই প্রৌঢ়ত্বের দিকে চলে গেল |
কতো বছর নষ্ট
হয়ে পড়ে হারমোনিয়াম
(ভালোবাসা
আমার)
তিন .
রুপোর গয়নার
মতো যে - মাত্র ঝলমল ঘর
অজান্তেই এই
গৃহের অধিবাসীদের ভেতর
একটু করে
অন্ধকার জমে উঠলো
তারপর , একটু ধুলো , আবর্জনা ,
মাকড়সার জাল ... ( বউ )
চার.
অন্ধকার
কণ্ঠনালির ভেতর
হড়কে যেতে
যেতে দেখি টনসিল রক্তের উচ্চচাপ
বায়ু কফ
পিত্ত
আর অন্ধকার
পেটের ভেতর আমার খুব হাসি পায়
আর ওরা
পাগলের মতো
কোনো বার
রমণীর কাছে হাঁটু মুড়ে বসে
প্রথমে
হুংকার : প্রেম চাই
তারপর সেও
খাদ্য হয়ে চলে যায় পেটে
(অপেক্ষা)
পাঁচ .
হাড়ের কঙ্কাল
থেকে সাদা হাত শূন্যে উঠেছে
জানো , আমারও পথের পাশে ঘর ছিলো , পর্যটন
ছিলো
বিবাহবার্ষিকী ( বিবাহবার্ষিকী )
ছয় .
আমিও নদীর
ছেলে জেলেডিঙি বেয়ে এতদূর
আমার সৎমা
পতঙ্গভুক প্রজাতির প্রাণী
ঘাসবন থেকে
মাথা তুলে হিসহিস করছে ভাই
ফণার তরঙ্গে
দোলে ব্যাপ্ত ধরণি ( সন্ধ্যাভাষা )
সাত .
জীবাণুযুদ্ধের
পর / খুচরো টিকে যাওয়া | আমি আর
কালো মেয়ে / সারাদিন মাটি খুঁড়ে পাতি ফাঁদ / কিন্তু ম্যামথ কোই ! জলভল্লুক !
নিতান্ত হরিণ / যার কাঁচা ও গরম রক্ত মুখ ভরে দুজনেই খাবো / রাগে অন্ধ হই |
একদিন টুঁটি চেপে ধরি মেয়েটির / আজ সে - মাংসও শেষ | বালি ও বরফের দেশ / তীব্র হয়ে নামে ক্ষুধা | শুরু
নিজের মাংসেই ভোজ ( আবার প্রস্তরযুগ )
আট .
যদি নির্মোহ
না - হও বিছানার পাশে বসে কীভাবে দেখবে / শ্যাওলায় ফুটে ওঠা ফুল ! সন্ধে হতেই /
বুদ্বুদের মতো চাঁদ ছেড়ে দিই শূন্যে / ওর সোনালি শরীর ঘিরে তারামাছ ঘুমিয়ে পড়েছে / এখন
স্পষ্ট দেহ , ওই ঠোঁট , ভ্রূভাগ ,
দীর্ঘায়িত স্তেপ / নদীজল লাফিয়ে - লাফিয়ে চূর্ণজলে ঢাকে চারপাশ / একটি মৃণাল এসে
আমাকে টেনে নিতে অর্ধেক মুছে যাই ( স্নান )
নয় .
অথচ আমার ভাই
দিগন্তে পেটাচ্ছে লোহা / ওই ধাতবযৌগেই আজ বিশ্ববলয়ে ভোর / আমিও আচ্ছন্ন | ধ্বনি থেকে মুহুর্মুহু / ছিটকে আসা তির |
এত হাবা !
( ভূমি )
দশ .
দেখি দেউড়িতে
জ্বলেছে মৃদুশেজ আর / খেতে দাও বলে পাত্রময় নক্ষত্রকুসুম অর্চনা করেছি ওই অলীককবরী
/ কতশত ক্ষুধার আগেই
(ক্ষুধা)
এগারো .
আকাশকে কেমন
বজ্রগর্ভ করছে | ওর
পেটে জন্মাতে জন্মাতে একদিন অন্ধকার | আর বহুপ্রজ নারী ভেসে
যাচ্ছে অনন্তের দিকে | / স্ফীতযোনি উগড়ে দিচ্ছে রক্তকমল | আর
ক্রমশ / উন্মাদ চারপাশে জাগতে থাকা এক - একটা নতুন চর ( চর )
বারো .
আরও গরম হয়ে
উঠবে অবর্ণনীয় কাচবন
আর ঝুলে থাকা
অসম্ভব বাঁকা হাড়ের ধারালো
সূর্যাস্ত
এমনই কোনো অপেক্ষার ব্যান্ডেজে
লাল পায়রার
লম্বা বিকলন
শূন্যের
ভুট্টাখেত খিদমতের ভেড়ার শান্ত
আরও শান্ত
জনপদ মহিষের মুণ্ড মাথায়
ঝিল হাড়ের
সামান্য। মৃতের পাঁকের
মাংসেন
অবিমিশ্র কুহু কোথাও পৌঁছুচ্ছে
শরীর ডাকের
ব্রোঞ্জ। লম্বাতর। আরও এক
গ্রস্তের
শিখায় ( সাঁকো )
তেরো .
সমুদ্রের
চামড়া তুলে সমুদ্রকেই ফুলিয়ে যাচ্ছে
চার লালরঙের
মেয়ে। চার বরফের ফ্যাকাসে সারস
লালরঙের
শূন্য চার বধির দেবতার
কাটা হাতে
স্তনের বিপুল
গাওনার ধুধু
তামা হাওয়াকে চোপাচ্ছে নীল ক্ষুরে
খাঁড়ির
রক্ষীচার পিতলচমকানো
কাঁধে
জলপায়রার ঘুম
চার মেয়েরঙের
শুশুক চার স্লেজের বিস্ফার
চার
ব্যাকপাইপার চামড়াতোলা সমুদ্র বাজাচ্ছে
( বাজনা
/ ২ )
চৌদ্দ .
কিন্তু আমি
তোমাকেই ভাবি
পোড়া জানলার
নীচে অতল ডাকছে
তবু পেরোতে
চাইলাম চাঁদলাগা চৌষট্টি আশমান
মর্মঅধিকহাঁস
বিন্দুবিহ্বল মুছে যায়
মায়াগঙ্গার
তীরে একা অগ্নিবৎ মুণ্ড জ্বলছে ( মুণ্ডমায়া )
পনেরো .
যে শূন্যে
ছিপ ফেলি
সেই শূন্যে
তুমিও অধরা
মায়া-সর্পের
বন৷ অন্ধ রাগিনীর
কূল,তীব্র রণিত৷ পাশে
বজ্রপোড়া
নৌকো দুলছে
আর এক
রাত্রিকুসুম
ঢেউ তুলে ঢেউ
তুলে
ঘনযামিনীর
তীরে
পাপড়ি খুলছে
( পদ্মরাগমণি )
ষোলো .
আমিও পাথর
ভাঙি
জলের জীবাশ্ম
খুঁজি রোজ
আমি জীবাশ্ম
ভাঙি
ভেঙে-ভেঙে
তুলি কালবেলা
কাল ঘুমিয়ে পড়েছে
কাল সসাগর,প্রস্তরপ্রণীত
সাঁই,ঢেউ তুলে ভাসতে চাইলাম
নিভু নিভু
পাথরের ভেলা
সতেরো .
পৌঁছুতে হবেই
! ও দয়াল তোমার পাজামা এই স্বপ্নে স্বপ্নে / পতাকার মতো এতদূর | গিজগিজ করছে লোক |,বলছে
নামিয়ে দে / পার্টটা শক্তই | নেমে যাবো ! আর এ - পাজামা থুড়ি
মীনধ্বজ / রাখি কোন হাতে ! দৌড়ে এলো লোক | অন্ধ মেয়ে বিলাপ
করছে মেরো না গো ওই তো ভৈরব / যোগাসনে নারীমুন্ড অবিকল মেয়েটির লিপে , থেটারই লোকশিক্ষে মানুষ / নেমে যাও | আর অন্ধ মেয়ে
ছোট্ট খোলাবুকে চেপে ধরছে মুখ / এই ব্রহ্মপাতালে তুমিই তো চাঁদ আঁকার নাগর গো
যাদুকর ...
ও দয়াল , এই দ্বাদশব্যক্তিকে তুমি কোথায় নামালে / কোন
কোদন্ডে এই মরু ভরে দিই আবাদি সোনায়
তোমার শিয়রে
সাঁই ঠান্ডা কুঁজোই বলো সেকের রুমাল / বেশ তো ছিলাম এতকাল ( ভোলামন )
আঠারো.
সমস্ত পিতাই
মৃত / মায়েরা বিলাপ করছে এমনই আচ্ছন্ন নদীতীর / সমস্ত নদীই সোঁতা ,
বিশ্বগ্রাম , মায়েদের চুল ভেসে যায় / পৃথিবী ধোঁয়ার দেশ ,
তার নীচে অলীক বাজার
( বিশ্বগ্রাম
থেকে সূর্যাস্ত )
উনিশ .
অপারগ | এই দেহপত্র | এই শিরস্ত্রাণ
/ নাখোদা মসজিদ যত , ততদূর গাজন চড়ক আর পিরের মাজার / আমিও
অলপ্পেয়ে স্বভাবঘূর্ণি ,
পেনিপাৎলুনহীন
/ এত খিন্নমুখ গ্রামসভা সালিশি
সঙ্কেত আর ক্রোধের ইজারা / জঙ্গল চেপেছে বসে | রাত্রি আরও
বল্কলে জড়ায় |
বগেরিপাখায়
চাঁদ / শিবা ডাকে তক্ষক ঝিঁঝি তস্যআঁধার / বেলেল্লারহিম , বাঁকাশ্যাম , গাঁট কাটি গাঁট বাঁধি / অচিনকালের মেয়ে গোধূলিজানলায় এসে / খুনের ফোয়ারা
তুলে যায় ( ভেরেন্ডা )
কুড়ি .
হত্যায়
মোছেনি সব / কিছু মৃত্যুর আগুনে জ্বলেছিল / রেললাইনের পাশে মুণ্ড ধড় , তামাদি চিহ্ন কিছু পড়ে / ডাকি |,কখন জাগবে ! / অন্নের চূড়ায় এসে রোজ রোজ সূর্য ঢলে যায়
( সব
নিঃশেষে নামছে )
থামি এবার | আমার কবিতাঘোর এই উন্মাদদশা না থামালে থামবে না | মাত্র কুড়িটি কবিতায় সমীরণ ঘোষের মতো কবিকে বোঝানো যায় না | দীর্ঘ সাড়ে চার দশকের ওপর যে সাধনা তাকে তখনই কিছু কবিতার মধ্যে দিয়ে
চিহ্নিত করা যেত , যদি তিনি সহজে ধরা দিতেন | কিন্তু বিস্ময়কর তার মনোজগৎ | সুদূরপরাহত বহু যুগ
বহুকালব্যাপী তার স্বপ্নের উড়াল | পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু ,
জড় , জীব , পতঙ্গ ,
এককোশি প্রাণী , শ্যাওলা , মস , নক্ষত্রজগৎ , মিল্কিওয়ে , প্রিমিটিভিজম ,
সাবল্টার্ন তত্ত্ব , কোলাজ , মন্তাজ , ইমেজারি , ম্যাজিক
রিয়ালিজম , minor religious sect বা গৌণ ধর্ম , বাউল , সাঁই , দরবেশ , আউল , সহজিয়া , অবধূতী ,
আগরী , পঞ্চধুনী , কর্তাভজা
, নিম্নবর্গ কৃষিজীবী শ্রমজীবী মানুষদের অন্ধ সংস্কার ও
বিপ্রতীপে দাঁড়ানো তাদের দেহগত চর্যা , নাগরিক সমাজের
মনস্তাত্বিক এলিয়েনেশন ও সম্পর্কের জটিলতা , কলোনিয়ালিজম ,
উত্তরগঠনবাদ , মিথ , তন্ত্র
এমনকি , কুলকুণ্ডলিনীর যাতায়াত বা ওঠানামার পথে যে অলৌকিক
দর্শন যা মহাসাধকদের অংশ , সমীরণ সাধক না হয়েও অনায়াসে
কল্পনাকে নিয়ে শরীরের উপস্থ থেকে মস্তিষ্ক তিন স্তরেই যাতায়াত করেছেন | ইড়া , পিঙ্গলা , সুষুম্নার
সঠিক যোগসূত্রে কেবলমাত্র কবিতার
মধ্যে এসে ঢোকে জীবন ও জগতের বিচিত্র স্তরের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি | যেন ভাবমগ্ন শিবের ত্রিশূল গেঁথে দেওয়া হয়েছে কবির শরীর ভেদ করে
মাটিতে , আর সে ত্রিশূল এফোঁড় ওফোঁড় করে গেছে ব্রহ্মান্ড |
সমস্ত ভুবন ও মহাশূন্যের বিদ্যুৎকণিকারা চলাচল করে সেই ত্রিশূল বেয়ে
| আত্মখনন ও আত্মপ্রজ্ঞার সঙ্গে যেখানে কবির অসম্ভব কল্পনা
এসে মেশে , কেউ কেউ বলেন হ্যালুসিনেশন কিন্তু কবির বিশুদ্ধ
কল্পনা সেই ভাবের গহন নির্জন পথে চলতে গিয়ে মুখোমুখি হয় , অনেক
মেঘ বৃষ্টি হিম ও ব্যথা | জড়িয়ে যায় কবিতার গায়ে | উপস্থে পৌঁছতে গলার সরু পথটি পেরোতে গিয়ে চাপ লাগে , কবির তৃতীয় ভুবন বা থার্ড আই সেই চাপের মুখে অনুভব করে , যেন ইস্পাতের কাঁকড়া আঁকড়ে ধরছে নলী | অবশেষে মুখের
গর্ত দিয়ে কান্না বা তীব্র বিষাদ বা ব্যথা বার করে দিয়ে হালকা হয়ে কবিতা চলে যায়
অন্য দেশে | কবিতা অনেক অনেক অনেক দূরে যায় -- কিন্তু কখনো
মস্তিষ্কের সীমানা , উপস্থের সীমানা , শরীরের
সীমানা পেরোতে পারে না |
এসব ভাবনা
আমার নয় | মহাজ্ঞানী সাধক ও সাধক কবিদের |
সাধক কবি নিশিকান্ত বা ঋষি অরবিন্দের লেখায় এসব পড়েছিলাম | পড়েছিলাম দালির আত্মভাষণ বলে একটি লেখায় , মণীন্দ্র
গুপ্তের গদ্যে , হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখায় |
অন্যতম
বহুস্তরীয় জটিল ও সীমাহীন ক্ষমতা নিয়ে যে প্রতিভাবান কবির কবিতা পড়ে আবার এসব
নানান ভাবনা মনে এলো , তিনি
কবি সমীরণ ঘোষ | পাঠক আপনার মন মনন প্রজ্ঞা চিন্তা চেতনা
অতিচেতনা দিয়ে এই কবির বিপুল কাব্যজগতের গহনে প্রবেশ করুন | এই
ধ্রুপদী কবি বাংলা কবিতার ভবিষ্যতের সম্পদ | হয়তো একসময় আমরা
বুঝবো | না বুঝলে গড্ডল প্রবাহে চলা বাংলা কবিতার কিছু যায়
আসে না হয়তো কিন্তু কথায় কথায় আমরা যারা আমাদের সম্পদকে ভুলে দ্রুত অন্য দেশের
অন্য কবিদের কবিতা প্রায় ভুলভাল অনুবাদ করে আত্মশ্লাঘা অনুভব করি , তাদের অবস্থা দেখে নিশ্চই বীণাবাদিনী ভারতী নিমঅন্নপূর্ণা এবং দুর্বিনীত মহাকাল এই ত্রয়ী শক্তি নিশ্চই অলক্ষে হাসবে বলে আমার নিশ্চিত
মনে হয় |
1 মন্তব্যসমূহ
খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ভালো লাগলো। সমীরণ ঘোষ দা'কে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।
উত্তরমুছুন